(Halloween)
সে প্রায় বছর তিরিশ আগের কথা। আমেরিকায় আমার প্রথম বছর। প্রথম হেমন্ত। রঙের দোলখেলা প্রথমবার দেখিয়ে আমার জানলার বাইরে নিউ ইংল্যান্ডের হেমন্তে, গাছপালা প্রায় নিস্পত্র।
আমার বন্ধু বলেছিল হ্যালোইনের কথা, বলেছিল বাড়িতে বাচ্চারা আসবে, নানান কস্টিউম পরে, ক্যান্ডি এনে রাখতে। অক্টোবরের শেষদিন মেঘলা, উল্টো-পাল্টা হাওয়ার দিন। তার সঙ্গে উড়ে বেড়াচ্ছে মাটিতে পড়ে থাকা মরচে, হলুদ বাদামি রঙের পাতারা। ছোট হয়ে আসা দিন, সময়ের আগেই অন্ধকার হয়ে এল, আর তখনই যেন আমাদের এমনিতে চুপচাপ অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংটা কেমন জেগে উঠল। সমস্ত সিঁড়ি দিয়ে ওঠানামা, করিডোর দিয়ে ছোট ছোট পায়ের, হাঁটা, দৌড়োনো, খিলখিল হাসি, মৃদু বকা। (Halloween)
দরজায় টোকা পড়ার আগেই খুলে দেখলাম, সামনে ঝকেঝকে নীল গাউন আর চিকচিকে রুপোলি মুকুট পরা, ছোট্ট রাজকন্যা, আর তার সঙ্গে তার থেকেও ছোট একটি ফায়ারম্যান, তার টুপিটি মাথার চেয়ে বড়। পিছন থেকে মা বলল, ‘বলো কি বলবে’? কচি আর আধো আধো গলায় রাজকন্যা আর ফায়ারম্যান বলে উঠল ‘হ্যাপি হ্যালোইন’! (Halloween)
তাদেরকে প্রথম ক্যান্ডি দেওয়া, তারপর এল আরও বেশ কিছু বাচ্চা। কতরকমের যে সাজ তাদের! একটু একটু করে আমার মেঘলা, চুপ করে থাকা ভেতরটা কেমন হালকা উষ্ণতায় ভরে উঠল। ভাবলাম এর পরের বার থেকে আরও বেশি ক্যান্ডি এনে রাখব। (Halloween)
দুহাজার বছর আগে আয়ারল্যান্ড, ইংল্যান্ড আর উত্তর ফ্রান্সে বসবাস করত কেল্ট সম্প্রদায়ের মানুষ। হেমন্তে যখন দিন আর রাত্রি সমান হয়ে যায়, আর গভীর শীতে যখন দিন প্রায় না থাকার মতো, শুধু থাকে দীর্ঘতম রাত, ঠিক এই দুটোর মাঝামাঝি সময়টা- যখন ফসল তোলা হয়ে যেত ক্ষেত থেকে, আর আগুনের চারপাশে ঘিরে বসে উৎসব পালন করা হত- ওই সময়টাকে কেল্টরা বলত সমহিন। কেল্টরা বিশ্বাস করত ওই সময়ে জীবিত আর মৃতদের পৃথিবীর বিভেদরেখা ঝাপসা হয়ে যায়। একটা সাঁকো দিয়ে পারাপার করা যায়। (Halloween)

অন্যপারে চলে যাওয়া আত্মারা আমাদের কাছাকাছি, আমাদের মধ্যে ঘোরাফেরা করেন তাই উৎসব শেষে তাদের জন্য রাখা থাকত খাদ্য, পানীয়। সপ্তম শতাব্দীতে আয়ারল্যান্ড চার্চ নভেম্বরের প্রথম দিনে চালু করে ‘অল সেন্টস ডে’। (Halloween)
দশম শতাব্দীতে তার অন্য নাম হল ‘অল হ্যালোস ডে’-পুরোনো ইংরাজীতে হ্যালোস মানে সাধু। তার আগের রাতকে বলা হত ‘অল হ্যালোজ ইভ’- সংক্ষেপ হতে হতে হ্যালোইন। আর ‘ট্রিক ওর ট্রিট’? যা কিনা এই উৎসবের এক মুখ্য অংশ? কোথা থেকে এল এই প্রথা? (Halloween)
“পুরো দেশে হ্যালোইনকে ‘ব্ল্যাক হ্যালোইন বলা শুরু হয়। অনেক শহরে হ্যালোইন পালন বন্ধ হয়ে যায়। সেটাকে আটকানোর জন্য, তখন থেকেই একসাথে ‘ট্রিক অর ট্রিটে বেরোনো, হ্যালোইন প্যারেড, হন্টেড হাউস ট্রেইল, এসব শুরু হয়।”
