(Short Story)
শেষপর্যন্ত বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেল।
ছেলেমেয়েরা তিনজনেই বলছিল বারবার। ওদের কাছে বাড়িটা একটা ‘লায়াবিলিটি’। দায়। ওরা দায় শব্দটা বেশ বোঝে, দায়িত্ব নয়। বর্ণালী বলতে চেয়েছেন, কীসের দায়? বাড়িটা তৈরি করেছিলেন ওদের বাবা। এ বাড়ি বর্ণালীর নামে। বাড়ির যাবতীয় খরচ, মেন্টেনেন্স বা রক্ষণাবেক্ষণ নিজেরাই করেন এখনও। ছেলেমেয়েদের দায় কিছু নিতে হয় না। বরং কলকাতা শহরে সল্টলেকে এই বাড়ি এক সম্পদ। (Short Story)
কিন্তু ছেলেমেয়েদের কাছে সম্পদের পরিভাষা অন্য। ওরা কেউ এবাড়িতে এসে থাকবে না আর। ওদের ছেলেমেয়েও না। তারা জন্মেছে যে দেশে, সেটাই তাদের ‘ঘর’। কলকাতা নিয়ে, এবাড়ি নিয়ে তাদের কোনও আবেগ নেই। তাদের বাবা-মায়েরা এবাড়িতে জন্মেছে, তবু তারা অন্যদেশে ‘ঘর’ বেছে নিয়েছে। স্পষ্টই বলে, ‘তুমি থাকতে থাকতেই সব বিক্রি করে ভাগ-বাটোয়ারা করে নেওয়া ভাল। পরে অনেক ঝামেলা। সাকসেশন সার্টিফিকেট বার করো। রেজিস্ট্রি অফিসে দৌড়োদৌড়ি করো। কার অত সময় আছে!’ (Short Story)

‘এখন থেকেই মায়ের মৃত্যুর পর কী কী হবে, সে হিসেব করছিস?’ বড় ননদ বলেছিলেন একদিন।
খুব রাগ করেছিল ছেলেরা, ‘এটাকে প্র্যাকটিকাল ভাবনা বলে বড়পিসি। তোমার তো এসব ভাবনা ভাবতে হবে না। দিব্য জয়েন্ট ফ্যামিলি।’ (Short Story)
‘বাবা বিছানায় পড়েছিল, তুমিই কী এসে একটু দেখাশোনা করতে পেরেছ?’ মিঠু কটকট করে কথা শুনিয়েছে, ‘পারোনি, সেজন্যে দোষ দিচ্ছি না। ওটাই প্র্যাকটিকাল অবস্থা। আমরাও প্র্যাকটিকালি ভবিষ্যতের কথা ভাবছি।’
বড়দি আর কথা বলেননি। আজকাল কেউই বলে না কিছু।
সমু বলেছিল, ‘আত্মীয়স্বজনের আর কোনও কাজ নেই, বাগড়া দেওয়া শুধু। একা একা থাকো তুমি মা, এত বড় বাড়ি… আমাদের চিন্তা হয় না?’
বাবা যতদিন ছিলেন, সে একরকম। এখন একা কাজের লোকের ভরসায় থাকা। যদিও লীলাকে কাজের লোক মনে করেন না বর্ণালী। (Short Story)
লীলা আছে অপুর জন্মের সময় থেকে। অপুকে বড় করেছে লীলাই। আর সাগর? সে আছে আরও আগে থেকে। নতুন কনেবউ বর্ণালীকে গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে এনেছিল সাগরই। সাগরের সঙ্গে লীলার বিয়ে দিয়েছিলেন সমর।
লীলা আছে অপুর জন্মের সময় থেকে। অপুকে বড় করেছে লীলাই। আর সাগর? সে আছে আরও আগে থেকে। নতুন কনেবউ বর্ণালীকে গাড়ি চালিয়ে বাড়িতে এনেছিল সাগরই। সাগরের সঙ্গে লীলার বিয়ে দিয়েছিলেন সমর। ওদের ছেলেমেয়ে, তাদের লেখাপড়া, বিয়ে… সব এবাড়ি থেকেই। অবশ্য ওদের এখন এবাড়িতে থাকার দরকার নেই। মেয়ে-জামাই থাকে আসানসোলে, ছেলে-বৌমা হায়দ্রাবাদে। ছেলে লেখাপড়া শিখে বেশ মানুষ হয়েছে। (Short Story)
হায়দ্রাবাদে বড় ফ্ল্যাট কিনেছে, বাবা-মাকে নিয়ে যেতেও চায়। বৌমাটিও লক্ষ্মীমন্ত, বর্ণালীকে বলে, ‘আপনিও চলুন জ্যাঠাইমা, সবাই একসঙ্গে থাকব।’ সাগর বেশ কয়েকবার আসানসোল-হায়দ্রাবাদে থেকে এসেছে। লীলা যায়নি, ‘বৌদিকে ছেড়ে যাব কী করে?’ (Short Story)
আগে বলত, ‘আমি গেলে দাদার দেখভাল করবে কে?’
