২৯ তম কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব (29th Kolkata International Film Festival) শুরু হবার সপ্তাহখানেক আগে থেকেই আঁচ করছিলাম এবারের ফেস্টিভ্যাল নানা কারণেই অন্যরকম হবে। তখন নন্দন চত্বর ধীরে ধীরে সেজে উঠছে। থিম সং তৈরি। সেলিব্রিটিরা এসে একবার ঘুরে যাচ্ছে চত্বর। আমাদেরও কাজের সুবাদে মিটিং সারতে যেতে হল। এবারের বিশেষ আকর্ষণ মৃণাল সেন শতবর্ষে তাঁকে ঘিরে প্রদর্শনীর আয়োজন ও উদযাপন। প্রদর্শনীর নাম ‘ম্যাভেরিক মৃণাল সেন’। সে সঙ্গে এবারে দেবানন্দ, রিচার্ড এটেনব্যরো, মুকেশদেরও শতবর্ষ। শতবর্ষ সেমবেনে, কার্লস সাওরা আর লিন্ডসে এন্ডার্সানদেরও। দেবানন্দকে নিয়েও আয়োজিত হয়েছে আরেকটি প্রদর্শনী। সে সঙ্গে থাকছে রোজ সন্ধ্যায় নন্দন প্রাঙ্গণে সাংবাদিক বৈঠক, সিনে আড্ডা, অজস্র খ্যাতনামাদের মাস্টারক্লাস, সেমিনার, সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা এবং দেশ বিদেশের কত সাম্প্রতিক অনবদ্য সব সিনেমা। আর ক’দিন পরেই তো নেতাজি ইন্ডোরে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের দামামা বেজে যাবে। তখন আর দেখে কে…
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই এবারের ফেস্টিভ্যাল শুরু হল। ডেলিগেটরা এসে পড়েছেন ইতিমধ্যে নানা দেশ থেকে। এবারে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ার ছবিকে। তা ছাড়াও ছিল নুরি বিলজে ছেলান, কেন লোচ, আলমাদোভারদের মতো কন্টেমপোরারি মাস্টারদের ছবি। অন্যান্য দেশ তো আছেই। অস্ট্রেলিয়া থেকে এসেছিলেন প্রখ্যাত পরিচালক ব্রুস বেরেসফোর্ড। তাঁর সঙ্গেও একদিন একটি আলোচনা সঞ্চালনা করার কথা সৃজিত মুখোপাধ্যায়ের। এবারে মাস্টারক্লাস রয়েছে সৌরভ শুক্লা এবং মনোজ বাজপেয়ীর। সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা দেবেন মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্টের দীর্ঘদিনের কিউরেটার লরেন্স কার্ডিশ।
অনুরাগ কাশ্যপ আসবেন তাঁর সাম্প্রতিক কেনেডি ছবিটি নিয়ে।
মৃণাল সেন শতবর্ষে অঞ্জন দত্ত পরিচালিত ‘চালচিত্র এখন’ ছবিটিকে ঘিরে এবারের উৎসাহ ছিল ব্যাপক। ব্যক্তিগতভাবে এ ছবিতে অভিনয় করার পাশাপাশি এ ছবির সঙ্গে জড়িয়ে ছিলাম শুরুর দিন থেকে। মৃণালবাবুকে নিয়েও শতবর্ষে আমরা নানা অনুষ্ঠানেরও আয়োজন করেছি এ বছর। সব মিলে এ ছবিটিকে ঘিরে উৎসাহ ছিল চরম। তখনও জানিনা এ ছবি আন্তর্জাতিক বিভাগে জুরিদের বিচারে অন্যতম সেরা ছবি-র তকমা পেতে চলেছে।
