সময়টা দুর্গাপুজোর ঠিক পরের, কোনও একদিন সকালে টালিগঞ্জের নানুবাবুর বাজার থেকে বাজার করে ফিরছেন এক প্রৌঢ়। সামনের রাস্তা দিয়ে চলেছে একটি বড় গাড়ি, গাড়ির ভিতরে বসা ভদ্রলোক প্রৌঢ় মানুষটিকে দেখে গাড়ি থেকে নেমে রাস্তার মধ্যেই বিজয়ার প্রণামটি সেরে নিলেন। ইতিমধ্যে রাস্তায় লোক জমে গেছে এই দৃশ্য দেখে, তাদের পাড়ার আপাত সাধারণ-দর্শন মানুষটির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করছেন সুপারস্টার মিঠুন চক্রবর্তী, আর সেই আপাত সাধারণ-দর্শন মানুষটি কে? তাঁর হাত ধরেই মিঠুন চক্রবর্তী, রবি ঘোষ, জয়া ভাদুড়ী, দেবশ্রী রায়ের মতো বহু বহু শিল্পীর সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের হাতেখড়ি। মানুষটি হলেন পরিচালক অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় (Arabinda Mukhopadhyay), যাঁর হাত থেকে বাঙালি পেয়েছে ‘আহ্বান’, ‘নিশিপদ্ম’, ‘মৌচাক’, ‘অগ্নিশ্বর’, ‘ধন্যি মেয়ে’র মতো অজস্র কালজয়ী সিনেমা।
ব্র্যাডলি কুপারের ‘মায়েস্ত্রো’ – আত্ম-সমীক্ষা ও আত্মা-সমীক্ষার গল্প : অনির্বাণ ভট্টাচার্য
এক বিচিত্র জীবনের অধিকারী এই পরিচালক, জন্ম ১৯১৯ সালের ১৮ জুন, শৈশব কেটেছে বিহারের কাটিহার জেলার মণিহারি গ্রামে। সত্যচরণ মুখোপাধ্যায়ের কনিষ্ঠ পুত্র, বড়ভাই বাংলা সাহিত্যের প্রবাদপ্রতিম লেখক বনফুল অর্থাৎ বলাইচাঁদ মুখোপাধ্যায়। ম্যাট্রিক পরীক্ষা পাশ করার পর অরবিন্দ চলে আসেন শান্তিনিকেতনে, রবীন্দ্রনাথ ছাড়াও ক্ষিতিমোহন সেন, শৈলজানন্দ মজুমদার, রামকিঙ্কর বেইজ, নন্দলাল বসু প্রমুখের সংস্পর্শে আসেন, সহপাঠী ছিলেন সত্যজিৎ রায়। পরবর্তী সময়ে অরবিন্দ মেডিকেল পড়তে আসেন, তবে মাঝপথে ইস্তফা দিয়ে যুক্ত হন বীরেন সরকারের নিউ থিয়েটার্স’এর সঙ্গে, সহকারী পরিচালক ও পার্শ্বচরিত্র অভিনেতা হিসাবে। ১৯৫৯ এ প্রথম ছবি ‘কিছুক্ষণ’ রাষ্ট্রপতি পুরস্কারের জন্য নির্বাচিত, ১৯৬১ সালে দ্বিতীয় ছবি ‘আহ্বান’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে আমন্ত্রণ পায়। এরপরে আর কাজের ক্ষেত্রে ফিরে তাকাতে হয়নি অরবিন্দবাবুকে। তবে তাঁর জীবনে সচ্ছলতা এসেছিল এমনটা বলা যায় না, জীবনের একটা বৃহৎ সময় কেটেছে নিম্নমধ্যবিত্ত অবস্থায়। দর্শনগতভাবে তিনি কেবল শিক্ষিতদের জন্য ছবি বানাননি, কেবল পুরস্কারের জন্য ছবি বানাননি, তিনি এমন ছবি বানিয়েছেন যা আজও মানুষ সমান উৎসাহে বসে দেখে, দেখছে। অরবিন্দবাবু একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, বীরেন সরকার তাঁকে একটি পরামর্শ দেন, ‘ছবি করবে সুরসিক ভদ্রলোকেদের জন্য। তাঁরা যাতে ছবি দেখে তৃপ্ত হন। এবং সেই ছবি দেখে যাতে ছোটলোকেরাও ভদ্রলোক হয়ে হল থেকে বেরিয়ে আসে।’ এই পরামর্শ মেনেই অরবিন্দবাবু ছবি করে গেছেন আজীবন, মোট ছবির সংখ্যা ২৬, তিনটি টেলিফিল্ম, একটি ধারাবাহিক।
অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়, অর্থাৎ সিনেমাপাড়ার ‘ঢুলুবাবু’ ঠিক কতটা সাধারণ জীবন কাটাতেন তার একটি উদাহরণ দেওয়া যাক, ‘মৌচাক’ ছবিটি নিয়ে একটি মিটিং হবে প্রযোজক জং বাহাদুর রানার, লেখক সমরেশ বসু এবং পরিচালক অরবিন্দবাবুর মধ্যে। বাকি দুজন আগে থেকে উপস্থিত থাকলেও, অরবিন্দ বাবুর মিটিং-এ পৌঁছাতে বেশ খানিকটা দেরি হয়। প্রযোজক যখন প্রশ্ন করেন, রাস্তায় গাড়ি খারাপ হয়ে গিয়েছিল কী না, তখন অরবিন্দবাবু জানান তাঁর গাড়ি নেই, বাড়িও করে উঠতে পারেননি ততদিনে। এই কথা শুনে প্রযোজক পরামর্শ দেন ছবিতে বড় ভাইয়ের রোলটা উত্তমবাবুকে রাজি করানোর এবং ছবিতে অরবিন্দবাবুর নিজের শেয়ার রাখার। শেষপর্যন্ত তাই হয়, ছবি সুপারহিট, ছবির টাকায় অরবিন্দবাবুর নিজের বাড়ি হয়।

লেখাটি এর পরবর্তী পর্যায়ে দু’রকম ভাবে সাজানো যায়, প্রথমটি হল তথ্যবহুল জীবনধর্মী লেখা। দ্বিতীয়টি হল বিভিন্ন সিনেমা সংক্রান্ত ও উত্তম কুমার, রাজেশ খান্না, গৌরী প্রসন্ন মজুমদার, নচিকেতা ঘোষ, বিধানচন্দ্র রায় প্রমুখ বিশাল বিশাল ব্যক্তিদের নিয়ে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় সম্পর্কিত গল্পধর্মী লেখা, তবে আমি এই দুটির কোনও পথই বেছে নিতে চাইছি না। আমি একটি তৃতীয় বিষয়ে কথা বলতে চাই, সেটি হল মেনস্ট্রিম সিনেমা ও সেই ধারায় অরবিন্দ মুখোপাধ্যায়।
যেসকল পরিচালকদের তৈরি সিনেমাকে দেখে মধ্যবিত্ত বাঙালি সিনেমাকে ‘বই’ বলতে শিখেছিল, তার মধ্যে অন্যতম একজন অরবিন্দবাবু। চিদানন্দ দাশগুপ্ত যতই বলুন ‘বই নয় ছবি’ লিখুন, দর্শককে অতটা বোকা ভাবার কোনও কারণ নেই। আজ যখন ওথেলো বা বল্লভপুরের রূপকথা থেকে সিনেমা বা ওয়েব সিরিজ তৈরি হয়, তখন এগুলোকে যদি স্মার্ট বলা যায়, অরবিন্দবাবুর সময়ের সিনেমাগুলি সময়ের নিরিখে আরও বেশি স্মার্ট, এ-বিষয়ে সন্দেহ নেই। অরবিন্দবাবু, দাদা