সমর শয্যাশায়ী ছিলেন প্রায় তিনবছর। ব্রেন-স্ট্রোক হয়েছিল। সাগর-লীলার ভরসাতেই সব।
এখন ছেলেমেয়েরা অন্য কথা বলে। ‘বাড়ির একতলাটা কাজের লোকের সম্পত্তি হয়ে গেছে। মা তো ওপর থেকে নামেই না। ওরাই ভোগ করছে গোটা বাড়ি।’ অপু বলে। যে অপুকে কোলে করে বড় করেছে লীলা। (Short Story)

‘কেন এত বড় বাড়ি করেছিলে তখন? বাবার কোনও প্ল্যানিং ছিল না।’ সমু বলে। যে সমুকে বিদেশে পড়তে পাঠানোর জন্য এবাড়ি মর্টগেজ রেখে সব ব্যবস্থা করেছিলেন ওদের বাবা।
বৌমারা বলে, ‘মায়ের যেমন স্বভাব… আলমারি খোলা-গোছানো সব কাজের লোকের হাতে… দেখো, কত কী সরিয়ে নিয়েছে। নইলে ছেলেমেয়ের অমন সুরাহা করে ফেলে! ওদের দেখে কেউ বলবে, ওরা কাজের লোকের ছেলেমেয়ে? ব্রতীন তো দু’বার ইউকে ইউএসএ পর্যন্ত ঘুরে এসেছে।’ (Short Story)
ব্রতীন নামটা বর্ণালীর দেওয়া। নামের অর্থ অক্ষুণ্ণ রেখে ছোট থেকেই ছেলেটা সংকল্পবদ্ধ। বাধ্য, মেধাবী। যা করেছে, নিজের চেষ্টায় করেছে। যা পেয়েছে, নিজের যোগ্যতায় পেয়েছে। মেয়েও ভাল, বাধ্য, কর্তব্যপরায়ণ। লীলার সন্তানভাগ্য ভাল।
কিন্তু ব্রতীন বা দোলনের উত্তরণের ছবি এবাড়ির ছেলে-মেয়ে-বৌমাদের ভাল লাগে না। ওরা চিরকাল ‘কাজের লোকের ছেলেমেয়ে’ থেকে গেল। (Short Story)
মিঠু আগে অন্যরকম বলত। দোলনের সঙ্গে তো বেশ ভাব ছিল। একই বয়সী দুজনে। এলে দোলনের জন্যে, লীলার জন্যে শাড়ি নিয়ে আসত। মেয়ে তো, মায়া বেশি। বাড়ি নিয়েও খুব আবেগ ছিল। দু’চার বছরে একবার হয়তো এল। অমনি ছুটে বেড়াচ্ছে ঘর থেকে বারান্দায়। ছোট্ট থেকে বেড়ে উঠেছে এই বাড়িতে। বলত, ‘জানো, এবাড়ি দু’হাত বাড়িয়ে জড়িয়ে ধরে আমায়। বলে… এসেছো মিঠু?’ (Short Story)
এখন দাদাদের সুরেই সুর মেলায়। ‘বিক্রি করে দাও মা। তুমি চলে গেলে আমাদের বাড়ি ওই কাজের লোকের ছেলেমেয়েরাই ভোগ করবে। এই তো বাবা চলে গেল। বাড়ি-বাড়ি করে আমাদের কাছে পর্যন্ত যায়নি।
এখন দাদাদের সুরেই সুর মেলায়। ‘বিক্রি করে দাও মা। তুমি চলে গেলে আমাদের বাড়ি ওই কাজের লোকের ছেলেমেয়েরাই ভোগ করবে। এই তো বাবা চলে গেল। বাড়ি-বাড়ি করে আমাদের কাছে পর্যন্ত যায়নি। এখন সব ফেলে চলে যেতে হল তো!’ (Short Story)
