Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

আহারেণু: পর্ব ২ – বাঙালির অম্বলরসনা

bengali-aamer-chatni-mango
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

কৃত্তিবাসী রামায়ণে সীতার বিয়ের ভোজনে খাবার পরিবেশনার বর্ণনাতেই আছে: “শেষে অম্বলান্তে হৈল ব্যাঞ্জন সমাপ্ত / দধি পরে পরমান্ন পিষ্টকাদি যত…”
বাঙালির শেষপাতে টকজাতীয় কিছু পদ চাইই। তা সে অম্বল হোক বা চাটনি কিম্বা টক বা জারক। এই অম্বলের সঙ্গে বাঙালির গাঁটছড়া বহুকাল আগে থেকেই। ‘মৈমনসিংহ গীতিকা’র মলুয়া পালাতে উল্লেখ আছে এমন অম্বলের কথা। “মানকচু ভাজা আর অম্বল চালিতার…”

বাঙালির ভাদ্র সংক্রান্তিতে মা মনসার রান্নাপুজোর অন্যতম পদ চালতার অম্বল বা টক। বাঁকুড়ায় মনসা পুজোর অরন্ধনের দিন হয় আমড়ার গুড় অম্বল। এটি নামানোর আগে চালবাটা দেওয়ার রীতি। মনে পড়ে গেল পিঠালি বা পিটুলি গোলা দিয়ে মঙ্গলকাব্যের রান্নার কথা। রাঢ়ের পৌষসংক্রান্তির বাউনি রীতিতে মূলো, বেগুন ও বড়ির টকের উল্লেখ আছে৷ আমাদের ঘটিবাড়ির কালীপুজোর দিনে দীপান্বিতা লক্ষ্মীপুজোয় রাঙালু, সদ্য ওঠা কাঁচা তেঁতুল, বেগুণ আর মটর ডালের ভাজা বড়ি দিয়ে টক নিবেদন করা হয় মায়ের ভোগে।

Chaltar Chutney
জিভে জল আনা চালতার টক। একটু থকথকে কিন্তু টক-ঝাল-মিষ্টি স্বাদে অনন্য

আসলে চাটনি বা অম্বল আমাদের পালা পার্বণের সঙ্গেও বিশেষভাবে জড়িত। যে সময়ে যেটা পাওয়া যায় সেটাই ঈশ্বরকে নিবেদনের রীতি। যেমন মাঘ মাসের গোটা ষষ্ঠীতে টোপাকুলের অম্বল, যার ওপরে ছড়ানো থাকবে সজনে ফুলের কুঁড়ি সমেত ফুলও। এই কম্বিনেশন সারাবছর মিলবে না। সেই ভাদ্রের অরন্ধনের চালতার মতোই।

মামাবাড়ির জগদ্ধাত্রী পুজোয় দেখেছি একদিনে মায়ের সপ্তমী, অষ্টমী আর নবমী পুজোর ভোগ রান্না। সেখানেও মায়ের ভোগের শেষপাতে চাটনির বৈচিত্র্য। একই রান্নাঘরে তিনজন ভোগ রাঁধছেন। কারণ একইদিনে একটার পর একটা ভোগ বেড়ে দিতে হবে তিথি অনুযায়ী। সপ্তমী পুজোর জন্য টমেটোর চাটনি হবে। সেখানে নামানোর সময় সামান্য আদাকুচি পড়বে। অষ্টমীর জন্য মহার্ঘ্য আমসত্ত্ব, খেজুর, কিশমিশ, তেঁতুল যুক্ত হবে আলুবখরার বেসে। আবার নবমীর ভোগে নিবেদিত হবে সদ্য ওঠা কচি জলপাইয়ের চাটনি। সেখানে নামানোর আগে সর্ষেবাটা দেওয়া হবে।

রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘যোগাযোগ’ উপন্যাসে মধুসূদন কেমন লোক তা বোঝাতে গিয়ে তাঁর দৈনিক মেনু উল্লেখ করেছিলেন। বলেছিলেন, মধুসূদন খান কলাইয়ের ডাল, কাঁটা চচ্চড়ি, তেতুঁলের অম্বল আর একবাটি চিনি মেশানো দুধ৷

সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘জলে ডাঙ্গায়’ বইতে আছে বাঙালির পঞ্চরসে ভোজন সমাপনের কথা। “আমরা তেতো, নোনা, ঝাল, টক, মিষ্টি— এই পাঁচ রস দিয়ে ভোজন সমাপন করি।” অর্থাৎ আমাদের পঞ্চব্যঞ্জন সেই হরেদরে পঞ্চরসের সমাহারও বটে এবং বিদেশি মেন্যুর ফাইভ কোর্স মিলও। বাঙালির এ এক প্রাচীন ট্র্যাডিশানও। বাঙালির সব ধরনের আনন্দানুষ্ঠানের নিমন্ত্রণের মেন্যুতে, তা সে নববর্ষেরই হোক কিম্বা ঠাকুরের ভোগের, আইবুড়োভাত, উপনয়ন কিম্বা সাধভক্ষণ অথবা অন্নপ্রাশনে তেতো দিয়ে দুপুরের খাওয়া শুরু করে আর টক দিয়ে সমাপন। মিষ্টির স্থান টক বা অম্বলের পরেই কারণ মিষ্টিমুখ হয়ে গেলে জিভে আরও টক লাগবে অম্বল সেই কারণে।

green-olive-chutney-bengali-jalpai-er-chutney
কাঁচা জলপাইয়ের অম্বল বাঙালির ভোগবাড়িতে থাকবেই

