ইহুদী বাইবেল বা ‘তানাখ’-এর অন্যতম নায়ক, ঈশ্বরের বরপুত্র স্যামসন ছিলেন অসীম সাহসী আর অতিমানবিক শক্তির অধিকারী। ফিলিস্তিন (আজকের প্যালেস্টাইন সংযুক্ত বিভিন্ন উপজাতি) রাজশক্তি স্যামসনের সঙ্গে সম্মুখ সমরে বারবার পরাস্ত হয়ে একসময় তাঁর প্রেমিকা ডিলাইলার শরণাপন্ন হল। ১,১০০ রৌপ্যমুদ্রার বিনিময়ে ডিলাইলা নিজের প্রেমিকের শক্তির উৎস যে তাঁর লম্বা চুল, সেই তথ্যটি দেশবাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েই ক্ষান্ত হলেন না, ঘুমন্ত প্রেমিকের চুল ছেঁটে তাঁকে ক্লীবে পরিণত করলেন। নিঃসন্দেহে ডিলাইলা সে যুগের এক সফল মহিলা গুপ্তচর।
সেই বাইবেলের যুগ থেকে আজ পর্যন্ত গুপ্তচরবৃত্তি খুব একটা পাল্টায়নি। শত্রুপক্ষের গোপন সংবাদ ছলে ও কৌশলে সংগ্রহ করে নিজের দেশ বা মিত্রপক্ষকে তা সরবরাহ করাই গুপ্তচরদের মূল উদ্দেশ্য। আর রাষ্ট্রই হল এই বৃত্তির প্রধান পৃষ্ঠপোষক। প্রাচীনকালে গুপ্তচর বাহিনীতে পুরুষ ও নারী দু’জনেরই উপস্থিতি ছিল বলে জানা গেছে। পুরুষ রাজনৈতিক নেতাদের প্রলুব্ধ করে সুন্দরী গুপ্তচরেরা সহজে তথ্যসংগ্রহ করতে পারবে বিশ্বাসেই তাদের নিয়োগ করা হত। প্রাচীন ভারত আর চীনদেশে গুপ্তচরের কর্তব্য বিশ্লেষণ করে তা সুষ্ঠুভাবে লিপিবদ্ধ করেছিলেন চাণক্য ও সান-জু। সামরিক কৌশল ব্যাখ্যা করে লেখা ‘অর্থশাস্ত্রে’ চাণক্য ছলনা ও প্রতারণা সম্বন্ধে দীর্ঘ আলোচনা করেছেন। চাণক্যের পরামর্শে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সাম্রাজ্য স্থাপন করতে গুপ্তচর ও গোপন আততায়ীর সাহায্য নিয়েছিলেন।
প্রাচীন মিশরে ফারাওরা গুপ্তচরের কাজকর্ম সম্পর্কে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল ছিলেন। গ্রিক ও রোমান সাম্রাজ্যেও গুপ্তচরেরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করত। জাপানে রাজার আদেশে, নিনজা যোদ্ধারা বিভিন্ন জায়গা থেকে গোপন সংবাদ সংগ্রহ করত। ভারতের ইতিহাসে ‘বিষকন্যা’র উল্লেখ আছে। বিষকন্যা গঠনের প্রণালীটি নিষ্ঠুর। জন্মের পর থেকে কিছু নির্বাচিত কন্যাশিশুকে সামান্য বিষ খাইয়ে বড় করা হত যাতে পূর্ণযৌবনে তারা ‘বিষাক্ত’ হয়ে ওঠে। রাজনৈতিক প্রয়োজনে এই মেয়েরা নিজের শরীরকে অস্ত্র করে সংবাদ সংগ্রহকারী ও গুপ্ত-আততায়ীর ভূমিকা পালন করত।