তা ঠিক। সমর বাড়ি ছেড়ে থাকতে চাইতেন না। পবিত্রদা-শ্রীলা ছেলের কাছে বিদেশ গেল, ওদের বাড়ির জানলা ভেঙে সব জিনিস নিয়ে চলে গেল রাতের অন্ধকারে। পাড়ার লোক কেউ টের পায়নি। ভর দুপুরে মিত্রবাবুদের বাড়ি চুরি হয়ে গেল। গাঙ্গুলীদের বাড়ির একতলাটা পার্টির ছেলেরা অফিস খুলে দখল করে নিল। সিরাজদের বাড়িতে হঠাত্ শর্ট-সার্কিট হয়ে আগুন লেগে দুর্ঘটনা। ওরা যদি তখন বাড়িতে না থাকত! সমীরদের বাড়ির বাগানে ক্লাবের ছেলেরা চেয়ার টেবিল পেতে নিয়মিত মিটিং শুরু করে দিল। কত বাড়ি, বাড়ির সামনের বাগান, পেছনের জমি যে এমন দখল হয়ে যাচ্ছে। (Short Story)
‘বেশিদিনের জন্যে বাড়ি ছেড়ে থাকা যাবে না, বুঝলে?’ সমর বলতেন।
সমু-অপু রাগ করত। মিঠু অভিমান করে কথা বলাই বন্ধ করে দিয়েছিল।
বাড়ি নিয়ে কম কাজ! আজ জলের লাইনে সমস্যা, কাল ইলেক্ট্রিকের লাইনে। ট্যাক্স জমা দিতে গিয়ে একটা গোটা বেলা কেটে যেত। অনলাইন ট্যাক্স জমা দেওয়া শুরু হল, তবে শান্তি। সমর যতদিন ছিলেন, সব সামলে নিতেন। (Short Story)
সমর অচিন পথে পাড়ি দেওয়ার পর দুই ছেলেই বাড়ি বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রেনোভেশনের কথা বলে সাগর-লীলাকে বাড়িছাড়া করল। চোখের জলে বিদায় দিয়েছিলেন বর্ণালী।
সমর অচিন পথে পাড়ি দেওয়ার পর দুই ছেলেই বাড়ি বিক্রি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। রেনোভেশনের কথা বলে সাগর-লীলাকে বাড়িছাড়া করল। চোখের জলে বিদায় দিয়েছিলেন বর্ণালী। ওরা দু’জন যে কতখানি সহায় ছিল, ছেলেমেয়েরা জানত না তা তো নয়। লীলার ছেলেমেয়ে এবাড়ির ছেলেমেয়েই হয়ে উঠেছিল। সমর চলে যাওয়ার পর রোজ ফোনে কথা বলত দুজনে। এখনও যোগাযোগ রাখে। (Short Story)
‘বাড়ি রেনোভেশন হবে, আর মাকে আমরা নিয়ে যাব। তোমরা কী করবে, কোথায় থাকবে দেখে নাও।’ সমু বলেছিল সাগর-লীলাকে। রণেন উকিল সেই বুদ্ধিই দিয়েছিল ছেলেদের।
অপু বলেছিল, ‘দরকার হলে কিছু টাকা নাও আমাদের কাছ থেকে।’
‘তোমাদের কাছ থেকেই তো নিয়েছি সারাজীবন’, সাগর বলেছিল, ‘আর দরকার হবে না।’
‘বলেছ যে, তাতেই মন ভরে গেল।’ লীলা বলেছিল, ‘বৌদিকে দেখো। আর বৌদির জন্য যে কোনও দরকারে ডেকো… যেখানেই থাকি, ঠিক চলে আসব।’ (Short Story)
ওরা ছেলের কাছে হায়দ্রাবাদ চলে গেল।
বর্ণালীরও বাড়ি ছেড়ে ছেলের সঙ্গে যাওয়া ঠিক। ছ’মাস বিদেশে থাকা। লম্বা জার্নিতে শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। সমুর কাছে প্রথম চারমাস, ক্যালিফোর্নিয়ায়। তারপর মিঠুর কাছে দু’মাস, ওয়াশিংটনে। তারপর অপুর কাছে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার কথা ছিল। জোর করে বাড়ি ফিরেছিলেন বর্ণালী। (Short Story)
