ইট-কাঠ-কংক্রিটে ঘেরা আমাদের কলকাতায় এখনও কি বসন্ত আসে? রংয়ে রসে তার উপস্থিতি আদৌ কি টের পাই আমরা? কেমন সে বসন্ত? এখানে তো শিমূল-পলাশের লাল নেই, রঙিন নরম রোদ্দুর নেই, ফিরোজা নীল আকাশ নেই! কেবল দূষণ আর ধোঁয়া আর ফ্লাইওভার আর আকাশঝাড়ু বাড়ির দল! তার ফাঁকে জংলি বসন্ত কোথায় লুকোবে আর কোথায় পালাবে?
এইটুকু পড়ে যদি কেউ ভাবেন এবার এক জব্বর নেটফ্লিক্সীয় রূপকথার জাল বুনব বলে সুতো-লাটিম নিয়ে তৈরি হচ্ছি, ভুল হবে।
আজ লিখতে বসেছি শহরের পুবপ্রান্তে নেমে আসা এক টুকরো বাসন্তিকার গল্প, দোলের সকালে যার সঙ্গে আমার দেখা হল একান্তে। তখনও বাতাসে আধো-হিম। রোদ্দুরের রং কাঁচা সোনার মতো। মেঘহীন আকাশে ছোট্ট পাখিদের ওড়াউড়ি মনে করিয়ে দিচ্ছে, শহুরে বসন্তেও রং লাগে, শোনা যায় অনন্তের বাণী। মুছে যায় রোজকার রোজগার করা ক্লেদ ক্লান্তি না-পাওয়ার হাহুতাশ।
কলকাতার পূর্বপ্রান্তে নিউটাউন রাজারহাট বেশ অনেকদিনই হল শহরের সাংস্কৃতিক মানচিত্রে একটা উল্লেখযোগ্য স্থান করে নিয়েছে। সৌজন্যে হিডকো। তারই সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ডে শামিল হতে দোলের সকালে ক্যামেরা কাঁধে পৌঁছে গিয়েছিলাম রবীন্দ্রতীর্থের বসন্তোৎসবে। আয়োজক হিসেবে সাতসকালেই হাজির ছিলেন হিডকোর চেয়ারম্যান শ্রী দেবাশিস সেন। আর অনুষ্ঠানের দায়িত্বে ছিল মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানি।
[videopress pFoB35Z7]
ঘড়ির কাঁটায় সাতটা। শুরু হল বসন্ত উদযাপন। এক আশ্চর্য মায়াময় সুরলাবণ্যে ভরে উঠল চারপাশ। মমতাশঙ্কর ডান্স কোম্পানির নৃত্যশিল্পীরা শুরু করলেন বাসন্তী আবাহন। নিক্কণ উঠল ‘ওরে গৃহবাসী, খোল দ্বার খোল। লাগল যে দোল… স্থলে জলে বনতলে।’ উপস্থিত প্রায় সাত-আটশো দর্শক যেন মন্ত্রমুগ্ধ সেই মূর্চ্ছনায়। রবীন্দ্রতীর্থের মাধবী-বিতানে বায়ু তখন বসন্তগন্ধে বিভোল। এক টুকরো শান্তিনিকেতন যেন স্বপ্নের মতো শহরের বুকে গা-ঝাড়া দিয়ে জেগে উঠল।
দেবাশিসবাবুর আনুষ্ঠানিক সম্ভাষণ এবং ধন্যবাদ জ্ঞাপনের পর মমতাশঙ্কর জানালেন অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে পুরোপুরি বিশ্বভারতীর বসন্ত উৎসবের আদলে। ঠিক যেমনটি ওঁর স্বামী শ্রী চন্দ্রোদয় ঘোষ বিশ্বভারতীর ছাত্র থাকাকালীন দেখেছিলেন। শুরু হল সমবেত নৃত্য। আর তার পরেই মমতাশঙ্কর স্বয়ং পা মেলালেন “যদি তারে নাই চিনি গো সে কি..”