যুদ্ধবৃত্তি যতই আধুনিক হয়েছে, ততই মহিলাদের সামরিক প্রতিষ্ঠান থেকে দূরে রাখার প্রবণতা সমাজে বেড়েছে। বিংশ শতাব্দীর শেষভাগ অবধি পৃথিবীর বেশিরভাগ রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীতে মহিলাদের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ, ফলে গুপ্তচরবৃত্তি থেকেও তারা ছিল বহিষ্কৃত। অন্তত আপাতদৃষ্টিতে তাই মনে হয়। মুশকিল হল গুপ্তচরের ভূমিকা স্বাভাবিকভাবেই গোপনীয়, অপ্রকাশ্য, নিগূঢ়, ও অনেক সময় আইনি আওতার বাইরে। তাই মহিলাদের অনুপস্থিতির সত্যাসত্য যাচাই করা সহজ নয়। শুধু তাই নয়, পিতৃতান্ত্রিক ইতিহাসে মহিলাদের অবদান বহু ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে মুছে দেওয়া হয়েছে বা বিকৃত করা হয়েছে। ইদানীং বহু গবেষক এই হারিয়ে যাওয়া ইতিহাস আবার নতুন করে আবিষ্কার করছেন।

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নারী গুপ্তচরবৃত্তির ঐতিহ্য যথেষ্ট পুরোনো। ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে মার্কিন স্বাধীনতা সংগ্রামে শামিল হয়েছিলেন বহু মহিলা গুপ্তচর। তাঁদের ওপর ছিল গোপন দলিল, তথ্য, এবং সংবাদ আদানপ্রদানের দায়িত্ব। এই কাজে তাঁদের সফল হবার একটি কারণ, তখনকার ঘোর পিতৃতান্ত্রিক ইংরেজ সমাজ বিশ্বাস করতে পারেনি মহিলারা এত লুকোছাপা করতে পারেন। এরপর মার্কিন গৃহযুদ্ধে (১৮৬১-১৮৬৫) দক্ষিণ রাজ্যগুলির জোট (কনফেডারেসি) মহিলা গুপ্তচরদের ব্যাপক কাজে লাগিয়েছিল। কনফেডারেট বাহিনীর পক্ষে গুপ্তচরের কাজ করেছিল সতেরো বছরের ইসাবেলা ‘বেল’ বয়েড। এই কিশোরী এতই দুঃসাহসী ছিল যে লড়াই চলাকালীন সৈন্যদের মধ্যে দিয়ে যাতায়াত করে সংবাদ চালাচালি করত। ১৮৬২ সালে এক হোটেল কামরায় দেয়ালের ফুটোয় আড়ি পেতে, শত্রুপক্ষের যুদ্ধের পরিকল্পনা শুনে ‘বেল’ তা কনফেডারেট বাহিনীর কাছে পাচার করে। সেই তথ্যের ভিত্তিতে পরবর্তী সংঘর্ষে কনফেডারেট দল জয়ী হয়। কাজের পুরস্কারস্বরূপ ‘বেল’ পেয়েছিল সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে একটি চিঠি। ‘বেল’-এর সঙ্গে কনফেডারেট দলে কাজ করতেন রোজ ও’নিল গ্রিনহাও, অ্যান্টোনিয়া ফোর্ড, শার্লট মুন, মেরি সুরাট, প্রমুখ আরও বহু মহিলা গুপ্তচর।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় থেকে গুপ্তচরবৃত্তিতে মহিলাদের আসন কায়েমি হল। সেই যুদ্ধের গুপ্তচর, হল্যান্ডের নাগরিক ‘মাতা হারি’ (আসল নাম Margaretha Geertruida Zelle McLeod), নারী গুপ্তচরের প্রতীক হিসেবে এখন স্বীকৃত। নিজেকে প্রাচ্যের মোহময়ী নর্তকী হিসেবে প্রচার করে তিনি ইয়োরোপের বিত্তবান ও কূটনৈতিক পুরুষসমাজে অভূতপূর্ব চাঞ্চল্য জাগিয়েছিলেন। প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর অক্ষ এবং মিত্রশক্তি, দু’পক্ষই তাঁকে নিজের দলে টানতে চাইল। তথ্য