(Upendranath Brahmachari)
নোবেল পুরস্কার পেতে পারতেন এমন বাঙালি বিজ্ঞানীর সংখ্যা কিন্তু নেহাত কম নয়। তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নাম আমরা জানি, যেমন জগদীশচন্দ্র বসু, প্রফুল্লচন্দ্র রায়, মেঘনাদ সাহা অথবা সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আবার কয়েকজনের সঙ্গে সেভাবে পরিচিত নই, যেমন প্রথম মহিলা পদার্থবিদ বিভা চৌধুরী যিনি মারি ক্যুরির পরেই মহিলা নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী হতে পারতেন, যেমন রসায়নবিদ জ্ঞানেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়। এঁদের সবারই কাজের উপরে ভিত্তি করে অন্যেরা নোবেলজয়ী হয়েছেন কিন্তু এঁরা পাননি।
এইসব বিজ্ঞানীরা হয় পদার্থবিদ্যা অথবা রসায়ন নিয়ে গবেষণা করেছেন কিন্তু এঁদের মতোই নোবেল পুরস্কারযোগ্য গবেষণা চিকিৎসাবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে করেছিলেন আরেক বাঙালি, সেই কাজের ফলে আমাদের দেশে এবং পৃথিবীতে লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন রক্ষা পেয়েছে। তাঁর নাম উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী। (Upendranath Brahmachari)
তাঁর সাবেক পিতৃভূমি আর মামাবাড়ি ছিল পূর্ব বর্ধমানের সরডাঙা গ্রামে কিন্তু তিনি জামালপুরে না সরডাঙায় জন্মেছিলেন সেটা সঠিকভাবে বলা যায় না।
উপেন্দ্রনাথের জীবনী লিখতে গেলে কয়েকটা জিনিস আবছা রয়ে যায়। যেমন তাঁর জন্মস্থান আর জন্মের তারিখ। তাঁর বাবা নীলমণি ছিলেন মুঙ্গের জেলার জামালপুরের নামজাদা ডাক্তার, আর তাঁর সাবেক পিতৃভূমি আর মামাবাড়ি ছিল পূর্ব বর্ধমানের সরডাঙা গ্রামে কিন্তু তিনি জামালপুরে না সরডাঙায় জন্মেছিলেন সেটা সঠিকভাবে বলা যায় না। হুগলি কলেজ, যার আজকের নাম হুগলি মহম্মদ মহসীন কলেজ, ছিল তাঁর উচ্চশিক্ষার প্রথম ধাপ। এখানকার খাতায় তাঁর জন্মতারিখ দেখা যায় ৭ই জুন ১৮৭৫ অথচ তাঁর ছেলে ফণীন্দ্রনাথের কথায় জানা যায়, তিনি ১৮৭৩ সালের ১৯শে ডিসেম্বর জন্মেছেন। এছাড়া তিনি এই কলেজ থেকে কোন বিষয়ে স্নাতক হয়েছিলেন তা নিয়েও কিছুটা সংশয় আছে। (Upendranath Brahmachari)
ফণীন্দ্রনাথের জবানীতে এবং অন্যান্য লেখাতে বলা হয় একই সঙ্গে গণিত এবং রসায়নে অনার্স নিয়েছিলেন কিন্তু আবারও ওই কলেজের খাতায় এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলেজওয়ারী হিসাবে তাঁর রসায়নে অনার্স পাওয়ার সাক্ষ্য মেলে না। (Upendranath Brahmachari)
