কম বয়সে অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে হিমালয়ে। কখনও বুঝে আবার কখনও না বুঝে হুজুগকে আশ্রয় করে। তখন ভরসা ছিল লোকাল রুটের গাড়ি, তাতেই সওয়ার হয়ে কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াতাম। অনেকটা সময় নিয়ে বেরোতাম, তা সে পনেরো দিন –কুড়ি দিন বা একমাসও হয়ে যেত। সব যে দেখা হত তা নয়, গাড়ি ঘোড়ার অভাবে অনেক বাকি থেকে যেত। প্যান্টের চোরা পকেটে কিছু বড় নোট পাকিয়ে রাখা থাকত,সামনের পকেটে কিছু খুচরো টাকা— তাও দিনের হিসাবে ছিল বড় কম। ব্যাগে থাকত ছাতু, চিঁড়ে আর নুন চিনি। বিশ্বের সব চেয়ে বড় ফার্স্ট ফুড। রাতে শোবার জন্য থাকত একটা পলিথিন শিট, একটা শতরঞ্চি আর একটা কম্বল। যেখানে খুশি শোবার জন্য রাজকীয় ব্যবস্থা।
বারবার মনে হত জীবনের শেষ বয়সে যখন হিমালয়ে আসব তখন অনেক টাকা নিয়ে এসে আরামে ঘুরব। শেষ বয়সের দিকে এসেছি, চোরা পকেটের টাকার চেয়ে অনেক বেশি টাকা জোগাড় করেছি, এটিএম কার্ড রাখতে শিখছি, ভালো হোটেলে থাকার ক্ষমতা অর্জন করেছি, কিন্তু দুটো জিনিস হারিয়ে ফেলেছি— এক হল সময়, কিছুতেই দশ থেকে বারো দিনের বেশি সময় বার করতে পারছি না, একমাস সময় তো দূর অস্ত। আর দুই হল শরীর, হাঁটু- কোমর মটমট করে জানান দেয়– হ্যাঁ রে পারব তো!
সাতপাঁচ সব ভেবে একটা ট্যুর কোম্পানি খুলে ফেললাম, নাম দিলাম অসমর্থ আরামভোগী টোটো কোম্পানি। সদস্য পদ নেওয়ার প্রাথমিক শর্ত হল হাঁটু খটখট করতে হবে। সদস্য হওয়ার সময় নি-ক্যাপটি দেখাতে হবে। কারণটা হল হাঁটার সময় কেউ কাউকে টপকে এগুতে পারবে না। আটান্ন, উনষাট, চৌষট্টি আর উনসত্তর এই চারজন সদস্য হল। বয়সের কারণে সকলের একটু ধম্মকম্ম করার ইচ্ছা, তাই সপ্তবদরি (Sapta Badari) যাওয়া সিদ্ধান্ত হল।

কলকাতা বইমেলায় ট্রাভেল রাইটার্স ফোরামের স্টলে আলাপ হয়েছিল সৌমিশ্রর সঙ্গে, প্রাণবন্ত ছেলে। হরিদ্বারে একটা ট্রাভেল এজেন্সি চালায়, নাম প্রচেষ্টা ট্যুরিজম। একটা কার্ড দিয়েছিল যদি কোনও প্রয়োজনে লাগে তাই। ফোনে পরিচয় দিতে চিনতে পারল। ওকে বললাম একটা আরামবাহন দিতে হবে, যাতে করে আমরা চারজন সপ্তবদরি ঘুরব।
— সব হয়ে যাবে দাদা, হরিদ্বার স্টেশনে নামুন, বাকি দায়িত্ব আমার।
— সমর্পণ তো কোথাও করতেই হয়, ওকে পুরো সমর্পণ করে বললাম— নাও নাও ঠাকুর হরিদ্বার থেকে হরিদ্বার অবধি সব দায়িত্ব তুমি নাও।
— ও একটু হকচকিয়ে বলল, আমায় ঠাকুর বলছেন!
— আরে, মানুষের মধ্যেই ঠাকুর থাকে। একটু ভাব আনার চেষ্টা করছি, এত ধরো কেন। পরে জেনেছি ও রামকৃষ্ণ মিশনের ছাত্র।
লক্ষ্মীপূজার পরদিন বাড়ি থেকে বেরিয়ে রাজধানী ধরে দিল্লি হয়ে পরেরদিন হরিদ্বার পৌঁছে গেলাম। রাতটা সেখানে কাটিয়ে পরের দিন সৌমিশ্রর ঠিক করে রাখা আরামবাহনে উঠলাম। গাড়ির নাম টাটা জেস্ট, এটি নাকি সুইফট ডিস্যায়ার-এর মতো। সে যাক গে,আমাদের বংশে কারুর গাড়ি ছিল না। মোটকথা, আমরা চারজনে আরামে বসেছি।
গাড়িটা স্বপনদার, নিজেই চালক, হৃষীকেশে বাড়ি, প্রবাসী বাঙালি। হৃষীকেশে জলখাবারের সময়ে স্বপনদাকে দুহাত পেতে দাঁড়াতে বলা হল, ওর দুহাতে আমরা চারজন দুহাত দিয়ে বললাম ‘তোমায় দিলাম এ ক’দিনের সব’। ও কম কথা বলে, বলল ‘নিলাম’। আর কিছু বলতে হয়নি।