আহরণে ‘মাতা হারি’ ছিলেন পারদর্শী। কিন্তু তাঁর কার্যকলাপে বোঝা যায়নি সত্যিই তিনি কোন পক্ষের হয়ে গুপ্তচরগিরি করছেন। শেষে ফরাসি সরকার ‘মাতা হারি’কে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে প্রাণদণ্ড দিল। ১৯১৭ সালে ফরাসি ফায়ারিং স্কোয়াড–এর গুলিতে তিনি প্রাণ হারান। আজকের গবেষকদের অনুমান, ‘মাতা হারি’ আসলে কোনও পক্ষেই স্থায়ী নাম লেখাননি। সংগৃহীত তথ্য তিনি প্রধানত নিজের স্বার্থসিদ্ধিতেই ব্যবহার করতেন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে মিত্রপক্ষের আর একজন বিখ্যাত মহিলা গুপ্তচর ছিলেন ব্রিটিশ নার্স, ইডিথ ক্যাভেল। এক শিশুর সেবিকা হয়ে ১৯০৭ সালে ইডিথ বেলজিয়ামে গিয়েছিলেন। তার কিছুদিন পরেই তিনি ওই দেশে একটি ধর্মনিরপেক্ষ নার্সিং-শিক্ষার স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। ততদিন অবধি বেলজিয়ামে নার্সিংয়ের দায়িত্ব ছিল ‘নান’দের ওপর। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রারম্ভে এই স্কুল পরিণত হল হাসপাতালে। সেখানে আহতদের শুশ্রূষা করা হত, আর সেই সঙ্গে ইডিথ বহু যুদ্ধবন্দি ব্রিটিশ সৈন্যকে জার্মান অধিকৃত বেলজিয়াম ছেড়ে পালিয়ে যেতে সাহায্য করতেন। হাসপাতালের আবরণের তলায় চলত সংবাদ চালাচালির গুপ্তকাজ। ১৯১৫ সালের ১২ অক্টোবর, গুপ্তচর অভিযোগে জার্মান সরকার ইডিথ ক্যাভেলকে গুলি করে হত্যা করে।
অনেকের মতে, ‘মাতা হারি’ বা ইডিথ ক্যাভেল কেউই গুপ্তচর ছিলেন না। গুপ্তচরবৃত্তিতে এঁদের প্রবেশ কাকতালীয়। পরিস্থিতির দৌলতে তাঁরা তথ্য সংগ্রহ ও পাচার করেছেন, সাহায্য করেছেন সৈন্যদের পালাতে। কিন্তু এঁরা কোনও প্রশিক্ষণ পাননি, গুপ্তচরের প্রকৌশল (spy craft) জানতেন না, এবং কখনই তা ব্যবহার করেননি। ‘স্পাই ক্রাফট’ বলতে বোঝায় সংকেতলিপি ভাঙা ও লেখা, অস্ত্র বা তথ্য লুকোনো ও পাচার, অদৃশ্য কালি ব্যবহার, নাশকতামূলক কাজে অংশগ্রহণ, ইত্যাদি। তবে নারী গুপ্তচরেরা যে দুটি কারণে বিশেষভাবে বলীয়ান তার উল্লেখ কেউ করেননিঃ (১) পুরুষের যৌন লালসা, এবং (২) নারীর বুদ্ধিবৃত্তি সম্পর্কে পিতৃতান্ত্রিক সমাজের অবজ্ঞা।

প্রথমটি কাজে লাগাতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ঝাঁকে ঝাঁকে মহিলা গুপ্তচর নিয়োগ করা হয়েছিল। এম–আই-৫–এর (MI5 একটি ব্রিটিশ গুপ্তচর প্রতিষ্ঠান) অফিসার, ম্যাক্সওয়েল নাইট বলেছিলেন, ‘পুরুষদের যৌন প্রলোভন দেখিয়ে মেয়েরা দরকারি তথ্য সংগ্রহ করতে পারে। সে জন্য চাই মোটামুটি সুন্দরী ও যৌন আবেদনপূর্ণ মহিলা। অতিরিক্ত চটকদার হলে লোকের মনে সন্দেহ ও ভয় জাগিয়ে কাজ পণ্ড হবার সম্ভাবনা আছে।’ দ্বিতীয়টিকে ক্ষমতা না বলে সুযোগ বলাই ভালো। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় দেখা গেছে মহিলাদের অবহেলা করে বেশির ভাগ চেকপয়েন্টগুলিতে ভালো করে তল্লাশি করা হত না। ফলে পুরুষের তুলনায় অস্ত্র এবং কাগজপত্র তারা সহজে পাচার করতে পারত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বহু মহিলা গুপ্তচরের উল্লেখযোগ্য অবদান রয়েছে। পোল্যান্ডের কাউন্টেস ক্রিস্টিনা স্কারবেক ওরফে ক্রিস্টিনা গ্র্যানভিল ছিলেন চার্চিলের প্রিয় গুপ্তচর। শীতকালে নাৎসি কবলিত পোল্যান্ডে প্রচারতথ্য বিতরণ করার কাজ তাঁর ওপর পড়েছিল। এক অলিম্পিক স্কি চ্যাম্পিয়ানের সাহায্য নিয়ে, বরফ ডিঙিয়ে তিনি সে দেশে প্রবেশ করেছিলেন। বারকয়েক জার্মান সৈন্যের কাছে ধরা পড়েও বুদ্ধি খাটিয়ে পালাতে পেরেছিলেন– একবার নিজের জিভ কামড়ে ঝুটো যক্ষ্মারোগী সেজে। আর এক কুখ্যাত গুপ্তচর ছিলেন নিউজিল্যান্ডের ন্যান্সি ওয়েক, গেস্টাপো যাঁর নাম দিয়েছিল “শাদা ইঁদুর।”

অপরূপা গুপ্তচর, বেটি প্যাক ওরফে সিন্থিয়া, নিজের যৌন আবেদন কাজে লাগাতেন যত্রতত্র। তাঁর মৃত্যুর পর শোকবার্তায় টাইম ম্যাগাজিন লিখেছিল, শত্রুনিধনে বেটি ‘বন্দুকের বদলে বিছানা ব্যবহার করেছেন।’ বেটির সংগৃহীত তথ্যের জোরে জার্মানির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সংকেতলিপি, ‘এনিগমা কোড,’ ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা ভাঙতে সক্ষম হয়েছিল। এই ‘কোড’ বুঝতে পারায় যুদ্ধের মোড় ঘুরে যায়।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে কূটতথ্য সংগ্রহ করেছিলেন আরও অনেকে। মিত্রপক্ষের উত্তর আফ্রিকা আক্রমণ পরিকল্পনায় (অপারেশন টর্চ) অসামান্য সাহায্য করেছিলেন মার্কিন গুপ্তচর এলোইজ় পেজ়। পরবর্তীকালে বিখ্যাত শেফ, জুলিয়া চাইল্ড, গুপ্তচরের কাজ করেছিলেন অধিকৃত ফ্রান্সে। তবে সবচেয়ে সফল মহিলা গুপ্তচরের খেতাব জিতেছিলেন এক উচ্চবিত্ত মার্কিন পরিবারের কন্যা, ভার্জিনিয়া হল। ছাব্বিশ বছর বয়েসে শিকার দুর্ঘটনায় ভার্জিনিয়া একটি পা হারান। কাঠের পায়ের প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে গুপ্তচরবৃত্তিতে তিনি দক্ষ হয়ে ওঠেন। শুধু তথ্য সংগ্রহ ও পাচার নয়, তাঁর সাংগঠনিক ক্ষমতা ছিল অসাধারণ। ফরাসি মহিলাদের সংগঠিত করে উনি মিত্রপক্ষের সৈন্যদের সুরক্ষার বন্দোবস্ত করেন। অক্ষশক্তি ভার্জিনিয়াকে ‘খোঁড়া মহিলা’ (Woman with a Limp) নাম দিয়ে ‘সবচেয়ে