বনফুল, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, সমরেশ বসু প্রমুখের গল্প নিয়ে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে ছবি বানিয়েছেন এবং সেগুলি মেনস্ট্রিম ছবি। এখন প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়, বাঙালি মেনস্ট্রিম সিনেমা কেমন ছিল, বস্তাপচা বড়ো-মোজো-ছোটো বউয়ের গল্প বা দক্ষিণের মারকাটারি রিমেকের বা গোয়েন্দাদের ঘনঘটার আগে বাংলা মেনস্ট্রিম কিন্তু একটি পোক্ত স্তম্ভ ছিল। সেইক্ষেত্রে অনেক নামের মধ্যে অরবিন্দ মুখোপাধ্যায় এক প্রধান নাম। যদি লক্ষ্য করেন তাঁর সিনেমার বিষয় বৈচিত্র্য, তাহলে সেখানে ‘নকল সোনা’র মতো চলচ্চিত্র আছে, যে সিনেমার বিষয় সিনেমায় এক্সট্রাদের জীবন। এই সিনেমার কাহিনি ও পরিচালনা দুইই তাঁর। বাংলা সিনেমায় প্রথম ক্যামিও’র কনসেপ্ট হয়তো এই সিনেমাতেই। এবার যদি ‘অগ্নিশ্বর’এর দিকে তাকানো যায়, তার বিষয়ে সমাজ ও ডাক্তারের দ্বন্দ্ব, ‘ধন্যি মেয়ে’র বিষয় ফুটবল ও প্রেম, এইরকম ভার্সিটাইল পরিচালককে বাঙালি সারাজীবনই ‘টেকেন ফর গ্র্যান্টেড’ করে রেখে দিল। বাঙালি যদি কেবল পুরস্কার নিয়ে মাথা ঘামায়, তাহলে সেদিক দিয়ে অরবিন্দবাবুকে অবহেলা করা যায় না, তাঁর সিনেমা কানে আমন্ত্রিত, পেয়েছেন ফিল্মফেয়ার পুরস্কারও, আবার মেনস্ট্রিম বলেই যে তাঁকে ফেলে দেওয়া যায় না, সেই বিষয়টিও এতক্ষণ আলোচনা করা হল। তাহলে কোন জাদুতে সত্যজিৎ-মৃণাল-ঋত্বিক-তপন-তরুণদের ভিড়ে একেবারে হারিয়েই গেল নামটা, এটি খোঁজার জন্য হয়তো নতুন কোনও মেনস্ট্রিম গোয়েন্দাকেই ডাকতে হবে আমাদের।
সিনেমা-পুস্তিকাতেও অনন্য সত্যজিৎ : দেবাশিস মুখোপাধ্যায় (দে.মু)
“Impossible is a word to be found only in the dictionary of fools.” কথাটি নেপোলিয়নের, তবে ‘অগ্নিশ্বর’এ কথাটি অরবিন্দ বলিয়েছিলেন উত্তমকুমারের মুখ দিয়ে, হয়তো জান-প্রাণ দিয়ে বিশ্বাস করতেন নিজে, তাই ডাক্তারি ছেড়ে, জীবনের নিশ্চয়তা ছেড়ে চলে এসেছিলেন সিনেমা বানাতে। আর হ্যাঁ, তিনি আর একটি বিষয়েও বাঙালিকে শিখিয়ে গেছেন, জীবনে পেনাল্টি এলেও, বলটা বাইরে মারতে হয়, পেনাল্টিতে গোল করতে নেই, জেন্টালম্যানরা পেনাল্টিতে গোল করে না।

রাজর্ষি ধাড়া
রাজর্ষি ধাড়া। প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর। অ-মৃত লিটল ম্যাগাজ়িনের সম্পাদক। শখ ছবি আঁকা এবং থিয়েটার।