Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

কলকাতার ছবিঘর আর বচ্চন-ভক্তেরা (রম্যরচনা)

পিনাকী ভট্টাচার্য

মে ১২, ২০২০

Khanna wikimedia commons
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় মাঝেমাঝেই সিঙ্গল স্ক্রিন হলের শোকগাথা চোখে পড়ে। আগে হেডলাইন হত- এখন ভেতরের পাতায় ছোট করে ছাপা হয়। সেই খবরগুলো পড়তে পড়তে হারিয়ে যাওয়া হলগুলোর কথা আবার মনে পড়ে যায়। কিন্তু সত্যিই কি হারিয়ে গিয়েছে? হারিয়ে যাওয়ার সংজ্ঞা কী? তাহলে সব আড্ডাতেই তারা ফিরে ফিরে আসে কেন? ভাঙা পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই কি একটা হল শেষ হয়ে যায়?

আজি এ প্রভাতে 

ইস্কুল জীবনে যে বয়েসে সবকিছুতে কেষ্টর দোহাই দিচ্ছি, যমুনার প্রতিও এক স্বাভাবিক দৌর্বল্য জন্মাল। সেটা যমুনার রঙ নীল বলে, না ধর্মতলার কুলীন হলগুলোতে পরিচিত মানুষের দেখে ফেলার সম্ভাবনা বেশি বলে, নাকি যমুনার টিকিটঘরের পাশে তাজ রেস্তোরাঁর বিফ কাবাবের গন্ধের জন্য, তা জানা ছিল না। কিন্তু পরীক্ষা শেষ হলেই বাকি গোপ-বালকদের সঙ্গে মিলে ডুব দিতাম যমুনায়।

এই সখ্যের অবশ্য এক অর্থনৈতিক ব্যাখ্যানও ছিল। ইস্কুলে পড়ার সময় পকেটে একটা আস্ত গড়ের মাঠ নিয়ে ঘোরার দিনগুলোতে আমাদের ত্রাণকর্তা ছিল ক্লাসের পাপা। পাপার বাবা ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’-এর গ্রাহক ছিলেন। প্রতি মাসে ম্যাগাজিনটা পোস্ট মারফৎ ওদের বাড়িতে আসত। কর্মসূত্রে কাকু ছিলেন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার। তাই বাড়িতে ম্যাগাজিনগুলো জমত যাতে উনি ছুটিতে এসে পড়তে পারেন। পাপা এক কপি করে পুরনো ম্যাগাজিন নিয়ে আসত ইস্কুলে। মৌলালি মোড় থেকে বাসে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট অবধি গিয়ে সেখান থেকে আমাদের দৌড় শুরু হত। থামত যমুনার পাড়ে এসে, মানে গেটের সামনে। রাস্তায় একটা নির্দিষ্ট দোকানে পাপা ম্যাগাজিনটা ছাব্বিশ টাকা দিয়ে বিক্রি করত। আজ থেকে পঁয়ত্রিশ বছর আগে ছাব্বিশ টাকা নেহাত কম ছিল না। পাঁচ/ছ’জনের টিকিট আর বিফ কাবাব/রোল স্বচ্ছন্দে হয়ে যেত। যেটুকু কম পড়ত বাকিরা চাঁদা তুলে গোঁজামিল দিয়ে দিতাম।

রেস্ত জোগাড় করার দায়িত্ব যেমন ছিল পাপা নিয়েছিল, হলে ঢোকার দায়িত্বে ছিল মনোদীপ। ‘এন্ডলেস লাভ’ দেখতে গিয়ে যখন আমাদের গেটে আটকেছিল, মুন হতোদ্যম না হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছিল চেকারকে- “সিনেমাটাতে হিরো-হিরোইনের বয়েস কত? আমাদের বয়েসি মানুষদের নিয়ে সিনেমা আমাদেরই দেখতে দেবেন না! আমাদের কাছে এটা শিক্ষামূলক ছবি!” এই অকাট্য যুক্তির কাছে মধ্যবয়সী প্রতিরোধ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছিল। এর পর থেকে মনোদীপকে দেখলেই তিনি বিনা বাক্যব্যয়ে আমাদের হলে ঢুকতে দিতেন। পরে এই হলে আমাদের ঢোকার রাস্তা আরও সুগম হয়ে গেল যে দিন হলের ম্যানেজার আমাদের ম্যাগাজিন বিক্রির ব্যাপারটা দেখে ফেললেন। কাউন্টারে বসা ছেলেটির মাধ্যমে উনি পাপার সঙ্গে একটা অলিখিত চুক্তি করেন। ম্যাগাজিনটা নগদ পনেরো টাকা দিয়ে কিনে উনি আমাদের হলে ঢোকার পাস দিয়ে দিতেন। যাকে বলে এক্কেবারে উইন-উইন সিচুয়েশন — ম্যানেজার শস্তায় বইটা পেয়ে যেতেন, আমাদের সিনেমা দেখাও হয়ে যেত আর কাবাবের পয়সাও উঠে যেত।  

