লখনৌ ফুড ট্রিপের দিনগুলো আমরা দুভাগে ভাগ করে নিয়েছিলাম। রাতগুলো নবাবি দাওয়াতের জন্য বরাদ্দ রেখে দিনের বেলা বেরিয়ে পড়েছিলাম লখনৌ-এর কিছু বিখ্যাত স্ট্রিট ফুড এবং ছোটখাট রেস্তোরাঁর খাবার চেখে দেখতে।

দ্বিতীয় দিনে ব্রেকফাস্টের গন্তব্যস্থল ছিল নেত্রাম। এই দোকান–কাম- রেস্তরাঁটি বিখ্যাত এর কচুরি আর মিনি জিলিপির জন্য। দোকানের সামনেই বিশাল বিশাল কড়ায় ভাজা হচ্ছে ডাল পুরি আর বেশ ছোট কিন্তু মুচমুচে আর রসালো জিলিপি। আমরা দোতলায় বেশ পরিষ্কার শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বসার জায়গায় গিয়ে কচুরি থালি অর্ডার দিলাম। থালিতে কচুরির সঙ্গে ছিল আলুর তরকারি আর খাট্টা মিঠা কদ্দু বা কুমড়োর সবজি, বুন্দির রায়তা, খাট্টা দহি ও জিলিপি। যত খুশি খাও। যারা খাবার পরিবেশন করছেন তাদের মধ্যে অদ্ভুত আন্তরিকতা। অনেকটা আগেকার দিনের বাঙালি বিয়ে বাড়িতে অতিথি সৎকারের সঙ্গে মিল খুঁজে পেলাম।
বাকি অভিজ্ঞতা বলার আগে ছোট্ট করে দ্বিতীয় দিনের লাঞ্চের কথা বলে নি। এটা যদিও স্ট্রিট ফুড নয়, বরং লখনৌ-এর একটি বেশ বিখ্যাত রেস্তরাঁ নওয়াবীন। এখানে আমার বারা কাবাব, বিরয়ানী, মুরগ কোরমা, মুরগ স্টু আর শাহী টুকরা খেয়েছিলাম। খাবার অত্যন্ত উচ্চমানের। বিশেষ উল্লেখ বিরয়ানী আর শাহী টুকরা পদের। জোর দিয়ে বলতে পারি, ভারতের আর কোন জায়গায় এই প্রণালী আর পারদর্শিতার পরিচয় পাওয়া মুশকিল।
আসি শেষ দিনের কথায়। সেদিন বিকেলে আমাদের ফেরার ফ্লাইট আর সারা দিনের প্রোগ্রাম ছিল ফুড ওয়াকের। যদিও আমাদের এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাওয়ার জন্য গাড়ির সাহায্য নিতেই হয়েছিল, তবুও পায়ে হেঁটে পুরনো লখনৌ-র অলি গলি পেরিয়ে নামকরা খাবার জায়গাগুলোয় যাওয়ার যে রোমাঞ্চ তা ওখানকার খাবারের মতই মজাদার আর রোমাঞ্চকর।

ফুড ওয়াকের প্রথম গন্তব্য ছিল লালবাগের শর্মাজি কি চায়। প্রায় পঞ্চাশ বছরের পুরনো ছোট্ট দোকান। সামনের ফুটপাথে কয়েকটা উঁচু নড়বড়ে টেবল। সেখানেই দাঁড়িয়ে খাওয়ার ব্যবস্থা। এই দোকানের বিখ্যাত খাবার হল বান মাক্ষান আর সামোসা, সঙ্গে অবশ্যই গাঢ় দুধ চা। আমরা ক্যামেরা নিয়ে দোকানে ঝাঁপিয়ে পড়ায় আশাপাশের লোকেরা বেশ মুচকি হাসছিল। বুঝতেই পেরেছিল যে এরা টুরিস্ট। কিন্তু কুলহাড়ে চা পরিবেশন সত্যি ক্যামেরাবন্দী করার মতো বিষয় ছিল। ভাঁড়ে প্রথমে গাঢ় লিকার ঢালা হয়, তারপরে সোজা ভাঁড়েই চিনিওয়ালা ফোটানো দুধ ঢালা হয়। ঢালার কায়দাতেই চা আর দুধ মিশে যায়, আলাদা করে চামচ দিয়ে নাড়ার কোন প্রয়োজন হয় না। চায়ে ডুবিয়ে খেতে হয় বান মাক্ষান। নরম, তুলতুলে, গোলাকার ও অল্প মিষ্টি বানের আধাআধি চিরে হাতে তৈরি সাদা মাখন দরাজ ভাবে লাগানো। অসাধারণ স্বাদ। মুম্বই-এর পার্সি ক্যাফে-র বান মাস্কার সঙ্গে এর মিল আছে। এছাড়াও খেয়েছিলাম গোল টেনিস বলের সাইজের ঝাল ঝাল আলুর পুর দেওয়া সামোসা। বেশ ভালো খেতে। খাওয়া, ছবি তোলা আর হাহাহিহির পর্ব শেষ করে বাসে উঠে বসলাম। লক্ষ্য চৌক।
চৌক-এর প্রথম স্টপ ছিল আমিনাবাদ। টার্গেট- লখনৌ-এর কাবাবের তীর্থস্থান টুন্ডে কাবাবী। একটু সুস্বাদু ইতিহাস চর্চা করে নি। আমরা সবাই মোটামুটি জানি যে লখনৌ-এর বিখ্যাত গালাওয়াত কাবাব আবিষ্কার হয়েছিল নবাব আসা-উদ-দোউলা-র আমলে কারণ নবাব কাবাবের ভক্ত, এদিকে গালে দাঁত নেই। নবাবের খানসামারা তাই মাথা খাটিয়ে তৈরি করল মুখে দিলে গলে যায় এমন কাবাব, গালাওয়াত! পরবর্তীকালে নবার ওয়াজিদ আলী শাহ-এর আমলে এই কাবাবের প্রণালী আরও উচ্চমানে নিয়ে যান হাজি মুরাদ আলী। প্রচলিত আছে হাজি মুরাদ ছাত থেকে পড়ে গিয়ে একটি হাত খোয়ান। সেই থেকে তাঁর টুন্ডে (হাতহীন) নামই রটে যায়। হাজি মুরাদের পরিবার এখন দুটো দোকান চালায় লখনৌ শহরে। শোনা যায় যে দোকানের কর্মচারীরাও কাবাবের রেসিপিতে কী কী মশলা আছে তা জানেন না। পরিবারের মহিলারা বাড়িতে মশলা তৈরি করে দোকানে পাঠান মাংসে মেশানোর জন্য। আমিনাবাদের টুন্ডে কাবাবী-তে মোষ ও খাসী – দু ধরনের মাংসেরই গালাওয়াত কাবাব বানানো হয়। আমরা দু ধরনের কাবাব-ই চেখে দেখলাম, সঙ্গে উলটে তাওয়া কি পারাঠে। মোষের মাংসে চর্বি বেশি থাকায় আমার মনে হয়েছে এটা বেশি সুস্বাদু আর নরম। এই কাবাব তৈরির আগে মাংস পিটিয়ে নরম তুলতুলে করা হয়। তারপরে মশলা মিশিয়ে বড় পাত্রের মাঝখানে জ্বলন্ত কয়লা দিয়ে ঢাকা দিয়ে রাখা হয়। এর পরে কাবাব গড়ে চর্বি আর ঘি দিয়ে ভাজা হয়। খেয়েদেয়ে বাসে ওঠার আগে আর একটা দারুণ জিনিস খেলাম। রাস্তায় সাইকেলে চেপে একজন লখনৌ-এর বিখ্যাত নিমিশ বিক্রি করছিলেন। নিমিশ শালপাতায় করে পরিবেশন করা হয়। ঘন দুধ ফেটিয়ে হালকা তুলোর মত ক্রীম করে তাতে কেশর, গোলাপ জল, এলাচ, চিনি আর পেস্তা বাটা মিশিয়ে তৈরি হয় এই নিমিশ। পালকের মত হালকা অদ্ভুত ভালো খেতে এই জিনিসটা দিল্লীতে দৌলত কি চাট আর বেনারসে মালাইও নামে পরিচিত।

টুন্ডে-র সঙ্গে প্রায়ে একই নিঃশ্বাসে যে নামটি উচ্চারণ করা হয় সেটা হল চৌকের অপর প্রান্তে অবস্থিত ইদ্রিসের বিরয়ানি। ঘিঞ্জি জায়গায় অত্যন্ত অপরিচ্ছন্ন এই খাবার দোকানটা দেখলে বোঝা মুশকিল যে এর এত নাম ডাক। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে অবশ্য বিশেষ কারও মাথা ব্যাথা নেই। দোকানের সামনেই রান্না হচ্ছে হাঁড়ি হাঁড়ি বিরয়ানী আর তা প্লেটের পর প্লেট অর্ডার হচ্ছে। কাস্টমাররা কেউ দাঁড়িয়ে কেউ বসে দিব্বি প্লেট সাফ করে দিচ্ছে। মহম্মদ ইদ্রিস নামক বিখ্যাত বিরয়ানী রাঁধুনে ১৯৬৮ সালে এই দোকানের প্রতিষ্ঠা করেন। এখন দোকান চালায় তাঁর দু ছেলে- আবু বাকর ও আবু হামজা। খাসীর মাংস দিয়ে রান্না এই বিরয়ানির এতো খ্যাতির রহস্য হল এর রন্ধনপ্রণালী। দুধ, জাফরান দিয়ে তামার ডেকচিতে দম স্টাইলে রান্না হয় পাথরের কয়লার ঢিমে আঁচে। খেতে কেমন? ভীষণ ভালো। ফুরফুরে হালকা, সুগন্ধি আর রঙিন সুস্বাদু ভাতের মধ্যে নরম মাংসর বেশ বড় বড় টুকরো। তবে ভাতটা একটু শুকনোর দিকে। সালান (মাংসর ঝোল) দিয়ে খেলে বেশি ভালো লাগে।

আমাদের শেষ গন্তব্য ছিল আরেক নামকরা খাবারের জায়গা – রহিমের নিহারি আর কুলচা। ১৮৯০ সালে দোকানের পত্তন করেন হাজি আব্দুর রহিম সাহেব। যারা নিহারি শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নন, তাদের জন্য বলি, এটা ঢিমে আঁচে অনেক্ষণ ধরে রান্না করা সুপ বা স্ট্যু জাতীয় পদ। গরুর বা পাঁঠার মাংসের পা-এর অংশ আট-ন ঘণ্টা ধরে ঝোলে কম আঁচে রান্না করা হয়। মুসলমানরা সাধারণত শীতকালে এটি দিয়ে প্রাতরাশ করেন। শীতকালীন খাবার এইজন্য যে এতে শরীর গরম রাখতে সাহায্য করে। দোকানের সামনের অংশে একটি মাচা মতন জায়গায় কারিগররা খামিরি রুটি বা কুলচা বানাচ্ছিল। বানানোর পদ্ধতিও বেশ দেখার মতন। ময়দার লেচি চাপ দিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে গোল করে মাটিতে গর্ত করে তন্দুর উনুনে গায়ে লাগিয়ে দিয়ে সেঁকা হয়। ফুলে গেলে, একটা লম্বা শিক দিয়ে খুঁচিয়ে বার করে আনা হয়। দোকানের পেছন দিকে বসে খাওয়ার জন্য টেবল চেয়ার পাতা আছে। আমরা গিয়ে দেখি সেখানে তিল ধারণের জায়গা নেই। বেশ তাক করে দাঁড়িয়ে থেকে তবে জায়গা পাওয়া গেল। রহিমের নিহারির স্বাদ একেবারেই আলাদা। আমারা দু ধরণের মাংসের নিহারি খেয়েছিলাম। অপূর্ব স্বাদ। কলকাতার জাকারিয়া অঞ্চলের যে নিহারি পাওয়া যায় তার থেকে অনেক কম মশলা দেওয়া। স্বাদের জন্য উপকরণের মানের ওপর বেশি জোর দেওয়া হয়, তাই মশলার আধিক্যও কম।
খাওয়া পর্ব আমাদের এখানেই শেষ করে দৌড় লাগাতে হয়েছিল এয়ারপোর্ট-এর দিকে। খুব অল্পের জন্য ফ্লাইট মিস হয় নি। ইতি টানার আগে এটুকই বলবো যে লখনৌ, আওয়াধি রান্নায় এখনও ভারতের বাকি শহর থেকে অনেক এগিয়ে আছে। এখানে খাওয়ার পর অনেক নামি রেস্তরাঁর খাবারই বেশ হাস্যকর রকমের অপরিণত লাগতে পারে। সময়ের অভাবে কিছু জায়গা এবারের আইটেনারারিতে রাখা যায় নি। তাই আবার লখনৌ ঘোরার ইচ্ছেটা মনে এখন থেকেই উঁকি দিচ্ছে।
আলোকপর্ণা পেশায় সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট প্রফেশনাল, নেশায় ফুড ব্লগার। ভালোবাসেন বেড়াতে আর নতুন নতুন খাবার চেখে দেখতে।