তবে দুটো বিষয় সুনিশ্চিত, ১৮৯৪ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়নে তাঁর প্রথম শ্রেণিতে এম এ পাওয়া এবং ১৮৯৯ সালে ডাক্তারিতে এল এম এস আর ১৯০০ তে মেডিসিন ও সার্জারিতে প্রথম হয়ে এম বি পাশ করা। এরজন্যে তিনি ‘গুডিভ’ ও ‘ম্যাকলয়েড’ পদক পেয়েছিলেন। তারপরে, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের সক্রিয় সমর্থনে ‘বিশেষ পরীক্ষার্থী’ হিসাবে ১৯০২ সালে এম ডি ডিগ্রী পান। তাঁকে যিনি ‘চিকিৎসা বিজ্ঞানের এক চলন্ত অভিধান’ বলতেন ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল সার্ভিসেসের সেই মহা-অধিকর্তা স্যর গেরাল্ড বমফোর্ডের অনুরোধে উপেন্দ্রনাথ ১৯০১ সালে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে ফিজিশিয়ান হিসাবে যোগ দেন। (Upendranath Brahmachari)

আজ থেকে ২০১ বছর আগে অর্থাৎ ১৮২৪ সালে যশোর জেলায় এক নতুন জাতের মারণব্যাধির কথা বিলিতি ডাক্তারদের কানে উঠল। এই রোগের ধরণ অনেকটা ম্যালেরিয়ার মতো কিন্তু এতে যকৃৎ বা লিভার আর প্লীহা বা স্প্লীন আক্রান্ত হয়, ফলে পেট ফুলে ওঠে। আর তার সঙ্গে হাত-পায়ের আঙুলের কোণ আর পেটের চামড়া কালো হয়ে যায় বলে এই রোগের নাম হল ‘কালাজ্বর’। ম্যালেরিয়াতে জ্বর বারে বারে অর্থাৎ পালা করে আসত তাই তার নাম হয়েছিল ‘পালাজ্বর’। প্রথমে কালাজ্বরকে পালাজ্বরেরই একটা রূপ বলে ভাবা হয়েছিল, কিন্তু দেখা গেল এই রোগের মারণক্ষমতা অনেক বেশি, শতকরা নব্বই থেকে পঁচানব্বইভাগ। ১৮২৪ আর ১৮২৫ এই দুইবছরে এক যশোর জেলাতেই পঁচাত্তর হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। (Upendranath Brahmachari)
কালাজ্বর তারপরে ছড়িয়ে পড়তে থাকে। ১৮৩২ সালে নদীয়া আর চব্বিশ পরগণায়, ১৮৫৭তে হুগলি, ১৮৬২তে ঢাকা, ১৮৬৬তে বর্ধমান, ১৮৭২ সালে উত্তরবঙ্গে, ১৮৭৫-এ তৎকালীন অসমের গারো পাহাড়ে, অবশেষে ১৮৮২ সালে বিহারে এই রোগ পৌঁছে যায়। ১৯০৩ সালে মাদ্রাজেও কালাজ্বরের সন্ধান পাওয়া গেল। Upendranath Brahmachari
“ম্যালেরিয়ার উপরে গবেষণার জন্যে নোবেলজয়ী রোন্যাল্ড রস্ এই দুই চিকিৎসক-বিজ্ঞানীর নাম মিলিয়ে এই পরজীবীর বৈজ্ঞানিক নাম দিলেন ‘লিশম্যানিয়া ডনোভানি’।”
ব্রিটিশ ডাক্তার আর সরকার বাহাদুর, সবাই তখন এই মৃত্যুমিছিল নিয়ে দিশাহারা কারণ এই রোগ শুধু নেটিভদের মধ্যে আটকে নেই, গোরাদেরও প্রচুর হচ্ছে। ১৯০৩ সালে এরকমই এক ব্রিটিশ সেনা দমদমে কালাজ্বরে আক্রান্ত হওয়ায় তাঁকে ইংল্যান্ডের রয়্যাল ভিক্টোরিয়া হাসপাতালে নিয়ে গেলে সেখানে তিনি মারা যান। ওখানকার এক সহকারী অধ্যাপক উইলিয়ম বুগ লিশম্যান তখন ম্যালেরিয়ার মতো বিভিন্ন অসুখের কারণ যে পরজীবীরা তাদের চিহ্নিত করার একটি পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন, সেই পদ্ধতি