কতদিন পর বাড়ি ফেরা! আহা, একলা বাড়ি! বাড়ির সারা শরীরে ধুলো, ময়লা। ধুলো ঝেড়ে ময়লা পরিষ্কার হয় না কতদিন। লীলা নেই। কেউ যত্ন করার নেই। ফাঁকা ফাঁকা ঘর। দরকারি আসবাবপত্র সব চলে গেছে। রণেন উকিল আর পাড়ার পার্টির ছেলেদের সাহায্য নিয়ে ফার্নিচার, বাসন, সিলিং-ফ্যান, ঝাড়বাতি… নানা বাড়তি জিনিস বিক্রি করে দিয়েছে ছেলেরা। সেগুনকাঠের পড়ার টেবিল। বাড়িতে এসে সব আসবাব তৈরি করে দিয়েছিল সরিফুল। (Short Story)
তিন ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করেছে, এত বড় টেবিল। সে জায়গাটা খালি। শাশুড়িমায়ের ঠাকুরের সিংহাসন নেই। বাইরের ঘরের শো-কেস নেই। ওগুলো তো শুধু নির্জীব আসবাব নয়, বহমান জীবনের কত ছবি কত ঘটনার সাক্ষী। সব চলে গেছে।
তিন ছেলেমেয়ে লেখাপড়া করেছে, এত বড় টেবিল। সে জায়গাটা খালি। শাশুড়িমায়ের ঠাকুরের সিংহাসন নেই। বাইরের ঘরের শো-কেস নেই। ওগুলো তো শুধু নির্জীব আসবাব নয়, বহমান জীবনের কত ছবি কত ঘটনার সাক্ষী। সব চলে গেছে। (Short Story)
ফাঁকা বাড়ি আনন্দে ছলছল করে উঠল তবু। ‘এসেছ তুমি? এসো এসো।’
একসময় তিনটে ছোট ছেলেমেয়ে এবাড়িতে হুল্লোড় করে বড় হয়েছে। কত বন্ধু, হাসি-গান-আড্ডা। তারা ডানা মেলে উড়ে গেছে আকাশের টানে, বৃহত্তর জগতের পানে। এবাড়ির কর্তার কর্মময় ব্যস্ততার সাক্ষী বাড়ি, অবসর জীবনেরও সাক্ষী। (Short Story)
একটা মেয়ে নতুন বউ হয়ে সংসার করতে এসে মহিলা হয়ে উঠল, এবাড়িকে জড়িয়ে। শাশুড়িমায়ের পোষ্য ছিল অনেক। বেড়াল, কুকুর, পাখি। ছোট্ট প্রাণীদের কত দুষ্টুমি। তিন ছেলেমেয়ে। তাদের বড় হয়ে ওঠা। তারপর এত কর্মকাণ্ড হঠাৎ থেমে গেল। বাড়ি আজ শুধুই প্রতীক্ষায় থাকে। কবে আসবে সবাই! (Short Story)
বাড়িরও কি মন খারাপ হয়? বাড়ি কি অপেক্ষা করে থাকে? কে জানে। গত ছ’মাস ধরে নতুন জায়গায় মানিয়ে নেওয়ার প্রচেষ্টা… শ্রান্তি। বড় ক্লান্তি। আজ বাড়ি যেন দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরল, সব শ্রান্তিতে হাত বুলিয়ে দিল। বড্ড মায়া। বাড়িরও প্রাণ আছে। সেই প্রাণের স্পর্শ পেয়েছে বর্ণালী। মায়ার নীড়ে ফেরা। বাড়ি মানে সবুজ ছায়া, বাড়ি মানে মায়া। অনেকদিন পর সেই মায়ার ছায়ায়। খোলা হাওয়া, সবুজ প্রকৃতি, পরিচিত মানুষজনের কাছে ফেরা। (Short Story)
সাগর-লীলা চলে গেছে হায়দ্রাবাদে, ছেলের কাছে। দু’জন কাজের লোকের ব্যবস্থা করে দিয়েছে ছেলেমেয়েরা। একজন রান্নার লোক। একজন ঠিকে কাজের লোক। রাতে থাকে না কেউ। কারণ একলা বৃদ্ধ-বৃদ্ধার অসহায় দুরবস্থার খবর রোজই পাওয়া যাচ্ছে। (Short Story)

