(Bengali Publications)
এইমুহূর্তে চোখে ঘুম নেই অনেক ছোট প্রকাশক এবং লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের। বইমেলা আসছে। জানুয়ারির তৃতীয় সপ্তাহ থেকে শুরু। অতএব এখন ছোট প্রকাশনীর শিরে সংক্রান্তি। দু’তিন মাস প্রেসের কর্মী এবং বাঁধাই কর্মীদের চোখে ঘুম থাকবে না। ডিটিপি অপারেটর সন্তানের মুখ দেখতে পাবেন না অনেকদিন। তার কারণ সাহিত্যের দায়! (Bengali Publications)
জীবনের চেয়ে বড় হয়ে দেখা দিয়েছে কবির দর্শন। সকলেরই চাহিদা নিজের বইটি বইমেলায় প্রকাশিত হোক। না হলে বন্ধু, অফিস কলিগ এবং শ্যালিকার কাছে মান থাকে না। তা খুব সুখের কথা অবশ্য নয়। সবচেয়ে বড় সমস্যা, ছোট প্রকাশকদের। তাঁরা একই দেহে কবি, সম্পাদক এবং প্রকাশক। যেহেতু এটাই তাঁর প্রধান জীবিকা, অনেকেই চাকরির পেছনে না ছুটে সর্বসময়ের কাজ হিসেবে প্রকাশনাকেই বেছে নিয়েছেন, অতএব সারা বছরের অধিকাংশ লাভ এবং মূলধন তুলে নিতে হবে বইমেলাতে। যেহেতু মূলধন কম, তাই ছোট প্রকাশক নিজেই প্রুফ রিডার, নিজেই প্রচ্ছদশিল্পী (নিদেন পক্ষে তাঁর স্ত্রী) নিজেই ডিটিপি অপারেটর, ফলে রাত্রি জাগরণ এইমুহূর্তে তার সাধনার অঙ্গ। (Bengali Publications)
আরও পড়ুন: আলো: অপ্রত্যাশিতের আলো
একে শ্রদ্ধার চোখে দেখব নিশ্চয়ই। তারপরও কয়েকটি প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে আমাদের। সমীহ এবং শ্রদ্ধার আবরণটি সরিয়ে দিয়ে দেখে নিতে হবে এই আবেগে বিশুদ্ধতা কতখানি। প্রতারণাই বা কতখানি? সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতার যে গল্পটি বাজার জুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে তা হুজুগে, না গভীরতার ও সুসময়ের ইঙ্গিত দিচ্ছে তার দিকে নজর রাখতে হবে আমাদের। কথায় কথায় বড় প্রকাশকদের কথা এসে পড়লেও, আমরা মূলত ছোট প্রকাশক এবং লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদকদের কথাই ভাবছি। ভাবছি এই তৎপরতা সুযোগের সদ্ ব্যবহার কী না। (Bengali Publications)
এইমুহূর্তে বাংলা বইয়ের ব্যবসা কি শুধুমাত্র বইমেলা নির্ভর হয়ে পড়ছে? এই প্রসঙ্গটি নিয়ে আলোচনার আগে ফিরে যেতে চাই মোটামুটি কুড়ি তিরিশ বছর আগের চিত্র ও চরিত্রে। তখনও জেলায় জেলায় এত লিটল ম্যাগাজিন শুরু হয়নি। ছোট প্রকাশনীর জন্ম হয়নি। পত্রিকাকেন্দ্রিক যে ছোট প্রকাশনী ছিল (নামেই প্রকাশনী, কাজে নয়) তার কোনও বাণিজ্যমূল্য ছিল না। কিন্তু জেলায় জেলায় বইমেলা শুরু হয়েছে। সেই বইমেলাগুলিতে কিছু বড় প্রকাশক যোগ দিতেন। পাঠকের ভিড় মোটামুটি ছিল। দর্শক টানতে কোনও কোনও বইমেলায় কবি সম্মেলন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুষ্প প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হত। এই বইমেলাগুলির মূল ক্রেতা ছিল মূলত বিভিন্ন সরকারপোষিত লাইব্রেরি। তারাই পাঠকের চাহিদা অনুসারে প্রচুর বই কিনতেন সরকারি অনুদানের বিনিময়ে। ফলে প্রকাশকদের আর্থিক ঘাটতি তেমন হত না। সাধারণ পাঠকের চাহিদা অতিরিক্ত লাভ মাত্র। (Bengali Publications)