বিপ্রদাস মুখোপাধ্যায়ের ‘পাকপ্রণালী’তে এখনকার ফ্রুট চাটনির মতো অনেক চাটনির কথা পেলাম। তার মধ্যে অন্যতম লিচুর চাটনি, লকেট ফলের চাটনি, করমচার চাটনির কথা। সবের মধ্যমণি সরষে ফোড়ন। কচি আমের ঝোল বা কমলালেবুর অম্বলের কথাও রয়েছে সেখানে।

রবীন্দ্রনাথের সেজদাদা হেমেন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং পূর্ণিমা দেবীর মধ্যম কন্যা প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী রান্নাকে সে যুগে একটি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেছিলেন। ১৩০৭ বঙ্গাব্দে লেখা “আমিষ ও নিরামিষ আহার”-এর লেখক ঠাকুরবাড়ির মেয়ে স্বনামধন্য এই রন্ধন গবেষক রবিঠাকুরের পঞ্চাশতম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে নিজের হাতের রান্না করা ‘পটোলের ঝুরঝুরে অম্বল’ খাইয়েছিলেন।

লোভনীয় মিষ্টি দেখলেই যেমন আমাদের নোলা শকশক করে তেমনই ঠিকঠাক চাটনি বা অম্বল মানে যার টক-নুন-মিষ্টির কেমিস্ট্রি এক্কেবারে নিক্তিতে মাপা। তেমন চাটনি পেলেই আমার মনে পড়ে মায়ের মুখে শোনা সেই প্রচলিত ছড়াটা:

“ও নোলা, তপ্ত খোলা / ও নোলা পরের ঘর।
ও নোলা সামলে চল / যবে যাবি বাপের ঘর
তুলে খাবি দুধের সর / এ হল শ্বশুরঘর
এখন কি আর করবি বল? / নোলা তুই সামলে চল” 

বাঙালির অম্বল, টক বা চাটনির মূলেই বুঝি প্রচলিত আরেকটি ছড়ার জন্ম হয়েছিল বহুকাল আগে:  “নুন চুপচুপে লেবুর রস, ত্যাঁদড়া ভাতার মাগের বশ…”  হ্যাঁ। মেয়েদের এমনি শুনতে হয়েছে বটে একসময়। আর তাই বুঝি আগেকার বাল্যবিধবারা কারোকে তোয়াক্কা না করেই শিখে ফেলেছিলেন চটজলদি “হাত অম্বল”। নয়তো লুকিয়ে বা তুলে খেলেও কথা শুনতে হবে তাদের, “বউদের মুখ চলে দিনে সতেরোবার…” সেখানে হাতঅম্বল চাটতে চাটতে হাতের এঁটো হাতে শুকিয়ে নেওয়াতেই ছিল মজা তাদের। 

Fig-chutney
গৌতম কুমার দে ‘বাঙ্গালীর লুপ্ত খাদ্য চর্চা’ বইতে জানিয়েছেন ডুমুরের চাটনির স্বাদ নাকি স্বর্গীয়

চিত্রা দেব ঠাকুরবাড়ির রান্নায় লিখেছিলেন কচি তেঁতুলের ফটিক ঝোলের কথা। সেখানে তিলবাটা দিয়ে আমড়ার টক, বেগুণ দিয়ে কাঁচা কুলের অম্বল আর পাকা পেঁপে কিম্বা পাকা পটলের অম্বলের রেওয়াজও ছিল। এছাড়াও ফলসা বা আমলকীর চাটনি, তেঁতুল বিচি কড়াইতে বালিখোলায় ভেজে গুঁড়ো করে পাকা কয়েৎবেল মাখা দিয়ে ডালিম, তেঁতুল, ফলসা, কুল আর লেবু এই পাঁচ ফলের উপস্থিতিতে পাঁচ মুখানি টকের কথাও উল্লেখ করেছেন তিনি। গৌতম কুমার দে ‘বাঙ্গালীর লুপ্ত খাদ্য চর্চা’ বইতে জানিয়েছেন পাকা কলার অম্বল, মন্দারের অম্বল, ডুমুরের চাটনি আর আলুর টকের কথা। এসবের স্বাদ নাকি স্বর্গীয়।

