banglalive logo
Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

নিবন্ধ: দৃশ্য যখন নিজেই সঙ্গীত

Bookmark (0)
ClosePlease login

No account yet? Register

Tarun Majumdar a stalwart filmmaker

সিনেমায় এত গানের ব‍্যবহার ভারতের একেবারে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য, বিশ্বের অন‍্যত্র যা বিরল। ছায়াছবির গান নিয়ে ভারতীয়দের উন্মাদনার শুরু সেই সবাক চলচ্চিত্রের আরম্ভের সময় থেকেই। সিনেমার তত্ত্বগত দিক থেকে ‘Film Music’ বিষয়টাকে যেভাবে ভাবা হয়, তার সঙ্গে আমাদের দেশের অধিকাংশ ছবি ঘিরে ‘ছায়াছবির গান’-এর যে ধারা, তাকে মেলানো বোধহয় ঠিক নয়। বাংলা ছবিতেও একইভাবে গানের উপস্থিতি অবশ‍্যম্ভাবী হয়ে আছে ছবি কথা বলে ওঠার সময় থেকেই। 

সদ‍্যপ্রয়াত চিত্রপরিচালক তরুণ মজুমদারের ছবিতে গান কতটা মুখ‍্য ভূমিকা নিয়েছে, তা নিয়ে নতুন করে কিছু বলার নেই। তিনি নিজে সংগীতবোদ্ধা ছিলেন। ফলে, তাঁর সঙ্গে সংগীত পরিচালকদের চিন্তাধারার তালমিলটা হত খুব ভালো। ছবিতে গান ব‍্যবহারের ব‍্যাপারে সংগীত পরিচালকের সঙ্গে তরুণবাবুরও যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকত। এই বোঝাপড়ায় যাতে কোনও অসুবিধে না হয়, সম্ভবত সেই কারণেই আমরা দেখি, তরুণবাবুর প্রথম ও শেষের দিকের কয়েকটি ছবি বাদে একটানা তাঁর সঙ্গে সংগীত পরিচালক হিসেবে কাজ করে গেছেন হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়। এর ফলে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গানের নির্মাণ ও নির্বাচন এবং তা নিয়ে দৃশ‍্যরচনা, হয়ে উঠেছে আদর্শ ও মনোগ্রাহী, যার মধ্যে আছে রবীন্দ্রনাথের গানের উজ্জ্বল উপস্থিতি। এমন অজস্র গানের দৃশ্যের কথা বলা যায় তরুণ মজুমদারের ছবিগুলির ধারাবাহিক আলোচনা করলে। তবে এই স্বল্প পরিসরে যেহেতু তা সম্ভব নয়, তাই বেছে নিলাম আমার প্রিয় কয়েকটি গানের দৃশ্য, যেগুলির সুরম্য তথা সুরময় অভিঘাত আমার মনে আজও টাটকা, যেখানে সুর-কথা-দৃশ্যপরিকল্পনার মেলবন্ধন যেন অদৃশ্য সূত্রে গ্রন্থিত হয়ে রয়েছে।

তরুণ মজুমদারের সঙ্গে শচীন মুখোপাধ‍্যায় ও দিলীপ মুখোপাধ‍্যায় মিলে গড়ে তুলেছিলেন ‘যাত্রিক’ পরিচালক গোষ্ঠী। এঁদের প্রথম পরিচালিত ছবি ‘চাওয়া পাওয়া’ (১৯৫৯)। নায়ক-নায়িকা উত্তম সুচিত্রা। সংগীত পরিচালক নচিকেতা ঘোষ। ছবিতে ঘটনাচক্রে নায়ক নায়িকার দেখা হয়ে গেছে এবং তাঁরা গিয়ে পড়েছেন এক আস্তানায়। বাধ্য হয়ে দু’জনকে পরিচয় দিতে হয়েছে স্বামী-স্ত্রী হিসেবে। চাঁদের আলোয় ভেসে যাওয়া চরাচরে, ছাদের ওপর বাড়ির লোকেরা দু’জনকে নিয়ে রোম্যান্টিকতায় মেতে উঠেছেন। সুচিত্রার গলায় মালা পরিয়ে, সাজানো হয়েছে কনের সাজে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে উত্তম। তখনও পর্যন্ত বাস্তবে এসব সত্যি না হলেও, দুজনের হৃদয় একে সত‍্যি বলে ভাবতে চাইছে। এই সময় সন্ধ‍্যা-কণ্ঠে সুচিত্রা গেয়ে উঠলেন 

‘এই যে কাছে থাকা
এই যে বসে থাকা
বন্ধু জেনো
এ তো খেলা নয়…।’ 

নায়কের উদ্দেশ্যে নিশ্চিত প্রেমের বার্তা। গান যেই শেষ হয়, উত্তম-ওষ্ঠে এসে বসেন হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায় “যদি ভাবো/ এ তো খেলা নয়/ ভুল সে তো শুরুতেই…”। প্রেমের পথেই নায়িকার গানের উত্তর। অপূর্ব গানদুটিকে সঙ্গী করে এই দৃশ‍্যভাবনার কোনও তুলনা নেই, যেখানে পরিচালকের সঙ্গে সেলাম জানাতে হবে সুরকারকেও। কেন আমাদের কাছে সুচিত্রা মানে সন্ধ‍্যা, আর উত্তম মানে হেমন্ত-কণ্ঠ, তার অন‍্যতম সেরা দৃষ্টান্ত ‘চাওয়া পাওয়া’-র এই দৃশ‍্যটি।

‘যাত্রিক’-এর তৃতীয় ছবি ‘কাঁচের স্বর্গ’ (১৯৬২)। ছবিতে রয়েছে, নায়ক দিলীপ মুখোপাধ‍্যায় অত্যন্ত মেধাবী হয়েও ডাক্তারি পড়া শেষ করতে পারলেন না অবস্থার ফেরে পড়ে। কিন্তু চাকরির তাড়নায় পাশ করা ডাক্তার পরিচয় দিয়ে যোগ দিলেন একটি হাসপাতালে। সেখানে অসাধারণ স্বাক্ষর রাখলেন কাজের। কিন্তু একটা সময় এল, যখন তাঁর আসল পরিচয় ধরা পড়ে গেল। জীবনে চলা আলো-অন্ধকারের এই টানাপোড়েনে তছনছ হতে লাগলেন নায়ক। এইসব অবস্থার মধ্যে একটি পরিস্থিতিতে ব‍্যবহার করা হয়েছে দ্বিজেন মুখোপাধ‍্যায়ের গলায় রবীন্দ্রনাথের ‘দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায় রইল না’ গানটি। অবশ্যই অনবদ্য প্রয়োগ, যা তরুণবাবুর ছবির বিভিন্ন আলোচনাতেও বারবার এসেছে। কিন্তু এই ছবিতেই আরেকটি রবীন্দ্রসংগীত ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে…’  যেভাবে পরিচালক ব্যবহার করেছেন দৃশ্যরচনায়, তা ভাবা যায় না। ছবির সংগীত পরিচালক ছিলেন স্বনামধন্য সুরসাধক জ‍্যোতিরিন্দ্র মৈত্র। এরকম একজন বিরাট মাপের সংগীতগুণীর ছোঁয়ায়, রবীন্দ্রসংগীতের ব‍্যবহার একটা অন‍্য মাত্রা পেয়েছে ছবিতে। দু’বার দু’রকম লয়ে গানটির ব‍্যবহার, অন্তরে ধাক্কা লাগিয়ে দেয়। প্রথমে একবার হয় স্বাভাবিক লয়ে, যেভাবে সাধারণত গাওয়া হয় ‘আগুনের পরশমণি’। কিন্তু আর একবার, যখন নায়কের মানসিক দ্বন্দ্ব চরম আকার নিয়েছে, সেইসময় দ্রুত লয়ে গানটি কোরাসে ভেসে আসে দূর থেকে। এই গান যে ঐভাবে দ্রতগামী হয়ে, ছবির পরিস্থিতিকে, নায়কের মনের উথালপাথালকে পরিস্ফূট করে তুলতে পারে, তা না দেখলে ও শুনলে বোঝা যাবে না। সংগীত-প্রয়োগের এই অভিনব ভাবনা সত‍্যিই অতুলনীয়।