কিন্তু গত পনেরো বছরে, আরও স্পষ্ট করে বললে গত দশ বছরে, প্রায় প্রতিটি জেলায় এক বা একাধিক লিটল ম্যাগাজিন মেলা হচ্ছে। সেখানে ছোট পত্রিকা এবং ছোট প্রকাশনীর একটি নির্দিষ্ট বাজার তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে জেলায় জেলায় সরকারি উদ্যোগে নানা বইমেলা। সেখানে বড় প্রকাশক এবং ছোট প্রকাশক সকলেই অংশগ্রহণ করছেন। বিক্রি খুব খারাপ নয়। তবু বলবার বিষয় এইসব বইমেলার চরিত্র পাঁচমিশালি। এখানে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে কলকাতার নামিদামি শিল্পী, ব্যান্ড নিয়ে এক প্রকার হইচই বেঁধে যায়। বই শুধুমাত্র উপলক্ষ হয়েই থাকে। বইমেলায় দেখা যায় সহস্য নায়িকা, গায়িকা, বিধায়ক এবং সাংসদের ছবি। বইমেলা, না হরেক মাল আর খাদ্যমেলা বোঝার উপায় নেই। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা এখানে ঘটছে। উত্তরবঙ্গ যেভাবে বিচ্ছিন্ন ছিল ইদানীং দক্ষিণবঙ্গ এবং উত্তরবঙ্গের একটা যোগসেতু বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন মেলা এবং বইমেলা। (Bengali Publications)
“একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই সহজে বই পাওয়ার আদর্শ জায়গা, বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা। সারা বছর ধরে পাঠক অপেক্ষায় থাকেন।”
ছোট প্রকাশনীর বই একটু খোঁজ রাখলে সহজেই পাওয়া যায়। এর পাশাপাশি প্রায় প্রত্যেক ছোট প্রকাশক কলেজস্ট্রিটে নিজস্ব আউটলেট নিচ্ছেন। সেখানে সব প্রকাশকের বই পাওয়া যায়। এমনকী অনলাইনে সারা ভারতবর্ষে, বিদেশে তাঁরা বই পাঠিয়ে আর্থিক লাভের মুখ দেখছেন। কিন্তু চরিত্র খুব বদল হয়েছে কি? সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতা খুব বেড়েছে কি? পাঠকের সঙ্গে সংযোগের উদারতা খুব বেড়েছে কি? এইসব প্রশ্নে আমরা চিন্তিত। এইসব ছোট প্রকাশনীর আউটলেটগুলিতে সুবিমল মিশ্রের পাঠকের যে কদর, তার কণামাত্র বুদ্ধদেব গুহর জন্য নেই। যেহেতু প্রকাশক নিজেই কবি তাই পাঠককে সন্দেহ করার ধরন দেখে আমাদের লজ্জা হয়! (Bengali Publications)
অথচ এরা থ্রিলার বেচতে যতটা উৎসাহী, একজন নবীন কবির কাব্যগ্রন্থ খোঁজবার পরিশ্রমটুকু করেন না অনেক সময়। মুখে অবশ্য সাহিত্যের প্রতি দায়বদ্ধতার কথা বলেন। প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে বই ক্ষতিগ্রস্ত হলে পাঠকের করুণার দ্বারস্থ হন। আর পাঁচটা ব্যবসার মতো বইও একটি ব্যবসা। এ কথা তাঁরা মানেন। তাঁদের আচরণে তা প্রতিষ্ঠিত। শুধু মুখে কোথাও একটা সাহিত্য সাধনার ভান আছে। এভাবেই চলছে। হয়তো আরও অনেকদিন এভাবেই চলবে। (Bengali Publications)