তাত্ত্বিক দিক থেকে অম্বল, টক বা চাটনি এসবই শেষপাতের রেলিশের আওতায়। অম্বল বা টক পাতলা আর চাটনি অপেক্ষাকৃত গাঢ়। চাটনিতে ফোড়ন থাকতেও পারে নাও পারে কিন্তু অম্বল বা টকে ফোড়ন দিতেই হয়। সুন্দরী চাটনি যেন অভিজাত ঘরের ঝাঁ চকচকে মেয়েটি। আর অম্বল বা টক হল আটপৌরে সুন্দরী যে নিজের রূপের বিষয়ে মোটেও সচেতন নয়। তাই বুঝি নিমন্ত্রণ বাড়ির ভোজে অম্বল বা টককে কেউ পাত্তা দেয় না। চাটনিরই সেখানে স্থায়ী আসন।

বহু আগেকার বিয়ের ভোজের ক্রমণী (নামকরণঃ প্রজ্ঞাসুন্দরী দেবী)  বা মেন্যু কার্ডে রয়েছে এমন সব কেতাদুরস্ত চাটনির নাম। আদা, আমাদা, আরকনানা, শশা আর চিনি দেওয়া পঞ্চরত্ন চাটনি কিম্বা আনারসের চাটনি কে সেখানে বলা হয়েছে “আনকরসাম্লম্”। “কন্দ-ভাগাম্লম্” বলা হয়েছে মহার্ঘ্য আলুবখরার চাটনি কে। ১৮৯৭ সালেও বিয়ের ভোজে থাকত এসব চাটনির উজ্জ্বল উপস্থিতি। আমড়ার চাটনি বা “আম্রাতকাম্লম্” এবং হজমি, আম এবং আদার জারক বা “চুতার্দ্রকম্” এর নামও পাওয়া গেছে সেখানে। অতএব অম্ল বা টকের সঙ্গে বাঙালির গাঁটছড়া বহুযুগের। ১৯৪৭ সালে সৌরীশচন্দ্র রায়ের “পাকা দেখা” বা আশীর্বাদের মেন্যুতে ছিল পাঁচরকমের চাটনির কথা। কিছুকাল পরে তা-ই আবার সপ্ত চাটনিতে পরিণত হয়েছে। কমলালেবুর চাটনির সঙ্গে ধনেপাতা, পুদিনা সবের চাটনি যুক্ত হয়েছে আধুনিক কালে। জানিয়েছেন বাঙালির প্রাচীন মেন্যু কার্ডের লুপ্তখাদ্যের লেখক গৌতম দে মহাশয়।

MouralarTak
মৌরলা মাছের টক

এ তো গেল বাংলার নিরামিষ চাটনি বা টক, অম্বলের কথা। বাঙালির সিগনেচার রেলিশ কিন্তু মাছের টক বা মাছের অম্বল। রন্ধন পটীয়সী ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর একবার দুই সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র এবং সঞ্জীবচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে বাড়িতে নেমন্তন্ন করে পাঁঠার মাংসের ঝোল, ভাত আর পাঁঠার মেটের অম্বল খাইয়েছিলেন। সেই শুনে বঙ্কিমচন্দ্র বিদ্যাসাগরকে রীতিমতো সার্টিফিকেট দিয়েছিলেন এই পাঁঠার মাংসের অম্বলের। দ্বিজেন্দ্রনাথ ঠাকুরেরও প্রিয় খাবার ছিল পাঁঠার মাংসের হাড়ের অম্বল। তিনি তার ‘গুম্ফ আক্রমণ’ কাব্যে লিখেছিলেন – বৃহৎ রুপার থালে/ পাচক ব্রাহ্মণ ঢালে/ মাংসের পোলাও গাদাগাদা/ কি গুন পাঁঠার হাড়ে/ অম্বলের তার বাড়ে /কে বুঝিবে ইহার মর্যাদা।

বিজয়গুপ্তের “মনসামঙ্গল” এ “শৌল মৎস্য দিয়া রান্ধে আমের অম্বল” অথবা “চেঙ্গ মৎস্য দিয়া রান্ধে মিঠা আমের বউল”-এর কথা পাই। আবার রাঢ়ের কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর “চণ্ডীমঙ্গল”-এ খুল্লনার রান্নায় রীতিমত অম্বলের জয়জয়কার। “করিয়া কণ্টকহীন, আম্রে শউল মীন / খর লুন দিয়া ঘন কাটি।”

হুগলীর রাজবলহাটের রাজবল্লভী দেবীর পুজোয় তেঁতুল দিয়ে মাছের অম্বল থাকবেই ভোগের আইটেমে।  ঝাড়গ্রামের আদিবাসী অধ্যুষিত চিল্কিগড়ের কনকদুর্গার মন্দিরে এবং তমলুকের বিখ্যাত বর্গভীমার মন্দিরেও চল আছে মাছের টক ভোগ দেবার৷

 

*ছবি সৌজন্য: লেখক, cookpad, facebook, Indian recipes

Author Indira Mukhopadhyay

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

Picture of ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।
Picture of ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

ইন্দিরা মুখোপাধ্যায়

রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস