স্বাধীনতার সূর্য ভারতে উদিত হয়ে, কেটে গেছে বেশ কয়েক বছর। প্রসবউত্তর যন্ত্রণায় দীর্ণ হচ্ছে দেশ। দেশভাগ, অসংখ্য ভগ্ন জীবন, তারই সঙ্গে চারিদিকে অন্ন, বাসস্থান ও স্বাস্থ্যের হাহাকার।
স্বাধীনতার কয়েক দশক আগে থেকেই বিজ্ঞান সরস্বতীকে গবেষণাগার থেকে মুক্ত করে মানুষের উন্নতির বরাভয় প্রদানে ব্রতী হন দেশের তথা বাংলার বিজ্ঞানীরা। এ বিষয়ে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য প্রণম্য আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত বেঙ্গল কেমিক্যালের প্রচেষ্টা ও অবদানের কথা। স্বাধীনতাপূর্ব যুগে সম্পূর্ণ দেশিয় পদ্ধতিতে প্রস্তুত জীবনদায়ী ওষুধ, স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রার জন্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য যেমন ফিনাইল, ন্যাপথলিন ইত্যাদি সাধারণ মানুষের সাধ্যের মধ্যে যেন থাকে, তার জন্য প্রাণপাত করেছিলেন আচার্য ও তাঁর ছাত্রছাত্রীরা। মনে রাখা ভালো, আজ থেকে প্রায় একশো বছর আগের সে সময়। অতিসম্প্রতি যে অতিমারীতে ক্ষতবিক্ষত, ধ্বস্ত হয়েছি আমরা– প্রায় তেমনই কিছু মহামারীর প্রকোপে সেসময় উজাড় হয়ে যেত গ্রাম, শহর, পরিবার ও মানুষ। তাই ম্যালেরিয়া, কলেরার মতো অসুখের ওষুধ, তার সংক্রমণ রোধ করার জন্য প্রয়োজনীয় জীবাণুনাশ ছিল সেই যুগের স্বাস্থ্যব্যবস্থার প্রাথমিক লক্ষ্য।
কুইনাইনের আবিষ্কার ও বিতরণ, ফিনাইলের ব্যবহার আশার রুপোলি রেখা দেখাল এই ধরনের সংক্রামক মহামারীর পৃথিবীতে।

কিন্তু যেসব অসুখ সংক্রামক নয়, হয়ত মহামারীও নয়, কিন্তু তার চিকিৎসা হয় অমিল অথবা সাধারণের আয়ত্তের বাইরে?
স্বাধীনতা-উত্তর ভারতে এমনই এক অসুখ এপিলেপ্সি, যা সাধারণের কাছে মিরগি বা মৃগী। এই অসুখের নাম শুনলে আজ হয়ত ভীত হয় না কেউ, শুধুমাত্র চিন্তিত হয়। কিন্তু একটা সময় ছিল যখন কোনও শিশুর মৃগীর উপসর্গ দেখা দিলে সঠিক চিকিৎসার পথ ছিল রুদ্ধ, নানান অবৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন ছাড়া উপায় ছিল না। অসুখ সারাতে তুকতাক, জলপড়া এমনকি ওঝা অবধি ডাকা হত।
সাধারণ মানুষকে এই অসুখের অভিশাপ থেকে মুক্তি দেন যিনি, তিনি স্বয়ং বিজ্ঞান সরস্বতীর প্রতিরূপ, তাঁর বরপুত্রী, বাংলার বিজ্ঞান সাধনার ইতিহাসে যার নাম লেখা আছে সোনার অক্ষরে– ডঃ অসীমা চট্টোপাধ্যায়।
