সাহিত্য সম্মানের অনুষ্ঠান আজকাল সংখ্যায় এত বেশি যে, মান নির্ণয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। ডিজিটাল যুগ আসার পর সাহিত্যের ভালো-খারাপ তকমা ক্রমেই অর্থহীন হয়ে পড়ছে। প্রতি সেকেন্ডেই কোনও না কোনও লেখা প্রকাশিত হচ্ছে আন্তর্জালে। তাই ব্যাপক এই সম্ভার থেকে সেরা নির্বাচন করার কাজটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে একরকম অসম্ভব। তবু, প্রতি বছর নিয়ম করে প্রকাশিত হয় পুজোসংখ্যা। শীতকালে বইমেলা নিয়ম মেনেই হাজির হয়। বইপাড়া আজও চলে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কাজেই, বাংলা ভাষায় সাহিত্য রচনাতে যে ভাটা পড়েনি, তার কিছু প্রমাণ তো আছেই। আর আছে বলেই আজও “সাহিত্য পুরস্কার প্রদান” অনুষ্ঠানের প্রাসঙ্গিকতাকেও কিছু কিছু প্রকাশক যথাযোগ্য সম্মানে বাঁচিয়ে রেখেছেন।
“কারিগর সাহিত্য সম্মান ২০২০” তেমনই একটি। বিগত কয়েক বছরে বই প্রকাশে অনন্য স্বাক্ষর রেখেছে কারিগর। শুধু অন্য রকম লেখাই না, বই মুদ্রণেও রেখেছে স্বাতন্ত্র্য। অবশ্য, গাঙচিল বা সপ্তর্ষির মত প্রকাশকরা বরাবরই বই ছাপার বিষয়টিকে বইয়ের বিষয়ের মতোই সমান গুরুত্ব দিয়ে চলেছে। কারিগরও তার ব্যতিক্রম না। তাই কয়েক বছরের মধ্যেই এই প্রকাশনা নিজের জায়গাও করতে পেরেছে পাঠক মহলে। গত ১৪ মার্চ সন্ধেয় শিশির মঞ্চে কারিগরের তরফে আয়োজিত হয়েছিল এ বছরের সাহিত্য সম্মান অনুষ্ঠান। নতুন লেখকদের পুরস্কার প্রদানের পাশাপাশি বিশিষ্ট লেখকদের উপস্থিতিতে সমৃদ্ধ হয়ে উঠছিল আবহ। ভিড়ও হয়েছিল চোখে পড়ার মতো।
মঞ্চসজ্জায় নাটকের প্রপস ব্যবহার করা হয়েছিল এ দিন। কাজেই পর্দা উঠতেই মনে হল বুঝি-বা কোনও নাটক শুরু হতে চলেছে। একাধিক বইয়ের তাক ছড়ানো এদিক-সেদিক। মাঝে লেখকদের বসার চেয়ার পাতা। একদিকে সঞ্চালকের ডায়াস। অন্যদিকে বরণের ফুল নিয়ে ঢোকার প্রস্তুতি কারিগরের সদস্যদের। উপস্থিত ছিলেন সুধীর চক্রবর্তী, দেবাশিস কুমার, প্রসাদরঞ্জন রায়, স্বপ্নময় চক্রবর্তী, দেবেশ চট্টোপাধ্যায় প্রমুখ।
নতুন লেখকদের খুঁজে নেওয়ার দায়িত্ব পালন করতেন সম্পাদকেরা। “করতেন।” কারণ আজ সে দায়িত্ব পালনের বড় অভাব। সে কথাই বলছিলেন বর্ষীয়ান লেখক-প্রাবন্ধিক সুধীর চক্রবর্তী।