ঘরের মধ্যে আলমারিতে গয়না, টাকা। বাড়িতে দামি আসবাবপত্র। ছেলেমেয়েরা বিদেশে। বাড়ি সামলাচ্ছেন একা বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। শারীরিক দুর্বল ওই মানুষটিকে কাবু করতে পারলেই দখল নেওয়া সম্ভব বাড়ির মূল্যবান জিনিসপত্রের। কোথাও বাড়ির পরিচারক, কখনও ইলেকট্রিক মিস্ত্রি, কখনও সাফাইকর্মী হিসেবে কাজে ঢুকে এই সুযোগ নিয়ে লুঠপাট চালাচ্ছে দুষ্কৃতীরা। রাতে বাইরের লোক থাকা মানেই বিপদ বেশি। (Short Story)
কাজ বেড়েছে বর্ণালীর। রোজ সন্ধে হলে নিচের তলা থেকে ছাদের দরজা পর্যন্ত একডজন তালা লাগানো। আবার সকাল হলেই সেই তালা খোলা। হাঁফ ধরে যায়। (Short Story)
প্রতিমুহূর্তে মনে পড়ে লীলা-সাগরকে। দাদা-বৌদিকে নিজে হাতে কাজ করতে দেয়নি কোনওদিন। গাড়ি চালানো, বাজার দোকান থেকে সমরকে ব্যাঙ্কে পোস্টাপিসে নিয়ে যাওয়া, বাগানের গাছের যত্ন… সব সাগর। আর ঘরের যত কাজ, রান্না… সব লীলা। (Short Story)
অবশ্য এ ব্যবস্থাটা সাময়িক। ছেলেমেয়েরা এসে পড়বে শিগগির। বাড়ি বিক্রির সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। মারোয়াড়ী দম্পতি যাঁরা বাড়িটা কিনবেন, একদিন এসে দেখাও করে গেছেন। আপাতত বাড়িতে যে আসবাবগুলো আছে, তা ওঁরাই কিনে নেবেন। বাগানের গাছগুলো সব বিক্রি করে দেওয়া হবে, কারণ ওঁরা বাগানটা রাখবেন না। ওখানে গ্যারেজ হবে। যত্নে তৈরি বাগান, নানা পাতাবাহার, ফুল, সবুজ লন। সকাল-বিকেল সবুজের কাছে বসা। বেতের চেয়ার টেবিল। খুব প্রিয় ছিল সমরের। (Short Story)
‘আপনি চাইলে কাউকে গাছ দিয়ে দিতেও পারেন… উই ডোন্ট মাইন্ড। আপনি তো গাছগুলো নিয়ে যেতে পারবেন না।’
বারান্দার সোজাসুজি একটা স্বর্ণচাঁপা গাছ। ফুলে ভরে থাকে গাছটা।
‘আপনি চাইলে কাউকে গাছ দিয়ে দিতেও পারেন… উই ডোন্ট মাইন্ড। আপনি তো গাছগুলো নিয়ে যেতে পারবেন না।’
বারান্দার সোজাসুজি একটা স্বর্ণচাঁপা গাছ। ফুলে ভরে থাকে গাছটা। সবুজ পাতার মধ্যে ছোট ছোট কমলা-হলুদ ফুল। লীলা লাগিয়েছিল। সারা বছর টুকটাক ফুল হয়। বারান্দায় বসলেই মন ভাল হয়ে যায়। এদিকেও সারি সারি সবুজ। হালকা সবুজ, গাঢ় সবুজ, হলুদে মেশানো চিকচিকে সবুজ। বাড়ির মধ্যে, সিঁড়িতেও ধাপে ধাপে পাতাবাহার। পাম-ক্রোটন-অ্যালকেশিয়া-সপ্তপর্ণী। পাশের বাড়ির কল্যাণীদির কাজের মেয়েটা এ ক’মাস রোজ জল দিয়ে বাঁচিয়ে রেখেছে তাদের। বাগানটা থাকবে না আর? (Short Story)
যতই প্রাণ থাক, গাছেরা তো আর ঠাঁইনাড়া বা ঘরছাড়া হওয়ার প্রতিবাদ করতে পারবে না। বর্ণালীও কী পারলেন? এই বয়সে ঠাঁইনাড়া হতেই হচ্ছে।
‘শুধু আবেগ দিয়ে জীবন চলে না, এটা আমি বুঝে গেছি।’ নিজেকেই বললেন মনে মনে।
স্বামী চলে গেছেন না-ফেরার দেশে। ছেলেরা নিজেদের স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আমেরিকা-অস্ট্রেলিয়ায়। তারা এখানে আর আসবে না। সেখানে মাকে রাখার চেষ্টাও করেছে। বর্ণালীই থাকতে পারেননি। ফিরে এসেছেন। তাহলে আর উপায় কী?
একটি মাত্র মেয়ে। সে এবং তার স্বামী দুজনেরই সবসময় বাইরে নানা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে ব্যস্ত। তাদের সংসারে থাকার সময় নিজেকে দোষী মনে হত। (Short Story)
বরং এই ভাল। নিউটাউনের পাঁচতারা হোটেলের মতো বৃদ্ধাশ্রম। ছেলেমেয়েরা চায়, মায়ের বাকি জীবনটা নিশ্চিন্তে কাটুক।
‘যখন চাইবে, আমাদের কাছে আসবে। আমরা তো আছি। এটা একটা সার্ভিস কেনা। অসুস্থ হলে যেমন হাসপাতালে সার্ভিস কিনি আমরা। সেইরকম।’ ছেলেমেয়েরা বুঝিয়ে বলেছে। (Short Story)
প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক মিসেস গুপ্ত বলেছেন, ‘মানুষ একা থাকছে। জয়েন্ট ফ্যামিলি ভেঙে নিউক্লিয়ার ফ্যামিলি গড়ে উঠছে। ছেলে-মেয়েরা দূরে দূরে থাকছে। এখানে সবাই মিলে একসঙ্গে থাকবেন। নিরাপত্তাহীনতা, দুঃখ ভুলে একটা সুন্দর ইনিংস খেলছেন এখানে সবাই। ভাল লাগবে, দেখবেন।’ (Short Story)
প্রায় দেড় একর জমিতে এগারোতলা অত্যাধুনিক সুসজ্জিত বৃদ্ধাশ্রম। নব্বইটি সিঙ্গল রুম, সাতান্নটি ডবল রুম। রুমের মধ্যে টিভি, এসি। সুইচ টিপলে রুম-সার্ভিস বা হেল্পের জন্য অ্যাটেন্ডেন্ট। ইন্টারনেটের সুবিধে আছে। প্রবীণ নাগরিকদের বিদেশে থাকা সন্তান বা আত্মীয়দের সঙ্গে ভিডিও কলে কথা বলার আলাদা ঘর আছে। অসুস্থ হলে ডাক্তার, নার্স, প্রয়োজনে অ্যাম্বুলেন্স। নামী বেসরকারি হাসপাতালের সঙ্গে ব্যবস্থা। এর চেয়ে ভাল কিছু হতে পারে? (Short Story)
‘জীবনের শেষ সময়টুকু বোঝা হিসেবে নয়, একাকিত্বের কষ্ট নিয়ে নয়… আরও অনেকের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে পারবেন।’ একজন আবাসিক বললেন।
‘জীবনের শেষ সময়টুকু বোঝা হিসেবে নয়, একাকিত্বের কষ্ট নিয়ে নয়… আরও অনেকের সঙ্গে কাটিয়ে দিতে পারবেন।’ একজন আবাসিক বললেন।
‘আমরা ভাল না থাকলে ছেলেমেয়েরাও তো অপরাধবোধে ভোগে। চিন্তায় থাকে। ওদেরও নিশ্চিন্ত করা দরকার।’ আরেকজন বললেন।
