(Prosanto Halder)
বইয়ের নাম: শৌখিন লোকেরাও পড়ে দেখতে পারেন
লেখক: প্রশান্ত হালদার
প্রকাশক: মুক্তাঞ্চল
প্রচ্ছদ: অংশুমান
বিনিময় মূল্য: ১২০ টাকা
প্রচলিত ব্যবস্থাকে সন্দেহ করাই একজন প্রকৃত কবির জীবনধর্ম। অথচ এখন এমন এক সময়, যখন একজন কবি প্রশ্ন করতে ভুলে গেছেন প্রচলিত ব্যবস্থাকে। এমনকি প্রচলিত অব্যবস্থাকেও? বরং তার নজর স্থিতাবস্থার দিকে যা কবিসম্মেলন ও কবিখ্যাতির সমানুপাতিক। ভাবতে ভাল লাগে শুরুর থেকেই শূন্য দশকের কবি প্রশান্ত হালদার এই পথে হাঁটেননি। সামান্যতম খ্যাতির সুযোগ থাকলেও, তাকে প্রয়োজনীয় লাথি কষাতে দ্বিধা করেননি। প্রশান্ত একজন কবি, প্রশান্তরা অনেকজন মানুষ ‘মুক্তাঞ্চল’ নামক বাংলা সাহিত্যে চাষাবাদের ব্যবস্থা করেছেন। শিল্প নামক কোনও মিথ্যাচারের তোয়াক্কা না করেই। প্রতিষ্ঠানের সদরে বই-কামান দাগতে তাঁদের দ্বিধা নেই। এবং প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা যখন, আরেকটি প্রতিষ্ঠান হয়ে উঠতে চায় সেই অবস্থাকেও চ্যালেঞ্জ জানান তাঁরা। রাজপথে, অন্ধকার চিলেকোঠার লাইভে প্রকৃত অর্থেই প্রশান্ত এবং তাঁদের যাবতীয় লেখালিখি আসলে এক চাপা সন্ত্রাস। নিজের মুখোশটিকে চিহ্নিত করতেও যাঁদের দ্বিধা নেই। (Prosanto Halder)
আরও পড়ুনঃ স্মৃতি-বিস্মৃতির অনন্ত বিকেল: কবিতাসংগ্রহ: অঞ্জলি দাশ
বইমেলায় এতদিনে হয়তো আপনি তাঁদের দেখা পেয়েছেন, অথবা দেখা পাননি। ফ্যাতাড়ুর দেখা কেই বা সহজে পায় যদি না বুকের ভেতর আশ্চর্য একটি চোখ থাকে! বইমেলায় তাঁদের কোনও স্টল নেই। এমনকি লিটিল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে টেবিলও নেই। তাঁরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকেন যত্রতত্র। লিটিল ম্যাগাজিন ঘেঁষে অস্থায়ী টেবিল কিংবা মাটির উপর; আপনি যখন ভিড় ঠেলে তাঁদের দিকে ছুটছেন তখন কার্যত তাঁরা অদৃশ্য। কেন লিটিল ম্যাগাজিনে টেবিল নেন না প্রশান্তরা? তার একটা সহজ যুক্তি আমার মনে হয়, ইদানিং আশি শতাংশ লিটিল ম্যাগাজিন, প্রতিষ্ঠানের চেয়েও বিপজ্জনক। তাই প্রশান্তরা আদতে কোথায় আছে আমরা জানি না। কিন্তু আমাদের প্রতিটি চলাফেরা, আমাদের সন্দেহজনক অবস্থান, দ্বিধাহীন তৈলাক্ত মার্জনা, সবই লক্ষ্য রাখছেন তাঁরা। আর গোপনে ছড়িয়ে রাখছেন তাঁদের নানা ব্ল্যাক কুক। রেডবুকের মতোই বিস্ফোরক এবং নির্জন হাত পুড়ে যায়, মেধার গর্ব ঘুচে যায়, এমন একটি মিসাইল। ((Prosanto Halder)
গতবছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রশান্ত হালদারের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘শৌখিন লোকেরাও পড়ে দেখতে পারেন’। এই প্রথম প্রশান্তর একটি বই বোর্ড বাঁধাইয়ের মুখ দেখল। আর হয়ে উঠল আরও বেশি ধারালো, বিপজ্জনক চিন্তার প্রদর্শনী।
গতবছর বইমেলায় প্রকাশিত হয়েছে প্রশান্ত হালদারের পঞ্চম কাব্যগ্রন্থ ‘শৌখিন লোকেরাও পড়ে দেখতে পারেন’। এই প্রথম প্রশান্তর একটি বই বোর্ড বাঁধাইয়ের মুখ দেখল। আর হয়ে উঠল আরও বেশি ধারালো, বিপজ্জনক চিন্তার প্রদর্শনী। ইতিপূর্বে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর যে কাব্যগ্রন্থগুলি হলুদ সিরাম ওড়ে (২০০৭), মেধাবী ও দুঃস্থ(২০০৯), অজানা জ্বর (২০১৭) এবং শময়িতা সেন(২০২২)। এই কাব্যগ্রন্থগুলির ভেতর দিয়ে যাত্রা করলে আমরা টের পাব প্রশান্ত শূন্য দশকে যেন নিজেই একটি দশক। তাঁকে কি ষাটের উত্তরাধিকারী ভাবছি আমরা? আমি অন্তত ভাবছি না। প্রশান্তর কবিতা পড়তে পড়তে যে শৈলেশ্বর ঘোষের কথা মনে পড়ে তার পেছনে বিষয় বা আঙ্গিক নেই। কোনও মিলই নেই। তবু মনে পড়ে। তার কারণ প্রশান্ত শৈলেশ্বরের মতোই যাবতীয় ভাঙচুরের পরেও কবিতাটিকে শেষপর্যন্ত তীব্রভাবে সার্থক করে তোলেন। (Prosanto Halder)
সেই আঘাত পাঠকের স্নায়ুতে যতখানি তীব্র হতে পারে, তার জন্য প্রশান্ত শিল্পের কয়েকটি অভিসন্ধি হয়তো মেনেই নিয়েছেন। তার একটা বড় কারণ প্রশান্ত জানেন শব্দ দিয়ে বলতে হবে। ব্যাকরণের পাল্টা ব্যাকরণও যেন শেষপর্যন্ত পাঠকের মনে সঞ্চরমাণ হয়। না হলে যুদ্ধের কোনও অর্থ হয় না। যতটুকু প্রশান্তর কবিতায় পাবেন না, ততটুকু জীবনের দ্রোহ দিয়ে সে পুষিয়ে দেয়। বাংলা কবিতার ন্যাকান্যাকা উচ্চারণকে কেটে, কুটি কুটি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দেয়। প্রশান্তর যাবতীয় কথাবার্তা এবং যাবতীয় না-লেখা আসলে এক হলুদ সিরাম যা প্রতিমুহূর্তে রক্তাক্ত আঘাতের পর জীবনের দাবি। (Prosanto Halder)

তাই প্রশান্ত এবং প্রশান্তর লেখায় আদতে কোনও ফারাক নেই। খুব সহজেই প্রশান্ত বলতে পারেন তাঁর যাবতীয় লেখালেখি ‘চিন্তার প্রদর্শনী’। তাঁর মতো একজন একক, সমষ্টিকে আঘাত করার জন্য যথেষ্ট। প্রশান্ত কেন লিখছেন? প্রশান্ত কেন লেখেন তা আসলে এক রাজনৈতিক প্রকল্প। যে- কোনও আধিপত্যের বিরুদ্ধে তাঁর লেখা জেগে থাকার স্বধর্ম পালন করে চলেছে। (Prosanto Halder)
প্রশান্ত হালদারের সাম্প্রতিক কাব্যগ্রন্থ ‘শৌখিন লোকেরাও পড়ে দেখতে পারেন’ প্রায় তিন ফর্মার।
