(Handwriting)
‘তুমি আর আমি’
‘তুমি মামা আমি মামী’
‘তুই স্বামী আমি আসামী’
‘তুমি কামাও আমি জানি’
‘I’m Not ur Dalmakhani’
এই অনুকবিতার প্রতিটি লাইন এক একটি অটোলিপি। অর্থাৎ পাঁচটি আলাদা জায়গায় বিভিন্ন সময়ে সংগৃহীত অটোপৃষ্ঠে লেখা কথা। জায়গা (সময়) যথাক্রমে বেহালা চৌরাস্তা (২০১১), বেলেঘাটা (২০০৩), শিলিগুড়ি (১৯৯৯), আরামবাগ (২০১৭) এবং চন্ডীগড় (২০১৮)। কবিতা রচনায় আমার ভূমিকা অনাথ আশ্রমের মায়ের মতন। সংগ্রহের পর বুক দিয়ে আগলে রাখা। তারপর সময় মতন তাদের পরপর সাজিয়ে দেওয়া! অটোলিপির ভাষায়, ‘This much just’, অর্থাৎ, ব্যস্ এটুকুই। (Handwriting)
হাতের লেখা, শেখা!: শুভেন্দু দাশমুন্সী
‘তুমি’ আর ‘আমি’-এক চিরায়ত জুটি। দুনিয়ার সবচেয়ে জনপ্রিয়। ইতিহাস-ভূগোল-বয়সের বেড়া টপকে এই সত্ত্বাদ্বয় পরস্পরের পরিপূরক, ‘Made for each other’ (বর্ধমান, ২০০২)। ফাজিল অটোর কথায়, ’69’ (হায়দ্রাবাদ, ২০১২)। প্রতিটি অঙ্ক ছিল বেশ-বড়, বোল্ড হরফে। আবার পুনের অটোপৃষ্ঠে হিন্দিতে লেখা ‘এক দুজে কে লিয়ে’ও তো প্রকারান্তরে দুটি পরস্পর প্রিয় প্রাণের মুখোমুখি- বসিবার কথা বলে। সেখানে দুজনে আবদ্ধ অর্গ্যানিক বন্ডে। তা সে কেমিস্ট্রি বা জীবনের মিস্ট্রি যাই বলুন। (Handwriting)

প্রশ্ন জাগে, তাহলে কেমিক্যাল বন্ডটা কীরকম? কাদের মধ্যে হয়?
‘রসো রসো’ (বারাসাত, ২০০৪), ‘আহিস্তা আহিস্তা’ (পাটনা, ২০১৪)।
বলবেখ’ন ‘সবজান্তা খাস গোমস্তা’, সৌজন্যে: গড়িয়াহাট-পার্ক সার্কাস রুটের অটো (২০১২)।
অবশ্যি এই গোমস্তা কোনও অটো নয়। এক ব্যক্তিগত চার-চাকার বাহন। তার রিয়ার স্ক্রিনে সাদা রঙে লেখা ছিল: ‘Chemical Bond temporary, Organic Bond Permanent.’ (Handwriting)
বাহনলিপিতে মৌনতার ইঙ্গিত রয়েছে। তবে সেই মননে কোথাও ভারসাম্যের বিচ্যুতি হয়নি। যদিও লিপিটির চিন্তকের, মুহূর্তের অসাবধানতার ফলে ভালগারিটির আঁচড় লাগতে পারত তার গায়ে। তবে লিপিকারের পাকা মাথার ভাবনা, সংযমী অনাড়ম্বর উপস্থাপন তা হতে দেয়নি। বেঁকে যায়নি বক্তব্যের কেন্দ্রীয় রেখাটি। (Handwriting)
বিশ্বাস ভারি একবগগা। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় বিশ্বাস সম্পর্কিত প্রচলিত নানান নীতিকথামূলক এবং ধর্মীয় ভাবাদর্শ দ্বারা তাড়িত লোকগল্পগুলি। অটোলিপিতেও তার প্রতিধ্বনি: ‘বিশ্বাসে পাই তোমাকে, অবিশ্বাসে হারাই।’