একথা অস্বীকার করবার উপায় নেই সহজে বই পাওয়ার আদর্শ জায়গা, বাংলা বইয়ের ক্ষেত্রে কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলা। সারা বছর ধরে পাঠক অপেক্ষায় থাকেন। লিস্ট তৈরি করেন। এবং ঘুরে ঘুরে প্রকাশনীর কাছে গিয়ে নির্দিষ্ট বইগুলি কেনার চেষ্টা করেন। যাঁরা নিয়মিত কলেজস্ট্রিটে আসতে পারেন না, নিজের শহরে ভাল বইয়ের দোকান নেই, তাঁদের পক্ষে এই বইমেলা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ। এর উপর নির্ভর করে বড় প্রকাশক এবং ছোট প্রকাশক তাঁদের বেশিরভাগ বই প্রকাশ করেন। আজ নতুন বইয়ের প্রকাশ নববর্ষ থেকে সরে গেছে বইমেলার দিকে। মূলত বাণিজ্যের কারণে, পাঠকের চাহিদার কারণেও। তাই বইমেলাকে কেন্দ্র করে বই প্রকাশিত হবে এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু এর ভবিষ্যৎ কী সেসব কি একবারও ভেবে দেখেছেন প্রকাশকেরা? বইমেলার আগে বিভিন্ন ছোট প্রকাশক বইয়ের যে বিজ্ঞাপন দেন তার চল্লিশ শতাংশ বইমেলার মাঠে পৌঁছয় না। (Bengali Publications)
“বহু প্রকাশনী লেখক পাকড়াও করে অর্থের বিনিময়ে বই করেন। তারপর বইমেলায় ছবি তুলে বইটিকে লেখকের হাতে তুলে দিয়ে দায়ভার ঝেড়ে ফেলেন।”
পাঠক দিনের পর দিন ঘুরে যান এবং প্রকাশক দেখেও না দেখার ভান করেন। বিভিন্ন ছোট প্রকাশনার বই, এমনকী লিটিল ম্যাগাজিন, বইমেলায় প্রথম দিন থেকে পাওয়ার আশা দুরাশা মাত্র। বইমেলা শেষের আগের শনিবারও অনেকের বই প্রকাশিতব্য। কোনওরকমে পাঁচ দশ কপি হাতেগরম এসে পৌঁছে প্রকাশকের মান রক্ষা করে। তার গায়ে তখনও কাঁচা আঠার গন্ধ। স্পাইন বাঁকাচোরা। এভাবেই মান রক্ষা হয়ে চলেছে বাংলা বইয়ের। ‘তরুণ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ’ এই বিজ্ঞাপনী প্রচারের ঢেউ উঠেছে ইদানীং। বিভিন্ন ছোট প্রকাশনী এই প্রকল্পে বই করছেন। গত বছর একটি প্রকাশনীর তরুণ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ, শেষপর্যন্ত মেলায় হাজির হয় বইমেলা শেষের চার দিন আগে। এর চেয়ে লজ্জা কী হয়! (Bengali Publications)

তরুণ কবির আবেগ এত সস্তা? সামান্য বড় প্রকাশনীর মোহ দিয়ে এই অপমান চাপা দেওয়া যাবে কি? দূর দূরান্ত থেকে যাঁরা বইগুলি কেনবার জন্য এসে ফিরে গেলেন তাঁরা আর কখনও এই বইগুলির কাছে আসবেন কি? আসবেন না। তার কারণ তাঁদের অনলাইন কিংবা কলেজস্ট্রিটে পৌঁছবার সাধ্য নেই। ফলে তাঁর প্রাথমিক আবেগ থেকে বইটি বাতিল হয়ে গেল। বইমেলায় কত কপি বই এসে পৌঁছোচ্ছে? পিওডির দৌলতে দশ থেকে কুড়ি কপি। সেই সব বই সংশ্লিষ্ট কবি বা লেখক বন্ধুরাই হয়তো কিনে নেন। কিংবা কিছু বিলিয়ে দেওয়া হয়। তারপর প্রকাশক এবং কবি গর্ব করে জানান বই নিঃশেষিত। আবার ছেপে আসছে। চাহিদা থাকলে আরও কুড়ি কপি আসবে বড়জোর। তার জন্য অপেক্ষা করবে কেবলই বিস্মৃতি। নির্ধারিত অনুপস্থিতির বিস্মৃতি। (Bengali Publications)