এখানে রয়েছে সংখ্যা চিহ্নিত ৩৩ টি কবিতা। সঙ্গে পাওয়া যাবে দুটি ভূমিকা। একে চিরাচরিত ভূমিকা ভাবলে ভুল হবে। তবে চাইলে, কবিতা হিসেবে পড়া যায়। কাব্যগ্রন্থে কোনও ভূমিকার প্রয়োজন নেই, এমনটাই মনে করি আমরা। সত্যি কি নেই? সবটাই কি বলা যায়? তারপরও থেকে যায় আরও কিছু ঘোষণা যা কবিতারই এক জরুরি এক্সটেনশন। তা সবার জন্য নয়। কাউকে কাউকে বলতে হয়। প্রশান্ত তেমনই বলেছেন। শুরুতে কী বলছেন প্রশান্ত একটু দেখে নেওয়া যাক: (Prosanto Halder)
আজ যখন কবিতা-লেখক হিসেবে পিছনে ও আশপাশে তাকাই, দেখি বর্ণবাদী, মনুবাদী, পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির সুবিধাভোগ থেকে উঠে আসা ব্যাপার-স্যাপারকে শিকড়, মাটি, ভারতীয়ত্ব ইত্যাদি তকমা পরিয়ে ঘটানো হয়েছে তার উদযাপন
“বাংলা কবিতার ইতিহাস আড়ে-বহরে নেহাত কম না; ঘরানাও বহুত। আজ যখন কবিতা-লেখক হিসেবে পিছনে ও আশপাশে তাকাই, দেখি বর্ণবাদী, মনুবাদী, পিতৃতান্ত্রিক ভারতীয় সমাজ ও সংস্কৃতির সুবিধাভোগ থেকে উঠে আসা ব্যাপার-স্যাপারকে শিকড়, মাটি, ভারতীয়ত্ব ইত্যাদি তকমা পরিয়ে ঘটানো হয়েছে তার উদযাপন; ধর্মীয় অনুষঙ্গই পরম্পরা; উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে যাওয়াই সার্থক কবিকৃতি। (Prosanto Halder)
‘ইহাই শিকড়’ দেগে দেওয়ার স্কুলে জানতে চাই, ব্রাহ্মণ্যবাদী বিভেদ যে সমাজের শিক্ষা, সংস্কৃতি, ভাষা চর্চার খুঁটি, সে সমাজে নারী ও দলিতের শিকড় কী, ‘পরম্পরা’ কী? এই প্রশ্ন থেকে জন্মাক আমার কাব্যতত্ত্ব।” (Prosanto Halder)
“প্রশান্তর অনেক কবিতার শেষে রয়েছে একটি ঘোষণা। কখনও সরব, কখনও মৃদু। এই ঘোষণাটি প্রশান্তর কবিতার সবচেয়ে জরুরি সম্পদ।”
এরপরই প্রশান্ত ঘোষণা করতে ভোলেন না, ‘আমার কবিতার প্রধান কাজ কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে দাঁড়ানো’। পাঠক, প্রশান্তর সবকটি কাব্যগ্রন্থ যদি পড়েন তাহলে দেখবেন এই সত্যি কথাটি কবিতা এবং জীবনে বারবার বলে চলেছেন প্রশান্ত। শুধু ব্রাহ্মণ্যবাদী অবস্থানের প্রতি ধিক্কার নয়, দলিত সত্তার চিৎকার নয়, যে-কোনও কর্তৃত্ববাদের বিরুদ্ধে, যেকোনও আধিপত্যের বিরুদ্ধে, প্রশান্ত সোচ্চার। এমনকি ভাষা ও শিল্পের আধিপত্যের প্রতিও তাঁর প্রশ্নচিহ্নটি জাগ্রত হয়ে আছে। আমরা একটি কবিতা তুলে দিয়ে দেখে নিতে চাই প্রশান্ত কী বলছেন: (Prosanto Halder)
ভায়োলেন্স ছাড়া জীবনের ওঠাপড়া দেখতে শিখিনি
রক্তপাতহীন কবিতার কথা কল্পনায় অচল
প্রতীকী চিত্রকল্পের দ্বারস্থ হতেই পারতাম আকাশকে ঢেকে দিয়ে গেল নতুন ভারত
পাখিটাও ভয়ে ভয়ে ঢুকলো খাঁচায়
আকাশের কাছে পাখি অলঙ্কার
পাখির কাছে আকাশ চলাচলের রাস্তা
মেলাতে পারি না