দেবপ্রয়াগে গঙ্গার সঙ্গে অলকানন্দা ও মন্দাকিনীর মিলিত সঙ্গম। এলাহাবাদের পরেই এর স্থান। দেবপ্রয়াগে যেখান থেকে সবচেয়ে ভালো দেখা যায় আমরা সেখানে দাঁড়িয়ে। আগে বাসে করে হুস করে চলে গেছি, এবার আশ মিটিয়ে সবাই উপভোগ করছে, চোখগুলো তাই বলছে, ষাটের পর আবার ছোট হতে শুরু করে বেশ বুঝতে পারছি।
পাঁচজনের একটা পরিবার চলেছে। দুপুরে সবচেয়ে ভালো বেগুন ভর্তার দোকানে লাঞ্চ হয়েছে। বুঝইবিএ, এই পথের কোন দোকানের চা, শরবত, ডাল, ভাত, সবজি যেটা সবচেয়ে ভালো সেটাই জুটবে আমাদের।
রুদ্রপ্রয়াগে কালিকমলি ধরমশালার সামনে গাড়িটা দাঁড়িয়ে গেল। এই ধরমশালা এখন আর কালো কম্বল দেয় না, এখন একদম আধুনিক। স্বপনদা বলল— সামনেই রুদ্রনাথ শিবের মন্দির ও অলকানন্দা-মন্দাকিনীর সঙ্গম। অল্পতে সারুন, সব জানলে আর বুঝলে এখানে এক সপ্তাহ থাকতে হবে। বুঝলাম হিমালয় দেখেছি বলতে পারব, কিন্তু বুঝেছি বলতে পারব না।

গাড়ি কর্ণপ্রয়াগ হয়ে ডানদিকে রানিখেত যাওয়ার রাস্তা ধরল। উনিশ কিলোমিটার গিয়ে একটি গুচ্ছ মন্দির এলাকায় গাড়ি দাঁড়াল, এটি আদি বদরির মন্দির। ১৬টি মন্দির নিয়ে মন্দির এলাকা। তার মধ্যে সাতটি মন্দির গুপ্তযুগে তৈরি। অতীতে বদরিনাথ যখন দুর্গম ছিল তখন ভক্তরা এখানে পূজা দিতেন। অনিন্দ্যসুন্দর এই মূর্তির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন শঙ্করাচার্য। মোহিত হয়ে দেখছিলাম মন্দিরগুলো।
গাড়ি ফিরতি পথ ধরেছে। কতকগুলো চিন্তা মাথায় পাকদণ্ডির মতো ঘুরছে। শঙ্করাচার্য অষ্টম শতাব্দীর, গুপ্তযুগের মন্দির মানে চতুর্থ শতাব্দী, মানে চারশ বছর আগেও এই মন্দিরে পূজা হত। কোন দেবতার পূজা হত? চারশ বছর বাদে এসে শঙ্করাচার্য প্রতিষ্ঠা করলেন আদি বদরির। গুপ্তরাজারা তো বিষ্ণুর উপাসক ছিলেন। তাহলে বদরি মানে শঙ্করাচার্য, এমন ব্যাপার কি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল সেই সময়। যোশীমঠে শঙ্করাচার্য মঠ প্রতিষ্ঠা করে সমস্ত দেবদেবীর প্রতিষ্ঠার দখল নিলেন, ব্যাপারটা সেই রকম মনে হচ্ছে। আরকিওলজি ডিপার্টমেন্ট তো বলেছে গুপ্তযুগের সাতটি মন্দির। দূর! বেশি মাথা ঘামাব না, দিনকাল খারাপ, দেখতে এসেছি– দেখব, বাড়ি চলে যাব।
সবাই মিলে গান ধরলাম – মুসাফির হ্যায় ইঁয়ারো, না ঘর হ্যায়, না ঠিকানা …