দারুণ অগ্নিবাণে

ইস্কুল থেকে বেরিয়ে এক দেবতার সন্ধান পেলাম। দেবতার নাম অমিতাভ বচ্চন। সেই দেবদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে এও জানলাম যে তাঁর ভক্তদের শ্রেণি বিভাজন আছে। আমাদের মতো সাধারণ ভক্ত ছাড়াও এক মহান্ত বা সাধক শ্রেণীর ভক্ত আছে- যারা দেবদর্শনের জন্যে জীবনের ঝুঁকি পর্যন্ত নিতে পারে। মানিকতলা মোড়ের কাছে ডিমগলিতে এমনই এক ভক্তদের আশ্রম ছিল, যার মহান্ত ছিল আমার কলেজের সহপাঠী রানা। বচ্চনের সিনেমা রিলিজ করলে রানা হয়ে উঠত রানা-প্রতাপ। এঁর শিষ্যত্ব-কালে বিভিন্নভাবে সিনেমা দেখার প্রভূত অভিজ্ঞতা অর্জন করলাম। 

আশির দশকের শেষ ভাগে উত্তর কলকাতার সমস্ত হলেই শো-এর দিন সকালে নব্বই পয়সা দামের টিকিট বিক্রি হত। সাইজে কিছুটা ছোট এই টিকিট ছিল হলের প্রথম দুটো সারির। একজন দাঁড়ানোর মতো সরু একটা লোহার খাঁচার মধ্যে লাইন দিয়ে টিকিট সংগ্রহ করতে হত। কাউন্টারের ঠিক পাশেই থাকত হলে ঢোকার গেট, যেটা দিয়ে এই টিকিটধারীরা হলে ঢুকত। এর গেটে লাঠি হাতে থাকত হলের এক সুরক্ষা-কর্মী যাকে বিশৃঙ্খলা থামাতে খানিকক্ষণ অন্তর লাঠি চালাতে হত। দেবতাকে সামনে থেকে দেখবে বলে রানা কখনও দামি টিকিট কাটত না। বরাবর নব্বই পয়সার টিকিটেই সিনেমা দেখত। এর জন্যে ওর বাছাই করা হল ছিল পূর্ণশ্রী, রাধা, শ্রী, উত্তরা, মিত্রা, মিনার আর টকি শো হাউস। ও দু’তিন জন শাগরেদ নিয়ে সকালবেলা হলে পৌঁছে যেত।

সকাল নটা নাগাদ খাটো টাইট গেঞ্জি, জিন্‌স আর কপালে লাল ফোঁটা পরা রানাকে দেখলে আমি অবধারিত ভাবে ওর পিছু নিতাম। হলে পৌঁছে রানা কখনও লাইনে দাঁড়াত না – সোজা লোহার গেট টপকে ভেতরে লাফিয়ে পড়ত। তাতে একটা তুমুল হট্টগোল সৃষ্টি হত। সুরক্ষা-কর্মী এই বিশৃঙ্খলা বন্ধ করতে এলোমেলো লাঠি চালাতে শুরু করত আর সবাই দৌড় দিত লোহার খাঁচার বাইরে। কিন্তু রানা আর তার সঙ্গীরা (যাদের ল্যাজে ল্যাজে আমিও থাকতাম) তখন কাউন্টারের পাশের গেটের দিকে ছুট লাগিয়ে হলে ঢুকে পড়ত। এই কৌশল অবশ্য সবসময় কাজে লাগত না। তখন রানা লাইনে দাঁড়াত আমাদের দু’তিন জনকে সামনে নিয়ে। আমাদের সামনের লোকটা যখন টিকিট কেটে হলে ঢুকতে চলেছে, সেই সময় রানা নিচু হয়ে হাত বাড়িয়ে পেছন থেকে তার প্যান্ট টেনে ধরত। লোকটা তখন বেরতে না পেরে ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দিকে তাকালে দেখত আমাদের হাত খালি। এদিকে লাইন এগোচ্ছে না দেখে ততক্ষণে চ্যাঁচামেচি শুরু হয়ে যেত। ঝামেলা এড়াতে গেট-রক্ষী এই টিকিট হাতে লোকটাকে ভেতরে ঢোকানোর জন্যে এক হ্যাঁচকা টান মারত, আর সেই টানে আমরাও ছিটকে গিয়ে পড়তাম খাঁচার বাইরে গেটের সামনে। তারপরই সুড়ুৎ করে ঢুকে পড়তাম হলে। 