শেষোক্ত অটোলিপিটি গড়নের দিক থেকে দেখলে রসায়নের আবরণে দর্শন (ফিলজফি)-এর কথা, যেখানে কেমিস্ট্রি গৌণ, দর্শনই মুখ্য। লিস্ট, মধ্যস্থ ‘bond’ শব্দটি এখানে ‘বিশ্বাস’-এর প্রতিভূ। যে বিশ্বাসের কাছে দুনিয়ার অন্য যেকোনও বন্ধন তুচ্ছ। ‘বিশ্বাস’ মানুষকে দিয়ে করিয়ে নিতে পারে না-এমন কিছুই নেই। বিশ্বাস ভারি একবগগা। এই প্রসঙ্গে স্মরণীয় বিশ্বাস সম্পর্কিত প্রচলিত নানান নীতিকথামূলক এবং ধর্মীয় ভাবাদর্শ দ্বারা তাড়িত লোকগল্পগুলি। অটোলিপিতেও তার প্রতিধ্বনি: ‘বিশ্বাসে পাই তোমাকে, অবিশ্বাসে হারাই।’ অন্যত্র প্রাপ্ত সমমনসষ্ক: ‘বিশ্বাস রাখি তোয়াতে অবিশ্বাস নাই আমাতে।’ (চুঁচুড়া, ২০০০)। (Handwriting)
‘তুমি আর আমি শুধু জীবনের খেলাঘর’- সতীনাথ মুখার্জির সুরে শ্যামল মিত্র-র গাওয়া গানের এই লাইনকে দেখা গেছে রাণাঘাটের অটো পৃষ্ঠে। এই দৃশ্য পথচলতি মানুষকে নস্ট্যালজিক করে তোলার পাশাপাশি ভরিয়ে তোলে মুহূর্তের অপ্রত্যাশিত ভাললাগার আবেশে। (Handwriting)
প্রসঙ্গত গানের এই লাইনটিই সূচীকর্মে ঘরের সোভা হয়ে থাকতে দেখেছিলাম ভবানীপুরের পদ্মপুকুরে আমাদের এক দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় আলয়ে (১৯৯৩)। আবার আচমকাই এর দেখা পেয়েছি দার্জিলিং-এ ম্যাল সংলগ্ন আস্তাবলের গলিতে দুপুরের সোনা রোদ্দুরে। সুবেশিনীর কালো টি-শার্টে।
প্রসঙ্গত গানের এই লাইনটিই সূচীকর্মে ঘরের সোভা হয়ে থাকতে দেখেছিলাম ভবানীপুরের পদ্মপুকুরে আমাদের এক দূর-সম্পর্কীয় আত্মীয় আলয়ে (১৯৯৩)। আবার আচমকাই এর দেখা পেয়েছি দার্জিলিং-এ ম্যাল সংলগ্ন আস্তাবলের গলিতে দুপুরের সোনা রোদ্দুরে। সুবেশিনীর কালো টি-শার্টে। সামনের অংশে উজ্জ্বল হলদেটে অ্যাক্রিলিক। (Handwriting)
‘তুমি+আমি’- কালিয়াগঞ্জে অটোর গায়ে দেখা এই লেখা ফিরিয়ে এনেছিল (২০০১), তারও বছর আটেক আগে বেলেঘাটার লেক সাইডে এক বাড়ির প্রবেশপথে পাথরের ফলকে লেখা নেমপ্লেট দর্শনের স্মৃতি। বাড়িটির নাম ছিল ‘তুমি-আমি’। (Handwriting)

‘দুয়ার এঁটে খিল দিয়েছো তুমি।/তোমায় দেখবো বলে বাইরে দাঁড়িয়ে আছি আমি।’ -এই লোককবিতায় বাজে দু’য়ের মধ্যে দূরত্বের মন্ত্রনা বেহালার রুদ্ধ সংগীত হয়ে। ‘তুমি নেই তোমাতে, আমি নেই আমাতে’।-এই মূল্যায়নও সেই তুমি-আমিকে ঘিরেই। এখানেও ঘুরিয়ে পরস্পরের প্রতি পরস্পরের একাত্ম না-হতে পারার অভিযোগ। এর ঠিক উল্টো সুরে লেখাঃ ‘তুমি আমার, আমি তোমার।’ একে অপরের প্রতি বিশ্বস্ত এখানে। সম্পর্ক বেঁধে রাখা বার্তা গ্রন্থিত, এখানে চলমান লিপির লোকায়ত ফ্রেমে। (Handwriting)