এ প্রসঙ্গে বলছিলেন একদা দেশ পত্রিকার সম্পাদক সাগরময় ঘোষের কথা। এ বছর কারিগর সাহিত্য সম্মান পেলেন কবি (এবং বিশিষ্ট মানসিক স্বাস্থ্যকর্মী) অনুত্তমা বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে ও তাঁর কবিতাকে খুঁজে নেওয়ার পিছনে কারিগরের শ্রমকে কুর্নিশ জানালেন উপস্থিত সকলেই। এদিনের অনুষ্ঠানে সংবর্ধিত হলেন প্রখ্যাত প্রাবন্ধিক বারিদবরণ ঘোষ এবং সুধীর চক্রবর্তী। বাংলা সাহিত্যে দীর্ঘ অবদানের জন্য তাঁদের যথাক্রমে “বঙ্কিমচন্দ্র সাউ স্মারক সম্মান” ও “অলোকা সাউ স্মারক সম্মান” প্রদান করা হয়। নতুন প্রতিভার স্বীকৃতি স্বরূপ “সাহিত্যকৃতি সম্মান” পেলেন কবি ও মনোবিদ অনুত্তমা।
অনুষ্ঠান শুরু হল নীলাঞ্জনা বাগচীর ধ্রুপদী সংগীতের সাহচর্যে। বড় উঁচু তারে সুর বেঁধে দিলেন তিনি। আর শেষে কীর্তন শোনালেন শোভন ভট্টাচার্য। সে সুরও ছিল বসন্তের, বড় মনকেমনের। মধ্যে স্বপ্নময়বাবু বলছিলেন তাঁর বিস্ময়ের কথা। বলছিলেন, যাঁদের লেখা পড়ে বড়ো হলেন, তাঁদের পাশে বসতে পেরে অদ্ভুত লাগছে আজ। একই বিস্ময় প্রকাশ করলেন প্রসাদরঞ্জন ও দেবাশিসবাবুও। কীভাবে সুধীরবাবুর মফসসলের কাহিনি তাঁর আখ্যানে মিশে যায়, তাও বলছিলেন স্বপ্নময়। একই ভাবে প্রসাদরঞ্জনবাবুও বলছিলেন, বারিদবরণের প্রবন্ধ পাঠের বিস্ময়ের কথা। আজীবন পরিশ্রমী ও নিষ্ঠায় যে অপার দুনিয়া লেখালেখির জগতে গড়েছেন সুধীরবাবু ও বারিদবরণবাবু, তা এক কথায় স্বীকার করলেন সকলেই।
এ দিন মেধাজীবীরা উপস্থিত থাকলেও, রসের অভাব ছিল না অনুষ্ঠানে। বইয়ের মুদ্রণের মান একই রেখে কীভাবে মূল্য একটু কমানো যায় তা কিছুটা সরেস ভাবেই জানান দিলেন প্রসাদরঞ্জন। সুধীরবাবুর কথায় তো রসসিঞ্চনের অপার খোরাক! শোনালেন, কত বিচিত্র অভিজ্ঞতা হয়েছে তাঁর গ্রামে গ্রামে ঘুরে গবেষণা ও লেখার কাজ করতে গিয়ে। এদিনের সাহিত্যকৃতি পুরস্কার প্রাপক অনুত্তমা শোনালেন কবিতা। জানালেন, কবিতা রচনায় কীভাবে চলে এসেছেন তিনি মনোরোগের জটিল ও ঘোলাটে জগত পেরিয়ে। টেলিভিশনে তাঁকে মনোবিদ হিসেবে আলোচনায় প্রায়ই দেখা যায়। সবাই তাঁর সেদিকটাই জানতেন এতদিন। কিন্তু এই প্রথম জানা গেল, আড়ালে তিনি এতকাল লিখে গেছেন কবিতাও, মনভালো রাখার আলোর কথাও।
চমৎকার সঞ্চালনা করলেন সুপর্ণা মজুমদার। বলিষ্ঠ বাংলায় ভরিয়ে রাখলেন হলঘর। তার সঙ্গেই ছিল দর্শকদের তথা সাহিত্যমোদী মানুষের করতালি। সংশয় পেরিয়ে সেই সমর্থনই পাথেয় হয়ে থাকল এ দিনের অনুষ্ঠানের।
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।