জন্ম ১৯১৭ সালে। বাবা ইন্দ্রনারায়ণ মুখোপাধ্যায় ছিলেন বিজ্ঞানসাধক। সম্ভবত তাঁর থেকেই বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণের সূত্রপাত। ছাত্রীজীবনের শুরু থেকেই রসায়নবিদ্যা অধ্যয়নের ইচ্ছা। বেথুন স্কুল থেকে পাশ করার পরে ১৯৩৬ সালে স্কটিশ চার্চ কলেজে কেমিস্ট্রি অনার্স নিয়ে সেই স্বপ্নের পথচলা শুরু। তবে, সেই সময় বিজ্ঞানে স্নাতকস্তরে পঠনপাঠনের সুযোগ পাওয়া কোনও ছাত্রীর পক্ষে সহজ ছিল না। উপযুক্ত নম্বর থাকা সত্ত্বেও টানা দুবছর অপেক্ষা করতে হয় অসীমাকে, তবুও রসায়নবিদ্যা অধ্যয়নের পাখির চোখ থেকে সরে আসেননি অসীমা।
১৯৩৮ সালে সফল ও সার্থকভাবে রসায়নবিদ্যার স্নাতক হন অসীমা, তারপর ১৯৪০ সালে স্নাতকোত্তর। ১৯৪৪ সালে লিখিত হয় এক নতুন ইতিহাস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম রসায়নের মহিলা ডক্টরেট ডিগ্রির অধিকারী হন অসীমা চট্টোপাধ্যায়– যার পোশাকি নাম তখন ছিল ‘ডক্টর অফ সায়েন্স’ বা ডিএসসি।

অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের আগেও ছিলেন আরেক বাঙালি ছাত্রী, যিনি ছুঁয়ে ফেলেন বিজ্ঞানচর্চার এক সোপান। তাঁর নাম বিভা চৌধুরী। পরবর্তীকালে এই বিভা চৌধুরীই কাজ করবেন হোমি ভাবা, বিক্রম সারাভাইয়ের সঙ্গে– আবিষ্কার করবেন এক বিরল অনুমৌল পইমেসোন।
অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের আগে, ১৯৩৮ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রথম বিজ্ঞান স্নাতকোত্তর উত্তীর্ণা বিভা চৌধুরী। সেই বিজ্ঞানমনস্ক বাঙালি কন্যার ইতিহাস এক অন্য ইতিহাস। আপাতত তোলা থাক সেই ইতিহাস কথন– আমরা ফিরি অসীমা চট্টোপাধ্যায়ের রসায়ন জীবনের উজ্জ্বল অধ্যায়ে
আরও পড়ুন: ভারতের প্রথম আধুনিক মহিলা চিকিৎসক আনন্দী যোশি
১৯৪৪ সালে, তৎকালীন লেডি ব্রেবোর্ন কলেজে রসায়নবিদ্যার অধ্যাপিকা হয়ে যোগ দেন অসীমা। মহিলা মহাবিদ্যালয়ে স্নাতকস্তরে বিজ্ঞানচর্চার জন্য নিরলস চেষ্টা শুরু করেন অসীমা। ছাত্রীজীবনের শুরুতে বিজ্ঞানচর্চার ক্ষেত্রে যে বাধা পেয়েছিলেন, সেই অভিজ্ঞতা তাঁকে চালিত করেছিল অন্য মেয়েদের বিজ্ঞানচর্চার পথ সুগম করার দিকে। ব্রেবোর্নে রসায়নবিদ্যা বিভাগের কাজের পাশাপাশি একই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার কাজও শুরু করেন অসীমা। তাঁর কাজের সুখ্যাতি ছড়াতে দেরি হয়নি। ডাক আসে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। গবেষণার কাজে বিদেশ পাড়ি দেন অসীমা। প্রথমে ইউনিভার্সিটি অফ উইস্কনসিন এবং তারপর ক্যালিফোর্নিয়ার বিখ্যাত ক্যালটেক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পোস্ট ডক্টরেট ডিগ্রি অর্জন করেন। তাঁর প্রাথমিক গবেষণার কাজই ছিল উদ্ভিজ্জ রসায়নিক পদার্থ থেকে ওষধির উদ্ভাবনা। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকাকালীন সুযোগ পান নোবেলজয়ী বিজ্ঞানী লাসলো জ্যাক্মাইন্সটারের সঙ্গে কাজ করার। গবেষক অসীমা, বিজ্ঞানী অসীমা এগিয়ে চললেন নতুন থেকে নতুনতর জ্ঞানপীঠে।