‘রাধাকৃষ্ণ’ তো এক চিরকালীন সম্পর্কের প্রতীক, ডিজায়ার। নবরসের সকল আবেগের আধার। ‘তুমি’, ‘আমি’-র মূথবদ্ধতার প্রতীক। একটু লঘু রূপে একই দৃশ্যের উপস্থাপনা -‘হাম দোনো’ কিংবা, ‘হামতুম’। শেষের দুটোই লেখা ছিল হিন্দিতে। সংগ্রহস্থল যথাক্রমে রাঁচি এবং দুর্গাপুর। (Handwriting)
‘তুমি আসবে বলে দাঁড়িয়ে আছি’ ঠা-ঠা রোদ্দুরে এমন লিপির দেখা পাওয়া বটগাছের ছায়ায় প্রাণ জুড়োনোর মতন, অলৌকিকের মতন। জানি সে আমার কেউ নয়, তবু এই যে অনির্দিষ্টের উদ্দেশে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া আশ্বাস-তার লক্ষ্য তো নিঃসন্দেহে আমি বা আমার মতন কেউ।
‘তুমি আসবে বলে দাঁড়িয়ে আছি’ ঠা-ঠা রোদ্দুরে এমন লিপির দেখা পাওয়া বটগাছের ছায়ায় প্রাণ জুড়োনোর মতন, অলৌকিকের মতন। জানি সে আমার কেউ নয়, তবু এই যে অনির্দিষ্টের উদ্দেশে হাওয়ায় ভাসিয়ে দেওয়া আশ্বাস-তার লক্ষ্য তো নিঃসন্দেহে আমি বা আমার মতন কেউ। রসিকমনের এই যে রোম্যান্টিক পরমাণু আখ্যান-এসবই জীবনের উদ্বৃত্ত পাওয়া। এর জন্য পথ চলতে চোখকান একটু খোলা রাখাটাই যথেষ্ট। সঙ্গে চাই কৌতূহলী মন আর মরমী উপলব্ধি।
‘তুমি আসবে/আমি ডুববো/এমন তো/কথা ছিল না’- কীসের অভিযোগ? কেনই-বা অভিযোগ? বোঝা দায়। কারণ মুখ খুলতে নারাজ সংশ্লিষ্ট অটোচালক। তবে বুঝতে অসুবিধে হয় না পুরো বয়ান, শরীরে মিশে আছে চাপা অভিমান। অন্তঃসলিলা ফল্গুর মতন বয়ে চলেছে বেদনার গাঢ় নীল স্রোত। অন্যত্র দেখা সমপ্রকৃতির বেদবাহত মনের লিপিরূপ: ‘তুমি যে না এসে আমাকে ডোবালে/ কেন করলে এমনটা কিছুই না বলে!’ (Handwriting)
সত্য মিথ্যে গুলিয়ে যায় সমাজমাধ্যমে, মিথ্যের চেয়েও বিপদজনক অর্ধসত্য। উভয়ের মধ্যে সম্পর্কে যাতে সমাজ মাধ্যম কোনও প্রভাব ফেলতে না পারে, তার চেতাবনি: ‘Maintain Social Media Free Relation’ সচেতন বুদ্ধিদীপ্ত বাস্তবমুখী মনের পরিচায়ক। তোমার আমার সম্পর্ককে কলুষমুক্ত এবং সন্দেহের উর্দ্ধে রাখার এই বার্তা ও প্রয়াস অবশ্যই সাধুবাদযোগ্য। আপাতভাবে মূল্যহীন মনে হলেও এহেন ব্যক্তিগত প্রয়াস সমাজের অভ্যন্তরীণ বিরল সত্তাকে তুলে ধরে। সংশ্লিষ্ট সমাজের সামগ্রিক মূল্যায়নের ক্ষেত্রে, যা অবশ্যই কাউন্টেবল। দিল্লির মতন মেট্রোপলিস এবং দ্রুতগতির নগরে আজও পথে প্রাণের স্পন্দন হয়ে টিকে আছে এমনই ভাবনামূলক মর্মস্পর্শী অটোলিপি। (Handwriting)