প্রয়োগ করে মৃত সেনার প্লীহাতে তিনি নতুন জাতের পরজীবীর নিদর্শন খুঁজে পেলেন। ওই একই বছরে মাদ্রাজের সরকারি সাধারণ হাসপাতালে কর্মরত আইরিশ চিকিৎসক চার্লস ডনোভান কালাজ্বরে আক্রান্ত একটি ছেলের রক্তে আর প্লীহায় ওই একই পরজীবীকে খুঁজে পেলেন। বোঝা গেলো এই পরজীবীটিই কালাজ্বরের জন্যে দায়ী। ম্যালেরিয়ার উপরে গবেষণার জন্যে নোবেলজয়ী রোন্যাল্ড রস্ এই দুই চিকিৎসক-বিজ্ঞানীর নাম মিলিয়ে এই পরজীবীর বৈজ্ঞানিক নাম দিলেন ‘লিশম্যানিয়া ডনোভানি’। (Upendranath Brahmachari)
পালাজ্বর বয়ে আনে আনোফিলিস জাতের স্ত্রী মশা, কালাজ্বর বয়ে আনে ফ্লেবোটোমস জাতের স্ত্রী বেলেমাছি, একধরণের ছোট্ট ছোট্ট মাছি।
কিন্তু এই পরজীবী মানুষের শরীরে ঢোকে কীভাবে? কাজই বা করে কীভাবে? যেমন পালাজ্বর বয়ে আনে আনোফিলিস জাতের স্ত্রী মশা, কালাজ্বর বয়ে আনে ফ্লেবোটোমস জাতের স্ত্রী বেলেমাছি, একধরণের ছোট্ট ছোট্ট মাছি। তাদের দেহে এই পরজীবী বাসা বাঁধে, তারপরে তারা মানুষকে কামড়ে রক্ত চুষলে পরজীবীটি রক্তে মেশে, সেখানে বংশবৃদ্ধি করে, রক্ত বেয়ে যকৃৎ আর প্লীহায় চলে যায়, সেখানকার সংক্রমণবিরোধী সব ক্ষমতা নষ্ট করে দেয়। এর অবশ্যম্ভাবী ফল, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, আমাশা প্রভৃতি রোগের আক্রমণ। এতেই মানুষের প্রাণ যায়, কালাজ্বরে সরাসরি নয়। (Upendranath Brahmachari)
১৯০৩ সালে অবশ্য এতকিছু জানা ছিল না। তবে এম বি পড়ার সময় থেকেই গবেষণার ব্যাপারে উপেন্দ্রনাথের প্রখর উৎসাহ, ১৯০০ সালেই তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় তারপরে সেই ধারা চলতেই থাকে। ১৯০৫-এ কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে বা আজকের নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজে ফার্স্ট ফিজিশিয়ান ও মেডিসিনের অধ্যাপক পদে আসার পরে ডক্টরেটের জন্যে গবেষণা শুরু করেন এবং ১৯০৯ সালে ওই ডিগ্রী পান। যেসব রোগের ফলে রক্তকণিকায় ভাঙন হয় সেগুলোই ছিল তাঁর থিসিসের বিষয় তাই ম্যালেরিয়া ও কালাজ্বর দুই নিয়েই তিনি সেসময় গবেষণা করেন। প্রথমদিকে তাঁর কাজ ছিল পালাজ্বরের উপরে, পরেও এই নিয়ে কাজ করেছেন, কলকাতা আর তার আশেপাশে আনোফিলিস মশার নতুন কয়েকটি প্রজাতির সন্ধান দিয়েছেন, কুইনাইনের প্রয়োগ নিয়েও নানা গবেষণা করেছেন। তবে যে কারণে উপেন্দ্রনাথের নাম ইতিহাসের পাতায় উঠে এসেছে তা হল কালাজ্বরের চিকিৎসায় তাঁর অবদান। (Upendranath Brahmachari)