এই কৌশল অবশ্য খুব বেশি দিন ব্যবহার করা যায়নি কারণ কিছুদিনের মধ্যেই হলের লোক রানাকে দেখলেই সতর্ক হয়ে যেত। তখন রানা খুঁজে বার করল কোন হলে কোন কর্মী টিকিট তুলেছে। খুব কম লোক জানে– নামী সিনেমার টিকিট শুধু ব্ল্যাকাররা তুলত না। হলের কিছু দুঃসাহসী কর্মীও টিকিট তুলে রাখত। গেটের কাছে টিকিট দেখতে চাইলে রানা নিচু গলায় সেই কর্মীর নাম বললে আমাদের গেটের ভেতরে ঢুকতে দেওয়া হত। তারপর একটা নির্দিষ্ট জায়গায় গিয়ে দাঁড়াতে হত। সেই কর্মী এসে হলের মধ্যে নির্দিষ্ট সিটে আমাদের বসিয়ে দিয়ে চলে যেত। লোকজন দেখে ফেলবে বলে, সেখানে সে পয়সা নিত না। সিনেমার শেষে একসময় এসে পয়সা নিয়ে যেত। এই ব্যবস্থাতে টিকিটের দাম ব্ল্যাকারদের চেয়ে শস্তা হত, কারণ এই কর্মীদের একটা ভয় ছিল — মালিক জানলে চাকরি চলে যেতে পারে। তাই টিকিটের দাম নিয়ে বেশি লোভ করত না।   

পকেটে পর্যাপ্ত পয়সা থাকলে দ্বিতীয় পন্থাটা কার্যকরী হত, যেটা কালেভদ্রে থাকত। তাই রানা অমিত-দর্শনের আর একটা পথ বার করেছিল। সেটা চালু ছিল খান্না, সুরশ্রী, বিধুশ্রী, ছায়া আর পুরবীতে। মানিকতলায় থাকার দৌলতে এক বিশেষ রাজনৈতিক দলের “দাদা”দের সঙ্গে মৌখিক আলাপ ছিল। তাদের নাম করে এই হলগুলোতে ঢুকে পড়া যেত। কিন্তু সিঁড়িতে বসে সিনেমা দেখতে হত। এই পন্থাটা এমনিতে বেশ আরামের ছিল। কিন্তু এই হলগুলোতে মাঝেমাঝে পুলিশ রেড করে সিঁড়িতে বসা দর্শকদের তুলে নিয়ে যেত। এইসব হল যে এলাকায়, সেই জায়গাগুলো বিরোধী-পক্ষের মুক্তাঞ্চল বলে যে পুলিশের নেকনজরে থাকত, সেটা জানতাম না। সেটা বুঝলাম যেদিন প্রথম পুলিশের লাঠি খাওয়ার আর গাড়ি চড়ার সৌভাগ্য হল। এরপর ভয়ের চোটে ঈশ্বর ত্যাগ না করলেও, গুরু ত্যাগ করলাম। 

