আগের পর্ব পড়তে:
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ১
সুরসম্রাজ্ঞী পর্ব ২
১৯২৯ সালে ২৮ সেপ্টেম্বর, শনিবার রাত দশটা তিরিশ মিনিটে ইন্দোরে দীননাথ-সুদ্ধামতির প্রথম সন্তানের জন্ম। দীননাথের প্রথম সন্তানের নাম রাখা হয়েছিল লতা। সে সময় দীননাথের একটি জনপ্রিয় নাটক অভিনয় হত যার নাম ‘ভাববন্ধন’। সে নাটকের নায়িকার নাম ছিল লতিকা। স্বয়ং দীননাথ নাটকে লতিকার ভূমিকায় অভিনয় করতেন। সেই নামেই দীননাথের প্রথম সন্তানের নামকরণ হয়েছিল ‘লতা’। দুঃখের বিষয় সেই শিশুকন্যাটি মারা যায় মাত্র ন’মাস বয়সে। তাই সুদ্ধামতি ফের সন্তানসম্ভবা হলে দীননাথ বলেছিলেন, সন্তানের নাম রাখা হবে আগের মেয়েটির নামেই। যদি পুত্রসন্তান হয়, তার নাম হবে ‘হৃদয়’, কন্যাসন্তান হলে ‘লতা’। শেষ পর্যন্ত তেমনই হয়েছিল। জ্যেষ্ঠা কন্যার নাম লতা এবং একমাত্র পুত্রের নাম হৃদয়নাথ।
পরিবারের তরফ থেকে প্রথমে নবজাতকের নাম রাখা হয়েছিল ‘হেমা’। তবে সবার মুখে মুখে লতা নামটি প্রতিষ্ঠা পেয়ে যায়, হারিয়ে যায় আদি নাম হেমা। ‘এই মেয়ে বিধাতার অকৃপণ আশীর্বাদ নিয়ে জন্মেছে। এ এক দিন খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছবে।’– জন্মের পরে লতার কোষ্ঠীবিচার করে এমনই কথা বলেছিলেন দীননাথ মঙ্গেশকর। বলেছিলেন বটে, কিন্তু তাঁর সেই কন্যা লতা মঙ্গেশকর যেখানে পৌঁছলেন, এতদূর বোধ হয় তাঁর কল্পনাতেও ছিল না। দীননাথের পুত্রকন্যারা সঙ্গীতের পূজারী হবেন এটা নির্ধারিত হলেও তাঁর দুই কন্যা যে এভাবে ইতিহাস গড়বেন, প্লে-ব্যাক সঙ্গীতের অল টাইম গ্রেট সাধিকা, চার দশকের শাসক হয়ে উঠবেন, এতদূর ভাবা সেদিন কারও পক্ষেই সম্ভব ছিল না।

লতা মঙ্গেশকরের প্রথম স্মৃতিতে ছিল তাঁর ঠাকুমার বাড়ির কথা। ছোট্ট সেই শহরটার নাম থালনার। সেখানে গেলেই দেখতে পেতেন তাঁর ঠাকুমা আপনমনে গান গাইছেন। তাঁর একটা পুজোর ঘর ছিল। সন্ধেবেলায় সেখানে বাড়ির সবাই জড়ো হত। ঠাকুমা হারমোনিয়াম বাজিয়ে ভক্তিমূলক গান গাইতেন, সঙ্গে হত আরতি। তাছাড়া রাতে শিশু লতাকে ঘুম পাড়ানোর জন্য গান গাইতে গাইতে সেই গানের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা নানা গল্প শোনাতেন। কখনও রান্না করতে করতে, কখনও বা স্নান করানোর সময় গান গাইতেন। লতা ডুবে যেতেন ভক্তিগীতি ও লোকসুরের সাগরে। এক সাক্ষাৎকারে লতা মঙ্গেশকর স্মৃতি খুঁড়ে সুদূর অতীত থেকে তুলে এনেছিলেন গানের সঙ্গে তাঁর প্রথম আত্মীয়তার ছবি।
লতার যখন ছ’মাস বয়স, তখন বাবার বাজানো সারেঙ্গি শুনে আধো আধো সুরে তার প্রতিধ্বনি তুলে দীননাথকে অবাক করে দিয়েছিলেন ছোট্ট শিশুটি। শিশুকন্যাকে কোলে বসিয়ে দীননাথ গান গাইতেন, এবং বাবা-মেয়ের এই খেলা চলত মাঝে মাঝেই। দীননাথ মঙ্গেশকর মেয়ের অসাধারণ সুরবোধ এবং স্মরণশক্তির পরিচয় পেয়েছিলেন। এভাবেই খেলতে খেলতে সুরের জগতে জড়িয়ে যান লতা। দীননাথ মঙ্গেশকর নাটকের দল নিয়ে মাঝেমধ্যেই নানা শহরে যেতেন। চার বছর বয়স থেকে লতা সে দলের সদস্য। একবার বাবার নাটকের দলের সঙ্গে ইন্দোরে গিয়েছিলেন লতা। সেখানকার রাজবাড়িতে এক ওস্তাদের সানাই শুনে, হুবহু সেই সুর গুনগুনিয়ে স্তম্ভিত করে দিয়েছিলেন চার বছরের লতা।