১৯০৬ সালে এই রোগের উপর তাঁর প্রথম দুটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এখানে এবং ১৯০৮ সালে প্রকাশিত আরেকটি প্রবন্ধে তিনি কালাজ্বরের বিভিন্ন উপসর্গ নিয়ে আলোচনা করেছেন, কারণ সেগুলি থেকে সঠিকভাবে নির্ণীত হলেই তবে এর চিকিৎসার পথে এগোনো যাবে। ১৯১৫ সালেই তিনি কালাজ্বর সারানোর পথে এগোতে থাকেন। অ্যান্টিমনি নামে একটি ধাতু আর জল দিয়ে এমন একটি মিশ্রণ তিনি তৈরি করলেন যেখানে ধাতুটি জলে গুলে যায় না, কিন্তু ধাতুর প্রায় অণুপ্রমাণ দানা জলের মধ্যে সমানভাবে ছড়িয়ে থাকে, যাকে বলে কলয়েডীয় দ্রবণ বা কলয়েড্যাল সলিউশন। (Upendranath Brahmachari)
চিকিৎসাবিদ্যার পৃথিবীবিখ্যাত ‘ল্যান্সেট’ পত্রিকায় তাঁর এই কাজটি প্রকাশিত হয়। এই দ্রবণ তিনি কালাজ্বর রোগীর শিরায় ইঞ্জেক্ট করেন এবং রোগ নিরাময়ে দ্রবণের ভূমিকা নিয়ে ওই বছরেই একটি প্রাথমিক বার্তা দেন। এরপরে ১৯২০ পর্যন্ত অ্যান্টিমনি ও তেঁতুল থেকে উৎপন্ন টার্টারিক অম্ল বা অ্যাসিডের সঙ্গে অ্যান্টিমনির যৌগ, আর্সেনিকের যৌগ, ফর্মাল্ডিহাইড, ইউরেথেন প্রভৃতি নানা ধরণের দ্রব্যকে কালাজ্বরে আক্রান্ত মানুষের উপর প্রয়োগ করে ওষুধ হিসাবে সেগুলির কার্যকারিতা নিয়ে একের পর এক প্রবন্ধ প্রকাশ করে চলেন। কিন্তু এগুলির নিরাময় ক্ষমতা নিয়ে তিনি নিজেই খুশি ছিলেন না, তাছাড়া এদের কিছু অবাঞ্ছিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াও ছিল। (Upendranath Brahmachari)

গবেষণার কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য ১৯১৯ সালে তিনি ইন্ডিয়ান মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের কাছে আর্থিক অনুদান ও গবেষণাগারের জায়গা চাইলেন। ওই বছর থেকে ক্যাম্পবেল হাসপাতালের একটি ঘরে পাঁচ সহকারী ছাত্র, পরিমল বিকাশ সেন, সারদাচরণ চৌধুরি, যুধিষ্ঠির দাস, বিভূতিভূষণ মাইতি ও শিরীষচন্দ্র ব্যানার্জীকে নিয়ে, অত্যন্ত সীমিত সরঞ্জামের উপরে নির্ভর করে, বিদ্যুৎসংযোগহীন গবেষণাগারে কেরোসিনের আলো নিয়ে তিনি তাঁর যুগান্তকারী গবেষণা শুরু করলেন। মনে রাখতে হবে গবেষণার কাজের পাশাপাশি তাঁর প্রাত্যহিক ডাক্তারি কিন্তু নিরলসভাবেই চলতে থাকে। (Upendranath Brahmachari)
এই ওষুধ যা করল তাকে এককথায় যাদুকরী বললে অত্যুক্তি হয় না। কালাজ্বর কমিশনের অধিকর্তা মেজর হেনরী শর্টের কথায়, “রাতারাতি ৯০ শতাংশ মৃত্যুর বদলে এল ৯০ শতাংশ সুস্থতা।”
