আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১]
বটতলা না হলে কত শিল্পের জন্মই হত না। চিৎপুরের (chitpur) ধারেই রয়েছে অসংখ্য ছোটো ছোটো দোকানের সারি। এটাই চিৎপুরের বৈশিষ্ট্য। যেমন কালীঘাটের (kalighat) মন্দির দর্শন করতে গেলে সেখানেও দেখা মেলে এমন অনেক সারি সারি দোকান, যেখানে হরেক রকম জিনিসের পসরা সাজানো থাকে মন্দির দর্শনার্থীদের জন্য। চিৎপুরে নানান কিসিমের পসরা সম্ভবত কিছুটা গজিয়ে থাকতে পারে চিত্তেশ্বরী মন্দিরের দৌলতে। একদিকে কালীঘাট অন্যদিকে চিত্তেশ্বরী মন্দির, উভয়ের মহিমায় ভক্তগণ বছরের পর বছর বাঁচিয়ে রেখেছেন এদের। তবে উত্তরের এই চিত্তেশ্বরী মন্দিরে ভক্তদের ভিড়় আর আগের মত নেই। কিন্তু চিৎপুরের সেইসব দোকানের রমরমা এখনও আছে। কালের গর্ভে অনেক পসরা হারিয়ে গেলেও কিছু অবশিষ্ট এখনও টিকে আছে। আর পরিবর্তিত রূপে আরও কিছু আছে। আর এটাই হলো চিৎপুরের চরিত্র। হুতমের বর্ণনার থেকে তেমন সরে আসতে পারেনি। আকাশে মেঘ ডাকলে চিৎপুরের রাস্তা কাদা হয়। রূপ পসারিনিদের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে থাকা বা দোতলার বারান্দা থেকে ঝুঁকে থাকা, এসব এখনও একই রয়েছে।
আরও পড়ুন: এভারেস্ট অভিযানের একাল সেকাল ও মেয়েরা
এখনও এই অঞ্চল দিয়ে হাঁটলে মনে হবে একটা মিনি ভারত দিয়ে হাঁটছেন। আমি কাঠ খোদাইকারদের খোঁজে যতবার গিয়েছি, ততবারই চিৎপুরের প্রেমে গভীর ভাবে আকৃষ্ট হয়েছি। এই ঘোর বিগত পঞ্চাশ বছর ধরেই চলছে। কত রাগ অভিমান করেছি অতীতের ইতিহাসকে ভুলে যাবার জন্য যারা দায়ী, তাদের উপর। ভাবতে পারেন, কেবলমাত্র ফুটপাথ সম্বল করে ডোম পাড়ায় বাঁশের কঞ্চি দিয়ে বিশাল বিশাল ত্রিমাত্রিক যে কোনও গঠন গড়়ে আজ তাদের একটা বিশাল গোষ্ঠী জীবিকা অর্জন করছে, আর এই শিল্প দেশ বিদেশের মানুষের মধ্যে আগ্রহ গড়ে তুলেছে। এদের বসবাস এখানে কলকাতা পত্তনেরও আগে। পেশায় ডোম হলেও অবসরে ঝুড়ি বুনে অতিরিক্ত রোজকার ছিল এদের নেশা। আজ আর কেউ ডোম নেই, কিন্তু এলাকার নাম একই থেকে গেছে। এতেই এদের খ্যাতি। এই বিশেষ দক্ষতা এরা বংশ পরম্পরায় শিখে আসছে। কী দক্ষতা না দেখলে বিশ্বাস করা মুশকিল। এখন এদের কেউ কেউ আর্ট কলেজ থেকে শিক্ষা নিয়ে আরও হয়ত কিছু করতে চাইছে। তবে এদের নিজস্ব ভাবনাটি যে মর্যাদা অর্জন করেছে, সেটার মধ্যে নিজস্ব মৌলিক স্কিল, কাজের ধরন সবই আছে। এদের হাতে এবারের দুর্গা পুজোর এক প্যান্ডেল রূপ নিয়েছিল আমার কাঠ খোদাই বই থেকে। বইয়ের অসাধারণ সব ছবি থেকে, যা শতাধিক বছর আগে হয়েছিল। কী অসাধারণ দক্ষতা দেখেছি। ডোম পাড়া আছে এই চিৎপুরের পাশেই।