‘যে স্বপ্ন স্বজনদের সঙ্গে পূরণ করতে পারেনি, নতুন মানুষ নতুন বন্ধুর সংস্পর্শ দিয়ে আমরা সেই স্বপ্ন পূরণ করি।’ মিসেস নির্মলা গুপ্ত বলেছেন।
স্বপ্ন! কী-ই বা স্বপ্ন থাকতে পারে আজ! এই বেশ হয়েছে। অন্তত ছেলেমেয়েদের স্বপ্নগুলো পূরণ হোক। (Short Story)
শেষপর্যন্ত বাড়িটা বিক্রি হয়ে গেল। আজ তিন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে এসে পৌঁছে দিয়ে গেছে এই বৃদ্ধাশ্রমে। টাকাপয়সা নেওয়া, রেজিস্ট্রেশন সব শেষ। বাড়ির নতুন মালিক এসে নতুন তালা লাগিয়ে দিয়েছেন বাড়িতে। মাকে পৌঁছে দিয়ে ছেলেমেয়েরা হোটেলে চলে গেল। অপু গড়িয়ায় নিজের শ্বশুরবাড়িতে। আগামীকাল যে যার নিজের জায়গায় ফিরে যাবে। বলে গেছে তিনজনেই, এয়ারপোর্ট যাওয়ার পথে দেখা করে যাবে। (Short Story)
বৃদ্ধাশ্রমে নিজের ঘরে বসেছিলেন বর্ণালী। বাইরে ঝড় উঠেছিল একটু আগে। কালবৈশাখী। মনের মধ্যেও ঝড়। বাইরের ঝড় থেমে গেলেও বুকের মধ্যে ঝোড়ো হাওয়া বইছে। (Short Story)
‘যা হারিয়ে যায় তা আগলে বসে
রইব কত আর?
আর পারিনে রাত জাগতে হে নাথ
ভাবতে অনিবার…’
আস্তে আস্তে উচ্চারণ করলেন। আজ থেকে এ-ই জীবনের সত্য। (Short Story)

‘ভিজিটর এসেছে।’ ইন্টারকমে বলল একটি মেয়ে।
ছেলেমেয়েরা কেউ ফিরে এল? বেরিয়ে এলেন ঘর থেকে।
লীলা। এগিয়ে এসে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। ‘তুই? কবে এলি কলকাতায়?’
‘আজই এসেছি।’ সাগর এগিয়ে এল, ‘খবর পেয়ে এলাম।’
‘তুমি আমার সঙ্গে চলো বৌদি। তোমাকে আমরা বৃদ্ধাশ্রমে থাকতে দেব না।’
পাগলী মেয়ে! ওর দুনিয়ায় সব বড্ড সহজ।
‘তোমাকে হায়দ্রাবাদ যেতে হবে না। আমরা সল্টলেকেই বাড়ি ভাড়া নেব। একসঙ্গে থাকব।’
কিছুতেই বোঝানো যায় না দু’জনকে।
‘আপনার জন্যে কিচ্ছু করতে পারব না আমরা? আজ আমাদের যা কিছু, সব তো দাদার দেওয়া।’ সাগরও জোর করতে লাগল। (Short Story)
‘আচ্ছা আচ্ছা। ওসব ডিসিশন কী এমন করে নেওয়া যায়? পরে ভাবা যাবে।’ আপাতত নিরস্ত করতে হবে ওদের। বললেন, ‘একটা কিছু করতে চাও তো? তাহলে একবার আমায় বাড়িটা দেখিয়ে আনো। কাল থেকে বাড়িতে নতুন মানুষ…’ গলা ধরে এল। (Short Story)
টিপটিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। তার মধ্যেই বেরিয়ে পড়লেন তিনজনে।
বাড়ি যত কাছাকাছি আসছে, বুকের মধ্যে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি শুরু। মোড় ঘুরতেই… ওই তো বাড়ি। অন্ধকার, নির্জন, নিঃশব্দ। শূন্যচোখে তাকিয়ে আছে। সব হারিয়ে একলা।
‘ও বৌদি! দ্যাখো দ্যাখো…’ লীলা উত্তেজিত হঠাত্।
‘কী? কী দেখব?’