তাঁর আগের কাজের ফলাফল থেকে উপেন্দ্রনাথ নিশ্চিত হয়েছিলেন কালাজ্বরের ওষুধ হিসাবে অ্যান্টিমনির জৈব যৌগই সবচেয়ে কার্যকর কারণ এগুলি জলে পুরোপুরি মিশে যায় তাই দেহের জলীয় অংশের সঙ্গেও এরা সহজেই মিশতে পারে। তিনি দেখেছিলেন অ্যান্টিমনিঘটিত যৌগ অম্ল প্যারা- অ্যামিনোফিনাইল স্টিবিনিক অ্যাসিড এই পরজীবীদের ধ্বংস করে এবং প্লীহার কোষবৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অন্যদিকে তিনি জানতেন ইউরিয়া স্থানীয়ভাবে অচেতন করে তাই এই দুইয়ের মিলনের ফলে যে যৌগ উৎপন্ন হবে তা একাধারে কালাজ্বর নাশক ও কম ক্ষতিকর হবে। অবশেষে ১৯২০ সালে এই কাজে তাঁরা সফল হলেন। এশিয়াটিক সোসাইটির জার্নালে এই নতুন যৌগটির কথা ঘোষণা করা হল। এর নাম দেওয়া হল ‘ইউরিয়া স্টিবামাইন’। নামটি উপেন্দ্রনাথেরই দেওয়া, যৌগটির সঠিক গঠন নিয়ে কিঞ্চিৎ বিতর্ক আছে, তবে প্যারা-অ্যামিনোফিনাইল স্টিবিনিক অ্যাসিড আর ইউরিয়া, এই দুই অংশই যে এতে আছে তা নিয়ে সন্দেহ নেই। (Upendranath Brahmachari)
এই ওষুধ যা করল তাকে এককথায় যাদুকরী বললে অত্যুক্তি হয় না। কালাজ্বর কমিশনের অধিকর্তা মেজর হেনরী শর্টের কথায়, “রাতারাতি ৯০ শতাংশ মৃত্যুর বদলে এল ৯০ শতাংশ সুস্থতা।” ১৯২২ সালে উপেন্দ্রনাথ প্রথম ইউরিয়া স্টিবামাইন প্রয়োগ করে বেশ কয়েকজনকে নীরোগ করার ফল প্রকাশ করলেন, তারপরের বছরেই এই নিয়ে পরপর দশটি প্রবন্ধ প্রকাশ পেল, তারমধ্যে একটি মেজর শর্টের, তিনি তখন শিলংয়ে কালাজ্বরের মোকাবিলা করছেন, সেখানে স্টিবামাইনের প্রয়োগের আশ্চর্য ফলাফল দেখেই তিনি অমন উচ্ছ্বসিত। উপেন্দ্রনাথও সেই খবরে যারপরনাই খুশি। (Upendranath Brahmachari)
আরও পড়ুন: এক চলন্ত কঙ্কালের পথনামচা: মাৎসুয়ো বাশৌ: তর্জমা – আলোকময় দত্ত
একে একে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সুখবর আসতে লাগল, সেইসঙ্গে এই মহৌষধের আবিষ্কারকের প্রতি শ্রদ্ধা ও প্রশংসার স্রোত। সেসময়ে দেশে এই ওষুধ তৈরি করা খুবই কঠিন ছিল, জার্মানির ওষুধ কোম্পানি কেমিশে ফাব্রিক ফন হাইডেন যৌগটি তৈরি করার সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করত। উপেন্দ্রনাথের পরামর্শে কলকাতার স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনে এবার সেই পদ্ধতিতে স্টিবামাইন উৎপাদন শুরু হয়ে দেশের সর্বত্র চালান হতে লাগল। দেখতে দেখতে কালাজ্বরের প্রকোপ অনেক কমে গেল, দেশের মানুষ মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসতে লাগলেন। বিশ্বের কাছে ইউরিয়া স্টিবামাইন ‘১৯২২-২৩ সালের উদ্ভাবন’ বলে গণ্য হল। (Upendranath Brahmachari)
১৯২৩ সালে উপেন্দ্রনাথ ক্যাম্পবেল হাসপাতাল থেকে অবসর নিয়ে কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে অ্যাডিশন্যাল ফিজিশিয়ানের পদে যোগ দেন, আর ১৯২৭ সালে এই চাকরি ছেড়ে কারমাইকেল মেডিক্যাল কলেজ অর্থাৎ আজকের আর জি কর মেডিক্যাল কলেজের অধ্যাপক হন। ১৯২৪ সালে তাঁর একদা শিক্ষাগুরু আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের আদর্শে তিনি বসতবাড়ির একাংশে ‘ব্রহ্মচারী রিসার্চ ইন্সটিটিউট’ নামে ইউরিয়া স্টিবামাইনের কারখানা গড়ে তোলেন। তাঁর কর্মজীবনের শেষপ্রান্তে এসে ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জীবরসায়নবিদ্যার অধ্যাপক পদে যোগ দেন। Upendranath Brahmachari