র সুরে। তাঁর প্রতিটি হমসস্যা, কটখামুখ, আলপল্লব মুদ্রায়, প্রতিটি পদক্ষেপে দর্শকদের মর্মে বেঁধালেন ফাল্গুনের আবেদন। স্বপ্নালু ঘোরে আচ্ছন্ন হল চারপাশ। পরপর কবিতায়, নাচের ছন্দে, পাঠে সে যেন এক অলৌকিক সুখ যাপন। সকালের নরম রোদ্দুর আস্তে আস্তে উষ্ণ হচ্ছে, ছড়িয়ে পড়ছে রবীন্দ্রতীর্থের গাছে গাছে, পাতায় পাতায়, ফুলে ফুলে। বসন্তের আতিশয্যের মাঝেও কোথায় যেন লেগে থাকছে এক শান্ত নিরুচ্চার, এক বিস্মিত স্তব- ” না জানি কেন রে এতদিন পরে জাগিয়া উঠিল প্রাণ।”
[videopress V8bP2iL5]
কচিকাঁচা থেকে প্রবীণ নাগরিক, সকলেই ততক্ষণে আপনহারা-বাঁধনছেড়া! মেতে উঠেছেন ফাগুন হাওয়ার দুলুনিতে! ইতিউতি ছড়িয়ে থাকা যুগলদের চোখের ভাষাতেও নীল দিগন্তের ফুলের আগুনের পরশমণির ঝিকমিক। সমবেত নাচে তখন রাঙা হিল্লোলের শপথ – “রঙ যেন মোর মর্মে লাগে, আমার সকল কর্মে লাগে।” তার পরেই রংপাগল বসন্তের খ্যাপামির ডাক এল উড়ে – “কোন খ্যাপামির তালে নাচে পাগল সাগর নীর
সেই তালে যে পা ফেলে যাই রইতে নারি স্থির।
সেই তালে যে পা ফেলে যাই রইতে নারি স্থির।
চলরে সোজা, ফেল রে বোঝা, রেখে দে তোর রাস্তা খোঁজা,
চলার বেগে পায়ের তলায় রাস্তা জেগেছে!”
সেই নাচের সাবলীলতা, প্রাঞ্জল প্রকাশ অনুষ্ঠানে যোগ করল এক অন্য মাত্রা।
আয়োজন ছিল আবিরেরও। পেতলের বড় রেকাবিতে রাখা ছিল নানা রংয়ের সুগন্ধি ভেষজ আবির। উৎসবের শেষ পর্বে সে রং মাখলেন উপস্থিত প্রায় সকলেই। তবে সংযত ভাবে আবির খেলার অনুরোধ ছিল অনুষ্ঠানের শুরুতেই। সে অনুরোধ রাখলেনও সকলে। হাল্কা আবিরের তিলক ছুঁয়ে গেল সকলের গাল, কপাল। করোনাভাইরাসের করালগ্রাসের কথা মাথায় রেখে স্বাস্থ্যবিধি মেনে হ্যান্ড স্যানিটাইজারেরও আয়োজন ছিল।
[videopress eWKYsMUN]
বাতাসে যখন উড়ছে ফাগের গুঁড়ো, রংয়ে রংয়ে নিখিলের যখন উদাস হওয়ার পালা, তখন মঞ্চে বাজছে শেষের সুরে কবির বাণী – “বকুলে বকুলে শুধু মধুকর উঠিছে গুঞ্জরি
অকারণ আন্দোলনে চঞ্চলিছে অশোক মঞ্জরি
কিশলয়ে কিশলয়ে নৃত্য উঠে দিবস শর্বরী
বনে জাগে গান,
হে বসন্ত, হে সুন্দর, হায় হায় তোমার করুণা
ক্ষণকাল তরে।
মিলাইবে এ উৎসব, এই হাসি, এই দেখাশুনা
শূন্য নীলাম্বরে!”
কৃষ্ণেন্দু মাঝে মাঝেই হিমালয়ের কোলে গগলস চোখে ধ্যানস্থ হন। কিন্তু গড়িয়াহাটার মোড় আর কচুরি মিস করেন বলে প্রেমিকাদের তাড়নায় সমতলে ফিরতে হয়। শখের সিনেমা বানানো ছাড়া বই পড়া এবং লেখালিখি নিয়ে বেঁচে রয়েছেন। বাড়িতে বছর দু'য়েকের এক অরণ্যদেব রয়েছেন৷ আপাতত তার দুষ্টুমিতে বুঁদ হয়ে মজাসে দিন কাটাচ্ছেন।
3 Responses
মন ছুঁয়ে গেল।
Anobaddyo barnona. Asadharan.
ami oi onus thane sedin uposthit chilam, sati i mon chuye gelo ei bornona