বেশ হালকা লাগছে। কর্ণ এরকম একটা ফাটাফাটি জায়গায় তপস্যা করেছিলেন। তাই নাম কর্ণপ্রয়াগ। অলকানন্দার সাথে কর্ণগঙ্গার মিলন এখানেই। এরকম জায়গায় সঙ্গমের ধারে দোতলার বারান্দা দেওয়া ঘরে রাতের আশ্রয়। হাঁটু খটখটেদের আনন্দ আর দেখে কে!
পরের দিন যোশীমঠ হয়ে সোজা বদরিবিশাল। মাঝে নন্দপ্রয়াগ ও বিষ্ণুপ্রয়াগ দেখা হল অনেকটা সময় নিয়ে, সঙ্গে আরামবাহন আছে। আগে কিন্তু কখনও এমনভাবে দেখা হয়নি। চারধামের নামে এই রাস্তায় এত উন্নয়নের হুড়োহুড়ি যে হিমালয়টা বিপিএল তালিকায় চলে গেছে। চওড়া রাস্তার দুধারে শুধু কংক্রিটের জঙ্গল। যোশীমঠ এলে একটু হিমালয়ের স্বাদ পাওয়া যায়। যদিও শহর যোশীমঠ এখন জ্যাম-জটে অস্থির। কতদূর গেলে হিমালয় তোমায় পাওয়া যায়…

মে-জুন মাসের গঙ্গাসাগরীয় ভিড়টা এখন বদরিতে নেই। অনেক ফাঁকা, আকাশ-বাতাস সব ঝকঝকে, কদিন বাদেই কালীপুজো। ফাঁকা বদরিতে খুশির হাওয়া ফুরফুরে হয়ে বইছে। চারপাশের উন্নয়ন জানান দিচ্ছে দেবতার কাছে প্রার্থনা নয়, দেবতা এখন পরিচালিত ও শাসিত হচ্ছে। তাই তো দেবতার প্রাসাদে ঢুকে মানুষের এত কেরামতি।
মন্দির ফাঁকা, ভিতরে গিয়ে সাষ্টাঙ্গে প্রণাম করা গেল। বাইরে ষ্ট্যাম্প সাইজের মতো নীলকণ্ঠকে দেখা যাচ্ছে। বেশি করে দেখার বড় সাধ হয়, এ আশা বহুদিনের। মন্দিরের বাইরে এসে চা খাওয়ার সময় একটা বোর্ড নজরে এল, চরণপাদুকা সাড়ে তিন কিলোমিটার। একে অপরের দিকে চাইলাম, উনসত্তর বলল, নীক্যাপগুলো সবাই সাথে এনেছিস, চল ওদিকটায় হেঁটে আসি।
সামনের চড়াইটা সবাই টুক টুক করে ভেঙে এগিয়ে গেল। মাঝে মাঝে পাথরে হেলান দিয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে আবার এগুচ্ছে। চারিধার নিস্তব্ধ হয়ে আসছে, ধ্যানগম্ভীর এক হাওয়ার নিশ্বাসের শব্দ জীবনের এই লগ্নে এক নতুন রাগের জানান দিচ্ছে। চারিধারের সৌন্দর্য যে যার মতো উপভোগ করছে। সামনে নীলকণ্ঠ তার মাথা ও বুকের ওড়না সরিয়ে নিরাবরণ হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।