উদ্বোধন নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। প্রত্যেকবারের মতোই এবারেও আড়ম্বরপূর্ণ ভাবেই নেতাজি ইন্ডোরে মন্ত্রী ও সেলেবদের উপস্থিতিতে তা ঘটে গেল। বাংলার খ্যাতনামাদের পাশেই এবারে বিশেষ অতিথি ছিলেন সলমন খান ও অনিল কাপুর। ছিলেন শত্রুঘ্ন সিনহা ও তাঁর অভিনেত্রী কন্যা সোনাক্ষী সিনহা, সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় এবং মহেশ ভট্ট। ছিলেন জুরির সদস্য তিগমাংশু ধুলিয়া এবং জুরির চেয়ারপার্সন পাভেল লুঙ্গিনও। অনুষ্ঠানের বিশেষ আকর্ষণ ছিল প্রবীণদের প্রতি নবীনদের শ্রদ্ধা জ্ঞাপন। ছয় দশকের বেশি সময় ধরে বাংলার সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে যাঁরা কাজে কাজে ভরিয়ে রেখেছেন, এ দিন তাঁদের সম্মান জানানো হল। অভিনেত্রী সাবিত্রী চট্টোপাধ্যায়, মাধবী মুখোপাধ্যায়, দীপংকর দে, পরান বন্দ্যোপাধ্যায়-সহ প্রবীণদের শ্রদ্ধা জানান নবীন অভিনেতা-অভিনেত্রীরা।

এ বারের ফেস্টিভ্যালে গৌতম ঘোষ, অঞ্জন দত্ত, অপর্ণা সেন, সুধীর মিশ্রদের মতো ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। বড় যত্নে এবারের ফেস্টিভ্যাল গড়ে তুলেছিলেন গৌতমবাবু, শেখরবাবুদের মতো ব্যক্তিত্বরা। উদ্বোধনের দিন থেকেই ভিড়ে ঠাসা থাকছিল প্রাঙ্গন চত্বর। প্রেমেন্দু বিকাশ চাকীর বানানো থিম সঙে অরিজিত সিং গলা দিয়েছেন, কলকাতাকে নতুন রংয়ে দেখা যাচ্ছে সেখানে। নন্দন ফয়ারে মৃণাল সেনের প্রদর্শনী থেকে গগনেন্দ্রর দেবানন্দের প্রদর্শনী ছিল জনসমাগমে পূর্ণ। নতুন অনেক পরিচালকদের ছবিকে ঘিরেও এবারে উৎসাহ ছিল দর্শকদের। এ প্রসঙ্গে শৌনক সেন, লুব্ধক চ্যাটার্জি, শ্রীময়ী সিংদের কথা বলতে হয়।
কেন লোচ এ মুহূর্তে বিশ্ব সিনেমার মানবতা তথা বামপন্থার অন্যতম বার্তাবাহক বললে খুব ভুল বলা হয় না। তাঁর ‘দ্য ওল্ড ওক’ ছবিটিকে ঘিরে ব্যাপক উৎসাহ ছিল সিনেমাপ্রেমীদের। ইংল্যান্ডের ডারহাম নামের এক গণ্ডগ্রামে এই সিরিয়ান পরিবারকে আশ্রয় দেওয়ার মধ্য দিয়ে এ ছবি শুরু হয়। আশ্রয় দেওয়ার পরই শুরু হয় টেনশন। ছবি শেষ হয় এক অসাধারণ দৃশ্যকল্পের ভিতর দিয়ে। সে পরিবারের এক উদ্বাস্তু পুরুষের মারা যাওয়াকে ঘিরে ইংল্যান্ডের ডারহাম অঞ্চলের ঘটনাক্রম নিয়ে এ ছবি। কান চলচ্চিত্র উৎসবে এ ছবি দেখানোর পর আধ ঘন্টা ধরে উঠে দাঁড়িয়ে হাততালি দেন দর্শকরা।
বেশ ভিড় হয়েছিল ‘হাউ টু হ্যাভ সেক্স’ ছবিটিকে ঘিরে। ভিড় ছিল উইম ওয়েন্ডার্স, ছিলানের ‘এবাউট ড্রাই গ্রাসেস’ আলমাদোভারদের ছবিগুলি ঘিরেও। উইম ওয়েন্ডার্সের ছবি ‘পারফেক্ট ডেজ’ ছবিটি এক টয়লেট ক্লিনারের জীবনকে ঘিরে নির্মিত। তাঁর সহজ, শান্ত, ধীরলয়ের জীবনের রোজনামচারই এ কাহিনি। তেমনি আলমাদোভারের ‘এ স্ট্রেঞ্জ ওয়ে অফ লাইফ’ ছবি বলে দুই অসম বয়সী পুরুষের বিকল্প প্রেমের গল্প। এ ছাড়া পোলান্সকি-র ‘দ্যা প্যালেস’ বা লিন্ডসে এন্ডারসানের ‘ইফ’ ছবিটিকে ঘিরে উৎসাহ ছিল ব্যাপক।

