(Handwriting)
‘হাতের লেখা খারাপ হলে ক্ষতি নেই, লেখার হাত ভাল হওয়াই আসল।’— এ-জাতীয় সান্ত্বনাদায়ী কথা প্রায়ই ঘোরাফেরা করে আমাদের সাহিত্যজগতে। বলা বাহুল্য, যাঁদের হাতের লেখা সত্যিই খারাপ, ওপরের বাক্যটি তাঁদের কাছে আশীর্বাদী। অবশ্য পাণ্ডুলিপিতে নজর রাখলে অনেক বাঘা-বাঘা কবি-সাহিত্যিককেই চিহ্নিত করা যায়, যাঁদের হাতের লেখা সহজপাঠ্য নয়। প্রাথমিকভাবে, লেখালিখি কিংবা পাণ্ডুলিপি তৈরির ক্ষেত্রে হাতে লেখার চল এই সেদিন পর্যন্তও বহুল পরিমাণে ছিল। সোয়া-দুশো বছর পিছিয়ে গেলে দেখা যায়, বাংলা মুদ্রিত বই প্রচলিত হওয়ার আগে হাতে-লেখা পুথিই ছিল একমাত্র সম্বল। আজকের আলোচনা প্রাগাধুনিক সেইসব পুথির হস্তাক্ষর নিয়েই। (Handwriting)
‘দেশগাঁয়ে ছিল কিন্তু ছেড়ে আসা প্রতিটি মানুষ’: তন্ময় ভট্টাচার্য
তার আগে বলে নেওয়া প্রয়োজন, বাংলা পুথির হস্তাক্ষর তথা হাতের লেখা বিচারের বিশেষজ্ঞ আমি নই। এ-বিষয়ে বহু অভিজ্ঞজন রয়েছেন, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে তাঁরা ব্যাখ্যাও করতে পারবেন সেসবের। আমি শুধু বিভিন্ন পুথিপাঠ ও পুথি দেখার অভিজ্ঞতা থেকে, নিজের মতো বোঝাপড়া গড়ে নিতে পারি বিষয়টির সঙ্গে। তা যে ধ্রুব সঠিক, সে-দাবিও করছি না।
সাধারণত পুথি লেখার তিনটি ভাগ লক্ষ্য করা যায়। এক, মৌলিক যে ব্যক্তি বা কবি প্রথম একটি পুথি তথা কাব্য লিখলেন; দুই, প্রাথমিক পুথি দেখে বা শুনে, এক বা একাধিক ব্যক্তি সেই পুথির নকল তৈরি করলেন; ও তিন, নকল থেকে তৈরি হল আরও একাধিক নকল। বস্তুত, উনিশ শতক পর্যন্ত বাংলায় পুথি লিখন পদ্ধতি এগিয়েছে মূলত এই পথেই। এ ছাড়াও আরও অনেক সূক্ষ্ম বিভাগ রয়েছে, যার ভিতরে আপাতত প্রবেশ না-করলেও চলে। প্রাথমিক অর্থাৎ মৌলিক পুথি উদ্ধার করা গিয়েছে কমই; যেগুলি সহজলভ্য, তার বেশিরভাগই কোনও-না-কোনও স্তরে নকল। (Handwriting)
বাংলায় প্রাথমিক পুথির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনটি হল বিজয়রাম সেনের লেখা ‘তীর্থমঙ্গল’, যা রক্ষিত আছে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এ। বাংলাভাষার প্রথম সার্থক ভ্রমণকাব্য এটি।
