দিল্লী এয়ারপোর্টে একটি চাটার্ড প্লেনে চড়ে লেহ-র উদ্দেশ্যে পাড়ি দিলাম এক ভোরে। লাদাখ যত এগিয়ে এল ততই প্লেনের জানলা দিয়ে পূবের প্রথম আলোয় নগাধিরাজ হিমালয়ের রুপোর তবকে মোড়া চূড়াগুলো দৃষ্টিগোচর হল। কখনও পাহাড়ের মাথায় সাদা পেঁজাতুলোর মেঘ ঢেকে দেয় তার রূপ আর কখনও মেঘের মধ্যে থেকেই উঁকি দেয় সেই গগনচুম্বী তুষার শৃঙ্গগুলি। প্লেন যত নীচে নামে আদিগন্ত বিস্তৃত পর্বতমালা মেঘ ঠেলে ততই যেন গ্রাস করে সমগ্র চরাচর। রোদে ঝলমল তুষারাবৃত পাহাড়। জুন মাসে বরফ কিছুটা গলে যাওয়ায় নীচের দিকের পাহাড়ের রং যেন ত্রিপলের মতো। অ্যালপাইন অঞ্চল। সবুজের লেশমাত্র নেই। হাত বাড়ালেই বুঝি বাদামি রং লেগে যাবে হাতে। লেহ্ এয়ারপোর্টের ভোরের তাপাঙ্ক ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

সোনাগলা সকালের আলো দু’চোখে মেখে গাড়িতে গিয়ে উঠলাম লেহ্র উদ্দেশ্যে। অলসভাবে দিনযাপন হবে। ১১৪০০ ফুট উচ্চতায় অক্সিজেনের অভাবে শরীরে নানারকম কষ্ট হয় তাই উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য হোটেলে গিয়েই নিরবচ্ছিন্ন বিশ্রাম। সময় মত হালকাফুলকা খাবার, প্রচুর জলপান আর অযথা শরীরকে পরিশ্রমে ভারী না করা। অত উচ্চতায় শরীরে ডিহাইড্রেশানে গলা, ঠোঁট শুকিয়ে যায় তাই পর্যাপ্ত গরম পানীয় খাওয় । হোটেলের আশপাশের অলিগলির তিব্বতী মার্কেট প্লেস, রিফিউজি হ্যান্ডিক্রাফট, ড্রাইফ্রুটস নাড়াচাড়া করে ধীর পায়ে ঘরে ফেরা ।
বর্ষা ঢুকে পড়েছে সারা দেশে। কিন্তু বৃষ্টিছায় লাদাখের কপালে বৃষ্টি, মেঘ কিছুই নেই। ধূ ধূ মরুভূমি, জলাশয় আর পাহাড়ের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান। সেখানে মুঠোমুঠো রোদের কণা আছড়ে পড়ছে হিমালয়ের মাথায়। নীচে সমতলে মাটি ফেলে একটু আধটু সবুজায়নের প্রচেষ্টায়। সেখানে হঠাৎ বৃষ্টির ছাঁট এসে ভিজিয়ে দেয়। হালকা ঠান্ডার সঙ্গে মেঘকালো আকাশ। সন্ধে নামে দেরিতে। মেঘ-মৌসুমীর অবাধ প্রবেশ নেই কিন্তু পাহাড়ের খামখেয়ালিপনায় বৃষ্টি যখন তখন।

পর দিন আমাদের ট্রিপের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিন লেহ্ থেকে নুব্রাভ্যালি। পৃথিবীর সর্বোচ্চ মোটরেবল পথ পেরিয়ে ১৮৩৮০ ফুটে খারদুংলা পাস যেতে হয় । লেহ্ থেকে ৩৪কিমি দূরে এই গিরিপথ যেতে ঘণ্টাদুয়েক আর খারদুংলা থেকে নুব্রা ভ্যালি যেতে আরো সাড়ে তিনঘন্টা ।
ঘুম ভাঙতেই দেখি মেঘে আচ্ছন্ন পাহাড়। গতকালের রোদ সব ধুয়েমুছে সাফ। মনখারাপ। ব্রেকফাস্ট খেয়ে বাক্সপ্যাঁটরা বেঁধে বেরলাম। খারদুংলা পাস থেকে বর্ডার রোডস অর্গানাইজেশন জানিয়েছে গতকাল সারারাত তুষারপাতের ফলে যাওয়ার রাস্তা বরফাচ্ছন্ন। যতক্ষণ না পর্যন্ত ওই রাস্তা আর্মিবাহিনী বুলডোজর দিয়ে পরিষ্কার করছে ততক্ষণ আমাদের হোটেলেই বসে থাকতে হবে। খারদুংলার ওপারে নুব্রা থেকে ফিরতি গাড়ির জ্যাম। রাস্তার বরফ সাফ হবে তারপর ওদিককার গাড়ি পাস করবে। তবেই এদিক থেকে আমাদের গাড়ির কনভয় খারদুংলার রাস্তার দিকে পা বাড়াবে। বেলা বারোটার সময় আকাশ এবং রাস্তা কিছুটা পরিষ্কার হতেই লেহ্ থেকে ল্যামডোন হয়ে খারদুংলার দিকে ।

