[১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪]
জানি না কতদিন আর আমরা এখানে থাকতে পারবো। কথাটা আক্ষেপ করে বলেছিলেন চিৎপুরের এক কাঠ খোদাই (Wood Block) শিল্পী। এঁরা বর্তমানে মাত্র কয়েক ঘর শিল্পী আছেন যাঁরা ছোট ছোট দোকানে বসে হাতুড়ি বাটালি দিয়ে কাঠ কেটে কেটে সন্দেশের ছাঁচ করেন। এই বাংলায় তো বটে ভারতের বহু জায়গা থেকেই কাজের বরাত এখনও আসে। প্রায় সারা বছরই ব্যস্ত থাকেন। কিন্তু এদের উচ্ছেদ করে অন্য কিছু করতে নানা চাপ আসে মাঝে মধ্যেই। এমন কী বাসস্থানেও আসে চাপ উঠে যাওয়ার জন্য। নিজস্ব ঘরবাড়ি তেমন কারও নেই।
চিৎপুর কাঠ খোদাই শিল্পীদের অবলুপ্তি ঘটে যাওয়ার পর কেবল এঁরাই আছেন এই শিল্পটাকে আঁকড়ে। বিয়ের তত্ত্বতে নানা নকশায় দেওয়া হয় বড় বড় মিষ্টি যা এঁদের হাতে তৈরি ছাঁচ থেকে করা হয়। আর প্রায় সব মিষ্টির দোকানেই প্রয়োজন হয় এঁদের কাঠের ছাঁচ। সাবধানে তৈরি করতে হয় এই ছাঁচ। স্রেফ কাঠ কাটতে কাটতে গর্ত করে এক একটা নকশা গড়ে ওঠে। একটু ভুল হলেই বাতিল, আর সবটাই হয় মনের আন্দাজে। এঁরা ওই ছাঁচ থেকে কেমন সন্দেশ উঠল দেখারও সুযোগ পান না। দিনের পর দিন একই কাজ করতে করতে হয়তো অভ্যাস হয়ে গেছে। ভুল করে সামান্য একটু বাটালির ঘা পড়লে যে গর্তটি হবে তাতে ছানা লেগে যাবে বেশি, মিষ্টির দাম একই থাকে, কিন্তু ছানা ওজনের বেশি ঢুকে গেলে দোকানির বিরাট ক্ষতি, একই ছাঁচ থেকে হাজার হাজার সন্দেশ মানে প্রচুর ক্ষতি। অতএব খুবই সাবধানে করতে হয় কাজটি।
কাঠ খোদাই থেকে ছাপাখানার মেশিনে ছাপ উঠতো বই বা পত্র পত্রিকার জন্য, কিন্তু এইসব মিষ্টির ছাঁচ থেকে মিষ্টিকে কী বলা হবে? এটাও তো একটা ছাপ! কেবল কাগজের বদলে মিষ্টির জন্য। আগের কাঠ খোদাই কাজটি ছিল সমতলে, তার থেকে ছাপ উঠতো। এটা ত্রিমাত্রিক, ছাপও ত্রিমাত্রিক। মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পী এখনও এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন নিজেরা কষ্ট করে।
কাঠ খোদাই থেকে ছাপাখানার মেশিনে ছাপ উঠতো বই বা পত্র পত্রিকার জন্য, কিন্তু এইসব মিষ্টির ছাঁচ থেকে মিষ্টিকে কী বলা হবে? এটাও তো একটা ছাপ! কেবল কাগজের বদলে মিষ্টির জন্য। আগের কাঠ খোদাই কাজটি ছিল সমতলে, তার থেকে ছাপ উঠতো। এটা ত্রিমাত্রিক, ছাপও ত্রিমাত্রিক। মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পী এখনও এই শিল্পকে বাঁচিয়ে রেখেছেন নিজেরা কষ্ট করে। আমরা জানি এইসব ছাঁচ অনেকে মাটি দিয়েও বানান। তারপর ওটাকে শুকিয়ে নিয়ে পুড়িয়ে নেন। এইসব ছাঁচ বিভিন্ন মেলা বা কালীঘাটে গেলেও পাওয়া যায় যেখান থেকে মা ঠাকুমারা কিনে নিয়ে যান লক্ষ্মী পুজোর সময় বা অন্য কোনও পার্বণে নারকেলের সন্দেশ বা ক্ষীরের সন্দেশ বানাবেন বলে। তবে কাঠের ছাঁচের কারিগরি কৌশল অনেক মৌলিক। প্রতিটি তৈরি হয় হাতে। মাটির ছাঁচ করতে আবার একটি ছাঁচ হলেই চলে।
চিৎপুরের দুজন শিল্পী এসেছিলেন ওখানেই একটা ওয়ার্কশপে। এঁদের মধ্যে একজনকে বলা হয়েছিল একটা ছবি দিয়ে কাঠ খোদাই করে ওই ছবির মতো একটা বড় সন্দেশ বানাতে। তিনি বানিয়েছিলেন। প্রথমে ত্রিমাত্রিক বড় ছাঁচ থেকে কেমন হবে আমরা আন্দাজ করতে পারিনি। কিন্তু তিনি সবদিক বজায় রেখে সন্দেশের মতোই একটা ছবি বানালেন ফ্ল্যাট সারফেসে। আমরা সেই বড় মাপের কাঠের ছাঁচ থেকে বড় মাপেরই এক সন্দেশ বানালাম দেখলাম সেই শিল্পীর কারিগরি দক্ষতার সঙ্গে মিশে আছে এক ধরনের চ্যালেঞ্জ নেওয়ার ইচ্ছা।
গড়ে উঠলো ত্রিমাত্রিক এক অনন্যসাধারণ ছাপ চিত্র বা প্রিন্ট।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিবর্তন আসবে স্বাভাবিক, এটাই কালে কালে হয়ে আসছে। পরিবেশের সঙ্গে ও জীবনের ধারার সঙ্গে শিল্পেরও পরিবর্তন ঘটবে। উনিশ শতক পাড় হয়ে বিশ শতকে এসে অনেকেই উৎসাহিত হয়ে এগিয়ে এসেছেন ওই মাধ্যমে আধুনিক ধারার শিল্প করতে, যা পৃথিবীর অন্য প্রান্তে বহু বছর আগেই শুরু হয়ে গেছে। সে এক অন্য অধ্যায় ভবিষ্যতের জন্য তোলা রইল।
(সমাপ্ত)
জন্ম কলকাতায় ১৯৫০ সালে। নিজে শিল্পী, বহু শিল্প বিষয়ক ইতিহাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দীর্ঘ বছর যাবত উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বই Woodcut prints of nineteenth century Calcutta (১৯৮২), উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই শিল্পী প্রিয় গোপাল দাস (২০১৩), আদি পঞ্জিকা দর্পণ (২০১৮, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত), কলকাতার কাঠ খোদাই ( ২০২২) রাজ্য সরকারের বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ২০২২।