সোজা কথায়
তোমাদের সমস্ত ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো আমার কাজ
আর হ্যাঁ, এটাই কবিতা (Prosanto Halder)
যেকোনও শিল্প এবং শুদ্ধবাদী কর্তৃত্বের বিপক্ষে প্রশান্ত ঘোষণা করেন তাঁর অবস্থান। সমস্ত ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সরাসরি তিনি বলছেন- আর হ্যাঁ, এটাই কবিতা।
২৮ নম্বর এই কবিতাটি প্রশান্তর কবিতার কেন্দ্রীয় সুর। তীব্র এক ঘোষণা। যেকোনও শিল্প এবং শুদ্ধবাদী কর্তৃত্বের বিপক্ষে প্রশান্ত ঘোষণা করেন তাঁর অবস্থান। সমস্ত ধারণার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে সরাসরি তিনি বলছেন- আর হ্যাঁ, এটাই কবিতা। এই ধাক্কাটি পাঠক কতখানি হজম করবেন জানি না, কিন্তু এটুকু বলাই যায় আমাদের অজস্র মেনে নেওয়া, অজস্র স্থিতাবস্থার স্বপক্ষে অভিসন্ধি সাজানোকে প্রশান্ত চ্যালেঞ্জ ছুঁড়েছেন। এই জরুরি জমিটুকুই মুক্তাঞ্চলের ধারণা। বাংলা কবিতার পরম্পরার দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখতে পাব, কবিতার আধুনিক ধারণাটি মূলত সাংস্কৃতিক সুবিধাভোগের। অথচ বাংলা সাহিত্য শুরু হয়েছিল চর্যাপদের জীবন দিয়ে। আজ অজস্র লোকস্বরকে, অজস্র দ্রোহকে শিল্পের দোহাই দিয়ে বাতিল করে দেওয়া সে তো গোপন ব্রাহ্মণ্যবাদী অভিসার। (Prosanto Halder)

এই কবিতার শিল্প ও আধুনিকতা কোনওদিন খুঁজেই দেখল না, ড্রয়িংরুমের বাইরে কোনও ভাষা আছে। মানুষের কোনও চলাচল ও কৌম প্রকৃতি আছে। প্রশান্ত এই জরুরি প্রশ্নটি তুলেছেন কবিতায় ও জীবনে। মঞ্চ থেকে দূরে সরব নির্জন অন্ধকারে। (Prosanto Halder)
প্রশান্তর অনেক কবিতার শেষে রয়েছে একটি ঘোষণা। কখনও সরব, কখনও মৃদু। এই ঘোষণাটি প্রশান্তর কবিতার সবচেয়ে জরুরি সম্পদ। না, কোনও সস্তা চমক নয়, পাঠককে শেষপর্যন্ত একটি সুড়সুড়ি দিয়ে জনপ্রিয়তার সুবিধা আদায় করে নেওয়া নয়। এই ঘোষণাটি গোটা কবিতার জাতক। তাকে বিচ্ছিন্ন করে স্মরণীয় পংক্তি হিসেবে গড়ে তোলেননি প্রশান্ত। যে কবিতাটি আগে উদ্ধৃত হয়েছে সেই কবিতার শেষ লাইনটি এমনই একটি ঘোষণা, তীব্র এক থাপ্পড়। এবার দু’টি কবিতা তুলে ধরি। (Prosanto Halder)
১.
লিখছি। মুছে ফেলছি
ডেস্ক্রিপশান অফ মেথডোলজি
ভীষণ মেঘ মেঘ, বৃষ্টি বৃষ্টি, রোদ রোদ
ভালোবাসাকে কাবু করতে চেয়েছি
ক্রিয়াপদের উপস্থিতি সত্ত্বেও হজম করছি কর্তার অশ্লীল উল্লেখ
কবি যখন পাঠককে ধন্যবাদ দিচ্ছেন
ধরে রাখতে চাইছি সেই মুহূর্ত
আরো আরো যোগাযোগ শিল্পীকে চাকর করেছে লিখে অস্থিরতা কমলো, বিদায় নিচ্ছি (Prosanto Halder)
(৩২সংখ্যক)
২.
