অন্তর্ভেদী সমুদ্র সৈকতে পৌঁছনোর ইচ্ছে আমার বহুদিনের। গঙ্গা নদীর পরে ভারতের দীর্ঘতম নদী গোদাবরী তার ১৪৬৫ কিলোমিটারের যাত্রা শেষ করে বঙ্গোপসাগরে এসে বিলীন হয়ে যায় ঠিক এখানেই। সুদীর্ঘ যাত্রাপথের সমস্ত ক্লান্তি দূর করে এই নদীর মোক্ষলাভ হয়। এহেন স্থান নিঃসন্দেহে পুণ্য তীর্থ। অন্ধ্রপ্রদেশের পূর্ব গোদাবরী জেলার এই সৈকতে পৌঁছে সাধ পূর্ণ হল ঠিকই, কিন্তু একইসঙ্গে মন খারাপও হল। নির্জন বালুকাবেলায় নদী ও সাগর সঙ্গমের যে ছবি কল্পনায় এঁকেছিলাম তার সঙ্গে বাস্তবের ফারাক অনেকখানি। নাহ্, প্রাকৃতিক রূপ সুষমার কোনও কমতি নেই। বিস্তৃত সাগরবেলা, দূরে দেবাদিদেব মহেশ্বরের মন্দির, হাতেগোনা পর্যটকের ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো— এই সবই চমৎকার ক্যানভাস তৈরি করেছে। অথচ দৃশ্য দূষণের মাত্রা এত বেশি যে মনের স্বস্তি উবে যায় নিমেষে। সমুদ্র সৈকত জুড়ে প্লাস্টিক বোতল, পলিথিন ক্যারি-ব্যাগ জায়গাটিকে ভাগাড়ে রূপান্তরিত করেছে। সমুদ্র ছুঁয়ে চলা প্রবল বাতাসে মানুষের তৈরি বিপদ তার নিশান রেখে যাচ্ছে সর্বত্র। এ দৃশ্যে মন খারাপ হয়, আশঙ্কায় শিহরিত হই। এই যদি নির্জন সমুদ্র-সৈকতের চিত্র হয়, তবে ভারতবর্ষ সহ গোটা বিশ্বের জনপ্রিয় সমুদ্র-সৈকতগুলির পরিস্থিতি কত ভয়ংকর হতে পারে?

দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিক দূষণ নিয়ে কাজ করার ফলে সমুদ্র দূষণের কিছু তথ্য মনে পড়ল। আজ আন্তর্জাতিক মহাসাগর দিবসে কিছু তথ্য ভাগ না করে পারলাম না। সমুদ্র দূষণ শুরু হয়েছিল শিল্প বিপ্লবের পরেই। দীর্ঘ সময় ধরে নিত্যদিনের জঞ্জাল থেকে শুরু করে তেজস্ক্রিয় পারমাণবিক বর্জ্য সবকিছুই সাগরের গভীরে ডুবিয়ে দিয়ে মানুষ নিশ্চিন্ত হতে চেয়েছিলো। ১৯৭২ সালের আগে সমুদ্র দূষণ নিয়ে কোনও আন্তর্জাতিক আইন সেই কারণেই সম্ভবত প্রণয়ন করা হয়নি। ৫১ বছর আগে লাগামহীন দূষণকে আয়ত্বে আনার সমষ্টিগত প্রচেষ্টার শুরু হল বটে, কিন্তু ততদিনে ক্ষতি অনেকটাই হয়ে গিয়েছে।
গত শতাব্দীর শেষ থেকে শুরু হল প্লাস্টিকের তৈরি দ্রব্যের বিপুল ব্যবহার। ফলশ্রুতি হিসেবে এখন আধুনিক পৃথিবীতে সমুদ্র দূষণের অন্যতম উপাদানই প্লাস্টিকজাত দ্রব্য, যা বর্জ্য হিসেবে সাগরে গিয়ে মেশে। এই বর্জ্যের পরিমাণ প্রতি বছরে ১৪ মিলিয়ন টন। ভাব যায়? ২০১৫ সালের একটি গবেষণা অনুযায়ী সমুদ্রে ১৫০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিক বর্জ্য রয়েছে, যার মধ্যে অন্তত আশি শতাংশ বর্জ্য পৃথিবীর বিভিন্ন শহর থেকে তৈরি। উন্নত দেশগুলির Waste Managment তুলনায় আধুনিক হলেও আফ্রিকা মহাদেশ-সহ আর্থিকভাবে দুর্বল বিশ্বের অন্যান্য দেশগুলির Waste Managemnt-এর পরিকাঠামোর বিশেষ উন্নতি হয়নি। কোনওরকম বাধানিষেধ বা প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বালাই না রেখে সাগর ও মহাসাগরকে ডাম্পিং গ্রাউন্ড হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে এইসব দেশে। যদি পরিস্থিতির পরিবর্তন না হয় তবে ২০৪০ সাল নাগাদ এই প্লাস্টিক বর্জ্যর পরিমাণ দাঁড়াবে ৬০০ মিলিয়ন টন। বলাই বাহুল্য, এই পরিমাণ জঞ্জালের ভার মহাসাগরগুলি বইতে পারবে না।