আগুনের চারপাশে উৎসব শেষ হয়ে যাওয়ার পর বিদেহী আত্মাদের জন্য ট্রিট অর্থাৎ খাবার রেখে দিত কেল্টিকরা। আরও পরে, ইংল্যান্ড ও স্কটল্যান্ডে গরীব মানুষরা, ধনীদের বাড়িতে গিয়ে সংগ্রহ করতেন ‘সোল কেক’ আর তার বিনিময়ে ওই ধনীর পরিবারের মৃত আত্মীয়দের আত্মার শান্তির জন্য প্রার্থনা করতেন তারা। পরে এই যাওয়াটা শুধুমাত্র বাচ্চাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়, তারা ধনীগৃহ থেকে পেত কয়েন, ফল, মিষ্টি আর বিনিময়ে গান, কবিতা ইত্যাদি শোনাত। (Halloween)
ইউরোপীয়রা আমেরিকায় পদার্পন করার পর বেশ কিছু সময় হ্যালোইন চালু হয়নি। মেরিল্যান্ড বা ম্যাসাচুসেটসে প্রথম আসা প্রটেস্টান্টদের মধ্যে হ্যালোইন মানা হত না। আইরিশ পটেটো ফেমিনের পর আইরিশরা যখন অনেক সংখ্যায় আমেরিকায় অভিবাসন করেন তারপর থেকে শুরু হয় এই উৎসব। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষে বা ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথমে কস্টিউম বলতে চালু ছিল বস্তা, সাদা চাদর দিয়ে ভূতের অবয়ব, মুখোশ। ডাইনী, কুমড়ো, ভূত সাজা। (Halloween)

ভয় দেখানোর উদ্দেশ্যতেই। একটু মজা মেশানো ভয়। সেই একই উদ্দেশে শোনা যায় মৃতদেহ সাজিয়ে ট্রেন লাইনে ফেলে আসার গল্প বা হাসপাতালের মর্গ থেকে মৃতদেহ চুরি করে এনে ভয় দেখানো। তবে এর থেকেও ধ্বংসাত্মক কাজ শুরু হয় গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়ে। ১৯৩৩ সালে বাবা মায়েরা টিনএজার ছেলেদের গাড়ি উল্টে ফেলে দেওয়া, টেলিফোন পোল ভেঙে ফেলা, লোকেদের বিরক্ত করা আরও অনেকরকম কাজে উত্যক্ত হয়ে ওঠেন। (Halloween)
“হ্যালোইনের দিন সন্ধ্যে হতে না হতেই বাড়ির দরজায় বেল, ফুটফুটে পরী, ভীষণ মিষ্টি ডাইনোসর, ভয়ঙ্কর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন।”
পুরো দেশে হ্যালোইনকে ‘ব্ল্যাক হ্যালোইন বলা শুরু হয়। অনেক শহরে হ্যালোইন পালন বন্ধ হয়ে যায়। সেটাকে আটকানোর জন্য, তখন থেকেই একসাথে ‘ট্রিক অর ট্রিটে বেরোনো, হ্যালোইন প্যারেড, হন্টেড হাউস ট্রেইল, এসব শুরু হয়। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে দেশে আর্থিক অবস্থার উন্নতি হয়, সিয়ার্স এবং অন্যান্য ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে বিক্রি হতে শুরু করে বাক্সবন্দী ছোটদের কস্টিউম। রাজকন্যা, মমি, ক্লাউন, ব্যাটম্যান, কাউবয়। ভয়ের থেকে সিনেমা বা কার্টুনের চরিত্ররা বেশি গুরুত্ব পেতে শুরু করে। আর তারপর থেকে শহরে, সাবার্বে বাচ্চাদের বাড়ি বাড়ি যাওয়া, প্যারেড, পার্টি, তার সঙ্গে বিভিন্ন ধরণের চকলেট ক্যান্ডির রমরমা। আর তার সাথে থাকে বাড়ির সামনেটা সাজানো। (Halloween)

কতরকমের জ্যাক দ্য ল্যান্টার্ন, অর্থাৎ কুমড়ো কার্ভ করে মুখের আকৃতি দেওয়া, কঙ্কাল, কবর, অট্টহাসি হাসা ভূত, দেওয়াল জোড়া বড় মাকড়শা, তার জাল, কালো বেড়াল, উড়ন্ত ডাইনী আরও কত কী। (Halloween)