দেশে ফিরে যোগদান করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের প্রথম মহিলা অধ্যাপিকার পালকও যুক্ত হয় অসীমার মুকুটে। কিন্তু বিজ্ঞান-সরস্বতী যে গবাষণাগারে বন্দি থাকার জন্য আসেননি। তাই আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের অনুপ্রেরণায় শুরু হয় এপিলেপসি বা মৃগী রোগের ওষুধের খোঁজ।
কিন্তু অর্থ কোথায়? গবেষণার জন্য যে প্রচুর টাকা প্রয়োজন। বেঙ্গল কেমিক্যালের আরও অনেক জনদরদি বিজ্ঞানীর মতোই, সম্পূর্ণ নিজের অর্থব্যয়ে গবেষণা শুরু করেন অসীমা।
১৯৬১ সালে তৈরি হয় সেই যুগান্তকারী ওষুধ, মারসিলা মিনাটা উদ্ভিজ্জের রসায়ন থেকে। নাম রাখা হয় আয়ুষ ৫৬– এক অমূল্য আবিষ্কার।
১৯৬১ সালেই এই কাজের জন্য প্রথম মহিলা হিসেবে শান্তিস্বরূপ ভটনাগর পুরস্কার পান অসীমা চট্টোপাধ্যায়। ১৯৬২-১৯৮২ এই কুড়ি বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে খৈরা চেয়ার অফ কেমিস্ট্রির পদ অর্জন করেন তিনি। ১৯৭৫ এ প্রথম মহিলা হিসেবে ভারতীয় সায়েন্স কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন। পান পদ্মভূষণ পুরস্কারও। ১৯৮২ সালে রাজ্যসভার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত সাংসদ হন। আরও অনেক পুরস্কার, উপাধিতে সম্মানিত হন ডঃ অসীমা চট্টোপাধ্যায় তাঁর দীর্ঘ কর্মজীবনে।
২০০৬ সালে এই নিরলস কর্মকাণ্ডের শেষে চিরশান্তি, বিরামের দেশে যাত্রা করেন ডঃ অসীমা চট্টোপাধ্যায়।
সত্যিই কি শেষ হয়ে যায় এই কর্মযজ্ঞ? বিজ্ঞানকে মানুষের পাশে দাঁড় করানোর প্রচেষ্টা? মেয়েরা অংক পারে না, বিজ্ঞান জানে না ধরনের অসাম্যের লিঙ্গবিচারকে মুছে ফেলার সেই ইতিহাস কি সত্যিই শেষ হতে পারে?
প্রাণের প্রদীপটুকু নিভে যায়। কিন্তু রসায়ন গবেষণাগারে কলেজের বিজ্ঞান শিক্ষার কক্ষে ছাত্রীর পাঠের পাতায় তৈরি হতে থাকে আরও অনেক অসীমা।
তথ্যসূত্র –
১)
Ghosal, Shibnath (8 April 2003). “A Tribute to Prof. Asima Chatterjee”. Arkivoc. 2003 (9): 1–3. doi:10.3998/ark.5550190.0004.901. Retrieved 1 June 2017.
২)
“ASIMA CHATTERJEE”. Ignite – Global Fund for Women. Global Fund for Women. 8 December 2014
৩)
Woollaston, Victoria (23 September 2017). “Asima Chatterjee’s life-saving work into treating cancer is marked in today’s Google Doodle”. Alphr.