তোমার-আমার সম্পর্ককে সুস্থ সাবলীল রাখতে অটোলিপিতে প্রাপ্ত বিধান: ‘Don’t Public Ur Relation’ (কানপুর, ২০১৮); ‘যা বলার সামনাসামনি আমাকে বলো’ (কোচবিহার, ২০০৭); ‘আমার নিন্দে আমার কাছেই কোরো’ (বজবজ, ২০০৪); ‘বাস্তববাদী হোন,সম্পর্ক ভালো থাকিবে।’ (অশোকনগর, উঃ ২৪-পরগণা, ২০০৯); ‘Don’t Mix Relation with Money(শিলিগুড়ি, ১৯৯৮)। এই পঞ্চশীল নীতি যে সুস্থ সম্পর্কের দীর্ঘায়ুর জন্য অপরিহার্য তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু এখন মানুষ বড় ছটফটে। ‘সবকিছুকে পেতে চায় চটপটে’ (ব্যান্ডেল, ২০০৬)। ‘সম্পর্কের জন্য ত্যাগ করাটা জরুরি’ (সোদপুর, ১৯৯৭)। (Handwriting)
উপরোক্ত ৫টি অটোলিপির কিছু ফলিত নমুনা পাওয়া গেছে সমাজের অন্য ভুবনে। কখনও সরাসরি, কখনও আর একটু এক্সটেনটড বয়ানে, কখনও বা ঈষৎ পরিবর্তিত রূপে। কীরকম? ‘Don’t Public Ur Relation… It’s Sensation!’- ছিল একটি কন্ডোমের প্রচার-স্টিকারে। রবার গুডস-এর দোকানের অভ্যন্তরে দেওয়ালে সাঁটা। এটা ২০১৯-এর কথা।
২নংটি ছিল গড়িয়াহাটের কাছে একটি কফি শপে, যার ঠিক নিচেই ছিল বাহারী মেনুর তালিকাটি (২০১১)। (Handwriting)
‘আমার নিন্দে আমার কাছে করবেন/ ভালো লাগলে অন্যের কাছে বলবেন’ তৃতীয়টির এই পরিবর্তিত ও পরিবর্ধিত রূপদর্শন হয়েছিল যাদবপুরে অধুনালুপ্ত একটি ছিমছাম ছোটোখাটো লেবানীজ খাবারের দোকানে। অন্নপূর্ণা বেডিং স্টোরের বাঁ’পাশের গলিতে একটু এগিয়ে বামদিকে। এটা ২০১৫ বা ২০১৬-র কথা। প্রায় এরকম আবেদন পেয়েছি অনুষ্ঠান বাড়ির মেনুকার্ডে।
আমার অগ্রজ প্রতীম বন্ধু ও রসিক মানুষ সত্যবান মিত্র। তাঁর বাড়িতে বৈঠকখানার দেওয়ালে একটা পাতিলেবু ঝুলিয়ে রাখতেন সারা বছর। তার নিচে বৃত্তের চাপের আকারে একটা কাগজে লেখা আমাকে বেশি কচলিয়ো না’। প্রথম দেখার পর তাঁর বাড়িতে আগত এক বিশিষ্টজন জিজ্ঞেস করেছিলেন সত্যবানদাকে, “এটা ঝোলানোর কারণ কী? সত্যবানদার উত্তর ছিল: “আপনার-আমার সম্পর্ক ভাল রাখায় দায় যে আপনারও সেটাই মজার ছলে মনে করিয়ে দেওয়া!” উদ্যোগটির সূচনাকাল ১৯৯৯-এর শুরুর দিক। (Handwriting)
সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতেই মোড়কের গায়ে সাবধানবাণীর মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। লক্ষ্যণীয় সংঘাতের বিষয় যাই হোক কুশীলব অব্যয় পদের মতন অপরিবর্তিত থাকে। সেই তুমি আর আমি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে মালুম হয় কেন বেলঘড়িয়ার কাছে দেখা অটোর পিঠে লেখা ছিল: ‘চাপ দেবেন না, চাপ নেবেন না।