আমরা চারজন চরণপাদুকা মন্দিরের সামনে। সামনে রূপবান নীলকণ্ঠ, এখানে কোথাও তার হলাহলের চিহ্ন নেই। এখানে মাথা উঁচু হয় না, নিচু আপনা হতেই হয়ে যায়।
— এতটা পাব ভাবিনি রে, উজাড় করে তুমি দিলে নাথ, এ জীবনের এই আমার শেষ আসা – উনসত্তর কথাগুলো বলে মাথা নীচু করে ফেলল। শেষ আসা শব্দটায় অনুরণন হল। চৌষট্টি উনসত্তরের হাতটা ধরে আছে, আটান্ন আর উনষাট ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে। নাটকের একটা অঙ্ক শেষ হওয়ার পরে নাটকের চারটি চরিত্র যেন, স্টেজের কমে আসা আলোর মতো সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ছে।
নি-ক্যাপ ছাড়া, কেউ উইন্ড-চিটার ছাড়া, কেউ হনুমান টুপি ছাড়া প্রস্তুতিবিহীন অবস্থায় সাত কিলোমিটার চড়াই উৎরাই ভেঙে সবাই বদরিতে ফিরে এসেছিল। শরীরের ক্ষমতা, তাকত, সাহস যাই থাক— সবার উপরে হল মন। সবই ঠিক করার জন্য টনিক পাওয়া যায়, মনের টনিক যে আজও অমিল! মন যে বড় চঞ্চল।
পরদিন সকালে ধীরে সুস্থে আবার বদরিবিশাল দর্শন করে ফেরার পথে পাণ্ডুকেশ্বর এলাম, এখান থেকে দু কিলোমিটার দূরে গোবিন্দঘাট। রাজা পাণ্ডু এখানে তপস্যা করেছিলেন বলে তাঁর নামে জায়গার নাম হয়েছে। নবীন পর্বতমালায় কত প্রাচীন স্থান। রাস্তার উপরেই মন্দির কমিটির বোর্ড আছে, সেখান থেকে কিছুটা নেমেই সপ্তবদরির অন্যতম যোগবদরির মন্দির। কথিত আছে পাণ্ডবরা এখানেই রাজা পরীক্ষিৎকে রাজধানী হস্তিনাপুর প্রদান করেছিল। মন্দিরের গঠনশৈলী নজর কাড়ে, গাড়োয়ালের সুন্দর মন্দিরগুলির অন্যতম এই মন্দির। তৃতীয় বদরি দর্শনের পর রাত্রিবাসের জন্য যোশীমঠের দিকে পা বাড়ালাম।

সকাল সকাল উঠে পড়েছি, আজকে ভবিষ্যবদরির যাত্রাপথ বেশ কঠিন। এই পথেই পড়বে আধবদরি। হাতে এই পথের তথ্য কম আছে, এ পথে কম পর্যটক যাতায়াত করেন। কারণ এই পথেই নিতি পাস। নিরাপত্তার কারণে এই পথে গাড়িও কম চলে। যোশীমঠ থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরে তপোবনে এসে মন ভরে গেল। ধৌলীগঙ্গার ধারে নির্জন গ্রামে দাঁড়িয়ে চারিধারের পর্বতশৃঙ্গের শোভা উপভোগ করতে লাগলাম। এখান থেকে ডানদিকে উষ্ণপ্রসবণকে রেখে রেনী গ্রামের দিকে এগোলাম, রেনীতে ধৌলীগঙ্গা ও ঋষিগঙ্গার সঙ্গম। রেনীর আগেই উঠে গেছে ভবিষ্যবদরির পথ।
প্রথম থেকেই প্রাণান্তকর চড়াই, ঝকঝকে আকাশ, ডানদিকে হাত বাড়ালেই ছোঁয়া যাবে এমন দূরত্বে দ্রোণাগিরি পর্বতশৃঙ্গ। চলার পথে বিভিন্ন বাঁকে তার সৌন্দর্য ক্লান্তি কিছুটা ভুলিয়ে দিলেও চড়াইকে বাগ মানাতে হাঁটু খটখটিয়ে যাচ্ছে। জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ, ফুসফুস মুখের গোড়ায় এনে, দুই চক্ষু সার্থক করে আমাদের দেহটাকে টেনে নিয়ে সুবায়ু গ্রামে এনে ফেললাম। এখানেই আধবদরির প্রাচীন মন্দির। পুরোহিত যোশীমঠে থাকেন, এখানে ছয় মাসের জন্য পূজার কাজে এসেছেন, কালীপূজার পর ঠাকুরের সঙ্গে ইনিও নেমে যাবেন যোশীমঠে।
সুবায়ু গ্রামটি হিমালয়ে দেখা গ্রামের মধ্যে অন্যতম সেরা গ্রাম। এত উঁচুতে নির্জনে তুষারাবৃত শৃঙ্গ ঘেরা এই গ্রামে বহু মানুষের বাস। এই আমাদের ভারতবর্ষ। এখান থেকে ১০ কিলোমিটার হেঁটে ছাত্ররা প্রতিদিন পড়াশুনা করতে যায়। কারুর মুখে কোনও অভিযোগ বা দুঃখের গল্প শুনিনি, যত দুঃখ শহরের।