তরুণ মজুমদার, দিলীপ মুখোপাধ্যায় ও শচীন মুখোপাধ্যায়ের মিলিত উদ্যোগে গড়ে ওঠা ‘যাত্রিক’ গোষ্ঠীর শেষ ছবি ‘পলাতক’ (১৯৬৩)। তার পরেই তরুণ মজুমদার এই গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে এসে এককভাবে ছবি করতে শুরু করেন। আর শচীন মুখোপাধ‍্যায়ও বেরিয়ে যান। তারপর অবশ্য দিলীপ মুখোপাধ‍্যায় একা ‘যাত্রিক’ নামে কয়েকটি ছবি পরিচালনা করেছিলেন। ‘পলাতক’ থেকেই তরুণ মজুমদারের সঙ্গে হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের গাঁটছড়ার আরম্ভ। যখন ছবির সংগীত পরিচালনার প্রস্তাব নিয়ে তরুণবাবু যান হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের কাছে, প্রথমে তিনি রাজি হচ্ছিলেন না। কারণ, মনোজ বসুর লেখা যে ‘আংটি চাটুজ‍্যের ভাই’ গল্প থেকে ছবিটা তৈরি, তার কাহিনি গ্রামীণ লোকজীবননির্ভর। স্বাভাবিকভাবেই সেই অনুযায়ী সংগীত-নির্মাণ করতে হবে। হেমন্তবাবু তাই বলেছিলেন, এটা তাঁর পক্ষে একটু অসুবিধে, কারণ, লোকগানের ব‍্যাপারে তিনি একটু “মাটো” আছেন। তরুণ মজুমদার শোনেননি সে কথা। হেমন্তকে কাজে নামতে হয়। এরপর এ ছবির গান ও সংগীত কোথায় গিয়ে পৌঁছয়, তা সবাইকার কাছেই জানা। ‘পলাতক’ ছবিতেই প্রথমবার বাংলা গান লিখলেন মুম্বইয়ের মুকুল দত্ত।

ছবিতে ‘বসন্ত’রূপী অনুপকুমার মুক্তবিহঙ্গের মতো। খাঁচায় রাখা তাকে সম্ভব নয়। সারাক্ষণ শিকল কেটে বেরিয়ে পড়াটাই তার কাজ। হরেকরকম পরিবেশ আর মানুষের মধ্যে উড়ে বেড়ায় সে। এ হেন বসন্তকে কেন্দ্র করেই এগিয়েছে ছবি। সেই অনুযায়ী হয়েছে প্রত‍্যেকটা গান ও তার দৃশ‍্য নির্মাণ। তা কতদূর সফল হয়েছে, সে সবাই জানেন। ‘পলাতক’ নামটা বললেই এর প্রায় সবকটি গান আমাদের কানে মনে বাজতে থাকে। তার মধ্যে তুলনামূলকভাবে কম আলোচিত একটি গান হল, ‘আহারে বিধি গো তোর…’। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের লেখা দেহাতি সুরঘেঁষা গানটিতে মুখ‍্য কণ্ঠ পঙ্কজ মিত্রর। সঙ্গে আছেন হেমন্ত ও অন‍্যান‍্যরা। জমিদার বাড়ির ছোটকর্তা বসন্ত রাস্তায় কতগুলি প্রান্তিক মানুষের সঙ্গে মেতে উঠেছেন গান নিয়ে। উদ্দাম ঢোল বাজছে। মূল গায়ক একটি অন‍্য লোক। বসন্ত মাতোয়ারা হয়ে উপভোগ করছে। গান থেকে বেরিয়ে আসছে বসন্তেরই চরিত্রলিপি 

‘আহারে বিধি গো তোর লীলা বোঝা দায়
যে উড়িয়া বেড়ায় তারে বাঁধিস খাঁচায়
সে যে উড়ে যায় উড়ে যায় যায় যায় যায়
আকাশে যে পাখি ঐ মেলে তার ডানা
কী সুখে খাওয়াস তারে শুধু সোনাদানা
সে যে উড়ে যায় উড়ে যায় যায় যায় যায়’। 