আমারা কলকাতার পাঁচজন বাঙালি আর ড্রাইভার রিকঝিন ভাই। কিছুপরেই লেহ্ আমাদের নীচে। আমরা পাহাড়ের ওপরে, জনমানবশূন্য তুষাররাজ্যে। পিচের রাস্তার ওপর দিয়ে গাড়ি ছুটছে আর তার একধারে বাদামি হিমালয়। একটা সবুজের কণা নেই তার গায়ে আর মাথায় বিস্তৃত বরফের মুকুট। পেরলাম তুষারধ্বস প্রবণ অঞ্চল। ভয়ে সিঁটিয়ে বসে আছি গাড়িতে ।
পাকদন্ডী পথ বেয়ে একফালি পিচের কালো রাস্তা চলেছে পাহাড় কেটে। যত ওপরে উঠছি তত যেন পাহাড় আমার নাগালের মধ্যে। বরফের চাদর মোড়া পাহাড়, তার সামনে বাদামি পাথুরে পাহাড় আর সামনে বালির পাহাড়। এই তিন পরতে হিমালয় আগে কোনওদিন দেখিনি। ইয়াক মনের আনন্দে চরে পাহাড়ি নততলে। দূরে এক পাহাড়ের গা দিয়ে বরফের সরু আস্তরণ আর তার ওপর সূর্যের আলোই কি তবে বঙ্কিমচন্দ্রের দিকচক্রবাল নাকি রবিঠাকুরের ধেয়ানে আলোকরেখা? তোলপাড় মন।
হঠাৎ হালকা মৃদুমন্দ স্নো-ফ্লেক্স ঝরার শুর। । ঠান্ডা হাওয়ায় প্রবল ধার। তারপরেই শুরু প্রবল তুষারপাত। গুড়িগুড়ি বরফ টুপটাপ ঝরছে আকাশ থেকে। গাড়ির কনভয় কাগজপত্র দেখিয়ে পেরতে থাকে ট্রাফিক কনট্রোল পোষ্ট । ঝলমলে রোদ তখন সমগ্র তুষাররাজ্যে । ছোট ছোট পাহাড়ি লাইকেন ও মস পাহাড়ের গায়ে। মাইলের পর মাইল যেন বরফের গালচে পাতা পথের দু’ধারে। কোথাও আবার রোদ পড়ে বরফ কিছুটা গলে গিয়ে ঝুলছে স্ট্যালাগটাইটের মত।
আরও ১৪ কিমি দূরে খারদুংলা গিরিপথ। গাড়ি চলেছে এক ফালি এবড়োখেবড়ো রাস্তা দিয়ে আর এক পাশে বরফের খাদ অন্যপাশে বরফের পাহাড়। কখনো উঁচুতে ওঠা আবার কখনো সেই বরফসমুদ্র পেরিয়ে নীচে নামা। আগের রাতের বৃষ্টিতে রাস্তা অনেকটাই ক্ষতিগ্রস্ত ও জলময় তাই গাড়ির গতি মন্থর। এদিকে অন্ধকার হয়ে আসছে। যদিও পশ্চিমে চলেছি তাই সূর্যাস্ত কিছু দেরিতে। খারদুংলা পাস এল । প্রচণ্ড ঠান্ডা সেখানে। বর্ডাররোড অর্গানাইজেশন “হিমাঙ্ক’ সেখানে টয়লেট, চা সাজিয়ে ধুনি জ্বেলে বসে। গিরিপথের এপারের শহর সাউথ পুলু আর ওপারে নর্থ পুলু। গিরিপথে নেমে ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে জলবিয়োগ সেরে চা খেয়ে আবারও গাড়িতে। নর্থ পুলু ক্রস করে খারদুং ভিলেজ ক্যান্টিনে লাঞ্চ। বসতি আছে। চাষ-আবাদও মন্দ নয়।