বেলা বয়ে যায় 

সিনেমা দেখার মধ্যে, নাকি সিনেমা হলে যাওয়ার মধ্যে, কোনও দুঃসাহসিক ব্যাপার ছিল কিনা জানি না, কিন্তু পারতপক্ষে কোনওদিন একা সিনেমা যাইনি। এবার সঙ্গী হিসেবে দীপকে পাকড়াও করলাম। রাজাবাজারের তসবির মহলে সিনেমা দেখতে গিয়েছি। ছ’টা-ন’টার ইভনিং শো দেখতে সন্ধ্যে পৌনে ছ’টায় পৌঁছে দেখি হল থেকে লোকে বেরিয়ে আসছে। আগের শো শেষ হয়ে গিয়েছে ভেবে হলে ঢুকে দেখি হল প্রায় ভর্তি ইতিমধ্যে। ব্যাপারটা ঠাহর করতে না-পেরে জিজ্ঞাসা করতে জানতে পারলাম ওটা ইন্টারভ্যাল। আগের শো দেরিতে শুরু হয়েছিল। বেরিয়ে এসে ইতস্তত ঘুরে পাশের দোকানে কাবাব-পরোটা সাঁটিয়ে এক ঘণ্টা পরে হলে ফেরত গিয়ে দেখি সত্যিই শো শেষ হয়েছে। হলের ভেতরে গিয়ে সিট খুঁজে বসতে গিয়ে দেখি আর এক চিত্তির! সিট নেই! মানে যে কাঠের পাটাতনের ওপর বসব, সেইটাই গায়েব।

শূন্যে তো ভেসে থাকা যায় না। আর দাঁড়িয়ে থাকলে পেছনের রোয়ে বসা লোকজনের কাছে মার খেতে হবে। দীপের সিট ঠিকঠাক। ও গ্যাঁট হয়ে বসে পড়ে বলল “ফ্রেমের ওপর ব্যালেন্স করে বসে পড়।” কিন্তু তিন ঘণ্টা ফ্রেমে বসে থাকলে তো অষ্টাবক্রমুনি হয়ে বাড়ি ফিরব! গিয়ে লাইটম্যানকে ধরতে সে বিরক্ত হয়ে বলল “খুদ ঢুঁন্‌ড লিজিয়ে”। তাকে টেনে নিয়ে এলে সে টর্চ ফেলে এদিক ওদিক খুঁজে বার করল দু’টো রো আগে একটা সিটের তলায় আমার সিটের পাটাতনটা পড়ে আছে। আমায় বলল, যেহেতু সিটটা আমার, ওটা আমাকেই নিয়ে আসতে হবে। অগত্যা ভাঙা পাটা কুড়িয়ে এনে তার ওপর ব্যালেন্স করে বসে সিনেমা দেখলাম। এই দীপ ক্যানেল ইস্ট রোডে অরবিন্দ সেতুর তলায় সুরশ্রীতে নাইট শো দেখতে গিয়ে ফেঁসেছিল। সেখানে এক রিক্সাওয়ালা দীপকে তার গামছা হাতে দিয়ে ওর জায়গা রাখতে বলে। পরে পাশের দিশি মদের ঠেকে মদ্যপান করে এসে দাবি করেছিল দীপ ওর জায়গায় বসেছে, তা নাহলে তার গামছা দীপের হাতে এল কী করে!    

কলেজ স্ট্রিট বাটা-র পাশে কেশব সেন স্ট্রিটে জহর বলে একটা হল ছিল। অমিতাভ বচ্চনের কোনও পুরনো সিনেমা যখনই আসত, রিভাইজ করতে আমরা সেখানে পৌঁছে যেতাম। জহরে ‘নমকহালাল’ ছবিটা রিভাইজ করতে গিয়ে এক বিপত্তি। এক একটা বিখ্যাত সিন আসে আর প্রচণ্ড হইচই আর স্ক্রিনের সামনে পয়সা পড়ার শব্দ হতে থাকে। তারপর সিনটা আবার দেখানো শুরু হয়। এইরকম হাতে ধরে সিন বাই সিন রিভিসন হবে আমরা ভাবতেও পারিনি। আমাদের বাড়ির দরজায় রাত এগারোটায় তালা পড়ে যেত। সন্ধ্যে সাতটায় শুরু হওয়া সিনেমা শেষ হল রাত ১০:৫০। তারপর সেখান থেকে ফুল স্পিডে দৌড়ে বাড়ি ফিরেছিলাম। এখানে খুব ভালো রিভিশন হয় বলে কয়েক মাস বাদে আবার হাজির হয়েছিলাম। কিন্তু এক সময় সিন রিপিট হওয়া বন্ধ হয়ে গেল। কারণ অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানলাম শোয়ের পর পয়সা কুড়োতে গিয়ে পয়সার চেয়ে বেশি কোল্ড ড্রিঙ্কের ছিপি পাওয়া যাচ্ছে। পয়সার বদলে লোকে সেগুলোই ছুঁড়ছে। 