বিপজ্জনক গুপ্তচর’ আখ্যা দেয়। এছাড়াও ভারতীয় মহিলা গুপ্তচর, রাজকুমারী নূর-উন-নিসা ইনায়ত খান ওরফে ম্যাডেলাইন, গুপ্তচর হিসেবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন। তিনিই প্রথম মহিলা রেডিও সংকেতজ্ঞ যিনি অধিকৃত ফ্রান্সে গিয়েছিলেন তথ্য আদানপ্রদান করতে। অক্ষশক্তির কাছে ধরা পড়ে রাজকুমারী নূর ১৯৪৪ সালে প্রাণ হারান। জীবনীকার শ্রাবণী বসুর উদ্যোগে ২০১২ সালে রাজকুমারী নূর-এর একটি আবক্ষ মূর্তি লন্ডনে তাঁর বাড়ির সামনের পার্কে স্থাপন করা হয়েছে।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বহু মহিলা গুপ্তচর ধরা পড়ে অত্যাচার সহ্য করেছেন, প্রাণদণ্ড পেয়েছেন, নাৎসি কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে তিলে তিলে প্রাণ হারিয়েছেন। এঁদের অবদান ছাড়া মিত্রশক্তি জিতত কিনা সন্দেহ। অক্ষশক্তির হয়েও বহু নারী গুপ্তচর নিশ্চয়ই কাজ করেছিলেন, কিন্তু পরাজিত পক্ষের বলে তাঁদের কথা আমরা প্রায় কিছুই জানি না। তবে মিত্রশক্তির মহিলা গুপ্তচরদের সম্পর্কেও আমরা জানতে আরম্ভ করেছি ইদানীং, কিছু মহিলা গবেষকের উৎসাহে।
বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে, কিন্তু গুপ্তচরবৃত্তির অন্ত হয়নি। মহিলা গুপ্তচরদের কাজকর্ম আবার বৃদ্ধি পায় শীতল যুদ্ধের (Cold War) সময়। এবারে ইংল্যান্ড ও আমেরিকার গুপ্তচরদের ওপর বর্তালো দেশের গোয়েন্দা সংস্থায় ঢুকে পড়া সোভিয়েত বা অন্যদেশের গুপ্তচরদের শনাক্ত করা। তেমনি একজন ছিলেন জেন সিস্মোর আর্চার ওরফে মিসেস ম্যুর। তিনিই ব্রিটিশ সংস্থা, এম-আই-৫ নিয়োজিত প্রথম মহিলা কর্মী। তাঁর জন্যেই সোভিয়েত গুপ্তচর ডোনাল্ড ম্যাকলিন, গাই বার্জেস, এবং কুখ্যাত কিম ফিলবি ১৯৫০ এবং ’৬০-এর দশকে ইংল্যান্ড ছেড়ে রাশিয়ায় পালাতে বাধ্য হয়। কিন্তু ধরা পড়েননি ধাতু-গবেষণাগারের সচিব মেলিটা নরউড। ব্রিটেন ও আমেরিকার পারমানবিক ক্ষেপণাস্ত্রের তথ্য সংগ্রহ করে সোভিয়েত সরকারকে পাচার করে তিনি সে দেশের আণবিক প্রকল্প পুষ্ট করেছেন।

১৯৩৪ থেকে ১৯৯৯ সাল অবধি মেলিটাকে কেউ সন্দেহ পর্যন্ত করেনি। যখন ধরা পড়লেন তখন তিনি বৃদ্ধা। ৯৩ বছর বয়সে মেলিটা ইংল্যান্ডেই মারা যান। তাঁর জীবন নিয়ে সম্প্রতি ‘রেড জোন’ নামে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছে। মেলিটার মতই আর একজন সফল সোভিয়েত গুপ্তচর ছিলেন উর্স্যুলা কুজিন্সকি ওরফে সোনিয়া। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর, ইংল্যান্ড ও আমেরিকায় কাজ করে তিনি ‘স্ট্যালিনের শ্রেষ্ঠ গুপ্তচর’ আখ্যা পান। এঁরা ছাড়াও ১৯৩০–এর দশক থেকে বহু সোভিয়েত মহিলা গুপ্তচর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইংল্যান্ডে বসবাস করছেন।
