(Ratha Yatra Recipe) আষাঢ়ের মেঘ ছায়া ফেলে যাচ্ছে অহরহ। ওই চষা মাটির গন্ধে মেঘের ভেজা হাওয়া মিশে যাচ্ছে সাতসকালেই। এমন একেকটা শান্ত সকালে বসে বসে কেবল বৃষ্টির অপেক্ষা। এই বৃষ্টি ধুয়ে দেবে রুক্ষতার পলি। পৃথিবীর ভিতরে ভিতরে যে ঋতুমতী মেয়েটি বার বার জন্মের আদি কথাটিকে মনে করিয়ে দিতে চায়, এই আষাঢ়ের সকাল যেন সেই মেয়েটির মতো।

আমাদের ফেলে আসা দেশকাল আষাঢ়ের পৃথিবীকে ভালোবেসেছিল। অম্বুবাচীর মধ্যে মেয়েলি নিয়ম জুড়ে দিয়ে যাঁরা কেবলই দেব মাহাত্ম্য খুঁজতে চান, আমার মনে হয় তাঁরা বুঝিবা এই পৃথিবী আর মানুষের আদি লীলাসূত্রটি বিস্মৃত হয়েছেন ক্রমে। কৃষিজীবী ভারতবর্ষের ভিতরে প্রকৃতিকে নিবিড় করে দেখার যে অভ্যাসটি ছিল, তাকে কি আমরা ভুলে যাব! যাঁরা দিনক্ষণ পঞ্জিকার খোঁজ রাখেন, তাঁরা জানেন। পণ্ডিতেরা মনে করেন, আজকের যে কোজাগরী লক্ষ্মীপুজোর সময়, বহু বহু বছর আগে সেই ছিল আম্বুবাচীর সময়। কৃষিজীবনের ছাপ দিয়ে দিয়ে বছর আর তারিখের হিসেব ভারী পুরানো সমাচার। আর সেইসব যাপনে জুড়ে ছিল খাদ্যাভ্যাসের নানা অনুষঙ্গ। (Ratha Yatra Recipe)
আরও পড়ুন: বনজ কুসুম: পর্ব – [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩]
উড়িষ্যার রজো পোড়া পিঠে’র নামেই জুড়ে আছে তার আদিকল্প। চাল দিয়ে এমন পিঠে আমাদের দেশজ সত্তায় কমে এসেছে। তবুও উড়িষ্যায় অম্বুবাচীর সময় (যার সময় বাংলার ক্যালেন্ডারের চেয়ে পৃথক) এই পিঠে বানান। বাড়ি বাড়ি বিলি করেন। প্রাচীন কৌমের কিছু কিছু লক্ষণ এভাবেই রয়ে যায় কোথাও কোথাও। তিন চার দিন থাকবে এমন রান্নাই তো করতে হবে! পোড়াপিঠার চেয়ে সুন্দর পেট ভরা খাবার আর কী হতে পারে! দেশজ ড্রাই-ফুডের গল্পে এদেরও কিছু ভূমিকা ছিল আসলে। মানুষের সেই বোধ, সেই স্নেহ ছাপ ফেলে যায় তার আধ্যাত্মিক অভ্যাসেও। (Ratha Yatra Recipe)
গুণ্ডিচা থেকে জগন্নাথ যখন ফিরে আসেন, তখন সেই উল্টোরথের দিনে মাঝপথে একটু জলপানের বিরতি নেওয়া হয়। সেই বিরতির সময়ে জগন্নাথ দেবকে খেতে দেওয়া হয় পোড়া পিঠে। এ যেন ঠিক আমাদের যাত্রাপথেও শুকনো খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ারই গল্প।
আষাঢ়ের রথের দিনে সেসব না হয় একবার ফিরে দেখা যেতে পারে। পঞ্চরসের আধারে দেবতা তো কবেই আমাদের ঘরের লোক হয়ে উঠেছেন। রথের চাকায় যে জীবনের ধ্বনি চক্রাকারে ফিরে ফিরে আসছে, তার মধ্যে গার্হস্থ্য সুখ দুঃখও কি এই! সেসব গল্প হয়ে রয়ে যায় মানুষেরই সঙ্গে। সেই কবে নাকি রামকে গৃহত্যাগ করানোর জন্য, ভরত খুবই কটূক্তি করেছিলেন তাঁর মাকে। কৈকেয়ী সেকথায় কেঁদে ফেলেছিলেন। রাম কিন্তু কৈকেয়ীকে আশ্বস্ত করেছিলেন এই বলে যে, আমি তোমার হাতের পোড়া পিঠে খেতে ফিরে আসবো আবার। কথাটা সামান্য, কিন্তু গার্হস্থ্য স্নেহ তো এমনই। (Ratha Yatra Recipe)