টালিগঞ্জ ফাঁড়ির অদূরে বুড়িগঙ্গার ব্রিজের পাশের প্রদীপে শুধু আমার নয়, অনেকেরই জুতো ভিজেছে জোয়ারের জলে। কিন্তু আমার অভিজ্ঞতাটা এখানে শেষ হয়নি। সামনের পর্দায় শাহেনশা বচ্চনসাহেবকে সরিয়ে ভেসে ওঠা সতর্কবাণী “জোয়ার আসিতেছে, পা তুলিয়া বসুন” দেখে পা তুলে বসেছিলাম কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম যে পায়ে চটি ছিল। মনে পড়তে জলের মধ্যে পা ডুবিয়ে উদ্ভ্রান্তের মতো চটি খুঁজে না-পেয়ে খালি পায়ে বাকি সিনেমাটা দেখেছিলাম। সিনেমা শেষ হলে লাইটম্যানকে নগদ দু’টাকা ঘুষ দিয়ে চটিজোড়া খুঁজে পেয়েছিলাম। মানিকজোড় “এক্সিট” লেখা দরজার পাশেই পড়েছিল।

প্রদীপ ছাড়াও সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ-মহাত্মা গান্ধী রোডের মোড়ে প্রভাতে হাঁটুজলে বসে সিনেমা দেখেছি। অমিতাভ বচ্চনের ‘হাম’ ছবির ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শোয়ের টিকিট জোগাড় করে সকাল সকাল মারিকের বাড়ি চলে গিয়েছি। শুরু হল আকাশভাঙা বৃষ্টি। খানিক বাদে জল জমে গেল। বেগতিক দেখে মারিক একটা হাফ প্যান্ট আর আমি ওর কাছ থেকে চেয়ে একটা লুঙ্গি পরে নিয়ে রওনা দিলাম সিঙ্গিবাগান থেকে। পথে মুক্তারামবাবু স্ট্রিট এক নদীতে পরিণত হয়েছে দেখে মনটা ভয়ে কেঁপে উঠল। কিন্তু বচ্চনের অমোঘ আকর্ষণে হেঁটে চললাম। গিয়ে দেখি যা ভয় পাচ্ছিলাম তাইই। প্রভাত জলে ভাসছে। বচ্চনের ছবির ফার্স্ট ডে ফার্স্ট শো ক্যানসেল হলে হল আস্ত থাকবে না। তাই শো শুরু হল। তবে লুঙ্গি পরে সঙ্কোচের বদলে বেশ একটা ফূর্তি হল। চারপাশে প্রচুর লুঙ্গি পরা লোক।

কিন্তু সেই ফূর্তি বেশিক্ষণ স্থায়ী হল না। আমাদের ঠিক সামনেই বিরলকেশ একজন বসেছিলেন। সিনেমা সবে শুরু হয়েছে, আমার পাশের ছেলেটা ফটাস করে তার মাথায় একটা চাঁটা মেরে বসল। ব্যস, সিনেমা মাথায় উঠল। লোকটা পেছন ফিরে অশ্রাব্য গালাগালি শুরু করল। নিজের শব্দভান্ডার বৃদ্ধি আর বচ্চনের মধ্যে কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ সেই নিয়ে দোলাচলের মধ্যেই পর্দায় গুরু হাজির হলেন “জুম্মা চুমা দে দে” গান নিয়ে। পাশে বসা ছেলেটা “গুরু আ গিয়া” বলে চিৎকার করে উঠল। তাতেই ম্যাজিকের মতো কাজ হল! সেই গালাগাল বর্ষণকারী লোকটা তার অপমান আর টাকের লাঞ্ছনা ভুলে “গুরু আ গিয়া! গুরু আ গিয়া!” বলে চেঁচিয়ে উঠে লাঞ্ছনাকারীর সঙ্গে নাচতে শুরু করে দিল।