বিস্মৃতির কথা বলছি, তার নির্দিষ্ট কারণ আছে। বইমেলার বই আর বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত বইয়ের মধ্যে বেশ কিছুদিন ধরেই একটি তফাৎ হয়ে গেছে। বহু প্রকাশনী লেখক পাকড়াও করে অর্থের বিনিময়ে বই করেন। তারপর বইমেলায় ছবি তুলে বইটিকে লেখকের হাতে তুলে দিয়ে দায়ভার ঝেড়ে ফেলেন। বহু তরুণ কবির কাব্যগ্রন্থ বইমেলায় প্রকাশিত হয়, তারপর কবে কোথায় কখন পাওয়া যাবে আমরা জানি না। অনেক মাঝারি প্রকাশক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ টাইটেল করেও দীর্ঘদিন বইটি অমুদ্রিত রাখেন। তাই বইমেলায় যে বই আছে তার একটা বড় সংখ্যক বইয়ের পাঠকের জন্য অপেক্ষা নেই। এই সব বই বইমেলার জন্য উৎপাদিত এবং তারপর চিরজীবনের জন্য সে নিরুদ্দেশের পথিক। এটাই বইমেলার অনেক বই ও প্রকাশনীর বর্তমান চিত্র। (Bengali Publications)
আরও পড়ুন: কলেজস্ট্রিট: সুরক্ষা দেবতার সন্ধানে
তবে বর্তমান চিত্র, একমাত্র চিত্র নয়। বরং একে একমাত্র চিত্র ভাবলে কিছু বিচ্ছিন্ন ভুলকে প্রমোট করা হয়। এর বিপরীত চিত্রও কিছু কম নেই। মূলত যাঁরা বড় প্রকাশক, যাঁদের কর্মী এবং মূলধন বেশি তাঁদের প্রত্যেকেরই বই প্রথম দিন থেকে পাওয়া যায়। এবং বইমেলা পরবর্তীতে কলেজস্ট্রিটে তা সহজলভ্য থাকে। লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে গেলে দেখব যাঁরা ছোট পত্রিকা করেন এবং একই সঙ্গে প্রকাশনী তাঁরা বছরের পর বছর অবিক্রিত বইগুলি রাখছেন। একজন ছোট প্রকাশক দীর্ঘ দশ বছর ধরে একটি বই রাখছেন। যার শেষ কপি অসিত সিংহ ‘রচনাসংগ্রহ’ আমি সংগ্রহ করতে পেরেছিলাম পুরুলিয়ায়। (Bengali Publications)
বিক্রি হয় না বলে প্রকাশক যদি তা না রাখতেন তাহলে আমি তার পাঠক হতে পারতাম না। একটি গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা তার বিভিন্ন সংখ্যার পাশাপাশি নিয়মিত রেখে চলেছিলেন একজন তরুণ কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ। যখন তাঁর পরবর্তী অনেক কাব্যগ্রন্থই পাওয়া যায় না তখনও দেখেছি প্রথম কাব্যগ্রন্থটি সযত্নে ডিসপ্লে করা হচ্ছে। এই পুনর্জন্মের দায় একজন সৎ প্রকাশক নিয়েছেন। এই দায়বদ্ধতা একজন প্রকাশকের থাকা উচিত। যাঁরা কাছে দূরে বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিন মেলায়, একটি লিটিল ম্যাগাজিনকে সামনে রেখে মূলত নিজস্ব প্রকাশনীর বই বিক্রি করেন তাঁদেরও দেখেছি নির্দিষ্ট কয়েকটি টাইটেল ছাড়া বাকি বইগুলি রাখেন না। প্রশ্ন উঠবে সব টাইটেল নিতে গেলে যে পরিমাণ খরচ বা কর্মী দরকার তা তাঁদের নেই। (Bengali Publications)