১৯২৪ সালে তিনি ‘কাইজার-ই-হিন্দ’ উপাধি পান এবং ১৯৩৪ সালে হলেন স্যার উপেন্দ্রনাথ। সেবছর কলকাতায় এশিয়ার প্রথম ব্লাড ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে তিনি প্রধান ভূমিকা নিলেন। পরের বছর এশিয়াটিক সোসাইটির ‘স্যার উইলিয়ম জোন্স’ পদক আর ১৯৩৯ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভিশন অফ সায়েন্স তাঁকে ‘কোচবিহার প্রফেসরশিপ স্বর্ণপদক’ দান করল। বিজ্ঞানের জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলিতে একে একে তিনি সভাপতি হন, ১৯২৮ থেকে ১৯২৯ এশিয়াটিক সোসাইটির, ১৯৩৬ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের তেইশতম অধিবেশনের, ১৯৪২এ ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভিশন অফ সায়েন্সের, আর ১৯৪৪ সালে ইন্ডিয়ান সায়েন্স নিউজ অ্যাসোসিয়েশনের। (Upendranath Brahmachari)
“১৯৪২ সালে আবার তাঁর নাম সুপারিশ করা হয়, এবার পাঁচজন করেছিলেন, অধ্যাপক ঘোষ ছাড়াও ছিলেন ঊষাপ্রসন্ন বসু, এম এন বসু, সুবোধচন্দ্র মহলানবিশ আর সি সি বসু। এবারও তা গ্রাহ্য হল না।”
স্বীকৃতি আর সম্মানের এই ধারার পাশাপাশি অপ্রাপ্তির ধারাটিও চলেই আসছে। ১৯০২ সালে পালাজ্বরের উপরে কাজ করে রোন্যাল্ড রস্ নোবেল পুরস্কার পেলেন অথচ ১৯২৯ সালে কালাজ্বরের উপশম নিয়ে এতবড় কাজটির জন্য জীবরসায়নবিদ অধ্যাপক সুধাময় ঘোষ যখন উপেন্দ্রনাথের নাম উত্থাপন করলেন তখন নোবেল কমিটি তা গ্রাহ্য করল না। ১৯৪২ সালে আবার তাঁর নাম সুপারিশ করা হয়, এবার পাঁচজন করেছিলেন, অধ্যাপক ঘোষ ছাড়াও ছিলেন ঊষাপ্রসন্ন বসু, এম এন বসু, সুবোধচন্দ্র মহলানবিশ আর সি সি বসু। এবারও তা গ্রাহ্য হল না। ততদিনে কিন্তু উপেন্দ্রনাথের গবেষণা আন্তর্জাতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত, শুধু স্টিবামাইন নয়, কালাজ্বর নিয়ে তাঁর দীর্ঘদিনের কাজ আরও অনেক গবেষককে প্রেরণা দিয়েছে, পরজীবীঘটিত বিভিন্ন রোগের নিরাময়ের পথ সুগম করেছে। (Upendranath Brahmachari)
এখানেই শেষ নয়, ১৯৪০ এবং ১৯৪১ এই দুই বছরে তাঁর রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ প্রাপ্তির জন্য স্বয়ং মেঘনাদ সাহা দস্তুরমতো লড়াই করেছেন।