প্লাস্টিকের করাল থাবা কীভাবে মহাসাগরগুলিকে তিলে তিলে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে যদি বিশদে বোঝাতে হয়, তবে অবশ্যই ‘গারবেজ প্যাচ’-এর কথা উল্লেখ করতে হবে। গারবেজ প্যাচ কী? সমুদ্র স্রোতের কারণে প্লাস্টিক সহ বিভিন্ন জঞ্জালের একটি নির্দিষ্ট এলাকায় জমা হওয়া। দ্বীপ-সদৃশ এই প্যাচগুলিই হল অশনি সংকেত। বিশ্বের সবচেয়ে বড় গারবেজ প্যাচ— দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ। ১.৮ ট্রিলিয়ন প্লাস্টিক অবশিষ্টর মধ্যে ৯৪% হল মাইক্রো প্লাস্টিক। মহাসাগরগুলির অতি গভীরে অনুসন্ধান চালিয়ে বিপজ্জনক পরিমাণে এই মাইক্রো প্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গিয়েছে।
এতসব ভয়াবহ তথ্যের আঁতুড়ঘর কোথায়? আমার, আপনার বাড়ি। সাধারণ গেরস্থালি থেকেই নদীবাহিত হয়ে লক্ষ লক্ষ টন প্লাস্টিক মিশছে সমুদ্রে। জন-সচেতনতার অভাবে সমুদ্র অঞ্চল থেকে দূরে বসবাসকারী আমজনতা জানতেই পারে না যে মহাসাগরগুলির এই তিলে তিলে মৃত্যুর জন্য দায়ী তারাও।
সমুদ্র দূষণের অন্য একটি কারণ নিঃসন্দেহে ওপেন ডাম্পিং অর্থাৎ তৈলবাহী জাহাজ, মালবাহী জাহাজের মাধ্যমে সমুদ্রে বর্জ্য পদার্থ ছড়িয়ে পড়া। এমন অনেক উৎস রয়েছে, যেগুলিকে খুঁজে বার করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার। এহেন প্রয়োজন অনুভূত হওয়াতে ১৯৯৬ সালে লন্ডন প্রোটোকল তৈরি হয়। বিশ্বের সর্বমোট ৫১ টি দেশ নিজেদের মধ্যে সংহতি স্থাপনের উদ্দেশ্যে স্বাক্ষর করে সেই প্রোটোকলে। এই প্রোটোকলের লক্ষ্য দূষণ তৈরির উৎসগুলোকে চিহ্নিত করে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নিয়ন্ত্রণ করা। এই চেষ্টা কতটা সফল, তার উত্তর জানা যাবে আগামীতে।

এতক্ষণ আলোচনা করেছি সমস্যা নিয়ে। নিঃসন্দেহে সমস্যাগুলি গভীর, কিন্তু মনুষ্যসৃষ্ট দূষণের সমাধান মানুষকেই খুঁজতে হবে। সমাধানের পথ দেখাচ্ছে কিছু উদ্যোগী মানুষ ও আর্টিফিশিয়াল ইন্টিলেজেন্স। উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায় ‘দ্য ওশেন ক্লিন-আপ’ সংস্থাটির কথা। এটি একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান, যেটির মূল উদ্দেশ্য মহাসাগরের বুকে জমে থাকা গারবেজ প্যাচগুলির দ্রুত নিষ্কাশন। এই সংস্থার সদস্যরা কাজ করছেন এক হাজার নদী ও সমুদ্রের পাঁচটি অঞ্চল নিয়ে। তৈরি করেছেন দু’টি ৮০০ মিটার দীর্ঘ আধুনিক যন্ত্র, যেগুলি ব্যবহার হচ্ছে জঞ্জাল অপসারণের জন্য। তৃতীয় একটি যন্ত্র না বলে যন্ত্র দানব বলা ভালো, ব্যবহারের অপেক্ষায় রয়েছে, যার দৈর্ঘ্য প্রায় আড়াই কিলোমিটার। অসাধ্য সাধনের জন্য এমন বড় কিছুই ভাবতে হয়। ঠিক কি না! এই প্রয়াসে এখন পর্যন্ত দুই লক্ষ কেজি জঞ্জাল সরানো গিয়েছে যা নেহাতই এক একটি গারবেজ প্যাচের শূন্য দশমিক দুই শতাংশ মাত্র।