এ তো একেবারে মনের কথা বসন্তর! তাই সে পাগলকরা উচ্ছ্বাসে ভেসে যাচ্ছে। মাঝেমাঝে “ওওওও…” ক‍রে গলা দিচ্ছে। অবশ্যই এই হামিং বেরিয়ে আসছে হেমন্ত-কণ্ঠ থেকে। গোটা গানে একটা লাইনই শুধু বসন্ত গাইল, ‘ছায়ারে কভু কি বলো ধরে রাখা যায়…’। দৃশ‍্যটি অদ্ভুত অর্থ বয়ে আনে, বিশেষ করে গানের শেষে পৌঁছে। জমিদার বাড়ির এক কর্মচারী বসন্তকে ডাকতে এসেছে। গানে মশগুল বসন্ত তার ডাক প্রথমে শুনতেই পায় না। তারপর বিরক্ত হয়ে উঠে তাকে তিরস্কার করে। গানও শেষ হয়। এই একটি গান ও দৃশ্যের মাধ‍্যমে পরিচালক স্পষ্ট করে দেন, আপনখেয়ালে গড়া মুক্ত জগতের সঙ্গে প্রথাগত নিয়ম দিয়ে ঘেরা দুনিয়ার চিরকেলে সংঘাতকে।

ছবির শেষের দিকের আর একটি গানের দৃশ্যের কথা বলি, যেখানে বসন্তরই বাড়িতে, তারই ছেলের অন্নপ্রাশনের উৎসবে ঝুমুরওয়ালিদের নাচের সঙ্গে গান হচ্ছে 

‘চিনিতে পারিনি বঁধু
তোমারই এ আঙিনা
তাই দেরি হল যে দেরি হল যে
তোমার কাছে আসিতে…।’ 

অভিনয় করে গাইছেন রুমা গুহ ঠাকুরতা। দীর্ঘদিন বাড়িছাড়া বসন্তও এসেছে এই দলের সঙ্গে। কিন্তু সে ভীষণ অসুস্থ। তাই বাইরে গরুর গাড়িতে শুয়ে রয়েছে। গান ক্রমশ কানে যেতে ধীরে ধীরে তার সম্বিৎ আসছে। সে তো জানে না কোথায় এসেছে? এবার বুঝতে পারল, এ তারই বাড়ি। গাড়ি থেকে নেমে সবাইকার অলক্ষ্যে ঢুকে পড়ল বাড়িতে। এরপর কী হল, তার বর্ণনা দেবার দরকার নেই। কিন্তু এরকম পরিস্থিতিতে গানটি যেভাবে দৃশ‍্যে এসেছে, তার বাণী সুর গায়নভঙ্গি এবং গোটা দৃশ‍্য উপস্থাপন যেন তৈরি করে দিয়েছে একটু পরেই ঘটা সেই বিস্ফোরণের প্রেক্ষাপট। কী সেই বিস্ফোরণ? তার কথা বলা অনর্থক। কারণ, ‘পলাতক’ আমাদের তন্ত্রীতে মিশে থাকা অন‍্যতম একটি ছবি।

এবার বলি, ১৯৬৭-র সুপার হিট ছবি ‘বালিকা বধূ’-র কথা। মিষ্টি প্রেমের গল্পের চিত্রবিন‍্যাস। ছবির একজায়গায়  নায়ক পার্থ মুখোপাধ‍্যায় সঙ্গীসাথীদের নিয়ে বরবেশে বিয়ে করতে আসছে মোটরে চড়ে। সবাই একযোগে তখন গান ধরেছে, 

‘আজি এসেছি
আজি এসেছি
এসেছি বঁধু হে
নিয়ে এই হাসি রূপগান…’। 

দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের এই বিখ্যাত গানটির এরকম ব‍্যবহার সত্যিই অভিনব! যেন এক নতুন আবেদনের প্রকাশ ঘটল এর ফলে। সমবেত কণ্ঠকে সহযোগী করে গানটি গেয়েছিলেন রবীন বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়। এ গানের সঙ্গে মাঝেমাঝেই বেজে উঠেছে মোটরগাড়ির হর্ন। এটাই যেন গানটির প্রিলিয়‍্যুড আর ইন্টারলিয়‍্যুডের কাজ করেছে। গান ও দৃশ্যের এ এক অসামান্য উপস্থাপন-ভাবনা। ছবি বেরনোর কিছুদিন পর থেকেই লোকের মুখে মুখে হর্নের আওয়াজ সমেত ‘আজি এসেছি…’ গান ফিরতে শুরু করেছিল। গাড়ির হর্নের কর্কশ শব্দও যে সুরের দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পারে, দেখিয়ে দিয়েছিলেন হেমন্তবাবু। 