এবার খারদুংলা থেকে নুব্রা ভ্যালি যেতে পথে পড়ল সায়ক নদী। কারাকোরাম থেকে উৎপত্তি। সায়ক ও নুব্রা নদীর উপত্যকায় ছোট্ট শহর ডিসকিট। নুব্রা ভ্যালির ১৪০ কিমি পর পাক-বর্ডার । ভারতের শীতল মরুপ্রান্তর । নুব্রা ভ্যালি পৌঁছতে খারদুংলা থেকে লাগে সাড়ে তিনঘণ্টা। এই উপত্যকায় ডিসকিটেই ডেসার্ট হিমালয়ার ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে তাঁবুতে থাকার ব্যবস্থা । রাত তখন পৌনে ন’টা আর ঠান্ডা শূন্যডিগ্রি সেলসিয়াসের সামান্য নীচে। ঐ ঠান্ডায় তাঁবুতে বাস সেই রাতে । মালপত্র পৌঁছে গেল তাঁবুতে। খাট-বিছানা, বাথরুম সহ ডাইনিং হলে নৈশভোজের ব্যবস্থা আছে।
মাঠের ওপর দিয়ে ডাইনিং হলে পৌঁছে ওই প্রত্যন্ত গ্রামে ডিনারের এলাহি আয়োজন দেখে চক্ষু চড়ক গাছ! রাতে তাঁবুর মধ্যে চোখে ঘুম নেই। কারণ বাইরে শনশন হাওয়ায় তাঁবুর পতপতানি। কিছু পরে ঝড় থামতে আমরা ঘুমের দেশে, সূর্যোদয়ের অপেক্ষায়। কখন বরফচূড়োয় রোদ পড়বে আর শুরু হবে রংয়ের খেলা। পরদিন ভোরে সোলার হিটারে স্নানের গরমজল ও বেড-টিও তাঁবুর মধ্যে পৌঁছল ।
এবার গন্তব্য ভারতের শীতলতম মরুভূমিতে। চারিদিকে উঁচু পাহাড়ের ঘেরাটোপে ষোলোআনা আব্রু সেই মরুপ্রান্তরের । সেখানেই চরে বেড়ায় দুষ্প্রাপ্য ব্যাক্ট্রিয়ান ডাবল হাম্পড ক্যামেল। নাতিউচ্চ, সর্বাঙ্গে লোম এবং পিঠে দুটি কুঁজ বিশিষ্ট উট সেখানে মুখটি তুলে চলেনা। শীতল মরুতেই এরা দিব্য থাকে বেঁচেবর্তে। রাজস্থানে শুধুই একটি কুঁজ বিশিষ্ট উটের পিঠে চড়েছি। অতএব লাদাখী দুইকুঁজ বিশিষ্ট উটের লোমশ পিঠে ওঠার জন্য মন উশখুশ। উঠে বসলাম উটের দুই কুঁজের মধ্যবর্তী গালচের গদিতে।

ডিসকিট হল নুব্রা আর সায়ক নদীর ভ্যালিতে ছোট্ট এক শহর। সেখান থেকে উত্তর পশ্চিমে এগুলে হুন্ডার নামক অঞ্চলে ঊষর, শুষ্ক, রুক্ষ বালিয়াড়ি। আদিগন্ত ধূ ধূ বালির চর গিয়ে ধাক্কা খেয়েছে পাহাড়ের গায়ে। দূরের পাহাড়ে তুষার চূড়া। সমগ্র মরুপ্রান্তরটাই সেই বরফচূড়ো পাহাড়ে ঘেরা। যার একদিকে লাদাখ পর্বতমালা অন্যদিকে কারাকোরাম রেঞ্জ। সূর্যোদয়ের আগে আর পরে এখানে তাপাঙ্ক পৌঁছায় সাব-জিরোয়।
অভিনব স্যান্ডডিউনসের কারসাজি আর তার মধ্যে বুনো উটের সারি। দূরে বাদামি পাহাড়, পেছনে বরফাবৃত শৃঙ্গ । পায়ের তলায় মাইলের পর মাইল ঊষর বালিয়াড়ি আর কিছুদূরেই নীল জলের লেক এমন তিনের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বুঝি ভারতের আর কোথাও নেই!
তবে লাদাখের এই তুষারশুভ্রতা দেখতে গেলে জুন-জুলাই মাস আদর্শ কারণ এর পরে বরফ বেশ কিছুটা গলে যায় ।
ছবি: লেখক
রসায়নের ছাত্রী ইন্দিরা আদ্যোপান্ত হোমমেকার। তবে গত এক দশকেরও বেশি সময় যাবৎ সাহিত্যচর্চা করছেন নিয়মিত। প্রথম গল্প দেশ পত্রিকায় এবং প্রথম উপন্যাস সানন্দায় প্রকাশিত হয়। বেশ কিছু বইও প্রকাশিত হয়েছে ইতিমধ্যেই। সব নামীদামি পত্রিকা এবং ই-ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি, রম্যরচনা ও প্রবন্ধ।