লতা মঙ্গেশকর, শৈশবেই মজেছিলেন সায়গলের গানের প্রেমে। ছ’বছর বয়সে পরিবারের বড়দের সঙ্গে ‘চণ্ডীদাস’ ফিল্ম দেখতে গিয়েছিলেন লতা। ছবির শেষে বায়না ধরেছিলেন– ‘আমি ওই লোকটাকে বিয়ে করব।’ ওই লোকটি ছিলেন ‘চণ্ডীদাস’ ছবির নায়ক-গায়ক কে এল সায়গল। বায়না ক্রমশ কান্নাকাটিতে পৌঁছলে, কোনওমতে তাঁকে বাড়ি নিয়ে আসা হয়। বোঝানো হয়েছিল, এখনও তাঁর বিয়ের বয়স হয়নি। তখন লতা ঘোষণা করেন, ‘বড় হয়ে আমি সায়গলকে বিয়ে করব।’ এই ঘটনা লতার আজীবন মনে ছিল। লতা জীবনে বিয়ে করেননি। সায়গলের সঙ্গে তাঁর দেখাও হয়নি। কিন্তু সায়গলের গান লতার বেড়ে ওঠার পিছনে অন্যতম প্রেরণা হিসেবে কাজ করেছে। লতার জীবনে প্রথম আদর্শ যদি হন দীননাথ, দ্বিতীয়জন অবশ্যই সায়গল।
তবে দীননাথ মঙ্গেশকর একেবারেই পছন্দ করতেন না সিনেমার প্রতি ছেলেমেয়েদের আকর্ষণ। অধিকাংশ সিনেমা রুচির বিকৃতি ঘটায়, এমন ধারণায় দীননাথ নিজের সন্তানদের সিনেমা থেকে দূরত্বে রাখবার ব্যাপারে সতর্ক ছিলেন। তাঁর বড় কন্যা যে সুরের আকাশে জ্যোতিষ্ক হয়ে বিরাজ করবে এটা তিনি ঠিকই বুঝেছিলেন, কিন্তু সেই আকাশটা যে ফিল্মের গান হবে, তা টের পাননি। বায়োস্কোপ নানাভাবে লতাকে জড়িয়েছে– অভিনেত্রী, গায়িকা, সঙ্গীত পরিচালক, প্রযোজক।
[১৯৩৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সায়গলের বিখ্যাত ছবি চণ্ডীদাস, যা দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন ছোট্ট লতা মঙ্গেশকর]
বাবা না চাইলেও মেয়ের সঙ্গে সিনেমার যোগসূত্র সেই ছেলেবেলা থেকেই। দীননাথ নাটকের দল নিয়ে বাইরে গেলে কন্যারা মাঝে মধ্যে রূপোলি পর্দার উত্তেজনার স্বাদ নিতেন। শুধু সিনেমা দেখার আনন্দতেই সীমাবদ্ধ থাকত না মঙ্গেশকর কন্যাদের আগ্রহ। লতা–মীনা–আশা, এই তিন বোনের বিনোদন বা ইন্ডোর অ্যাক্টিভিটি ছিল বাড়ি ফিরে সিনেমার পছন্দসই দৃশ্যের রিমেক। লতার নিজের কথায়:
— মনে পড়ে যায় মারাঠি ছবি ‘সন্ত তুকারাম’ দেখে বাড়ি ফেরার পরের অ্যাডভেঞ্চার। ছবিটায় একটি গানের দৃশ্য ছিল, যেখানে দেখানো হয়েছিল বীজ পোঁতার পর গাছের শীষ বেরনো থেকে প্রথম পাতা, মুকুল থেকে শস্য ভরা গাছের পরিণত পর্যায়। বাড়িতে সেই দৃশ্যটা অভিনয়ের খেলা শুরু করতাম আমরা তিন বোন। আমি ধরতাম গান। মীনা আর আশা প্রথমে শস্যের বীজ হয়ে মেঝেতে শুয়ে পড়ত তারপর চারা হয়ে একটু একটু করে মাথা তুলে বসত। ধীরে ধীরে দাঁড়িয়ে ওরা গাছ হয়ে যেত আর হাত নাড়িয়ে গাছের ডগা হয়ে দুলতে থাকত হাওয়ায়। যতক্ষণ ওরা এই অঙ্গাভিনয় করত আমি গানটা চালিয়ে যেতাম।