তবু এক কপি করে রাখবার দায়বদ্ধতার প্রশ্নটি অমূলক নয়। এই ধরনের বেশ কয়েকটি ছোট প্রকাশনী কিন্তু আমাদের দায়বদ্ধতার সেই শিক্ষাই দিচ্ছে। অথচ আমরা এর থেকে শিক্ষা নিতে প্রস্তুত নই। এখনও বাংলা ছোট প্রকাশনার কাছে প্রফেশনালিজম শব্দটি আসলে ঘৃণ্য। উদ্যোগের চেয়ে উদাসীনতায় তার আত্মপ্রেম তৃপ্তি পায় বেশি। (Bengali Publications)
কলকাতা আন্তর্জাতিক পুস্তক মেলার ঐতিহ্য নিয়ে যত কথা হয় তার ভগ্নাংশ হয় না বইয়ের মান বা গ্রন্থশিল্প নিয়ে। এ ব্যাপারে পাঠকের সচেতনতা এক প্রকার নেই বললেই চলে। হয়তো এটাই উদাসীন প্রকাশকের একমাত্র হাতিয়ার। তবু ভেবে দেখেছি বইমেলায় পাঠক প্রতারণার সুযোগ অনেক বেশি। এইমুহূর্তে প্রুফরিডারের চাকরি কমে গেছে। কম্পোজিটারের চাকরি প্রায় নেই। হয়তো আগামীতে প্রচ্ছদশিল্পীর জীবিকাও যাবে। তার কারণ আজ সব একই দেহে লীন। যখন দেখি একজন দু’জন ছোট প্রকাশক একটি মেলাতেই অজস্র রচনাসংগ্রহ, কবিতাসংগ্রহ প্রকাশ করছেন তখন তার অথেন্টিসিটি নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। (Bengali Publications)
“যদি কোনও একটি বই পঞ্চাশ বছর পর টিকে যায় ধূসর এক লাইব্রেরির কোণে এবং তা প্রামাণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় সেই ভুল ইতিহাসের দায় কে নেবেন?”
এবং এই ধরনের প্রশ্নে প্রকাশকের মুখের ডগায় জবাবদিহি উপস্থিত ‘পরের মুদ্রণে আমরা শুধরে নেব।’ কিন্তু যে পরিমাণ বই বেরিয়ে গেল সেগুলো শুধরোনো হবে কী উপায়ে? বাংলা প্রকাশনায় সম্পাদকের পদটি বহুদিন ধরেই খালি এবং তা কোনওদিন পূরণ হবে বলে মনে হয় না। আমাদের কবি এবং লেখক এত বেশি জানেন, তাঁরাই এমন বিশ্বনাগরিক সম্পাদনার প্রয়োজন কোথায়! আর এর ফাঁকেই স্বেচ্ছাচার হয়ে উঠছে এক ধরনের প্রবণতা। এমনিতেই বইমেলায় কমিশন দশ শতাংশ। তার উপর অজস্র বই ছাপা, বাঁধাইয়ের ভুলে ভরপুর। (Bengali Publications)
যদি কোনও একটি বই পঞ্চাশ বছর পর টিকে যায় ধূসর এক লাইব্রেরির কোণে এবং তা প্রামাণ্য হিসেবে বিবেচিত হয় সেই ভুল ইতিহাসের দায় কে নেবেন? আবেগবশত বইমেলার মাঠ থেকে একটি বই কেনার পর যখন দেখি কিছুদিন পর দু-একটি লেখা যোগ করে নতুন সংস্করণ প্রকাশিত হচ্ছে, কিংবা মেলার মাঠের বইটির সার্বিক অযত্ন দূর করে আবার বইটি নিখুঁত হয়ে আসছে, তখন নিজেকে বড় প্রতারিত মনে হয়। অধিকাংশ ছোট প্রকাশনী বইমেলার মাঠে এভাবেই হাতেগরম ক্রেতা পাকড়াও করে পাঠক ঠকিয়ে চলেছে। কোথাও কোনও চিকিৎসাযোগ্য শুশ্রূষা নেই। (Bengali Publications)
যথেষ্ট আবেগ আছে অথচ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেই। আর্থিক অভাব আছে অথচ বাজেটের বালাই নেই। একইসঙ্গে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং উদ্দেশ্যহীন এইসব সম্পাদক, প্রকাশক বনাম কবির লড়াই শেষপর্যন্ত কী হতে পারে তার দৃষ্টান্ত আমরা প্রতিদিন দেখছি। সবারই সুড়ঙ্গের পিচ্ছিল পথ জানা কিন্তু প্রতিরক্ষার দিকে নজর নেই। যে-কোনও স্বপ্নের গলি শেষপর্যন্ত উচ্চাকাঙক্ষার রাজপথে মিশলে পথভ্রষ্ট শব্দটির যত্ন হয়তো নিজেকেই নিতে হয়। (Bengali Publications)