খুন হয়ে গেছি
লেখালিখি, থেকে থেকে চিৎকার-
এ শুধু স্মরণোৎসব
এই আমার ভিতর দুজনের একজন মৃত আরেকজন নেহাতই একক স্মরণসভা ডাকে
নিজেই নিজের সঙ্গে মদ খায়, গল্প করে, লেখে
যদি বলো এসবের মানে নেই, তো নেই
স্মৃতিসৌধে ছড়ানো ফুলও অপচয়
মানুষ অপচয় পছন্দ করেছে (Prosanto Halder)
(৩১সংখ্যক)
এই দুটি কবিতাতেই স্পষ্ট দুটি ঘোষণা দেখতে পাচ্ছি। এমনই আরও কয়েকটি কবিতা শেষ হচ্ছে তীব্র ঘোষণায়- ‘তোমাকে ছাড়ছি’, ‘তুমি নেই জেনে আরেকটু নেশা করছি, এই, এই আর কি’, ‘কত লিখে ফেললাম, বলো’, ‘সামনে আদালত। এর কোনো বিচার হবে না’, ‘জীবনের দোহাই দিয়ে মৃত্যুকে ছোট করা ঠিক নয়’ ইত্যাদি। এখানে তীব্র ঘোষণা যেমন আছে তেমনই রয়েছে নিয়তি হিসেবে সামান্য স্বীকারোক্তির ছলনা। এ সবই কবিতার, প্রশান্তর কবিতার, আবহমান সৌন্দর্য। এই আবহমানের ধারণাটি কৌম সমাজের সঙ্গে জড়িত। এই আবহমানের শিকড় কয়লা খাদানে নেমে গেছে। এই আবহমানের শিকড় বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ কেন্দ্রের পাশে দাঁড়িয়ে মাংস কিনেছে। এই শিকড়টি অনায়াসে দেখে ফেলেছে সমাজসেবকের মতো অবাধ্য হাত। সমাজসেবকের ছায়ায় ভরে উঠেছে ছোট ছোট কত না অন্ধকার, কত না অলিগলি, কত না চাওয়া পাওয়া। সুবিধার ছোট ছোট গোপন চুক্তি। মানুষ নিয়তির ছদ্মবেশে তাকে মেনে নিয়েছে। কিন্তু প্রশান্ত মানেননি। কবিতায় নয়, জীবনেও নয়। আর তাই তিনি জানেন মঞ্চ বা সম্বর্ধনা নয়, তার চেয়ে শববাহক গাড়ি, স্বর্গশকট তাঁর নিশ্চিন্ত আশ্রয় হতে পারে। (Prosanto Halder)

প্রশান্তর আরেকটি ভূমিকার দিকে এবার নজর দেব। কবি লিখছেন:
‘কোথাও পৌঁছতে পারি না। বিফলতার কাছে ফেরত আসার বাই বহু পুরাতন। লেখার পথে নিষ্ঠুর না হতে পারার ব্যথা লুকোবার নয়। চালু রাখছি কথাবার্তা।
আমার এ লেখা চিন্তার প্রদর্শনী। কোনো চিন্তাই স্থায়ী নয়, তারোপর আমার ভাঙন-প্রবণতা, মরে ওঠার শখ, মানুষের মাংস থেকে দূরে, লেখা ছাড়া, ছোট হোক বড় হোক, বাক্য জুড়ে যাওয়া ছাড়া নিস্তার মেলে না!’ (Prosanto Halder)
প্রশান্ত লেখার পথে নিষ্ঠুর হচ্ছেন না, তা নিশ্চিত এক দুর্বলতা, কিন্তু সেই দুর্বলতা বিষয় এবং চিন্তার ভাঙচুর বহাল রেখেই এক ধরণের কমিউনিকেশনের আপোষ। এটুকু মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই।
প্রশান্ত লেখার পথে নিষ্ঠুর হচ্ছেন না, তা নিশ্চিত এক দুর্বলতা, কিন্তু সেই দুর্বলতা বিষয় এবং চিন্তার ভাঙচুর বহাল রেখেই এক ধরণের কমিউনিকেশনের আপোষ। এটুকু মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। তাহলে অন্তত কবিতা, অস্ত্র হিসেবে তার ব্যবহার, সঙ্গত সুরে বাজবে না। প্রশান্ত এ কথা বলেছেন জীবনের দোহাই দিয়ে মৃত্যুকে ছোট করা ঠিক নয়। এর পাশাপাশি এই ভূমিকায় বললেন মরে ওঠার শখ। এ যেন বেঁচে ওঠার শখের বিপরীতে ক্রিয়াপদের এক উল্টো ধারণা। মরে ওঠা, মরে যাওয়া নয়। মরে যাওয়ায় আত্মসমর্পণ আছে। আর মরে ওঠায় আছে নিজের অস্তিত্বের তীব্র ঘোষণা এবং নিয়ন্ত্রণ। এই সমাজ ও সভ্যতার দিকে তাকিয়ে আমি যে জীবন বেছে নিয়েছি তা মৃত্যুর মতোই নিজেকে জরুরি করে তুলেছে।