প্রথম মহাযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর অক্ষ এবং মিত্রশক্তি, দু’পক্ষই মাতাহারিকে নিজের দলে টানতে চাইল। তথ্য আহরণে ‘মাতা হারি’ ছিলেন পারদর্শী। কিন্তু তাঁর কার্যকলাপে বোঝা যায়নি সত্যিই তিনি কোন পক্ষের হয়ে গুপ্তচরগিরি করছেন। শেষে ফরাসি সরকার ‘মাতা হারি’কে বিশ্বাসঘাতকতার অপরাধে প্রাণদণ্ড দিল। ১৯১৭ সালে ফরাসি ফায়ারিং স্কোয়াড-এর গুলিতে তিনি প্রাণ হারান।
তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সবচেয়ে আলোচিত গুপ্তচর বোধহয় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দম্পতি– জুলিয়াস ও এথেল রোজেনবার্গ। এঁরা ছিলেন আমেরিকার কম্যুনিস্ট পার্টির সদস্য এবং অপেশাদারি গুপ্তচর। সেনাবাহিনীতে চাকরিরত অবস্থায় জুলিয়াস মার্কিন সেনাবাহিনীর অস্ত্র সম্বন্ধে তথ্য জোগাড় করে সোভিয়েত সরকারকে সরবরাহ করতেন। এথেলের ভাই, ডেভিড গ্রিনগ্লাস, যুদ্ধের সময় আণবিক অস্ত্র তৈরির প্রকল্প, ম্যানহ্যাটান প্রজেক্ট-এ সংশ্লিষ্ট ছিলেন এবং সেখান থেকে তথ্য সংগ্রহ করে দিতেন বোন ও ভগ্নীপতিকে। এঁদের হাত ঘুরে সেই তথ্য যেত সুইৎজারল্যান্ডের সংবাদবাহক হ্যারি গোল্ডের কাছে, এবং তারপর নিউ ইয়র্কে সোভিয়েত কূটনৈতিক প্রতিভূ আনাতোলি ইয়াকভলেভের দপ্তরে। এফবিআই-এর অনুসন্ধানে রোজেনবার্গ দম্পতি ধরে পড়েন। বিচারে তাঁদের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিয়েছিলেন ডেভিড গ্রিনগ্লাস। অভিযুক্ত রোজেনবার্গদের দোষ সাব্যস্ত হয়ে প্রাণদণ্ড দেওয়া হলে সারা পৃথিবী জুড়ে তাঁদের, বিশেষত দুই শিশুসন্তানের মা, এথেলের প্রাণভিক্ষা চেয়ে আন্দোলন হয়েছিল। সব উপরোধ নাকচ করে ১৯৫৩ সালের ১৯ জুন, রোজেনবার্গদের প্রাণদণ্ড কার্যকরী করা হয়। আমেরিকার ইতিহাসে এথেল রোজেনবার্গ হলেন দ্বিতীয় মহিলা যাঁকে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়। প্রথমজন ছিলেন মেরি সুরাট, আব্রাহ্যাম লিঙ্কনের হত্যা ষড়যন্ত্রে জড়িত বলে ১৮৫৩ সালে তাঁকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল।