সত্যজিৎ রায় স্মারক বক্তৃতা দিতে এসে লরেন্স কার্ডিশ একান্ত সাক্ষাৎকারে জানালেন, এ মুহূর্তে আমেরিকায় সত্যজিতের মতোোই জনপ্রিয় ঋত্বিক ঘটকও। বাবার বন্ধু লরেন্স কার্ডিশকে কলকাতায় স্বাগত জানাতে এসেছিলেন প্রখ্যাত চিত্রপরিচালক, অভিনেত্রী অপর্ণা সেন। সত্যজিতের পথের পাঁচালির সঙ্গেও তাঁর সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। মানবতার এমন অনবদ্য দলিল দেখে বিশ্বসিনেমা সম্পর্কে তাঁর ধারণা বদলে যায়। সে কথা এ দিন অকপটেই জানান কার্ডিশ। একই কথা জানান বেরেসফোর্ডও। মার্কিন দেশের বর্তমান সিনেমা চর্চা নিয়েও নানা কথা বলেন কার্ডিশ। বিশদে মোমার ইতিহাস ও কার্যক্রমও ব্যাখ্যা করেন তিনি।
সৌরভ শুক্লা আর মনোজ বাজপেয়ীর মাস্টারক্লাসেও ছিল রীতিমতো ভিড়। সৌরভ বলছিলেন তাঁর অভিনয় বোধের আর অনুশীলনের কথা সহজ ভাবেই। মনোজও একই কথা বলছিলেন, তার সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছিলেন ডিজিটাল যুগে আরও বেশি অভিনেতার মনঃসংযোগের প্রসঙ্গও। এবারের ফেস্টিভ্যালের সেরা ছবি হিসেবে মনোনীত হল ইজরায়েলের ‘চিল্ড্রেন অফ নোবডি’। যুদ্ধবাজ দেশের ছবি কেন এ পুরস্কার পাবে, তা নিয়েও দর্শকদের মধ্যে ছিল প্রশ্ন যদিও।
দেখতে দেখতে কীভাবে চোখের পলকে শেষও হয়ে গেল ফেস্টিভ্যাল। দিন দশেক কোথা থেকে যে কেটে গেল কে জানে! রবীন্দ্রসদন প্রেক্ষাগৃহে জুরি তথা মন্ত্রীদের উপস্থিতিতে শেষ হয়ে গেল এই বিপুল আয়োজন। এখানেই দেখা হল বুনুয়েলের শেষ ছবির অভিনেত্রী আংহেলা মলিনার সঙ্গে। বুনুয়েলের আরেকটি প্রবাদপ্রতিম ছবি অবস্কিওর অবজেক্ট অফ ডিজায়ারেও অভিনয় করেছেন তিনি। সেল্ফি তোলার পর হাতে চিমটি কেটে দেখে নিলাম সত্যিই ব্যপারটা ঘটল কি না… প্রতিবারের মতো এবারেও দিন কতক মনে হল বুঝিবা ছিলাম আবিশ্ব এক মহাদেশে, যেখানে স্বর্গ থেকে নেমে এসে আমাদের সঙ্গে চলাফেরা করতে পারে যে কোনও তারকা। কত বিখ্যাত সাধারণ বন্ধুরা এ ক দিন এসে সিনেমা দেখে চা খেয়ে আড্ডা মেরে গেল। সিনেমাপ্রেমী সবার এক ছাতার তলায় মিলে যাবার এ এক আশ্চর্য মেলা! সিনেমাই সেখানে একমাত্র পাসপোর্ট। এবারে আরও এক বছর এই স্বপ্নের এক সপ্তাহের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া শীতের এই পড়ন্ত বেলায় আর কীই বা করা যেতে পারে!
ছবি সৌজন্য: Flickr এবং Facebook
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।