বাংলায় প্রাথমিক পুথির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শনটি হল বিজয়রাম সেনের লেখা ‘তীর্থমঙ্গল’, যা রক্ষিত আছে বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এ। বাংলাভাষার প্রথম সার্থক ভ্রমণকাব্য এটি। এ-পুথি উল্লেখের কারণ হল, ১৭৭১ খ্রিস্টাব্দে খোদ বিজয়রাম সেনের স্বহস্তলিখিত ও স্বাক্ষরিত পুথিটিই আছে সেখানে। সে-পুথি পড়তে গিয়ে দেখেছি তাঁর সুস্পষ্ট হস্তাক্ষর, অধিকাংশ শব্দই পৃথকভাবে লেখা, যা সে-যুগের নিরিখে বিশেষ। প্রাক-ঔপনিবেশিক ও ঔপনিবেশিক যুগের বিভিন্ন পুথিতে দেখা যায় একেকটি পদ বা বাক্য টানা লেখার প্রবণতা। বস্তুত, কাগজ থেকে কলম না-তুলে একটানে একটি পদ লেখা পুণ্যকর্ম বলে বিবেচিত হত। ফলে, শব্দগুলি গায়ে-গায়ে লেগে থাকত অধিকাংশ পুথির ক্ষেত্রেই। এর কিছু ব্যতিক্রমও দেখা যায়, যেমন বিজয়রাম-লিখিত ‘তীর্থমঙ্গল’। (Handwriting)
কৃষ্ণরাম ও সত্যেন্দ্রনাথের সূত্রে যখন সাহিত্য-মানচিত্রে উঠে এসেছিল নিমতা: তন্ময় ভট্টাচার্য
তীর্থমঙ্গল ছাড়াও আরও কয়েকটি বাংলা পুথির মূল পাণ্ডুলিপি উদ্ধার করা গেলেও, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই আমাদের নাগালে যা আসে, তা নকল। অর্থাৎ, মূল পুথির অনুলিপি। আর সময়ের সঙ্গে সঙ্গে নকল হতে-হতে ব্যক্তিভেদে বানান বদলে যেত, বদলে যেত শব্দ এমনকি শব্দের ছাঁচও। অবশ্য যুগের সঙ্গে শব্দের ছাঁচ বদলানো এই আলোচনায় বিবেচ্য নয়, কারণ তার জন্য প্রবণতার বিবর্তনই মূলত দায়ী। যাইহোক, যাঁরা পেশাদারভাবে পুথি লিখতেন, তাঁদের বলা হত লিপিকর। এঁরা ধান, বস্ত্র বা টাকার বিনিময়ে পুথি নকল করে দিতেন। পেশাদারিত্বের খাতিরেই, অধিকাংশের হাতের লেখাও হত সুষ্পষ্ট, টানা ও গভীর। ড. কল্পনা হালদার লিপিকরদের তিনভাগে ভাগ করেছেন— শিক্ষিত, অল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিত। এর মধ্যে অল্পশিক্ষিত ও অশিক্ষিতরা, ড. হালদারের মতে, নিছক সহজ উপার্জনের খাতিরেই এ-পেশায় এসেছিলেন, ফলে হস্তাক্ষরে সেই সৌকর্য ছিল না। তৈরি হত পাঠবিকৃতিও। অবশ্য আধুনিক যুগে দাঁড়িয়ে, এই পাঠবিকৃতির সাপেক্ষে লিপিকরদের শ্রেণিবিভাগ করা মুশকিল। সেকালে নির্দিষ্ট কোনও বানানবিধি না-থাকায়, তাঁরা বানানের যথেচ্ছাচার করতেন। এমনকি একই পুথিতে একই শব্দের একাধিক বানানও দেখা গেছে। বস্তুত, সেকালে বেশিরভাগ কাব্যই যেহেতু পাঠকের তুলনায় শ্রোতা ছিলেন মুখ্য, লিপিকররা অনেকসময় পাঠযোগ্য বানান লিখেই ছেড়ে দিতেন, যেহেতু শ্রোতার কানে বানানভুল ধরা পড়ে না। (Handwriting)

হস্তাক্ষর নিয়ে আলোচনায় বানান-বিকৃতি গৌণ। শুধুমাত্র লেখায় মন দিলেও বিভিন্ন পর্ববিভাগ উঠে আসে। কিছু হস্তাক্ষর সুঠাম, পরিশীলিত, গাঢ়; দেখে বোঝা যায়, অপর পুথি দেখে যত্ন করে লিখেছেন লিপিকর। এমন উদাহরণ ভুরি-ভুরি। বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ-এ রক্ষিত ‘শ্রীকৃষ্ণকীর্তন’-এর পুথিটি পাকা হাতের লেখা, তাতে সন্দেহ নেই। প্রসঙ্গত, শ্রীকৃষ্ণকীর্তনের লিপিকর বা লিপিকাল জানা না-গেলেও, এমন বহু পুথি পাওয়া যায়, যার পুষ্পিকায় লিপিকর নিজের নাম, নকলের তারিখ ইত্যাদি লিখে রেখেছেন। সেগুলি বিশ্লেষণ করে বহু তথ্য পেয়ে থাকেন গবেষকরা। এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত জয়ানন্দের ‘চৈতন্যমঙ্গল’-এ (লিপিকর সনাতন পাল, ১০৯৬ সন) টানা হাতের লেখা, লিপিও পরিশীলিত। বিশ্বভারতী পুথিশালায় বিপ্রদাস পিপিলাই-এর ‘মনসামঙ্গল’-এর পুথিটিও (লিপিকর জয়দেব নন্দী, ১২৩১ বঙ্গাব্দ) পেশাদারিত্বের সাক্ষ্য বহন করে। এর বিপরীতে, এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত বিপ্রদাসের মনসামঙ্গলটি খানিক দ্রুত হাতের লেখা, অক্ষরের মাপেও সাযুজ্য নেই। ওপর-নিচের পঙক্তিগুলি অনেকক্ষেত্রেই গায়ে-গায়ে। অনুমান করা চলে, অপর পুথি দেখে নয়, শুনে-শুনেই এটি লিখেছিলেন লিপিকর গোপীনাথ সিংহ এবং তিনি পেশাদার লিপিকর নন। অপেশাদারিত্বের অভিযোগ আনা চলে বিশ্বভারতীতে রক্ষিত মুকুন্দরামের ‘চণ্ডীমঙ্গল’-এর একটি পুথি (লিপিকর বেচারাম সর্ম্মণ, ১১৯৪ বঙ্গাব্দ) ও ওই পুথিশালারই দ্বিজ রঘুনন্দনের ‘পঞ্চাননমঙ্গল’ (লিপিকর রামকান্ত পণ্ডিত, ১২০২ বঙ্গাব্দ)-এর ক্ষেত্রেও। এশিয়াটিক সোসাইটিতে রক্ষিত নিত্যানন্দ ঘোষের ‘মহাভারত’ পুথিটিও (১১৯৯ বঙ্গাব্দ, লিপিকরের নামোল্লেখ নেই, ‘এ পুস্তক শ্রীনিমাইচরণ মল্লিকের’, মালিকের স্বহস্তলিখিত?) খারাপ হস্তাক্ষরের অন্যতম উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরা যায়। তবে পরিশীলিত হস্তাক্ষরের উদাহরণও কম নয়। বস্তুত, পুথি দেখে, অক্ষরের দ্রুতি ও গঠন দেখে লিপিকরের কুশলতা সম্পর্কে ধারণা করা যায় সহজেই। (Handwriting)

পশ্চিম মেদিনীপুরের চন্দ্রকোণায় রামেশ্বর ভট্টাচার্য্যের শিবায়ন পুথির খণ্ডিত অংশ খুঁজে পেয়েছিলাম, যার রচনাকাল অষ্টাদশ শতকের শেষার্ধ কিংবা ঊনবিংশ শতকের প্রথমার্ধ। পুষ্পিকা না-থাকায়, লিপিকর সম্পর্কে জানা যায়নি। কিন্তু হস্তাক্ষর (Handwriting) দেখে লিপিকরের ধৈর্য ও মনঃসংযোগ সম্পর্কে আন্দাজ মেলে। অন্যদিকে, লিপিকর ছাড়াও কখনও-কখনও নিতান্ত ব্যক্তিগত ব্যবহারের