একবিংশ শতাব্দীতেও গুপ্তচরবৃত্তির দাপট কমেনি। ২০১০ সালে ভারতের কূটনৈতিক প্রতিনিধি, মাধুরী গুপ্ত, পাকিস্তানে তথ্য পাচারের অভিযোগে রাষ্ট্রদ্রোহের দায়ে অভিযুক্ত হয়েছেন। ২০১১ সালে মার্কিন সেনা, জঙ্গি সংগঠন আল-কায়দার নেতা, ওসামা বিন লাদেন–এর গুপ্ত বাসস্থান আক্রমণ করে তাঁকে হত্যা করে। বিন লাদেনের ঠিকানা, যাতায়ত, ইত্যাদি সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেছিলেন এক মহিলা গুপ্তচর। তিনি এখনও কাজে নিযুক্ত, তাই পরিচয় জানার উপায় নেই। ২০১৬ সালে রাশিয়ার মারিয়া বুটিনা ছাত্র হয়ে আমেরিকায় এসে বহু রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে ভাব জমিয়েছিলেন। গুপ্তচর অভিযোগে ছ’মাস জেল খাটার পর, ২০১৯ সালে তাঁকে রাশিয়ায় ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে।
মহিলা গুপ্তচরের শৈলীকে অনেকে বিদ্রূপ করে বলেছেন, ‘এটি এস্পিওনাজ নয়, এটি হল সেক্সপিওনাজ।’ কথাটা ভুল নয়। কিন্তু এই ‘সেক্সপিওনাজ’ কেন সফল হল তা নিয়ে কোনও বিতণ্ডা শোনা যায় না। পুরুষের লোভ এবং যৌনলালসাই যে এর মূলে, সেই চেতনা থেকে যায় উহ্য। অর্থাৎ বিদ্রূপ, নিন্দা, তাচ্ছিল্য, সব কিছুরই লক্ষ্যে থাকে নারী– পুরুষের ভূমিকা ক্ষমার্হ।
বিভিন্ন রাষ্ট্রের মধ্যে যতদিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা এবং অসহযোগিতা রয়েছে, গুপ্তচরবৃত্তি বন্ধ হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। তবে ভবিষ্যৎ গুপ্তচরবৃত্তিতে শারীরিক উপস্থিতির চেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে কম্প্যুটার কোডিং, হ্যাকিং, এবং তথ্য বিশ্লেষণের ক্ষমতা। বহু বিশেষজ্ঞের মতে মহিলারা তথ্য বিশ্লেষণে সূক্ষ্ম তারতম্য, সামাজিক সংকেত, কূটনৈতিক পরিমণ্ডল বুঝতে পুরুষের চেয়ে বেশি পারঙ্গম। তাঁদের ধৈর্য বেশি ও প্রাধান্যের প্রতিযোগিতা থেকে দূরে থাকেন। আগামী দিনের গুপ্তচরদের মধ্যে এই সব বৈশিষ্ট্যই বাঞ্ছনীয়।
*ছবি সৌজন্য: History.com, The Telegraph, Hoover Institution, The Famous People, Medium
শমীতা দাশ দাশগুপ্ত অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, লেখক, এবং নারীকল্যাণ কর্মী। পাঁচ দশকেরও বেশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী। আমেরিকার প্রথম দক্ষিণ এশীয় পারিবারিক নির্যাতন বিরোধী সংস্থা, ‘মানবী’র (১৯৮৫) অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। ইংরেজিতে লেখা বইয়ের সংখ্যা পাঁচ। বাংলায় একটি রহস্যোপন্যাস (‘দ্বন্দ্ব,’ আনন্দ পাবলিশার্স), দু’টি রহস্য গল্প-সংকলন (‘মৃত্যুর মুখ চেনা’ ও ‘ছায়া জগতের গল্প,’ দ্য কাফে টেবিল প্রকাশনী), ও দু’টি কবিতার বই (আবর্ত প্রকাশনী) রয়েছে। এছাড়া তিনটি বই ইংরেজি থেকে অনুবাদ করেছেন। বেশ কিছু পত্র-পত্রিকায় গল্প, প্রবন্ধ, কবিতা লেখেন।