— ওই ছবির আর একটা দৃশ্য আমরা বাড়িতে করবার চেষ্টা করতাম, সেটি সন্ত তুকারামের মৃত্যুর দৃশ্য। ঘরের কোনায় তোষকের স্তূপ করে তার ওপর খানকতক বালিশ চাপিয়ে একটা উঁচু জায়গা তৈরি করা হত এবং আমি সাদা শাড়ি পরে সেখানে আশীর্বাদ করবার ভঙ্গিতে চোখ বুজে দাঁড়াতাম। মেঝেতে মীনা আর আশা কান্নাকাটি করে চলত– এভাবেই খেলাটা খেলতাম আমরা। আমরা সিনেমার সংলাপের সঙ্গে নিজেদের মনের মতো ডায়ালগ তৈরি করে খেলাটা চালিয়ে যেতাম। কোনও দৃশ্যে তিনজনের বেশি চরিত্র থাকলে আমরা খুড়তুতো ভাই পানঢারীনাথ কোলহাপুরেকে দলে নিতাম।

— কোনও রূপকথার দৃশ্য নিয়ে খেলা চললে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ছোট আশা সাজত রাজকুমারী। মীনার চরিত্র হত কুচক্রী দুষ্টু রানির। আমি অবতীর্ণ হতাম ত্রাতার ভূমিকায়, যে রানিকে হত্যা করে রাজকন্যাকে উদ্ধার করবে। রাজা আর খলনায়ক– দুটো চরিত্রই করত পানঢারীনাথ। যখন সে চুলটা বাঁ দিকে আঁচড়ে নিত তখন সে ভিলেন, আবার চুল ডান দিকে আঁচড়ে নিয়ে সেই হয়ে যেত রাজা। এই সব ঘরোয়া নাটকে প্রচুর গান হত, যার বেশিরভাগই বাবার গাওয়া নাটকের গান। গান গাওয়ার একটা উপলক্ষ চাই বলেই আমরা এসব করতাম। যেমন নতুন কোনও গান তুললে সেটা শোনাবার ছটফটানি থাকত। দুই বোনকে সামনে বসিয়ে কানে আঙুল ঢুকিয়ে গ্রামোফোনে দম দিতাম এবং অন্য হাত দিয়ে পিনের হ্যান্ডেল তুলে নেওয়ার ঢঙে নিজের মাথাটাকে রেকর্ড বানিয়ে তার ওপর বসিয়ে দিতাম আঙুল, সেই সঙ্গে শুরু করে দিতাম গান।
–এ সমস্ত কাণ্ডকারখানা হত যখন বাবা বাড়িতে থাকতেন না। আরও কত রকমের যে দুষ্টুমি করেছি আমরা ছেলেবেলায় সে সব ভাবলে হাসি পায়। কম বয়সে আমরা গাছে উঠে পেয়ারাও পেড়েছি। ছোট ভাই হৃদয়নাথ এ সবে ছিল না কোনওদিনই। ছেলেবেলা থেকেই ওর পায়ে একটা সমস্যা ছিল। এ জন্য ও একা একাই গান গাইত। মাঝে মাঝে বই নিয়ে বসে পড়ত। এ সব দুষ্টুমির জন্য নালিশ করলে বাবা শাসন করতেন। বাবা ডাকলেই আমরা সবাই কেঁদে ফেলতাম। বাবা মারতেন না কখনও, তবে মা মাঝেমধ্যে কিল চড় দিতেন। মায়ের মারে তেমন জোর না থাকলেও হাতের ভারী বালাটা লেগে গেলে বেশ ব্যাথা পেতাম।’ (চলবে)
পরবর্তী পর্ব প্রকাশিত হবে ৫ এপ্রিল ২০২২
ছবি সৌজন্য: Pinterest, Starsunfolded
বিশিষ্ট গ্রামোফোন রেকর্ড সংগ্রাহক সঞ্জয় সেনগুপ্ত, গান বাজনা-র জগতে এক বিস্ময়কর নাম। কলকাতায় জন্ম হলেও ছেলেবেলা কেটেছে ওড়িশায়। দীর্ঘদিন এইচ.এম.ভি-র মতো ঐতিহ্যশালী সাঙ্গীতিক প্রতিষ্ঠানে কাজ করেছেন কৃতিত্বের সঙ্গে। তাঁর অনবদ্য কর্মকাণ্ড ছড়িয়ে আছে প্রায় ১২০০ বই ও পত্র-পত্রিকায়, দেশ বিদেশ জুড়ে। সঙ্গীত ছাড়াও আগ্রহ নানা বিষয়ে। খেলাধূলা, মূলত ক্রিকেট ও সিনেমা সংক্রান্ত লেখায় তাঁর পান্ডিত্য ঈর্ষণীয়।
2 Responses
তিনটে পর্ব পড়ে খুবই ভাল লাগল। অনেক কিছু জানতে পারলাম ও সম্বৃদ্ধ হলাম!
“In search of Lata Mangeshkar” by Harish Bhimani r “Amar Malatilata ” (Harishjir boi theke bangla kora) by Atanu Chakraborty porar anurodh kori sabaike.