সাতের দশকের মাঝামাঝি।
অবসর নিলেও বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রকে মাঝে মাঝে যেতে হয় আকাশবাণী ভবনে।
কখনও ‘মহাভারত কথা’ বলতে, কখনও বা নাট্য প্রযোজনার কাজে।
এক বার হল অঘটন। সাধারণ ধুতি-পাঞ্জাবি-চাদর পরা মানুষটিকে চিনতে না পেরে নিরাপত্তারক্ষী জানালেন, ‘বিনা পাসে প্রবেশ নিষেধ।’
রাগে কাঁপতে কাঁপতে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বললেন, ‘আমি রেডিয়োর জন্ম দিয়েছি। আমার কাছে পাস দেখতে চাইছ?’

বিন্দুমাত্র ভুল বলেননি বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। রেডিয়োয় এমন কোনও বিভাগ ছিল না যেখানে পাঁচ দশক কাটিয়ে আসা মানুষটি তাঁর চিন্তাশীল মন আর উদ্ভাবনী শক্তির পরিচয় রেখে যাননি। অনুষ্ঠানের ঘোষণা থেকে বেতারনাটক প্রযোজনা হয়ে ‘মহিলা মজলিস’ পরিচালনা। রবীন্দ্রনাথ ও বিধানচন্দ্র রায়ের শেষ যাত্রা থেকে দশমীতে দুর্গাপ্রতিমা নিরঞ্জনের ধারাবিবরণী। এ ছাড়াও আবৃত্তি, পিয়ানোবাদন… সোনা ফলিয়েছেন সর্বত্র । টুপিতে সেরা পালক অবশ্যই ‘আশ্বিনের শারদপ্রাতে’, মহালয়াতে ‘মহিষাসুরমর্দিনী’, যার গ্রন্থনাকে তিনি বলতেন ‘এ আমার পাঠ নয়, পূজা।’ শুধু সে কথা মনে রেখে গত বছরই নির্মিত হয় দুটি বাংলা কাহিনিচিত্র, ‘মহালয়া’ ও ‘বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র’।
শুধু কী তাই? আকাশবাণীর বহু নতুন চাকুরে মুখিয়ে থাকতেন বেতারের এই প্রবাদপ্রতিম ব্যক্তিত্বের সঙ্গে একবার দেখা করার জন্য। এমনই দু’জনের সঙ্গে কথা হল সম্প্রতি। তিন দশকেরও বেশি সময় জনপ্রিয় প্রভাতী অনুষ্ঠান ‘প্রাত্যহিকী’র উপস্থাপক ছিলেন দেবাশিস বসু। তিনি বললেন, ‘১৯৭৯ সালে আকাশবাণীতে আসি। এর কিছুদিন পর তাঁর সঙ্গে দেখা। প্রণাম করতেই বললেন, ‘জানো বাবা, এক সময় এই রেডিয়োর জন্য অনেক কষ্ট করেছি। তোমরা একে বাঁচিয়ে রেখ।’ এই কথা আমার কাছে আজও প্রভুর বাণী।’

১৯৯১ সালে আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রে আসার পর বন্দনা মুখোপাধ্যায় এক বার বিশিষ্ট বাচিক শিল্পী পার্থ ঘোষকে অনুরোধ করেন, ‘একবার বীরেনদার বাড়ি নিয়ে যাবেন?’ উত্তর কলকাতার শ্যামপুকুর এলাকায় তাঁর বাড়িতে সাক্ষাতের পর অশীতিপর বৃদ্ধ বন্দনাকে বলেন, ‘আমার আসল সময়ে এলে না, এখন দেখতে এসেছ!’ সেই বছরেরই শেষ দিকে ৮৬ বছর বয়সে প্রয়াত হন তিনি। তবে আকাশবাণীর প্রাক্তন চিফ প্রোডিউসার বন্দনার সান্ত্বনা, ‘রেডিয়োতে বলার ভাষা যিনি আলাদা করে শিখিয়েছেন, তাঁকে দেখতে পাওয়া কী কম কথা? ওঁর ‘বিরূপাক্ষের দপ্তর’ রেডিয়োর ইতিহাসে তো একটি মাইলফলক।’
একটা ঘটনার কথা বলি। ১৯৭৭ সালের ২৬ অগস্ট। ভারতে বেতারের সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে রবীন্দ্রসদনে সে দিনের অনুষ্ঠানে উপস্থিত তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু এবং কেন্দ্রীয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী লালকৃষ্ণ আডবানি। প্রেক্ষাগৃহে রয়েছেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্র, পঙ্কজকুমার মল্লিক, রাইচাঁদ বড়াল, তিমিরবরণের মতো কিংবদন্তিরা। সবাইকে আশ্বস্ত করে আডবানি বললেন, ‘এ বারের মহালয়ায় রেডিয়োতে পুরোনো ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ই সম্প্রচার করা হবে।’ না করে উপায়ও ছিল না। কারণ আগের বছরের ওই দিন নতুন আঙ্গিকে মহালয়ার অনুষ্ঠান প্রচার করতে গিয়ে মুখ পুড়েছিল আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের। এই প্রসঙ্গে ওই অনুষ্ঠানের প্রধান কুশীলব উত্তমকুমারের একটি উক্তি আজও অমর। ‘ঠাকুরঘরকে রেনোভেট করে ড্রয়িং-রুম বানালে যা হয়, তাই হয়েছে।’

ফিরে যাই সুবর্ণজয়ন্তীর সেই অনুষ্ঠানে। সেখানে কলকাতা বেতারের ইতিহাস নিয়ে একটি কুড়ি মিনিটের অডিও-ভিসুয়াল ছিল। সেটির দিকে এক বারও না তাকিয়ে সম্পূর্ণ স্মৃতি থেকে শ্রোতাদের অজস্র মণিমুক্তো বিলিয়ে দেন উপস্থাপক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। শোনা যায়, বেতারে ‘মহাভারত কথা’ বলার সময়ও তাঁর সামনে কোনও কাগজ থাকত না।
ইউটিউবে ছড়িয়ে আছে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের পাঠ, আবৃত্তি, ধারাবিবরণীর কিছু নমুনা। সব ক’টিরই গুরুত্ব ঐতিহাসিক। তার মধ্যে একটি তুলে ধরা যাক। সে দিন প্রথম স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের আনন্দে মেতে উঠেছে কলকাতাবাসী। তখন নেপথ্যভাষণে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ বলছেন, ‘আজ ১৫ অগস্ট, ১৯৪৭। …ভারতবর্ষের বহু প্রতীক্ষিত এই স্বাধীনতা উৎসবের বার্তা বহন করে নিয়ে চলেছে পথে পথে প্রভাতফেরির দল। … জাগে না আজ কে? … জনতার কাছে আজ লাটপ্রাসাদের আভিজাত্য তুচ্ছ হয়ে গেছে। শাসন পরিষদের গৃহে উড়ছে জাতীয় পতাকা।’
আকাশবাণী কলকাতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে ‘বেতার জগৎ’ পত্রিকা। এখানে অনুষ্ঠানলিপি ছাড়াও থাকত গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস। ‘বেতার জগৎ’কে জনপ্রিয় করতে সম্পাদক নলিনীকান্ত সরকারের সঙ্গে কাঁধ মিলিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণও সেই পত্রিকা ফেরি করতেন ধর্মতলা ও ডালহৌসি এলাকায় দিনের পর দিন। সেই পত্রিকা আজ আর নেই।
বেতারনাটকের ক্ষেত্রেও পথিকৃৎ সেই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। গোড়ার দিকে মঞ্চের নাটকই সরাসরি প্রচার করা হত রেডিয়োতে। কিন্তু এর সময়সীমা অনেক সময় তিন-চার ঘণ্টা হয়ে যাওয়ায় রেডিয়োর কর্তারা স্বল্প সময়ের জন্য বেতারের নিজস্ব নাটক প্রযোজনার কথা ভাবেন। এই কাজে এগিয়ে আসেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। প্রথম দিকের নাটকগুলি হত বেতার নাটুকে দল এবং এআইআর প্লেয়ার্স-এর ব্যানারে। পরে এগুলি আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্রের নিজস্ব প্রযোজনার আওতায় চলে আসে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণ প্রযোজিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলির মধ্যে রয়েছে ‘সাজাহান’, ‘কত অজানারে’, ‘তটিনীর বিচার’, ‘সিরাজদ্দৌল্লা’, ‘আলিবাবা’, ‘চিত্ত চকোর’ ও ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি।’ সেখানে শামিল হয়েছেন অহীন্দ্র চৌধুরী, ছবি বিশ্বাস, সরযূবালা দেবী, সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়ের মতো তারকারা। শোনা যায়, শুক্রবার রাতের বেতারনাটকের জনপ্রিয়তার কারণে হাতিবাগানের থিয়েটার মালিকরা শনি ও রবি ছাড়া থিয়েটারের বাকি দিনটি বৃহস্পতিবারে এগিয়ে আনতে বাধ্য হন।