৪)
Medal Lectures, 1950–1983: A Collection of Lectures Delivered by Eminent Men of Science who Have Been Recipients of Various Medals and Honours from the Academy. Vol. 3. Indian National Science Academy. 1984. p. 112
৫)
De, Asish (1 January 2015). “Asima Chatterjee: A unique natural products chemist”. Resonance: Journal of Science Education. 20 (1): 6–22. doi:10.1007/s12045-015-0148-9. S2CID 119841303
ছবি সৌজন্য: Picryl, Wikipedia, Google Arts & Culture,
ঈশা আদতে অর্থনীতির ছাত্রী, শিক্ষিকা ও সমাজকর্মী। বিধাননগর কলেজের স্নাতক ঈশার পড়াশোনা ও শিক্ষকতার ক্ষেত্র ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়, ইউনিভার্সিটি অফ ম্যাসাচুসেটস, আমহের্স্ট। ছোটবেলা কেটেছে পিতামহী শিক্ষাবিদ মৃণালিনী দাশগুপ্তের ছত্রছায়ায়, অনেক গল্প, গল্পের বইদের সঙ্গে। গল্প বলার ছায়ারা পিছু নিয়েছে তখন থেকেই। ছোটবেলার স্মৃতিদের নিয়ে লেখা 'আমার রাজার বাড়ি' প্রথম প্রকাশিত গদ্যগ্রন্থ। প্রকাশিত হয়েছে 'রাই আমাদের' নামে ছোটদের গল্পের বইও। কবিতার বই 'চাঁদের দেশে আগুন নেই' আর 'রোদের বারান্দা' আছে ঈশার ঝুলিতে। কবিতার জন্য কৃত্তিবাস পুরস্কারও পান। বড়দের গল্প লেখেন অল্পস্বল্প- 'দেশ' পত্রিকা সাক্ষী। বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় লেখেন গবেষণামূলক লেখা, যার বিষয় মহিলাদের বিভিন্ন সমস্যা ও তার সামাজিক ঐতিহাসিক স্থানাঙ্ক। মহিলাদের প্রতিবাদের ইতিহাস তুলে আনাই এখন মূল লক্ষ্য ঈশার।
One Response
আমাদের অসীমাদি। আমাদের এম-এস-সি ক্লাসে জৈব রসায়ন স্পেশালে পড়াতেন। তখন উঁচু ক্লাসেও পড়া মানে বই থেকে পড়া, বা স্যার যা ব্ল্যাক বোর্ডে লিখে দেন তাই লিখে নিয়ে মুখস্ত করে পরীক্ষার সম্য উগরে দেওয়া। একমাত্র অসীমাদি (কেন দিদি বলতাম জানি না। সবাই বলতো) পড়াতে এসে জার্নালের রেফারেন্স দিতেন।
তখন নকশাল আন্দোলনে কলকাতা তথা পশ্চিম বঙ্গ উত্তাল। পরীক্ষা নেওয়া ও দেওয়া প্রায় বন্ধ। তার মধ্যে আমাদের এম-এস-সি পার্ট টু -র ফাইনাল পরীক্ষা হচ্ছে সায়েন্স কলেজে। পরীক্ষার প্রশ্ন হাতে পেয়ে খুব শক্ত কিছু মনে হয় নি। হঠাত কয়েকজন ‘পরীক্ষা বয়কট করো’ শ্লোগান দিতে দিতে বেরিয়ে গেল, সবাইকে উঠে যেতে বলে। আমি উঠবো উঠবো করছি। হঠাত অসীমাদি এসে পাশে দাঁড়ালেন। স্বভাবসিদ্ধ শান্ত, কঠিন, আনু নাসিক ভঙ্গিতে বললেন – “কোথায় প্রশ্ন শক্ত লাগছে?” আমি আমতা -আমতা করে বললাম -“না, শক্ত নয়। তবে ওরা বয়কট করতে বলছে যে।” আবার শক্ত গলায় বললেন – “ওরা যা বলে বলুক। তুমি পরীক্ষা দাও। ক্লাসে তো খুব প্রশ্ন করা হয়।” ভাগ্যিস উঠে যাই নি। সেই পরীক্ষায় আমি খুব ভাল করেছিলাম। বলা বাহুল্ভায যে ভাল ছাত্র হিসাবে ক্লাসে প্রশ্ন করা ছিল আমার স্বভাব।
প্রণাম জানাই আমার শ্রদ্ধেয় অসীমাদিকে।