দিল্লিতে এক সুসজ্জিত কেতাদুরস্ত ফলের দোকানে ক্রেতাদের যে প্লাস্টিকের ব্যাগে ভরে ফল দেওয়া হচ্ছিল (২০০৫) তার গায়ে লেখা দেখেছিলাম: ‘Don’t Create Pressure On Me. I May be Disfigured’, এই বলাটাও ব্যবসায়িক স্বার্থে, দোকানির তরফে তোমাকে বা আমাকে উদ্দেশ্য করে। সম্ভাব্য ক্ষতি এড়াতেই মোড়কের গায়ে সাবধানবাণীর মুদ্রণের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। লক্ষ্যণীয় সংঘাতের বিষয় যাই হোক কুশীলব অব্যয় পদের মতন অপরিবর্তিত থাকে। সেই তুমি আর আমি।
এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখলে মালুম হয় কেন বেলঘড়িয়ার কাছে দেখা অটোর পিঠে লেখা ছিল: ‘চাপ দেবেন না, চাপ নেবেন না। দু’জনেই ভাল থাকবেন।’ এই সুবচনের কাছাকাছি যাকে রাখব তাকে পেয়েছিলাম কেরলের আলেপ্পিতে আরেক অটোর ক্যানভাসে: ‘Unne–cessary presure destroy 2 Mans & their Relation’. বাসলিপির ভাষায়, ‘Relax Guru, Enjoy Guru’।
ভালবাসার প্রেক্ষাপটে তুমি আমির অবস্থান নিয়ে কী ভাবছে অটোলিপি দেখে নেওয়া যাক একবার। (Handwriting)
১. ‘তোমাকে ভালো রাখতে পারলেই আমি happy’ (উল্টোডাঙা, ২০০১)।
২. তোমার যাতে খারাপ লাগে তা থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে রাখতে পারাতেই ভালো থাকা (ঘোলা ২০০২)।
৩. ‘একলা ভালো থাকা যায়না,/ দুজনে একসাথে ভালো থাকতে হয়।’ (সন্তোষপুর, ২০০৮)-এ হল ভাল থাকার যৌথ যাপন।
৪. ‘আজকে যে ভালো আছে মনে হয়, কালকে সেইই অসুখী। আমি কী করবো? (হাজরা, ২০২২)। দ্বিধাগ্রস্তের অন্বেষণ!
৫. “To be happy depends on others’ (হরিদ্বার, উত্তরাখণ্ড, ২০০৬), অর্থাৎ ভাল থাকার সিংহভাগ পরসম্বন্ধী, একান্তই পরস্মৈপদী। (Handwriting)
দেখা যাচ্ছে দু’জনার ভাল থাকাটা অনেকটা শিল্পীর তেলরঙের ব্যবহারের মতন। হতে পারে, শিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রথমে ক্যানভাসে আর্থ কালার দিয়ে একটা বেস তৈরি করে, অ্যাক্রিলিকে (এইচডি) চাপানো। গুণগত দৃষ্টিকোণ থেকে এই রং চয়নের কারণ ব্রামিংয়ের দ্রুত স্টাইলকে জ্যা-মুক্ত রাখা।
দেখা যাচ্ছে দু’জনার ভাল থাকাটা অনেকটা শিল্পীর তেলরঙের ব্যবহারের মতন। হতে পারে, শিল্পীদের মধ্যে কেউ কেউ প্রথমে ক্যানভাসে আর্থ কালার দিয়ে একটা বেস তৈরি করে, অ্যাক্রিলিকে (এইচডি) চাপানো। গুণগত দৃষ্টিকোণ থেকে এই রং চয়নের কারণ ব্রামিংয়ের দ্রুত স্টাইলকে জ্যা-মুক্ত রাখা। ভালো থাকাটা একটা আর্ট হলেও এক্ষেত্রে এই নিয়ম অচল।
ব্যক্তিভেদে ভাল থাকার সংজ্ঞা বদলায়। পাল্টায় ভাল থাকার মাত্রার ধারণাও। কেউ ‘একটু ভাল হলেই ভাল’ মনে করেন, কারও কাছে ‘ভাল থাকা একটা টানা সুরের মতন’। কারও কাছে, ‘কাছে থাকলেই ভাল থাকি’। তবে এমন অটোলিপিও পাওয়া গেছে, সংখ্যায় কম হলেও যেখানে ভাল থাকার দুটি মাত্রাই এসেছে একই বন্ধনীতে, যথা-