জন্যও অনেকে নিজেরাই নকল করে নিতেন। সেক্ষেত্রে হস্তাক্ষর খারাপ হওয়ার যেমন সম্ভাবনা থাকে, তেমন পরিশীলিত হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে বইকি! ধর্মীয় কাব্য ছাড়া, ব্যক্তিগত তথ্যাদিও অনেকে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন। তুলট কাগজের একটি পাতড়ায় লাল কালিতে লেখা বিষঝাড়ার মন্ত্র দেখেছিলাম, যার হস্তাক্ষর নিতান্তই কাঁচা, শিশুসুলভ। লেখকের সামাজিক অবস্থান ও পেশার প্রতিফলনও কি বোঝা যায় না এর মধ্যে দিয়ে? (Handwriting)

অন্যদিকে, ১৮৮৩ বঙ্গাব্দের কয়েকটি হিসাবের কাগজ-টুকরোতে হস্তাক্ষর সুঠাম। লেখা ছিল— ‘শন ১২৮৩ তিরাসি সাল তারিখ ১২ চৈত্র খাটানি আরম্ভ শ্রীনারাণ মণ্ডল সাং সুলতানপুর।’ খাটানির ও পাওনা ফসলের পরিবর্তে, উক্ত নারাণ (নারায়ণ) মণ্ডলকে অগ্রিম ৯ টাকা দাদনও দেওয়া হচ্ছে। অপর একটি টুকরোয় দেখা যায়, ওই বছরেরই ১৮ চৈত্র গরু কেনার জন্য ২০ টাকা খরচ হচ্ছে। নাম লেখা না-থাকলেও, হস্তাক্ষর একই ব্যক্তির। এরপর, ধাপে-ধাপে সেই টাকা উসুলের খতিয়ান লেখা। সেসব হিসাবনিকাশ আমাদের আলোচ্য নয়। আমরা হস্তাক্ষরের সঙ্গে সামাজিক অবস্থানটুকু বুঝে নিতে চাইছি। সে-সময়ের কৃষকরা অধিকাংশই ছিলেন নিরক্ষর, ফলে তাঁদের পক্ষে লেখাপড়া সম্ভব ছিল না (এখানে নারায়ণ মণ্ডল)। অন্যদিকে যিনি চাষ করাচ্ছেন, অপেক্ষাকৃত সম্পন্ন; শুধু অক্ষরজ্ঞান আছে তা-ই নয়, রীতিমতো পরিশীলিত হাতের লেখা। নিয়মিত হিসাব রাখছেন যাবতীয় খরচের। ফলে, শুধুমাত্র পেশাদার লিপিকররাই সুন্দর হস্তাক্ষরের অধিকারী— এমন সরলীকরণ করা চলে না। (Handwriting)
এতক্ষণ পুথির হস্তাক্ষর নিয়ে কথা হলেও, এবার প্রাসঙ্গিক ও জরুরি অপর এক পর্বে প্রবেশ করা যাক। শিলালিপি, তাম্রশাসন ও মন্দিরফলকের লিপির অক্ষর। প্রচলিত অর্থে হস্তাক্ষর বলা না-গেলেও, শিল্পীর খোদাই করা সেসব লিপি এক অর্থে প্রচলিত অক্ষর অনুসরণ করেই। পরবর্তীকালে, হস্তাক্ষরের অনুকরণে খোদিত লিপিরও ভুরি-ভুরি উদাহরণ পাওয়া যায়। লক্ষ্মণসেনের (১১৭৯-১২০৬) মাধাইনগর তাম্রশাসন ও ভাওয়াল তাম্রশাসনে নজর দিলে খোদিত লিপির পরিশীলিত রূপটি উঠে আসে। সেগুলি যে রাজকীয় দান, আনুষ্ঠানিক ও প্রশাসনিক কর্মসূচি, তা শিবের সিল ও খোদিত অক্ষরের স্পষ্টতা দেখেই বোঝা যায়। অন্যদিকে ত্রিপুরার একটি তাম্রশাসনের কথা ধরা যাক। ত্রিপুরার রাজা বিজয়মাণিক্যের আত্মীয়া পুণ্যবতী দেবী, ১৪৮৮ খ্রিস্টাব্দে জনৈক আচার্য বনমালীকে কুমিল্লার কয়েকটি গ্রাম দান করছেন। তাম্রশাসনটির ভাষা সংস্কৃত হলেও লিপি বাংলা। কোনও সিল তো দূরস্থান, খোদিত অক্ষরও অপরিশীলিত, শিশুসুলভ, অন্যান্য তাম্রশাসনের মতো রাজকীয় নয়। ফলে, কোন স্তরে কার দ্বারা দান করা হচ্ছে, তার প্রতিফলন দেখা যেত তাম্রশাসনের ‘হস্তাক্ষর’-এও। (Handwriting)

এবার অন্যদিকে নজর দেওয়া যাক। বাংলায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য মন্দিরফলকের দিকে নজর রাখলে, প্রবণতাগুলি বোঝা যায় সহজেই। এককালে কালো পাথরের ওপর প্রতিষ্ঠালিপি খোদাই করা হত। পরবর্তীতে টেরাকোটার ফলক ও আরও পরে মার্বেলফলকে (শেষেরটি মূলত ছাপা অক্ষরের অনুসারী) প্রতিষ্ঠা-বিষয়ক তথ্য জানানোর প্রবণতা দেখা যায়। এই ফলকগুলির লিপি বিশ্লেষণ করলে, হস্তাক্ষর না-হলেও, খোদাইকরের অক্ষরের ছাঁদ সম্পর্কে জ্ঞান ও দক্ষতার ধারণা মেলে। চন্দ্রকোণার লালজীউ মন্দিরের (বর্তমানে ধ্বংসপ্রাপ্ত) বিখ্যাত প্রতিষ্ঠাফলকটি বর্তমানে রক্ষিত আছে চন্দ্রকোণা সংগ্রহশালায়। ১৫৭৭ শকাব্দ অর্থাৎ ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে খোদিত সে-লিপিতে বলা আছে শ্রীমতী লক্ষ্মণাবতী কর্তৃক মন্দির প্রতিষ্ঠার কথা। (Handwriting)
খোদিত বক্তব্যের বিবরণ এ-ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক, তবে শেষ পঙক্তিটি নজর টানে। ‘পৌরাণিক শ্রীমোহন চক্রবর্ত্তী গোকুল দাস।’ তারাপদ সাঁতরার অনুমান, মোহন চক্রবর্তী ছিলেন লিপিটির রচয়িতা ও খোদাইকারক ছিলেন গোকুল দাস।
লিপিগুলি পরিশীলিত নয় মোটেই, আঁকাবাঁকা এবং অক্ষরের ছাঁদে সামঞ্জস্য নেই। বোঝাই যায়, খুব পোক্ত খোদাইকারকের কাজ নয়। খোদিত বক্তব্যের বিবরণ এ-ক্ষেত্রে অপ্রাসঙ্গিক, তবে শেষ পঙক্তিটি নজর টানে। ‘পৌরাণিক শ্রীমোহন চক্রবর্ত্তী গোকুল দাস।’ তারাপদ সাঁতরার অনুমান, মোহন চক্রবর্তী ছিলেন লিপিটির রচয়িতা ও খোদাইকারক ছিলেন গোকুল দাস। অর্থাৎ, মন্দিরের স্থপতি আর খোদাইকারক এক ব্যক্তি নন। আবার, খোদাইকারকই যে মূল বক্তব্যটির রচয়িতা, তা-ও নয়। বস্তুত, অপরের লেখা বয়ান ও অক্ষরছাঁদ রেফারেন্স হিসেবে নিয়ে, সেটির রেখাচিত্র আগে গুটিয়ে তোলা হত পাথর বা মাটির ফলকে। তারপর, সেই রেখা ধরে-ধরে খোদাই করা। ফলে, পরোক্ষে একজনের হস্তাক্ষরই ফুটে উঠত ফলকগুলিতে। (Handwriting)