‘ওই দ্যাখো… সমু আর মিঠু। আরে… ওই গাড়িটা থেকে নামছে… অপু না?’
তাই তো। বাগানের গায়ে কাঞ্চনফুলের বেড়া। তার পাশে দাঁড়িয়ে পড়লেন বর্ণালী।
‘বললাম না দাদা? বৃষ্টি আসবে? তাড়াতাড়ি কর… ভিজে যাবে।’ মিঠুর গলা। (Short Story)
‘তোরাও এসেছিস? আমারও মনটা ছটফট করে উঠল,’ অপু খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে, ‘ঝড় থামতে দেখেই বেরিয়ে পড়েছি আমি। তোরা আসছিস জানলে আর…’
‘তোরাও এসেছিস? আমারও মনটা ছটফট করে উঠল,’ অপু খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে, ‘ঝড় থামতে দেখেই বেরিয়ে পড়েছি আমি। তোরা আসছিস জানলে আর…’ (Short Story)
‘বেশ করেছিস। আমরা ঝড় শুরু হতেই বেরিয়ে এসেছি। কী করে যে ভুল হয়ে গেল! সব বৃষ্টিতে ভিজে যেত…’ সমুর গলা, ‘মিঠু টেবিল তুলে ফেলেছে। আমি বাবার চেয়ারটা তুলে নিচ্ছি… তুই মাকে নিয়ে আয়… নিচে শক্ত করে শেকল দিয়ে বাঁধা আছে। ওই শাবলটা নে।’ ‘তোরাও এসেছিস? আমারও মনটা ছটফট করে উঠল,’ অপু খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে, ‘ঝড় থামতে দেখেই বেরিয়ে পড়েছি আমি। তোরা আসছিস জানলে আর…’ (Short Story)
বাগানে বেতের বসার জায়গা। মাটি খুঁড়ে শেকল দিয়ে শক্ত করে বেঁধে দিয়েছিল সাগর। শীতের সকালে, গরমের সন্ধেয় সমর-বর্ণালীর চা-পানের প্রিয় জায়গা। বর্ষাকালে মোটা ত্রিপল দিয়ে ঢাকা থাকত । বৃষ্টি আসার সম্ভাবনায় ছুটে এসেছে তিন ভাইবোন। বাবা-মায়ের বসার জায়গা… প্রিয় চেয়ার টেবিল ভিজে যাবে। আহা। ‘তোরাও এসেছিস? আমারও মনটা ছটফট করে উঠল,’ অপু খোলা গেট দিয়ে ঢুকে পড়েছে, ‘ঝড় থামতে দেখেই বেরিয়ে পড়েছি আমি। তোরা আসছিস জানলে আর…’ (Short Story)
মুদ্রিত ও ডিজিটাল মাধ্যমে সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত
অলংকরণ – আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
আইভি চট্টোপাধ্যায়ের জন্ম ১৯৬৩ সালে ইস্পাতনগরী জামশেদপুরে। সে শহরের সঙ্গে তাঁর নাড়ির যোগ। পরিবেশবিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা। ব্যাংকে চাকরি করেছেন। নেশা বই পড়া। সর্বভূক পাঠক। দীর্ঘদিন ধরে লেখালিখির জগতে রয়েছেন। বিভিন্ন নামী পত্রপত্রিকা ও ওয়েবজিনে তাঁর গদ্য প্রকাশিত হয়। বইয়ের সংখ্যা এখনও পর্যন্ত বারো।