‘ফুলেশ্বরী’ (১৯৭৪) গান দিয়ে সাজানো তরুণবাবুর আর একটি ছবি। এ ছবির টায়টল দৃশ্যের পিছনে ছিল পরিচালকের এক বিশেষ ভাবনা। বিভূতিভূষণ মুখোপাধ‍্যায়ের এই কাহিনি নিয়ে যখন ছবিটি করার সিদ্ধান্ত নেন তরুণবাবু, তখন একটা বিষয় নিয়ে তিনি ভেবেছিলেন। সত্তর দশকের ঐরকম সময়ে, চারিদিকে যখন চলছে পুরনো অনেক ধ‍্যানধারণা ভাবনাচিন্তা ভাঙাভাঙির প্রক্রিয়া, যুবসমাজ তাদের মতো করে খুঁজে নিতে চাইছে নতুন দিশা; তখন  গ্রামবাংলার প্রেক্ষাপটে এরকম একটি প্রেমের ছবি করার উদ্দেশ‍্যটা সকলের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। এই কাজটি তিনি করেছিলেন একটি কথকতাধর্মী টায়টল-সংয়ের মাধ‍্যমে। গানটির শুরু হচ্ছে এইভাবে 

‘শুনো শুনো মহাজন
শুনো দিয়া মন
বিচিত্র কাহিনি এক
করি গো বর্ণন
আহা বেশ বেশ বেশ
যদিও জানি গো ইহা চুয়াত্তর সন
দিকে দিকে প্রগতির কত না লক্ষণ
আহা বেশ বেশ বেশ…।’ 

এভাবে গান এগিয়েছে নানা ধরনের ‘প্রগতি’-র বর্ণনা দিতে দিতে। সেই অনুযায়ী ছবি দেখানো হচ্ছে। একেবারে শেষে গিয়ে গানটির চরিত্র পালটে গেল। বলা হল আসল কথা। দ্রুত লয়ের দাদরা বাজতে লাগলো বিলম্বিতে। মান্না দে-র একক কণ্ঠ থেকে যেন প্রকাশ পেল আবেশে ভরা স্মৃতিতাড়িত গায়কী। যেখানে গান বলছে

‘তবু মাঝেমাঝে মন যেতে চায় ফিরে ফিরে
ছায়াসুনিবিড় স্বপ্নমদির হারানো দিনের ভিড়ে

আকাশ যেথায় নীলিমায় নীল
তরুমর্মরে বিশ্বনিখিল
গেয়ে ওঠে গান…।’ 

শেষের এই অংশটাতেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় ছবি তৈরির কারণ। একইরকমভাবে, ‘গণদেবতা’ (১৯৭৯) ছবিতেও টায়টলে প্রভাতী সুরে তৈরি মান্না দে-রই গাওয়া ‘ভোর হইল জগত জাগিল…’ গানের ব‍্যবহার থেকে ছবির নির্যাস বেরিয়ে আসে। যদিও দুটি ছবির টায়টল-সং  দু’রকম উদ্দেশ্যে ব‍্যবহৃত, কিন্তু ভাবনা অসাধারণ!

আগেই বলেছি, ‘ফুলেশ্বরী’র সবকটি গানই অসামান্য। প্রেমকে এ ছবিতে এক ঐশ্বরিক পথে এগিয়ে নিয়ে গেছেন পরিচালক। গুমটিম‍্যান বৃন্দাবন দাস (শমিত ভঞ্জ) হয়ে উঠেছেন ভক্তি ও প্রেমে মাতোয়ারা যেন এক পরমবৈষ্ণব। ফুলেশ্বরীর (সন্ধ‍্যা রায়) প্রতি তাঁর তীব্র প্রেম ভীষণ অন্তর্মুখী। প্রকাশিত হতে চায় না বাইরে। অথচ একের পর এক গানে যা বাইরে আসে রূপকের আড়ালে। এর মধ্যে একটি গানের দৃশ‍্যে বোধহয় একূল ওকূল দুকূল ছাপিয়ে গেছে প্রেম। চারিপাশ ভেসে যাচ্ছে জ‍্যোৎস্নায়। নিজের কুঁড়েঘরের বাইরের উঠোনে সেই চাঁদের আলোয় স্নান করতে করতে বৃন্দাবন দাস গাইছে,