‘দ্য ওশেন ক্লিন-আপ’ চায় এই দশকের শেষ পর্যায়ে এমন দশটি যন্ত্রের ব্যবহার করতে, যার মাধ্যমে উত্তর প্রশান্ত মহাসাগরের ৮০ শতাংশ বর্জ্য তুলে ফেলা যাবে। এমন মহৎ কর্মকাণ্ডের জন্য বিশ্বের সকল নাগরিক তাদের পাশে থাকবে আশা করি।
নদী, সাগর, মহাসাগর একে অপরের সঙ্গে হাত ধরাধরি করে রচনা করেছে প্রাণের নিরাপত্তা। জীব সৃষ্টির আদি স্থল যে মহাসাগর এখন সেটিই ধ্বংসের মুখে। ফ্রাঙ্কেস্টাইনের গল্পের মতোই। তবে এটি ঘোর বাস্তব। কল্পবিজ্ঞানের গল্প নয়। প্লাস্টিকের নিয়ন্ত্রিত ব্যবহার, পুনর্ব্যবহার ও বিজ্ঞানভিত্তিক প্লাস্টিক বর্জ্যকে ডাম্প করার মাধ্যমেই সমুদ্র দূষণ কমানো সম্ভব। এছাড়া রাষ্ট্রীয় স্তরে যে দেশগুলি ওপেন ডাম্পিং করে চলেছে তাদের ওপরেও রাষ্ট্রপুঞ্জের নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার আশু প্রয়োজন।
অন্তর্ভেদী সমুদ্র সৈকত মানুষের কদর্য রূপ বুকে ধরে রেখে চুপ করে আছে সময়ের অপেক্ষায়। আমরা না বদলালে প্রকৃতি নিজের শক্তিতে আগের মতো মহাসাগরকে তার রূপ ফিরিয়ে দেবে। মানুষ পারবে তো সেই প্রলয়কে সহ্য করতে? এখনও সময় আছে। শেষ মাইলফলক পার হওয়ার আগেই যেন আমরা সাবধান হই। সাগর-তীরে মানুষ এসে দাঁড়াক মানুষের চেহারা নিয়ে।
সম্রাট মৌলিক পেশাদার কর্পোরেট জগতকে বিদায় জানিয়ে কাজ করছেন নদীর সঙ্গে। জল ও নদী সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে ঘুরে দেখছেন ভারত-সহ পৃথিবীর অন্যান্য দেশের নদীব্যবস্থা, জানছেন ব্যবহারযোগ্য জলের সুষম বন্টনের পরিস্থিতি। ভারত, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা, থাইল্যান্ড ও রাশিয়া- পাঁচটি দেশে এখন পর্যন্ত প্রায় পনেরো হাজার কিলোমিটার একা ভ্রমণ করেছেন দু চাকায় সওয়ার হয়ে। এছাড়াও প্রায় দু দশক ধরে হেঁটেছেন অনেক শহর, প্রত্যন্ত গ্রাম,অজানা পাহাড় ও জঙ্গল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যায়ের স্নাতক সম্রাটের শখ প্রজাপতি ও পোকামাকড়ের ছবি তোলা। প্রথম প্রকাশিত বই 'দাগ'।
3 Responses
সমযপোযগী এবং কঠিন বাস্তব কথা তুলে ধরেছেন ।সঙ্গে আশার আলো ও দেখিযেছেন।।
এই ধরণের পরিবেশ সংক্রান্ত লেখা পরতে চাই ।
তোমার সম্পূর্ণ লেখার আংশিক জানা ছিল এবারে সমৃদ্ধ হলাম কিন্তু বেশী খুশি হতাম এই সমস্যার সমাধানে যদি নিজেকে নিয়োজিত করতে পারতাম। আসলে মানুষ নিজে থেকে সচেতন হলে তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্ম বাঁচবে নয়তো কোনো আইন বা কোনো সরকারি ব্যাবস্থায় এটা সম্ভব নয়। আমি কথা দিচ্ছি আমার পাশে যেসব নদী আছে তাদের যার কাছেই যাইনা কেন এই বর্জ্য গুলি যতটুকু সম্ভব সরিয়ে নেবার চেষ্টা করবো এবং মানুষকেও বোঝাতে চেষ্টা করবো।
Really khub kharap obostha…ar khub sundar reality ta tule enecho..amader sotti socheton hotei hobe…