ক. ‘অল্প ভালোয় অসুখী, বেশি ভালোয় অশান্তি।’ (কাটোয়া, ২০০৩)
খ. ‘ভালো যখন কম তখন বৌ আমার যম / ভালো যখন বেশী তখন বৌ-ই পুর্ণশশী’ (শান্তিপুর, ১৯৯৬)। এই সাংসারিক ভাল থাকার সঙ্গে অর্থের যোগানের কম-বেশির সম্পর্ক প্রত্যক্ষ এবং ব্যস্তানুপাতিক।
গ. ‘অল্প প্রেমে সময় নষ্ট গভীর প্রেমে বুকে কষ্ট’।
ঘ. ‘Less Money Less Happy, Hevy, Money Hevy Happy’ (কন্যাকুমারিকা, ২০১৭)। (Handwriting)

যৌথ ভাল থাকায় যতই আমরা টেকনিক্যালি সাউন্ড হই না কেন, অপরের শুভেচ্ছা ও ভালবাসা তাকে আরও নিষ্কন্টক ও সুবিন্যস্ত করে। পরিচিত অপরিজনকে ভাল থাকার আশীর্বাদ, শুভেচ্ছা কামনা করে জানানো আর্শীবাণীগুলোও চমকপ্রদ। সাড়ে তিন দশকের বাহনলিপির ব্যক্তিগত সংগ্রহের ঝোলা থেকে সেরকম কিছু এক ঝলকে –
১. ‘তোরা ভালো থাকিস’
২. ‘দুজনাই ভালো আছিস ভালো থাক’। (চন্দননগর, ২০০৮)।
৩. ‘Be Happy Both of You’। (যোধপুর, ২০১০)
৪. ‘Always Be Happy U & Ur Partner’, (আমেদাবাদ, ১৯৯৭),
৫. Wish His & Her Be Happy for Ever’, (আসানসোল, ১৯৯৯)।
৬. ‘গোটা পরিবারের আশীর্বাদ তোরা দুজনে ভালো থাক’ (চেন্নাই, ২০০৭)। মূল লিপিটি ছিল তামিলে। অনুবাদ করে দিয়েছিলেন এম. কারিয়াপ্পান (পথচারী)।
৭. ‘বাবা-মা দাদু-দিদার আশীর্বাদ তোরা দুইজনা সুখে থাক’ (কাঁথি, ২০০৯)।
৮. ‘চোদ্দ গুষ্টির আশীর্বাদে আমরা দু’জনে বেঁচে আছি’। (বাঘাযতীন, ১৯৯৩)। (Handwriting)
এই বলার মধ্যে ব্যঙ্গ, ক্ষোভ-রাগ, বক্রোক্তির মিশেল রয়েছে। এটা একটা নৈর্ব্যক্তিক ও সংক্ষিপ্ত সংস্করণও পেয়েছি অতি সম্প্রতি (১৫-০১-২০২৫) – ‘১৪ গুষ্টির আশীর্বাদ’। অটোলিপির দর্পনে যৌথতার এই যে বর্ণময় বিচ্ছুরণ জনসংস্কৃতি ও লোকসংস্কৃতি চর্চায় বিশেষত কৌমের চরিত্র অনুধাবনে অতীব গুরুত্বপূর্ণ। সমাজমাধ্যম ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু মানুষের মধ্যে যে এক রকমের সাইকোলজিক্যাল ডিজঅর্ডার ইতিমধ্যেই শিকড় গেঁড়েছে, তারা বাহন সংস্কৃতির এই বিশেষ জঁ-র লিপিকে খোঁজার ও সংরক্ষণের কথা ভাবতে পারেন। আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্সের নজরে পড়েনি বিষয়টা এটাই বাঁচোয়া। এখনও এই ধারার সৃষ্টিতে পাবেন মাটির গন্ধ, আম আদমির ভাবনার নাগাল, আন্তরিকতার ছোঁয়া। সর্বোপরি, কোনওরকম ভাল পাঠ, ভাল দেখা, ভাল লাগা, ভাল থাকা ও অন্যকে ভাল রাখার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াহীন নির্ভেজাল রভসানন্দানুভূতি। (Handwriting)