‘আমি দেখতে ভালোবাসি
আমি নয়নভরে দেখতে ভালোবাসি
নয়ন যদি ভরে কভু
ভরে না তো মন কভু
আমি পাগল হইলাম শুনে শুনে
তোমার মোহনবাঁশি…।’ 

পরিবেশ যেন প্রেমময় লীলাভূমি বৃন্দাবনের রূপ নিয়েছে। আর সুরপথে সেই প্রেমের সাধনা করে চলেছে পরমবৈষ্ণব বৃন্দাবন। মুকুল দত্তের বাণীকে আশ্রয় করে যেন সুরলোক থেকে ঝরে পড়ছে হেমন্তের গলা, যে অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ অসম্ভব। গানের মাঝে বৃন্দাবনের সৎমা (মলিনা দেবী) ঘর থেকে বেরিয়ে এসে কিছু বৈষয়িক কথা বলেন। এ ব‍্যাপারে বৃন্দাবনের কী করণীয়, তা নিয়েও পরামর্শ দেন। কিন্তু বৃন্দাবন বলে, ওসব তার প্রয়োজন নেই। সে শুধু বলতে চায়,

‘আমার বসতি ওহে ভালোবাসার দেশে
সুখের বাতি জ্বলে যেথায় সকল পাওয়ার শেষে
খেদ নাই আর এ জীবনে
কেটেছে রে আপনমনে
যেন হে বিধাতা এই মাটিতে আবার ফিরে আসি…।’

দু’হাত প্রসারিত অবস্থায় ভাবে বিভোর হয়ে গান শেষ করে বৃন্দাবন। এরকম দৃশ‍্যবিন‍্যাসকে চিরকালের জন্যে আঁকড়ে ধরে রাখতে চায় মন। আর একইসঙ্গে পরিচালক-সহ সংশ্লিষ্ট সবাই স্মরণীয় হয়ে থাকেন আমাদের কাছে।

উপরে যেসব ছবির কথা বলা হল, তা বাদেও তরুণ মজুমদারের আরও অনেক ছবিতে স্মরণীয় মনকাড়া সুরময় সঙ্গীতময় দৃশ্য এসেছে। রবীন্দ্রনাথের গান সেখানে অত‍্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছে। শহর গ্রাম নির্বিশেষে তরুণবাবুর ছবি থেকে মনকাড়া বাংলার রূপ প্রতিভাত হয়। ফলে তা এতটাই আমাদের নিজের মনের কাছে আপন লাগে, যে তা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে মন চায় না। শুধু আবিষ্ট হয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়।

 

*ছবি সৌজন্য: Pinterest
*ভিডিও সৈজন্য: Youtube

জন্ম ১৯৬৫-তে কলকাতায়। বেড়ে ওঠা চন্দননগরে। স্কুল জীবন সেখানেই। কলকাতার সিটি কলেজ থেকে স্নাতক। ছোটো থেকেই খেলাধূলার প্রতি আগ্রহ। গান শেখাও খুব ছোটো থেকেই। তালিম নিয়েছেন রামকুমার চট্টোপাধ্যায়ের কাছেও। দীর্ঘদিন মার্কেটিং পেশায় যুক্ত থাকার পর, গত বারো বছর ধরে পুরোপুরি লেখালেখি, সম্পাদনার কাজে যুক্ত। পুরনো বাংলা গান, সিনেমা, খেলা ইত্যাদি বিষয়ে অজস্র প্রবন্ধ লিখেছেন। আনন্দবাজার পত্রিকা, এই সময়-সহ বহু পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লেখেন। সম্পাদিত বইয়ের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উত্তমকুমারের "হারিয়ে যাওয়া দিনগুলি মোর", হেমন্ত মুখোপাধ‍্যায়ের "আনন্দধারা", রবি ঘোষের "আপনমনে", মতি নন্দীর "খেলা সংগ্রহ"। লিখেছেন "সংগীতময় সুভাষচন্দ্র" বইটি। সাত বছর কাজ করেছেন "মাতৃশক্তি" ও "জাগ্রত বিবেক" পত্রিকায়। বর্তমানে নিজস্ব লেখালিখি ও সম্পাদনা নিয়ে ব্যস্ত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com