আপনার মাল্টিস্টোরিডের বিপণনের দিকে তাকিয়ে নয়, তার উল্টোদিকের ফুটপাতে, ভাঙা ব্রিজে বসে আমি যে জীবন বেছে নিলাম স্বেচ্ছায়। তাই মরে ওঠা। তাই জীবনের সবচেয়ে জরুরি প্রতিরোধ। আর ঠিক সেই কারণেই প্রশান্তর কবিতায় লেখা হয়, তার নতুন কবিতা খুঁজে নেয় ‘ব্যর্থতার এলাহি আয়োজন’। পাঠক খেয়াল করুন ‘এলাহি’ শব্দটির ব্যবহার, যা একই সঙ্গে ধনাত্মক এবং ঋণাত্মক। যা একই সঙ্গে ব্যর্থতার উদযাপন এবং ব্যর্থতাকে উপেক্ষা। প্রশান্তর কবিতা বারবার বিফলতার কাছে ফিরে আসে। কিন্তু এই বিফলতাটি কোনওভাবেই হতাশার নয় বরং বেছে নেওয়া একজন একক স্থির মানুষের স্পর্ধিত নির্বাসন, প্রতিরোধ এবং স্বনির্বাচন। (Prosanto Halder)

প্রশান্ত বিরামহীন কথা বলতে পারেন। শৃঙ্খলাহীন হতে পারেন। এমনকি শব্দের আধিপত্য রেখাটিকে কষে লাথি মারতে পারেন। কিন্তু কবিতায় তিনি আশ্চর্য সংযত ও সংহত। তীব্রতার ক্ষেত্রে নয়। তাই সামান্য একটু বেশি বলে ফেললেই তাকে বলতে হয়, ঘোষণা করতে হয় ‘অল্প কথায় এর চে বেশি বলা সমীচীন হবে না’। এর চেয়ে বেশি প্রশান্ত বলতে চান। তাই এই কাব্যগ্রন্থে দুটি ভূমিকা আছে, যা অপ্রাসঙ্গিক এবং অপ্রয়োজনীয় নয়। একজন কবি শুধুমাত্র লিখিত জীবনেই কথা বলবেন কেন? প্রতিদিনের জীবনে যে অজস্র চিৎকার সে কথাটিও জরুরি তরুণ কবির জন্য। অথচ আজকের তরুণ কবি, জীবন যাপনে আশ্চর্য সংযত, সামান্যতম সুবিধা ছাড়তে চায় না, উঞ্ছবৃত্তি করতে তার আপত্তি নেই। তাই কবিতায় রোমান্টিক বিদ্রোহ। (Prosanto Halder)
যতটুকু বিদ্রোহ শিল্প সাপোর্ট করে, জনপ্রিয়তা দেয়। সেটুকু ছাড়া বাস্তবজীবনে সে রাগ করে না। পাছে মঞ্চ বেদখল হয়ে যায়। সরকারি ঘোষণা থেকে নাম বাদ যায়। প্রশান্ত এসবের তোয়াক্কা করেন না। তাঁর কবিতা এবং জীবন আয়নার মুখোমুখি দাঁড়াতে জানে। প্রশান্ত আমাদের সময়ের একজন বিশ্বাসযোগ্য কবি। যখন গোপন ছুরির জন্য কোনও বিশ্বাসই আর যোগ্য নেই। (Prosanto Halder)
প্রশান্ত কী আশ্চর্য, অসামান্য, অনিবার্য কবিতা লিখতে পারে তার দু’টি উদাহরণ দেব। দু’টি কবিতাতেই কাকতালীয় জবাফুলের প্রসঙ্গ আছে। জবা ফুল বলতে আমার মনে পড়ে সুব্রত চক্রবর্তী বা আলোক সরকারের কথা। আর হ্যাঁ আমাদের অনেকের বাড়িতেই, খেয়াল করে দেখেছি কাজের মেয়েটির নাম জবা। হয়তো আপনাদেরও এমন অভিজ্ঞতা আছে। কবির এই কবিতা দু’টি এমন এক গভীর পরিণামে পৌঁছচ্ছে যা কবিতার সামগ্রিক পরম্পরায় রীতিমতো দখল না থাকলে সম্ভব নয়। প্রশান্ত সমাজমাধ্যমে টুকরো টুকরো গদ্যে এমন কত না ইঙ্গিত দিয়ে চলেছেন। বুঝতে পারি তাঁর পড়াশোনার চরাচর বিস্ময়কর। এমনই দুটি বিস্ময়কর কবিতা এবার পড়ুন: (Prosanto Halder)
প্রশান্ত ‘ব্যাখ্যার নামে কবিতার চ্যারিটেবল কুচাকাওয়াজ’কে বাতিল করেছেন। তাই প্রশান্তর লেখাই তাঁর সম্পর্কে শেষ কথা।
১
কী অদ্ভুত হাওয়া
মেঘ-মেঘ, থম মারা গলি
যেন রাষ্ট্রনেতা একটু আগেই খুন হয়ে গেছে
যেন এ বছর লিচুর মরসুম শেষ, পাখিরা এ তল্লাট ছেড়ে
শত্রুদেশে আশ্রয় নিয়েছে
এ বছরের মতন গাছের শেষ আমটা ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে
অজানা এরোপ্লেন
বন্ধুমৃত্যু জারি…
এসব দৃশ্য এক দুপুরের নিখুঁত বর্ণনা হতে পারতো
যদি না বারান্দায় ফুটে উঠতো একটা নরম
জবাফুল (Prosanto Halder)
(১৪ সংখ্যক)
২.
জবাকে বলেছিলাম ফুটো না। শোনেনি সে। বাগান অন্ধকার করে ফুটে উঠেছিল। মানুষের পক্ষে ছিঁড়ে নেওয়ার ক্ষমতা ছাড়া বাকি সবই ছিল জয়, তাও হার মানাই যেন নিয়তি, আর ছেঁড়া জবাও বাগানের আলো ফিরিয়ে দিতে দিতে নেমে এলো পচা-গলা শবের চরিত্রে। মানুষ ভূমিকা বদলে নামেনি, জবাও। যে যার চরিত্রে ছিল; কেউ কারো প্রতীক না। জবার ব্যাপারে এই সামান্য কথা তোমাকে জানাই। আজকাল এপ্রিলে হাওয়া বইছে। পলাশ দেখতে আস্ত গেস্ট হাউস ভাড়া করে মানুষ প্রকৃতি ঠাপাচ্ছে। ভাল লাগছে আমার। আপনার চেনা-জানা গেলে বলবেন, কুসুম নিজের জন্য ফুটে নিজের কারণে ঝরে, মানুষ তার সাক্ষীমাত্র, রসিক, ধ্বংসপ্রিয়। রসিকের কাজই তো দুমড়ে-মুচড়ে দেখা। জবার কাজ আলোক সরকার থেকে প্রশান্ত হালদারের কাছে আসা নয়। তাও জবা এসেছিল, খুন হতে (Prosanto Halder)
(১৫ সংখ্যক)

এবার কোনও কারণ ছাড়াই প্রশান্তর দু’টি কবিতা আপনাদের পড়তে দিচ্ছি। সবসময় কথা বলতে হবে, আলোচনা করতে হবে, এমন দিব্যি কে দিয়েছে! বরং প্রশান্তর কবিতা পড়াটি আমার কথার চেয়ে জরুরি। কবিতা দু’টি দেওয়ার একটা বড় কারণ, এই লেখাটি পড়ে যদি কবির কবিতা সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহ তৈরি হয়। তবে বই পাওয়ার সুযোগ কম। আপনাকে বইমেলায় কোনও এক অনির্দিষ্ট, অনির্দেশ্য গোপন ডেরার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। ততদিনে হয়তো আপনার প্রশান্তর কবিতা নিয়ে কোনও স্মৃতি নেই। ইদানিং কলেজস্ট্রিটে প্রচুর আউটলেট হয়েছে, যাঁরা সম্মানের সঙ্গে ছোট পত্রিকা এবং ছোট প্রকাশনীর বই পাঠকের হাতে তুলে দেন। তবে সর্বত্রই চিত্র এমন নয়। বরং অনেক বিপ্লবী ছোট প্রকাশনীর দরদী মানুষেরা মুক্তাঞ্চলের বইগুলিকে অবিশ্বাস্য তৎপরতায় হাজার বইয়ের ভিড়ে এমনভাবে লুকিয়ে ফেলে আপনি তা খুঁজে পাবেন না। সরাসরি প্রত্যাখ্যাত হবেন। তাই ছোট প্রকাশনীর দরদী আউটলেটগুলিকে আর ভরসা হয় না। ছোট প্রকাশনীর ছোট বড় দালাল কিছু কম নেই বাজার সভ্যতায়। এখানেই না হয় পড়ুন… (Prosanto Halder)
কবিতা দু’টি দেওয়ার একটা বড় কারণ, এই লেখাটি পড়ে যদি কবির কবিতা সম্পর্কে আপনাদের আগ্রহ তৈরি হয়। তবে বই পাওয়ার সুযোগ কম। আপনাকে বইমেলায় কোনও এক অনির্দিষ্ট, অনির্দেশ্য গোপন ডেরার জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
১.
কাটা ছাগলের ভূমিকায় না নেমেও কত উপমায় তাকে ব্যবহার করেছি। সে-সব গিলে মদ-মাংস, সঙ্গমে গিয়েছ, কবি ও পাঠক; হত্যাদৃশ্য বরাবর হিট। তাও কাটা ছাগলের স্বাদ নিয়ে, সেদ্ধ হওয়ার গুণাবলী নিয়ে কত কত আলোচনা,
সে-সব বাতিল, লিখতে না পারার যন্ত্রণাটুকু থাক; তার বেশি বলাটাই অ-কবিতা, বিদ্যায়তনিক
খণ্ড সময়ের মদখোর আমি, ঐতিহ্যের মুখে মুতে যাওয়া লাম্পট্যের নতুন প্রতিভূ
এই কথা দিকে দিকে প্রচারিত হোক, এই সম্মান, এই নৌকোযাত্রা। (Prosanto Halder)
(১১সংখ্যক)
আরও পড়ুনঃ দেশভাগ আর কৈশোরক স্মৃতির আখ্যান
২.
ঠান্ডা, ফাঁকা ঘরে আমার নির্বাসন। যদি দেওয়াল, বন্ধ দরজা-জানলা বা ছাদকে সঙ্গী হিসেবে না ধরি, নিজেরই নানান সত্তাকে আলাদা আলাদা মানুষ কল্পনা না করি, তবে আজ নিঃসঙ্গ। অতএব এই বাতাস-অনুভববিহীনতা, এই একাকিত্বকে কি সমাজ বলে ধরে নেওয়া যায়? বেদনাহতরা বুঝবে চাঁদ শেষপর্যন্ত একটা প্রোজেকশান; মনখারাপ থাকে মনের ভিতর, সূর্যাস্ত দিয়ে তাকে নতুন ব্যঞ্জনা দেওয়া যায় না। হৃদয়ের দুঃস্থতাকে ঢাকা যায় না মেধার চাদরে। শরীর অসুখ মাত্র, আনন্দ দুই অসুখের ভাব-ভালোবাসা। (Prosanto Halder)
(২৭সংখ্যক)
এইসব বলা এবং না- বলা নিয়ে প্রশান্তর কবিতা। এবং তাঁর কবিতা বুঝতে দীক্ষিত পাঠক হতে হয় না বরং সৎ ও যোগ্য হয়ে উঠতে হয়। এরপর যা বলার প্রশান্তর কবিতাই বলবে। প্রশান্ত ‘ব্যাখ্যার নামে কবিতার চ্যারিটেবল কুচাকাওয়াজ’কে বাতিল করেছেন। তাই প্রশান্তর লেখাই তাঁর সম্পর্কে শেষ কথা। এর চেয়ে বেশি বলা বোধহয় সমীচীন হবে না। (Prosanto Halder)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বস্বত্ব সংরক্ষিত
চিত্র ঋণ- পঙ্কজ চক্রবর্তী
জন্ম ১৯৭৭। লেখা শুরু নব্বইয়ের দশকে। পঞ্চাশের বাংলা কবিতার আতিশয্যর বিরুদ্ধে এযাবৎ কিছু কথা বলেছেন। ভ্রমণে তীব্র অনীহা। কিংবদন্তি কবির বৈঠকখানা এড়িয়ে চলেন। এখনও পর্যন্ত প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ - বিষণ্ণ দূরের মাঠ চার ফর্মার সামান্য জীবন, উদাসীন পাঠকের ঘর, লালার বিগ্রহ, নিরক্ষর ছায়ার পেনসিল, নাবালক খিদের প্রতিভা। গদ্যের বই- নিজের ছায়ার দিকে, মধ্যম পুরুষের ঠোঁট। মঞ্চ সফলতা কিংবা নির্জন সাধনাকে সন্দেহ করার মতো নাবালক আজও।