সুবায়ু থেকে ২.৫ কিলোমিটার হাঁটলেই ভবিষ্যবদরি। ভবিষ্যতের বদরি পাহাড়ের গায়ে এখানে রূপ নিচ্ছে। প্রবাদ আছে, কলির শেষে বদরিবিশাল যখন ধবংস হয়ে যাবে তখন বদরির পূজা হবে এখানে। গ্রামের মানুষ একটি শর্টকার্ট পথ দেখিয়ে দিলেন যে পথে ওরা যান। এ পথে তেমন রাস্তা ছিল না, গাইড না থাকাতে আমরা পথ হারালাম। গলদঘর্ম হয়ে একটি কুকুরের সাহায্যে অবশেষে মন্দিরে পৌঁছালাম। অনেক ইচ্ছার অবসান হল।
পুরোহিত চা না খাইয়ে ছাড়লেন না, রাতে থাকার অনেক অনুরোধ করলেন। কিন্তু আমাদের যে আরামবাহন দাঁড়িয়ে আছে, ফিরতেই হবে। তিনি সোজা রাস্তাটা দেখিয়ে দিলেন। পড়ন্ত বিকেল, আমরা দ্রুত নামতে লাগলাম। সুবায়ু গ্রাম অবধি আসতেই সূর্য পাটে বসলেন। গ্রাম পেরিয়ে জঙ্গল পথের সরু রাস্তাটা ধরার পরেই অন্ধকার নামল। বড় বড় গাছের মধ্যে নিকষ কালো অন্ধকারে আমরা চারটে প্রাণী। সকালবেলায় যে পথে সৌন্দর্যের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিলাম এখন সেই পথ অন্ধকারে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠায় বিপদগ্রস্ত আর অসহায় আমরা। এই অবস্থায় হাঁটতে গিয়ে চৌষট্টির পায়ে শিরে টান ধরল। সঙ্গে থাকা একটা টর্চ আর মোবাইলের আলোয় দেড় ঘণ্টার পথ চার ঘণ্টায় নামলাম। যাতায়াতে মোট পথ ছিল ২০ কিলোমিটার।

যোশীমঠের বিছানায় চারটে দেহ নিথরভাবে সারারাত পড়েছিল। নড়াচড়া কেউ বিশেষ করতে পারছিল না। সকাল আটটার পরে এক গ্লাস লাল চায়ে আবার সবাই চাঙ্গা। নটার মধ্যে সবাই তৈরি। খালি পেটে বৃদ্ধবদরি দর্শন করে ব্রেকফাস্ট হবে এই আশায় গাড়ি ছাড়ল।
যোশীমঠ থেকে হেলাং-এর পথে পাঁচ কিলোমিটার গিয়ে প্যায়নি গ্রাম, এখানেই বৃদ্ধবদরির মন্দির। কথিত আছে দেবর্ষি নারদ এখানে বিষ্ণুর তপস্যা করেছিলেন এবং বিষ্ণু বৃদ্ধ বেশে নারদকে দর্শন দিয়েছিলেন। নারদ এই মন্দির প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। মূল রাস্তা থেকে একটু হাঁটলেই এই মন্দির। মন্দিরের অবস্থান এক অতীব সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মাঝে।
হেলাং-এ গিয়ে জম্পেশ করে ব্রেকফাস্ট। এখান থেকে নদী পেরিয়ে আমরা যাব শেষ বা সাততম বদরি দর্শনে। হেলাং থেকে এই পথ কল্পেশ্বরের পথ, মাঝে উরগম গ্রামে রয়েছেন ধ্যানবদরি। মনে মনে জানি, এ পথে কিছুটা হাঁটতে হবে, যতদূর গাড়ি যাবে আমরা যাব তারপরে হাঁটা দিয়ে যাব ধ্যানবদরি।