লোহার চমৎকারিত্ব অবাক করে দেয়। চিৎপুর রবীন্দ্র কাননের পাশেই ফুটপাথের উপরই রাখা থাকেে বিশাল বিশাল হাড়ি, কড়াই, খুন্তি আরও কত কত জিনিস, যা ওরা বানিয়ে চলে সারাদিন ধরে। এরাও চিৎপুরের আর এক ঐতিহ্য। কাঠ খোদাই সন্ধান করতে করতে এদের দেখা পাই। আরও কত শিল্প অহরহ হয়ে চলেছে এই রাস্তার পাশ ধরে। কাঠের কত রকমের মালসা, হাতা-খুন্তি, কত রকমের ছোটবড় পাত্র, পুজোর জন্য বা দৈনন্দিন ব্যবহারের জন্য গড়ছে ওখানে বসেই। ওটাই কর্মস্থল, ওটাই বিপণন কেন্দ্র। পাথর কেটে কেটে মূর্তি বানিয়ে চলেছে একদল শিল্পী এই ফুটপাথে বসেই। এখান থেকে সোজা চলে যাবে ভক্তর ঠাকুর ঘরে বা মন্দিরে। চারিদিকে কেবল শিল্পের ছড়াছড়ি।
আর আমাকে আরও অবাক করে দেয় এমন অপরিসর রাস্তার দুপাশে গড়ে ওঠা কত কাঠ খোদাইয়ের দোকান আর লিথো পোস্টার ছাপার প্রেস। পাশেই যাত্রাপাড়া, এদের যাত্রার পোস্টারও এইসব লিথো প্রেস থেকে ছাপা। আগে পাথরের উপর হাতে উল্টো করে লিখে তার থেকে ছাপা হতো নানা অক্ষরের তুফান তোলা রঙিন পোস্টার। এখন সেইসব লেখার লোকের অভাব, তবে পোস্টার এখনও ছাপা হয়। তবে মেটাল শিটে প্লেট করে। এখন তো ছোটো বড় কত অফসেট মেশিন এইসব প্রেসের চরিত্র বদলে দিয়েছে।

সময়ের সঙ্গে চরিত্র বদলাবে, এটা স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। তবে যতই চরিত্র বদলাক, চিৎপুর কিন্তু চিৎপুরই থাকবে। নাম বদলে রবীন্দ্র সরণি হয়ে গেছে বহু বছর হলো, কিন্তু আজও আমি চিৎপুরকে ভালোবাসি চিৎপুর বলতেই।
বটতলার বই বলতে এই চিৎপুরের প্রকাশনাকে বলতে হয়ত। এই প্রকাশনা ঘিরেই গড়ে উঠেছিল একের পর এক শিল্পের মুখ। শিল্পীর আবির্ভাব। বটতলার বইয়ের কাছে মাইকেলকেও ধরাশায়ী হতে হয়েছিল। এখানেই বেঙ্গল থিয়েটারে মাইকেলের ‘শর্মিষ্ঠা’ নাটক চলছিল। হল ফাঁকা, হল মালিকের প্রতিদিনকার আর্থিক ক্ষতি। হঠাৎ করে রাতারাতি তারকেশ্বর মহন্তর কেচ্ছা নিয়ে লেখা নাটক নিয়ে হাজির জনৈক লেখক। হল মালিক সেই নাটককেই তাড়াতাড়ি মঞ্চস্থ করতে বললেন। রাতারাতি ‘শর্মিষ্ঠা’ বন্ধ করে শুরু হলো ‘মোহন্তর এ কী কাজ’! হল দর্শক পূর্ণ হল। এই হল চিৎপুর, এই হল বটতলা। বিচিত্র রসে পরিপূর্ণ।
ছবি সৌজন্য: লেখক, চিত্তেশ্বরী মন্দিরের ছবি সৌজন্য- গৌতম বসু মল্লিক
জন্ম কলকাতায় ১৯৫০ সালে। নিজে শিল্পী, বহু শিল্প বিষয়ক ইতিহাস ও প্রবন্ধ রচনা করেছেন। দীর্ঘ বছর যাবত উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই নিয়ে গবেষণা করে চলেছেন। তার উল্লেখযোগ্য বই Woodcut prints of nineteenth century Calcutta (১৯৮২), উনিশ শতকের কলকাতার কাঠ খোদাই শিল্পী প্রিয় গোপাল দাস (২০১৩), আদি পঞ্জিকা দর্পণ (২০১৮, বাংলা একাডেমি পুরস্কার প্রাপ্ত), কলকাতার কাঠ খোদাই ( ২০২২) রাজ্য সরকারের বিনোদ বিহারী মুখোপাধ্যায় স্মৃতি পুরস্কার ২০২২।