এখানেই শেষ নয়, ১৯৪০ এবং ১৯৪১ এই দুই বছরে তাঁর রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ প্রাপ্তির জন্য স্বয়ং মেঘনাদ সাহা দস্তুরমতো লড়াই করেছেন। জীবাশ্মবিদ বীরবল সাহনি, পদার্থবিদ কে এস কৃষ্ণান, রসায়নবিদ ও ভূতাত্ত্বিক লুইস ফার্মোর, প্রাণীতত্ত্ববিদ রবার্ট সেমুর, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে বারেবারে তিনি উপেন্দ্রনাথের নাম সুপারিশ করেন কিন্তু সোসাইটির পরিচালকদের গোঁড়া ভারতবিরোধী রাজনীতির কাছে তাঁর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। এখানে সবচেয়ে বড় ভূমিকা নিল স্কুল অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার লিওনার্ড রজার্সের উপেন্দ্রনাথ-বিরোধিতা এবং রয়্যাল সোসাইটির সম্পাদক এ ভি হিলের সঙ্গে স্যার লিওনার্ডের ঘনিষ্ঠতা। (Upendranath Brahmachari)
১৯৪০ সাল থেকে আরেকটি ঘটনা ঘটতে শুরু করল। কীটনাশক ডিডিটির উদ্ভব মশামাছিবাহিত রোগের প্রায় সম্পূর্ণ উচ্ছেদক হিসাবে দেখা দিল। ম্যালেরিয়াবাহক আনোফিলিস মশার সঙ্গে সঙ্গেই ফ্লেবোটোমস মাছিও লোপ পেয়ে গেল। তাই কালাজ্বর নিরাময়ের প্রয়োজন যেন ফুরিয়ে গেল, স্টিবামাইন আর সেই মহৌষধের আবিষ্কারকের গুরুত্বও কমে গেল। তাঁকে আর নোবেল পুরস্কার বা রয়্যাল সোসাইটির ফেলোশিপ দেওয়ার দরকার কী? Upendranath Brahmachari
কালাজ্বর কিন্তু হারিয়ে গেলো না। পালাজ্বরের মতোই এই রোগবাহক পরজীবীরও বিবর্তন হল। এই ব্যাপারটা যে হবে সেকথা উপেন্দ্রনাথই বলেছিলেন, তাঁর আবিষ্কৃত ওষুধের প্রতিরোধক্ষমতা যে এই পরজীবীর মধ্যে গড়ে উঠছে এবং এক নতুন ধরণের চর্মরোগের জন্ম দিচ্ছে সেটাও তিনি লক্ষ্য করেন। কালক্রমে ডিডিটির ক্ষতিকারক প্রভাবের কারণে ওই কীটনাশকের ব্যবহার বন্ধ করে দেওয়া হল। ধীরে ধীরে আবার ম্যালেরিয়া আর কালাজ্বর বিবর্তিত চেহারা নিয়ে ফিরে এসেছে। আজ পৃথিবীতে এই দুই রোগ আবার মানুষের সবচেয়ে বড় মারণব্যাধি হয়ে উঠেছে। হয়তো আজ আবার আরেকজন উপেন্দ্রনাথের প্রয়োজন যিনি সব উপেক্ষাকে তুচ্ছ করে এই ব্যাধির বিরুদ্ধে সার্বিক যুদ্ধঘোষণা করতে পারবেন। (Upendranath Brahmachari)
তথ্যসূত্র – শ্যামল চক্রবর্তী, ‘উপেক্ষিত চিকিৎসক-গবেষক উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী’,
অক্ষর পাবলিকেশানস্, ফেব্রুয়ারী ২০২৪
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
আলোকময় দত্ত ২০১৭ সালে সিনিয়র প্রফেসর পদে সাহা ইনস্টিটিউট অফ নিউক্লিয়ার ফিজিক্স থেকে অবসর নেওয়ার পর রাজা রামান্না ফেলো হিসাবে সেন্ট্রাল গ্লাস অ্যান্ড সেরামিক রিসার্চ ইনস্টিটিউটে তিন বছর অতিবাহিত করেন। বর্তমানে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগের এমেরিটাস অধ্যাপক।