দ্বিতীয় উদাহরণ হিসেবে দেখা যাক নদিয়ার শিবনিবাসের রাজরাজ্ঞীশ্বর মন্দিরের প্রতিষ্ঠালিপিটি। প্রতিষ্ঠাতা মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র, প্রতিষ্ঠাসাল ১৬৮৪ শকাব্দ অর্থাৎ ১৭৬২ খ্রিস্টাব্দ। এতে খোদাইকারকের নাম নেই, তবে খোদিত লিপিগুলির মধ্যে ভারসাম্য রয়েছে, চন্দ্রকোণার ফলকের মতো ‘কাঁচা’ কাজ নয়। আবার, শেওড়াফুলির নিস্তারিণী কালীবাড়ির (১৮২৭ খ্রি.) প্রতিষ্ঠাফলকটি লিপির সৌকর্যের দিক থেকে অন্যতম আদর্শ। প্রসঙ্গত, আলোচ্য তিনটি ফলকেই হরফ বাংলা, ভাষা সংস্কৃত (এ-উদাহরণ দেখা যায় বঙ্গদেশে প্রাপ্ত প্রচুর সংস্কৃত পুথিতেও)। তবে, শেষোক্ত ফলকের শেষ চারটি পঙক্তি বাংলায় লেখা। শেষ দু-পঙক্তি— ‘মাটিয়ারি গ্রামবাসি নির্ম্মানেতে দক্ষ। কৃষ্ণচন্দ্র ভাস্কর নির্ম্মিল সমক্ষ।’ অর্থাৎ, মাটিয়ারি গ্রামের কৃষ্ণচন্দ্র ভাস্কর মন্দিরটির স্থপতি। ফলকে উৎকীর্ণ লিপিটিও কি তাঁরই কীর্তি? সম্ভবত না। (Handwriting)

ফিরে আসা যাক পুথির কথায়। হস্তাক্ষরের তারতম্য ছাড়াও যে নকল করার সময় বানান-বিভ্রাট, শব্দ বা বাক্যের প্রক্ষিপ্তকরণ ইত্যাদি হত, আগেই বলেছি। সেজন্য, পুথির শেষে পুষ্পিকায় লিপিকররা স্পষ্টই বলে দিতেন— ‘যথা দৃষ্টং তথা লিখিতং লেখক দোষ নাস্তি’ অর্থাৎ যা দেখেছি তাই লিখেছি, লেখকের (পড়ুন লিপিকরের) কোনও দোষ নেই। আবার, কখনও কখনও দিতেন ‘ভীমাস্বপি রণে ভঙ্গ মুনিনাঞ্চ মতিভ্রম’ ইত্যাদি সাফাইও। জনৈক লিপিকর, ফকির চান্দ সেন তো স্পষ্ট বলেই দিয়েছিলেন— ‘এই পুস্তক দেখিয়া যেবা মন্দ বোলে। অঘোর নরকে তার বাস নিশ্চএ।’ এসব কি নিতান্ত পুথির ভুলের ডিফেন্স, হস্তাক্ষরেরও কি নয়? লিপিকর-কর্তৃক নকলের পর, হস্তাক্ষর জটিল হলে কীভাবে পাঠ করতেন মালিকেরা? অনুমান, মূল কাব্যটি তাঁদের অংশত কণ্ঠস্থই থাকত, ফলে হস্তাক্ষর পাঠে আটকালেও সমস্যা হত না বিশেষ। তদুপরি, অনেক লিপিকর পুথি নকলকে ধর্মীয় পুণ্যকর্ম বলে বিবেচনা করায়, বাহ্যিক হাতের লেখাটি যথাসম্ভব পাঠযোগ্য রাখার চেষ্টা করতেন। পরবর্তীকালে, আঠেরো শতকের দ্বিতীয়ার্ধে যখন বাংলা হরফ মুদ্রণের প্রচলন ঘটতে থাকে ধীরে-ধীরে, অক্ষরের ছাঁচ তৈরির প্রাথমিক উপাদান ছিল পুথির হস্তাক্ষরই। (Handwriting)
বস্তুত, হস্তাক্ষর দিয়ে একজন লিপিকরের প্রবণতা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। বানান, অক্ষরের ছাঁদ ইত্যাদির বিবর্তন সময়ের ফসল ও তা যৌথ প্রবণতার দিকেই ইঙ্গিত করে, একক ব্যক্তির হাতের লেখার ধরনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্ষীণ।