নাটক নিয়ে বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কিছু গল্প এ বার পাঠকদের সঙ্গে ভাগ করে নিই। তাতে তাঁর চারিত্রিক দৃঢ়তার কিছুটা আভাস পাওয়া যাবে।
পাঁচের দশকের শেষ দিকের কথা। বেতার নাট্য উৎসবে মনোজ মিত্রের ‘মৃত্যুর চোখে জল’ নাটকে বিস্তর কাটছাঁট হয়েছে, এই অভিযোগ নিয়ে মনোজ ও তাঁর বন্ধুরা হাজির হলেন রেডিয়ো স্টেশনে। তাঁদের মুখোমুখি হয়ে নাট্য প্রযোজক বীরেন্দ্রকৃষ্ণ সোজাসাপটা বলে দিলেন, ‘রেডিয়োতে আমরা কাটাছেঁড়া করবই। আমরা রবীন্দ্রনাথ-শরৎচন্দ্রকেও কাটি।’ কথায় কথায় দেবাশিস জানালেন, লাইভ নাটক যাতে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ করা যায় তার জন্য স্টুডিয়োতে বসেই সম্পাদনা করার বিরল ক্ষমতা ছিল বীরেন্দ্রকৃষ্ণের। এমনই এক দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় ‘কলকাতা বেতার’-এর একটি নিবন্ধে। বঙ্কিমচন্দ্রের জন্মদিনে সম্প্রচারিত হচ্ছে নাটক ‘সীতারাম।’ হাতে মাত্র দশ মিনিট সময় দেখে বীরেন্দ্রকৃষ্ণ, অভিনেতা শেখর চট্টোপাধ্যায় ও তাঁর এক সহশিল্পীর মুখ চেপে ধরে পাঁচটি পাতা ডিঙিয়ে বলে দিলেন কোথা থেকে আবার পড়তে হবে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের নির্ভুল আন্দাজের ফলে নাটক ঠিক সময়েই শেষ হয়েছিল।
‘প্রহারেণ ধনঞ্জয়’, ‘জীবনবিমা’, ‘জগদম্বা’র মতো সফল বেতারনাটক লেখার পাশাপাশি রেডিয়োতে তাঁর আর এক অবদান ‘বিরূপাক্ষের দপ্তর।’ এখানে সমাজের নানা ওঠাপড়া, ভুলভ্রান্তিকে তির্যক দৃষ্টিতে মূল্যায়ন করতেন বীরেন্দ্রকৃষ্ণ। এই সিরিজে উল্লেখযোগ্য গল্পগুলির মধ্যে রয়েছে ‘ব্ল্যাক আউট’, ‘ঝকমারি জীবনের রকমারি কথা’ এবং ‘গারস্টিন প্লেসের সাহেব ভূত।’ আশার কথা, বইপাড়ার এক প্রকাশক ‘বিরূপাক্ষ রচনাসমগ্র’ বার করায় তাঁকে নিয়ে পাঠক মনেও নতুন করে আগ্রহ তৈরি হয়েছে।
শেষ করি একটি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা দিয়ে। বীরেন্দ্রকৃষ্ণের ক্যাসেট-সিডি-রেকর্ড আজ বাজারে দুর্লভ। বহুদিন আগে করা বাংলার মনীষীদের নিয়ে ‘স্বাধীন ভারত’ এবং ভি বালসারার সঙ্গে যৌথ ভাবে করা ‘দেবতার গ্রাস’ এখনও পাওয়া যায় ইউটিউবে। কিন্তু সাতের দশকে, আমার জন্মভিটে বিহারের মোতিহারিতে গ্রামোফোন রেকর্ডে শোনা বীরেন্দ্রকৃষ্ণের কণ্ঠে গান্ধীজির জীবনকাহিনি আজও ভুলতে পারি না। বিশেষ করে যেখানে পূর্ব পাকিস্তানের নোয়াখালিতে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পর বীরেন্দ্রকৃষ্ণের আকুল করা ‘নোয়াখালি গান্ধীজিকে ডাকে’র সঙ্গে মিলে যায় শরৎ সকালে শোনা ‘জাগো, জাগো মা’র সুর।
দু’দশক ইংরেজি সংবাদপত্রের কর্তার টেবিলে কাটিয়ে কলমচির শখ হল বাংলায় লেখালেখি করার। তাঁকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন কয়েকজন ডাকসাইটে সাংবাদিক। লেখার বাইরে সময় কাটে বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতটাও নেহাত মন্দ গান না।