“যেকোনও বইয়ের ভবিষ্যৎ, পাঠযোগ্যতা বা গুরুত্ব সমকালের দাবি নয় বরং সময়ের দাবি। তাই আমাদের কাজে কোথাও যেন সচেতনাব অভাব না থাকে।”
আগেই বলেছি আর পাঁচটা ব্যবসার মতো প্রকাশনাও একটা ব্যবসা। তারও লাভ ক্ষতি আছে। আবেগ দিয়ে সবটা হয় না। কিন্তু একটি ব্যাপারে এই ব্যবসায় কিছু পার্থক্য আছে। যেকোনও উৎপাদিত দ্রব্যের এক্সপায়ারি ডেট আছে। কিন্তু বইয়ের তা নেই। (এখানে পাঠ্যপুস্তক চাকরির পরীক্ষার বা মানে বইয়ের কথা হচ্ছে না)। তাই যেকোনও বইয়ের ভুলটি শেষপর্যন্ত ঐতিহাসিক ভুল হয়ে দাঁড়ায়। বাংলা বই যখন বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে তখন এই ধরনের অসতর্কতার সুযোগ বেশি। এভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলা প্রকাশনা এবং অনেক প্রকাশনা তার বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। (Bengali Publications)
মনে হতে পারে সব দোষ কেবলমাত্র প্রকাশকদের। তা অবশ্য নয়। তাঁরাও চান কয়েকজন জনপ্রিয়, গুরুত্বপূর্ণ বা বরিষ্ঠ লেখকের কোনও একটি টাইটেল পেতে। এ নিয়ে তাঁদের সবচেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে হয়। এবং শেষ পর্যন্ত দশ জন প্রকাশকের দায় মিটিয়ে যখন ছোট প্রকাশনীর হাতে পাণ্ডুলিপি আসে তখন দেখা যায় বইমেলার আর একমাস বাকি। আবার যে তরুণ বা মধ্যবয়স্ক কবিটি সিগনেট প্রেসের জন্য গোপনে পাণ্ডুলিপি পাঠিয়েছেন বইমেলার দশ মাস আগে তিনিও কাজের অজুহাত দিয়ে বইমেলার দিন কুড়ি আগে পাণ্ডুলিপি হাতে তুলে দেন ছোট প্রকাশকের হাতে। প্রুফ দেখতে মাসের পর মাস কাটিয়ে দেন। আবার যথা সময়ে বইমেলায় বই না এলে অভিমান করে বই তুলে নেওয়ার হুমকিও দেন। (Bengali Publications)

শুধু প্রকাশক প্রফেশনাল হবেন কবি বা লেখক নন এও বা কেমন কথা! কাজেই ছোট প্রকাশকই শুধু নয় ছোট প্রকাশনীর সঙ্গে যুক্ত কবি লেখকেরা, লিটল ম্যাগাজিনে লিখে গর্ব করা লেখকেরা এই ধরনের ইচ্ছাকৃত প্রতারণা করেই চলেছেন। প্রকাশক অসহায়। তাঁর রাতের ঘুম নেই। দিনের ক্লান্তি বেড়েই চলেছে। অবসাদ অনেক দূরে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে বইমেলার পর গোটা দেহে ঝাঁপিয়ে পড়বে বলে। (Bengali Publications)
যেকোনও বইয়ের ভবিষ্যৎ, পাঠযোগ্যতা বা গুরুত্ব সমকালের দাবি নয় বরং সময়ের দাবি। তাই আমাদের কাজে কোথাও যেন সচেতনাব অভাব না থাকে। যে কোনও প্রকাশক, মূলত ছোট প্রকাশকদের ক্ষেত্রে বলবার, প্রকাশনার সাময়িক উদ্দেশ্য বইমেলা হতেই পারে কিন্তু সামগ্রিক অভিমুখ যেন বইমেলা না হয়। যদি বইমেলাই সব হয় তাহলে আউটলেটগুলি রয়েছে কী কারণে? আপনারা কি মনে করেন নির্দিষ্ট একটি মাসেই পাঠকের হাতে কোনও গুপ্তধন এসে যায় বই কেনবার জন্য? (Bengali Publications)
