আতাতুর্ক স্টেডিয়াম, ইস্তানবুল, ২০০৫। খেলা শুরুর পঞ্চাশ সেকেন্ডের মাথায় ফ্রিকিক থেকে আন্দ্রে পিরলোর ভাসানো বলে দুর্দান্ত ভলিতে এ সি মিলানকে এগিয়ে দিলেন “এল কাপিতান” মালদিনি। চল্লিশ মিনিট গড়ানোর আগেই কাকার তৈরি করা বল শেভচেঙ্কো বাড়িয়ে দিলেন ক্রেসপোকে। আবার গোল। পাঁচ মিনিটের মধ্যেই আবারও। গোল করলেন ক্রেসপো, অ্যাসিস্ট কাকার। হাফ টাইমে স্কোরবোর্ডে এ সি মিলান ৩ – লিভারপুল ০। আক্রমণ, পাল্টা আক্রমণ, মিসড চান্স, অফ সাইড, পেনাল্টির আবেদন নাকচ, পেনাল্টি মঞ্জুর মহানাটকীয় উপাদানে ভরপুর এই ফাইনাল তর্কযোগ্যভাবে চ্যাম্পিয়নস লিগের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠ ফাইনাল। হাফ টাইমের পরের সময়টা এ সি মিলানের দুঃস্বপ্ন আর লিভারপুলের স্বপ্নের উড়ানের ইতিহাস। পাঁচ মিনিটের একটা লাল ঝড় লালকালোদের (যদিও সেদিন জার্সির রঙ ছিল সাদা) ডিফেন্স ছারখার করে দেয়। নির্ধারিত সময়ের শেষে ফলাফল ৩-৩। গোলশূন্য এক্সট্রা টাইমের শেষে খেলা গড়ায় পেনাল্টি শ্যুটআউটে। টাইব্রেকারের ফলাফল লিভারপুলের পক্ষে ৩-২। তবে এখানেই শেষ নয় দাদারা। কম্পানি এরপর সিক্যুয়েল দেবে।
তা আচমকা এই অতীতচারণের কারণ? আমাদের মোহনবাগানের থেকে দশ বছরের ছোট এ সি মিলানের বয়স একশো কুড়ি হল যে। তাছাড়া রসোনেরিদের বর্তমান ও সাম্প্রতিক ইতিহাসও যে বড্ড ম্যাড়মেড়ে। আগুনে লাল আর প্রতিপক্ষর ভয়ের মতো কালো হয়ে ওঠার লক্ষ্য নিয়ে যে ক্লাবের পথ চলা শুরু, যে ক্লাবের ঝুলিতে ১৮টি সিরি আ, ৫টি কোপা ইতালিয়া, ৭টি চ্যাম্পিয়নস লিগ টাইটেল তাদের সাম্প্রতিক ট্রফি বলতে ২০১৬র সুপারকোপা ইতালিয়ানা। যে ক্লাবের জার্সি গায়ে চাপিয়েছেন বারেসি, রিভেরা, খুলিট, বাস্তেন, মালদিনি, নেস্তা, ইব্রাহিমোভিচ, সিডর্ফ, পিরলো, শেভচেঙ্কো, রোনাল্ডিনহো, কাকা, দিদা, কাফুদের মতো নায়কেরা সেই ক্লাবের এখন দশা এখন বিশ্বম্ভর রায়ের মতো। ইতালীয় ফুটবলের মানের সামগ্রিক অবনমন আর অপ্রতুল কোষাগারকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যায় এই অবস্থার জন্য। কিন্তু মন পড়ে থাকে অতীতের সোনালি দিনগুলোয়।
বিদেশি খেলোয়াড় খেলানো নিয়ে মতানৈক্যের কারণে এই ক্লাব ভেঙে ভেন্ন হয় ইন্তারন্যাজিওনাল বা চালু কথায় ইন্টার মিলান। জন্ম হয় নতুন রাইভ্যালরির। সেও একশো এগারো বছর আগের কথা। সান সিরো স্টেডিয়াম সাক্ষী থেকে চলেছে বছরের পর বছর। আর এক প্রতিপক্ষ জুভেন্তাস ধারে-ভারে সাম্প্রতিককালে এগিয়ে গেছে অনেকটাই। জন্মদিনের আনন্দ উৎসবের দিনে তাই আহা সে কী দিন ছিল রে ভাই গোছের কথাবার্তাই উঠে আসছে বারবার। এখন কাতানেচ্চিওর আদি পৃষ্ঠপোষক নেরিও রক্কোর মতো কোচ নেই, নেই অ্যান্সেলোত্তির মতো কোচও যাঁর তত্ত্বাবধানে ফিনিক্সের মতো পুনর্জন্ম হবে এ সি মিলানের। সমর্থক ও ফুটবলপ্রেমীদের ভরসা দিয়ে পুনরুত্থান হবে কিনা সেটা সময় বলবে। কিন্তু কথামতো আমরা ফিরে যাই গল্পের পরের অংশে।
২০০৭ এর চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল। এবার সাগরের অন্য পারে, আথেন্সে। এ সি মিলান বনাম লিভারপুল। মালদিনির মতো অনেকের কাছেই শেষ সুযোগ ইউরোপসেরা হওয়ার। প্রতিশোধ নেওয়া যাবে কিনা তাই নিয়ে স্বভাবতই চর্চা তুমুল। হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পরেও প্রথমার্ধ গোলশূন্য হতে চলেছে। পেনাল্টি এরিয়ার কাছাকাছি আলোন্সো ফাউল করে বসলেন কাকাকে। যথারীতি পিরলো গেলেন ফ্রিকিক নিতে। ইনজাঘি, ২০০৫ এর ফাইনালে বেঞ্চে বসে থাকতে হয়েছিল যাঁকে, এবার জায়গামতো এসে দাঁড়ালেন। ফ্রিকিক তাঁর গায়ে লেগে ঢুকে গেল গোলে। দ্বিতীয়ার্ধে লিভারপুলের বারংবার আক্রমণ আটকে গেল মিলান ডিফেন্সে। ৮২ মিনিটে কাকার বাড়ানো বল লিভারপুল গোলকিপার রেইনাকে ধরাশায়ী করে গোলে ঠেলে দিলেন ইনজাঘি। লিভারপুল খেলা শেষের আগে এক গোল শোধ করলেও সেদিনটা ছিল লালকালোর পুনরুত্থানের, লালকালোর ইউরোপসেরা হওয়ার। একশো কুড়ি বছরের ক্লাবের বোধহয় সময় এবার একবার পিছন ঘুরে দেখার। তাদের সেই প্রাচীন অনমনীয় মনোভাব, শেষ সিনে উঠে দাঁড়ানোর হিরোইজম যাতে উদ্বুদ্ধ করতে পারে এ সি মিলানের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে।
জন্ম এবং বেড়ে ওঠা ভাটপাড়ায়, স্নাতক স্তরের পড়াশোনা কলকাতা সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে। বর্তমানে বোস ইন্সটিটিউটে পদার্থবিদ্যা নিয়ে গবেষণারত। সিনেমা, গান এবং ফুটবল নিয়ে সময় কাটাতে ভালোবাসেন।