সেকথার সূত্র ধরেই গুণ্ডিচা থেকে জগন্নাথ যখন ফিরে আসেন, তখন সেই উল্টোরথের দিনে মাঝপথে একটু জলপানের বিরতি নেওয়া হয়। সেই বিরতির সময়ে জগন্নাথ দেবকে খেতে দেওয়া হয় পোড়া পিঠে। এ যেন ঠিক আমাদের যাত্রাপথেও শুকনো খাবার নিয়ে বেরিয়ে পড়ারই গল্প। জগন্নাথের প্রিয় পিঠেগুলির মধ্যে এটি অন্যতম বলে যাঁরা মনে করেছিলেন, তাঁরা জানতেন ঘরোয়া খাবারের স্বাদই আলাদা। মামা-মাসিদের আদরের ধরণই আলাদা। এই বাৎসল্য রসের আরাধনা কী সুন্দর! (Ratha Yatra Recipe)

দেশকালের রান্নাঘর কতকিছুকেই তো প্রসাদ করে তুলেছে! দেবতার ভোগের স্পর্শে সেসব হয়ে উঠেছে বিশেষ। এই যেমন নাদি বড়ি। আমাদের দেশজ বড়ির ইতিহাসে যাকে খুব বিশেষ বলে মনে হয় বরাবরই। যার গড়ন, স্বাদ এবং ব্যবহার অন্যান্য বড়ির মতো নয়। জগন্নাথ দেবের ভোগের ডালমায় এবং ব্যঞ্জনে এই বিশেষ বড়ির ব্যবহার দেখেছি আমরা। দেশজ খাবারের যে সংরক্ষণের ইতিহাস, নাদি বড়ি তার অন্যতম তো বটেই, কিন্তু তার চেয়েও বেশি মুগ্ধ হই লোকজ রান্নার স্পর্শগুলি কী আশ্চর্য ভাবে রয়ে গেছে আদিম দেবালয়ের রান্নাঘরে। যে রান্নাঘর আলু, লঙ্কা, বিট বা কাজুবাদাম পূর্ব এক ভিন্নতর দেশজ রান্নার স্মারক হয়ে টিকে আছে আজও। (Ratha Yatra Recipe)

রথের অনুষঙ্গে ফিরে ফিরে আসা ভোগ আর রান্নার গল্পে মেয়েলি স্পর্শ খানিক কম। মন্দিরের পাচকরাও তো মহিল নন! কিন্তু এই পোড়া পিঠে আর নাদি বড়ির গল্পে মা-মাসিদের কথা জুড়ে আছে বিনি সুতোর মালাটির মতো। আষাঢ় দিনের কৃষ্ণকথায় এইটুকু মাতৃসত্তা জুড়ে থাকুক না হয়। রথচক্রের ঘূর্ণনে কত কিছুই তো মুছে যায়, বদলে যায়! কিন্তু স্নেহ কি বিষম বস্তু! জলখবারের বিরতি অবিচল থাকে আজও। ভাতে, ডালে, মিষ্টি আর ব্যঞ্জনে পেট ভরে খাওয়ানোর তৃপ্তি কি কম! রান্নাঘরকে এমন করে গুরুত্বপূর্ণ করে তোলার চেষ্টা, সে ভারী সুন্দর। সেসব দেখে দেখে একথা ভেবেছি কখনও বা –’আর পাবো কোথা, দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়রে দেবতা’। (Ratha Yatra Recipe)
পোড়া পিঠে
উপকরণ : আতপ চাল ১ কাপ, বিউলির ডাল ১/২ কাপ, নারকেল – অর্ধেক কুরানো, অর্ধেক পাতলা পাতলা করে কেটে নেওয়া, গুড় ৩/৪ কাপ বা স্বাদমতো, টাটকা গুঁড়ো করা গোলমরিচ ১/২ কাপ, অল্প কুরানো আদা, এক মুঠো কিশমিশ, দু-তিনটে ছোট এলাচের গুঁড়ো, ঘি – দুই/আড়াই টেবিল চামচ। কাজুবাদাম চাইলে দিতে পারেন। সাধারণত পুরীর মন্দিরের ভোগে কাজুবাদাম ব্যবহার করা হয় না। (Ratha Yatra Recipe)
পদ্ধতি: আগের দিন চাল ও ডাল আলাদা আলাদা করে ৪-৫ ঘণ্টা ভিজিয়ে রাখুন। ভিজে গেলে আলাদা আলাদা করে খুব ভালোভাবে বেটে নিন। বাটা চাল-ডাল ভালো করে মিশিয়ে নিন এবং মিশ্রণটি ৮ থেকে ১০ ঘণ্টার জন্য ফার্মেণ্ট হতে দিন। কড়াইতে গুড় এবং কোরানো নারকেল পাক দিয়ে নরম করে নিন। নারকেলের পাক, দুই চামচ ঘি, গোলমরিচ, এলাচের গুঁড়ো, আদা সব কিছু এবারে চাল-ডাল বাটার মিশ্রণে মিশিয়ে মেখে নিন। (Ratha Yatra Recipe)

বেকিং ট্রে-তে অল্প ঘি মাখিয়ে কলাপাতা বিছিয়ে নিন। বাটার পেপারও দিতে পারেন। এবারে সমস্ত মিশ্রণটি ঢেলে, উপরে নারকেল বা কিশমিশ ছড়িয়ে দিন। ৪৫-৫০ মিনিটের মতো ১৭০ ডিগ্রিতে বেক করুন। কড়াইতে বালি দিয়েও বেক করতে পারেন। হয়ে গেলে একবার কাঠি ফুটিয়ে দেখে নেবেন। পুরোপুরি ঠান্ডা হলে পরিবেশন করুন পোড়া পিঠে। আগেকার দিনে শালপাতায় মুড়ে ঘুঁটের আঁচে অনেক সময় ধরে এই পিঠে বানানোর চল ছিল। ঘণ্ট বা ডালমার সাথেও এই পিঠে খাওয়ার প্রচলন আছে। (Ratha Yatra Recipe)
নাদি বড়ি ডালমা
উপকরণ : অড়হর ডাল, কুমড়ো, পটল, কাঁকরোল, ওল, পটল প্রভৃতি, নাদি বড়ি এক মুঠো, গোলমরিচের গুঁড়ো, আদা বাটা, ঘি, গুড়, নুন, নারকেল কোরা, গোটা জিরে, কালো সরিষা, হিং, শুকনো লঙ্কা।

পদ্ধতি: অড়হর ডাল ভালো করে ধুয়ে ভিজিয়ে রাখুন। সবজি গুলো ডুমো ডুমো করে কেটে ডালের মধ্যে দিয়ে সেদ্ধ হতে দিন। সামান্য নুন আর হলুদ দিন। ডাল ও সবজি ভালো মতো সেদ্ধ হয়ে গেলে গোল মরিচের গুঁড়ো, গুড়, আদা এবং নারকেল কোরা দিন। নাদি বড়িগুলি লঙ্কা ভেজে দিয়ে দিন। সব ভালো মতো মিশে গেলে আগে থেকে তৈরি করে রাখা ভাজা মশলা (শুকনো লঙ্কা আর জিরে শুকনো খোলায় ভেজে গুঁড়ো করে রাখা) ছড়িয়ে দিন। আলাদা একটি পাত্রে ঘি দিন। গরম হলে জিরে, শুকনো লঙ্কা, কালো সরিষা ও হিং ফোড়ন দিন। সুগন্ধে ঘর ভরে গেলে বুঝতে পারবেন, নিরামিষ উপাদেয় এই ডালমা প্রস্তুত হয়ে গেছে। (Ratha Yatra Recipe)
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons, Wikimedia Commons, Facebook
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।