কেটে গেছে জীবনের অনেকগুলি বছর আমারও। দ্রুত। সংসারী মায়েদের যেরকম যায়। পুজো কাটার পর, যাতায়াতের পথে বাড়িগুলোর লনে কুমড়ো, ভূত এদের আবির্ভাব হলেই, ‘কবে কস্টিউম কিনতে যাব, ক্যান্ডিস কিনতে যাব’ তাড়া দিতে থাকা দুটো উৎসুক মুখ-গাড়ির ব্যাকসিটে। নিজের বাড়ির দরজায় মোমবাতি জ্বালানো কুমড়ো, মিষ্টি ভূত আর সবেধন নীলমনি একটি সবুজ কঙ্কাল দিয়ে সাজিয়ে ফেলা। হ্যালোইনের দিন সন্ধ্যে হতে না হতেই বাড়ির দরজায় বেল, ফুটফুটে পরী, ভীষণ মিষ্টি ডাইনোসর, ভয়ঙ্কর ফ্রাঙ্কেনস্টাইন। তাদের হাতে ক্যান্ডি, চকলেট দিতে দিতে, পাশ দিয়ে আমার বাড়ির দু’জন ছোট মানুষ, কোনও হ্যালোইনে ভ্যাম্পায়ার, কখনও পাইরেট, কখনও এলিয়েন হয়ে বেরিয়ে পড়ছে ঝোলা বা কুমড়ো শেপের বালতি নিয়ে। (Halloween)

কাচের দরজা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি বাড়ির দিকে আসছে একের পর এক বিভিন্ন বয়সী বাচ্চা, দূরে দাঁড়িয়ে বাবা মায়েরা, কখনও আসছে একটু বড় বাচ্চাদের দল। অন্ধকার নামছে, চারদিকে উড়ছে শুকনো পাতা। ঠান্ডা বাড়তে শুরু করছে। চকোলেট, ক্যান্ডি প্রায় শেষ। তারপর চোখমুখ উৎসাহ আর ঠান্ডায় লাল করে নাক মুছতে মুছতে আমার ঘরের দু’জনের ফেরা। তারপরের ছবিটা বোধহয় সব বাড়িতে এক। কে কত রকমের, কোন ব্রান্ডের, ক্যান্ডি, চকলেট পেয়েছে সেগুলো সাজিয়ে রাখা, গোনা আর প্রতিযোগিতা। তার থেকে প্রিয়গুলো বের করে খেতে শুরু করা, সাথে মায়ের বকুনি। (Halloween)
আরও পড়ুন: সূত্রধার: প্রথম পর্ব
আমার বাড়িতে ক্যান্ডির ব্যাগ মাথার কাছে রেখে, রাত্রে দুই ভাই ঘুমিয়ে পড়লে তার থেকে অর্ধেক লুকিয়ে ফেলা। এখন আর ক্যান্ডি কিনতে যাওয়ার তাড়া নেই, সামান্য সাজানোতেও আলস্য লাগে। তাও বেল বাজানোর সঙ্গে সঙ্গেই দরজা খুলে, ক্যান্ডি দিই। অচেনা রাজকন্যা, সুপারহিরোদের দেখে জিজ্ঞাসা করি তোমরা কে? তাদের উত্তরে বুঝি, সন্তান বড় হলে ছোটদের জগৎটাও দূরে সরে যায়। এই নতুন চরিত্রগুলোকে আমি চিনি না তো! বড় মন কেমন করে হঠাৎ। (Halloween)
ওই দৌড়োতে থাকা মা, ঠান্ডায় নাকমুখ লাল করে আসা হাসিতে চকচককে দুটো কচি মুখের জন্য। দ্রুতগামী ট্রেনের কম্পার্টমেন্টের মতো এক বছরের সাথে আর এক বছর মিশে যায়, আলাদা করে উঠতে পারি না বছরগুলোকে। কিন্তু জ্যাক ও ল্যান্টার্ন এর ভেতরের মোমবাতির টিমটিম করে জ্বলতে থাকা নরম আলো, মনের মধ্যেই থেকে যায়, যেন সন্তানদের অনাবিল ছোটবেলা। হ্যালোইন। (Halloween)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
মহুয়া সেন মুখোপাধ্যায় বস্টন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। মূলতঃ ছোট গল্প এবং আর্টিকেল লেখেন। ছোট গল্প সংকলন ক্যালাইডোস্কোপ এবং অপরাজিতা প্রকাশিত হয়েছে, কমলিনী,দেজ পাবলিকেশন থেকে।একটি ছোট গল্পের অনুবাদ শর্টলিস্টেড হয়েছে, ‘Armory Square Prize for women writers in South Asian literature’ এ। অনুদিত গল্পটি প্রকাশিত হয়েছে বিখ্যাত Words Without Borders এর পাতায় ।আনন্দবাজারের বিদেশ পাতার নিয়মিত লেখেন তাছাড়া রোববার-সংবাদ প্রতিদিন, বাংলা লাইভ, গুরুচণ্ডালী এবং আরো কিছু ম্যাগাজিনে গল্প এবং ছোট বড় প্রবন্ধ নিয়মিত লেখেন।