আরও পড়ুন: শিক্ষার সেই ট্রাডিশন: যোগ্য-অযোগ্যের সেকাল-একাল
তাই এটুকু বিনীতভাবে বলতে চাই, সারা বছর ধরে বই বিষয়ে পরিকল্পনা করুন। নির্দিষ্ট বাজেট করুন। পাঠকের গুরুত্ব বিচার করুন এবং সুনির্দিষ্ট সম্পাদনার পর নিশ্চিত হয়ে তবেই বইটি প্রকাশ করুন। একটি বই কখনও বইমেলার বারো দিনের প্রোডাক্ট হতে পারে না বরং তা বছরের পর বছরের জন্য। তা ক্ষনিকের অতিথি নয়, ঝরা শেফালির পথ বাহিয়া তার শুধু মুখদর্শন করালেই চলে না। আপনারা অনেকেই বইমেলায় পঞ্চাশ কপি বিক্রি করেই লভ্যাংশ তুলে নিতে চাইছেন। এই হঠকারিতা আজ সুদিন মনে হলেও তা দীর্ঘস্থায়ী হবে না। চাকরি কিংবা অন্যান্য ব্যবসা ছেড়ে যখন প্রকাশক হয়েছেন তখন জহুরীর চোখ যেমন দরকার, তেমনই দরকার বিবেচনা, সৎ উদ্দেশ্য। এবং যেকোনও বইয়ের জন্য অপেক্ষা ও ধৈর্য। কাব্যগ্রন্থ বিক্রি হচ্ছে না বলে আপনি যদি থ্রিলারের দিকে হাঁটেন, তখন দেখবেন থ্রিলারের দিন শেষ হয়ে জীবনী উপন্যাসের দিন শুরু হয়ে গেছে। (Bengali Publications)
এইভাবে প্রতিদিন প্রতিমুহূর্তে উদ্দেশ্যহীন ছুটেছুটি করবেন না। বরং অপেক্ষা ও ধৈর্যের প্রতি বিশ্বস্ত থাকুন। একটি বই দশ বছর ধরে একইভাবে বিক্রি হয়ে যেতে পারে। আবার কোনও বই দশ কপির পর দু’বছর অবিক্রিত থাকতে পারে। যাঁর বই অবিক্রিত সেই লেখককে গঞ্জনা দেবেন না। যাঁর বই প্রচুর বিক্রি হয় তাকে কালজয়ী বলে বিবেচনা করবেন না। আবার জনপ্রিয়তাকে ক্ষণস্থায়ী বলে সন্দেহ করবেন না। আপনি আপনার বিবেচনায় স্থির থাকুন। প্রতিমুহূর্তে নিজের সামর্থ্য বৃদ্ধি করুন। যখন সরকার পোষিত গ্রন্থাগারগুলি বন্ধ হয়ে গেছে যখন রিলসের চাহিদা তুঙ্গে, তখন গ্রন্থপ্রকাশই এক ধরনের বিবেচনা, প্রতিরোধ, বিস্মৃতির বিরুদ্ধে জেগে থাকার ধর্ম। সাময়িক লাভের আশায় এত বড় প্রতিরোধকে ব্যর্থ করে দেবেন না। এরপরও যদি আপনি চান বইমেলার তিন দিনেই প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হবে তাহলে মনে রাখবেন তা আসলে বাংলা বই এবং প্রকাশনার অন্তিম দীর্ঘশ্বাস। (Bengali Publications)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
জন্ম ১৯৭৭। লেখা শুরু নব্বইয়ের দশকে। পঞ্চাশের বাংলা কবিতার আতিশয্যর বিরুদ্ধে এযাবৎ কিছু কথা বলেছেন। ভ্রমণে তীব্র অনীহা। কিংবদন্তি কবির বৈঠকখানা এড়িয়ে চলেন। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - বিষণ্ণ দূরের মাঠ চার ফর্মার সামান্য জীবন, উদাসীন পাঠকের ঘর, লালার বিগ্রহ, নিরক্ষর ছায়ার পেনসিল, নাবালক খিদের প্রতিভা। গদ্যের বই- নিজের ছায়ার দিকে, মধ্যম পুরুষের ঠোঁট। মঞ্চ সফলতা কিংবা নির্জন সাধনাকে সন্দেহ করার মতো নাবালক আজও।