বস্তুত, হস্তাক্ষর দিয়ে একজন লিপিকরের প্রবণতা ছাড়া আর বিশেষ কিছুই চিহ্নিত করা সম্ভব নয়। বানান, অক্ষরের ছাঁদ ইত্যাদির বিবর্তন সময়ের ফসল ও তা যৌথ প্রবণতার দিকেই ইঙ্গিত করে, একক ব্যক্তির হাতের লেখার ধরনের সঙ্গে তার সম্পর্ক ক্ষীণ। আবার এ-ও সত্য যে, দীর্ঘ সময় ধরে হস্তাক্ষরের পরিবর্তনের ফলেই অক্ষরগুলিও বদলের মুখোমুখি হয়েছে ও কালক্রমে তা ‘আদর্শ’ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। তবে হস্তাক্ষরের সৌন্দর্যের সঙ্গে কালির, লেখার মাধ্যমের (তালপাতা বা তুলোট কাগজ) সম্পর্কও উড়িয়ে দেওয়ার নয়। লিপিকরের মনঃসংযোগ, বয়স, পরিশ্রম (‘প্রিষ্ঠ ভঙ্গ কটি গ্রিবা তুল্য প্রষ্ঠ অধোমুখং’) ইত্যাদিও প্রভাব ফেলত হাতের লেখায়। সর্বোপরি, পুথির হস্তাক্ষর বাংলাভাষার হাজার বছরের লিখিত সংস্কৃতিরই উত্তরাধিকার। আজ আমাদের অক্ষরপাঠ মুদ্রণ-নির্ভর হলেও, প্রাথমিক দিনগুলিতে মুদ্রিত অক্ষরও ছিল হস্তাক্ষর-নির্ভরই। ফলে, যে-ধারা সমানে চলছে, আমরা তারই অংশ। উত্তরাধিকারের গর্ব যদি থাকে, দায়ও কিছু বর্তায় বইকি! তা হল, বাংলাভাষার চর্চা বাঁচিয়ে রাখার দায়। সে-দায় থেকে যেন আমরা বিচ্যুত না হই… (Handwriting)
ঋণ:
ড. কল্পনা হালদার, পাণ্ডুলিপি পঠন সহায়িকা, সাহিত্যলোক, ১৯৯৮
ড. ত্রিপুরা বসু, বাংলা পাণ্ডুলিপি পাঠপরিক্রমা, পুস্তক বিপণি, ২০০০
তন্ময় ভট্টাচার্য, গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ, মাস্তুল, ২০২৩
তারাপদ সাঁতরা, মন্দিরলিপিতে বাংলার সমাজচিত্র, টেরাকোটা সংস্করণ, ২০১৫
যূথিকা বসু ভৌমিক, বাংলা পুথির পুষ্পিকা, সুবর্ণরেখা, ১৯৯৯
এশিয়াটিক সোসাইটি, বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষৎ, বিশ্বভারতী, চন্দ্রকোণা সংগ্রহশালা
আত্রেয়ী চক্রবর্তী, অরিন্দম গোস্বামী, সুবর্ণকান্তি উত্থাসনী
ছবি ঋণ: লেখক
জন্ম ১৯৯৪, বেলঘরিয়ায়। কবি, প্রাবন্ধিক ও স্বাধীন গবেষক। প্রকাশিত বই: বেলঘরিয়ার ইতিহাস সন্ধানে (২০১৬), আত্মানং বিদ্ধি (২০১৮), বাংলার ব্রত (২০২২), অবাঙ্মনসগোচর (২০২৩), বাংলার কাব্য ও মানচিত্রে উত্তর চব্বিশ পরগনা ও হুগলি জেলার গঙ্গা-তীরবর্তী জনপদ (২০২৩) ইত্যাদি। সম্পাদিত বই: না যাইয়ো যমের দুয়ার (ভ্রাতৃদ্বিতীয়া-বিষয়ক প্রথম বাংলা গ্রন্থ), দেশভাগ এবং (নির্বাচিত কবিতা ও গানের সংকলন), সুবিমল বসাক রচনাসংগ্রহ (২ খণ্ড)।