প্রায় দু’দশক আগের কথা, তখন ‘সালন’ কথাটার সবে চল শুরু হয়েছে, চুল-শিল্পী হাবিবের বিপনি খুলেছে নগর কলকাতায়। সেই সময় গড়িয়ায় একটা ইউনিসেক্স সেলুন চালু হয়। তার নাম ছিল ‘তুমি আর আমি’, সেখানে চুল কেটে বেরোনোর সময় ধূমপায়ী পুরুষ খদ্দেরকে দেওয়া হত একটা দেশলাই। যার একদিকে লেখা ‘তুমি’ আর, অন্যদিকে লেখা থাকত ‘আমি’, অধূমপায়ী পুরুষদের জন্য ছিল ‘তুমি আর আমি’ লেখা একটা ডট পেন।
দাঁড়ি টানার আগে একটা মজার ঘটনার কথা বলি। প্রায় দু’দশক আগের কথা, তখন ‘সালন’ কথাটার সবে চল শুরু হয়েছে, চুল-শিল্পী হাবিবের বিপনি খুলেছে নগর কলকাতায়। সেই সময় গড়িয়ায় একটা ইউনিসেক্স সেলুন চালু হয়। তার নাম ছিল ‘তুমি আর আমি’, সেখানে চুল কেটে বেরোনোর সময় ধূমপায়ী পুরুষ খদ্দেরকে দেওয়া হত একটা দেশলাই। যার একদিকে লেখা ‘তুমি’ আর, অন্যদিকে লেখা থাকত ‘আমি’, অধূমপায়ী পুরুষদের জন্য ছিল ‘তুমি আর আমি’ লেখা একটা ডট পেন। এবং মহিলাদের জন্য বরাদ্দ ছিল একটা চুলের ক্লিপ যার গায়ে লেখা থাকত সংশ্লিষ্ট পরিষেবা প্রদানকারী দোকানের নাম। প্রসঙ্গত দোকানটি এক বছরও চলেনি। ৮/৯ মাস চলার পরেই ঝাঁপ ফেলে। (Handwriting)
পূর্বোক্ত সেলুনের প্রসঙ্গ অবতারনার একটা কারণ আছে। সেটি হল, এই লেখার একেবারে শুরুতেই বলা অটোলিপিটির উৎস এই সেলুন-নাম! ভাবছেন আমি জানলাম কীভাবে? কারণ সেলুনটির অবস্থান গড়িয়ায় আর অটোলিপিটি দেখেছিলাম বেহালা চৌরাস্তা থেকে একটু এগিয়ে তারাতলার দিকে যেতে। (Handwriting)
আসলে সেলুনটির নাম-এর প্রতি আকর্ষণবশত সেখানে কর্মরত মানুষের সঙ্গে আলাপ করতে যাই। সেখানেই কথায় কথায় ‘হেয়ায় আর্টিস্ট’ (হ্যাঁ, ঠিক এই টার্মটাই শুনেছিলাম) রাজু থাপা জানান, তাঁদের ঝাঁ চকচকে এসি সেলুন এবং নামের জন্য দাড়ি কামাতে আসেন এক ফ্লোটিং কাস্টমার, বেহালার বাসিন্দা। যাওয়ার সময় তিনি আবারও আসবেন জানিয়ে এও বলেছিলেন যে তাঁর অটোর পিছনে ‘তুমি আর আমি’ লেখানোর ব্যবস্থা করবেন। এতটাই সরল এবং হৃদয়গ্রাহী নাম! (Handwriting)
ছবি: লেখকের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে
প্রাবন্ধিক-গবেষক, গৌতমকুমার দে পেশাগতভাবে এলআইসি-র বীমা পরামর্শদাতা ও বিক্রয় প্রতিনিধি। স্প্যানিশ পড়িয়েছেন একাধিক কলেজে।
মেতে থাকেন ফিলাটেলি, ফিলুমেনি, মুদ্রা, নোটাফিলি, স্ল্যাং, বুকমার্ক, মেনুকার্ড, ট্রেকিং, বই, পত্রিকার জন্মসংখ্যা ইত্যাদি নিয়ে। প্রকাশিত বই: বাহনলিপি, সেকেলে গপ্পো, ভ্রমণ: নানা রূপে দেখা ইত্যাদি।