হেলাং থেকে নদীর ব্রিজ পেরিয়ে গাড়ি কিছুদূর যাওয়ার পর চালক স্বপনদা আমাদের নামিয়ে দিয়ে বললেন, এবার হাঁটতে হবে। মহানন্দে এক কিলোমিটার হাঁটার পর একটি ট্রেকারের দেখা পেলাম, জানা গেল ওটি উরগম থেকে আসছে। হাঁটার মধ্যে স্বপনদাও গাড়ি নিয়ে এসে হাজির, গাড়িতেই উরগম গেলাম।
উরগম গ্রামটি ছবির মতো, বেশ বড় গ্রাম। প্রচুর চাষবাস হয়, গ্রামে হাইস্কুল আছে, সদ্য কলেজও হয়েছে। ছবির মতো বাড়ি, বাড়ির সামনে ফুল ও ফলের বাগান। এখান থেকে জিপে কল্পেশ্বর ঘুরে আসা যাবে। রাস্তা তৈরি হচ্ছে জোরকদমে, সামনের বার হেলাং থেকে কল্পেশ্বর অবধি গাড়ি চলে যাবে। আমরা রাস্তার ধারের ছোট দোকানে ভাত-ডাল-মিঠা করলার তরকারির অর্ডার দিয়ে মন্দিরে গেলাম।
মনোরম সৌন্দর্যের মাঝে ধ্যানবদরির মন্দির। মূল দেবতা এখানে বিষ্ণু। মন্দির চত্বর নির্জনে আপন খেয়ালে পড়েই থাকে। পাণ্ডববংশীয় পুরঞ্জয়ের পুত্র উর্বঋষির তপস্যক্ষেত্র, তাই নাম উরগম। শঙ্করাচার্য এখানেই প্রথম কেদারনাথের মন্দির গড়েছিলেন। ধ্যানবদরি মন্দির দেখার সঙ্গে আমাদের সপ্তবদরি দর্শন শেষ হল।
হাঁটু খটখটে ক্লাবের সদস্যরা এতে দ্বিগুণ উৎসাহ পেয়ে প্রথমেই আরামবাহনের মেয়াদ বৃদ্ধি করে ফেলল। আগামী আরও ছয়দিন স্বপনদা আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। কল্পেশ্বর দর্শন সেরে নতুন করে রুট তৈরি হল, এই ক’দিনে পঞ্চকেদারের পাঁচটি সামার রিসট সহ কয়েকটি একদিনের ট্রেকও হয়ে গেল।

গাড়ির পাইলট স্বপনদা হৃষীকেশের প্রবাসী বাঙালি। এই ক’দিনে উনি নিজেকে আর সরিয়ে রাখতে পারেননি, পাঁচজনের একটা পরিবার হয়ে গেছিল। রাস্তার ধারে কোন হোটেলে ভালো খাবার আর কোথায় গেলে সৌন্দর্যের মাঝে আমাদের রাত্রিবাস হবে এ দায়িত্ব ছিল স্বপনদার হাতে। বয়স কোথাও বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, এত ছেলেমানুষি, এত মজা, এত আনন্দ— সব নিয়ে টিমটাকে মনে হত স্কুল পালানো ছেলের দল। প্রকৃতির মাঝে যেন পাঁচটা দুরন্ত বাচ্চা।
আহা এমন যদি হত আমি পাখির মতো
উড়ে উড়ে বেড়াই সারাক্ষণ।
পাহাড়ে হাঁটুগুলো ভালোই ছিল, বাড়ি ফিরে যেন বেশি জ্বালাচ্ছে, হাঁটুও বলছে, চলো, আবার পাহাড়ে যাই।
শক্তিপদ ভট্টাচার্য্য, অবসরপ্রাপ্ত ইতিহাসের শিক্ষক, ভ্রামণিক, জেলা ভ্রমণ গ্রন্থমেলা ও জেলার উৎসব ও মেলা গ্রন্থের লেখক, ভ্রমণ আড্ডা ও ভাবনায় ভদ্রেশ্বর পত্রিকার সম্পাদক মন্ডলীর সদস্য ও ট্রাভেল রাইটার্স ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য।
One Response
খুব ভাল লাগল ।আর-ও লেখা চাই আপনার ভ্রমণের ।