দূরে কোথায় 

হলের অভিজ্ঞতা শুধু যে কলকাতাতেই হয়েছে, তা কিন্তু নয়। তমলুকের রাধামনি বাজারে শ্যামশ্রীতে দেখেছি হলের মধ্যে সিঁড়ি ধরে প্রায় দু’শো মানুষকে বসে থাকতে। অমিতাভ বচ্চনের ছবি এলে হলের ৯০০ টিকিট শেষ হতে বেশিক্ষণ লাগত না। তাই দূর গ্রাম থেকে আসা মানুষদের এক টাকার কুপন দেওয়া হত যার জোরে তারা হলে ঢুকে সিঁড়িতে বসে সিনেমা দেখতে পেত। গ্রামের লোকও সিনেমা দেখতে পেয়ে খুশি, আবার হল মালিকেরও উপরি দু’শো টাকা রোজগার। কিন্তু কুপনের দাম বাড়ানো যেত না, কারণ দাম একটাকার চেয়ে বেশি হলে ট্যাক্স দিতে হবে আর লাভের গুড় পিঁপড়েয় খাবে। 

ইতিহাসে পড়েছি মুঘল যুগে দিওয়ানি আম‌ এমনভাবে তৈরি করা হয়েছিল যাতে প্রাঙ্গণের যে কোনও প্রান্ত থেকেই বাদশাকে দেখা যায়। থামগুলো কোনও প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি না করে। কালনার মদন টকিজে আবার হলের থামগুলো এমনভাবে তৈরি, যে যেখানেই বসা হোক, সিনেমা দেখার সময় থাম প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করবেই। 

তবে এই অভিজ্ঞতা শুধু সিঙ্গল স্ক্রিনেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। ছত্তিসগড়ের বিলাসপুর আর রায়পুরের মধ্যবর্তী ভাটাপাড়ায় কর্মরত থাকার সময় এ শহরের মাল্টিপ্লেক্সে অমিতাভ বচ্চনের ‘শমিতাভ’ দেখতে গিয়ে দেখি শো ক্যান্সেল‌ হয়ে গিয়েছে। খবর নিয়ে জানলাম দশজন দর্শক না হলে সেখানে শো ক্যান্সেল করে দেওয়া হয়। অফিসে ফেরত এসে বাকি সহকর্মীদের প্রায় জোর করেই ছবিটা দেখতে নিয়ে যাই। 

তবু মনে রেখো

রানা, বিলু, মারিক আর আমি সেদিন একসঙ্গে মারিকের বাড়ির ৪২ ইঞ্চি টিভি স্ক্রিনে ফায়ার-স্টিকে অমিতাভ বচ্চনের ‘বদলা’ দেখলাম। রানার আনা স্কচ খেতে খেতে পুরনো দিনের গল্প করছিলাম। রানা এখন তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানির উচ্চপদে আসীন। এখনও সে অমিতাভ বচ্চনের কোনও ছবি বাদ দেয় না। আমরা এখন মোবাইলে আর ফায়ার-স্টিকেই অমিতাভকে দেখি। হলে যাই না, কারণ হলগুলো খুঁজে পাই না। যাদের পাই, তাদের সঙ্গে পরিচয় নেই। দীপও আমাদের সঙ্গেই ছিল। আমাদের ওয়াটস্যাপ গ্রুপের ডিসপ্লে ছবি হয়ে। কে বলেছে দীপ নেই, হলগুলো নেই?

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।

Picture of পিনাকী ভট্টাচার্য

পিনাকী ভট্টাচার্য

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।
Picture of পিনাকী ভট্টাচার্য

পিনাকী ভট্টাচার্য

পেশার তাগিদে সার্ভিস সেক্টর বিশেষজ্ঞ, নেশা আর বাঁচার তাগিদে বই পড়া আর আড্ডা দেওয়া। পত্রপত্রিকায় রম্যরচনা থেকে রুপোলি পর্দায় অভিনয়, ধর্মেও আছেন জিরাফেও আছেন তিনি। খেতে ভালোবাসেন বলে কি খাবারের ইতিহাস খুঁড়ে চলেন? পিনাকী ভট্টাচার্য কিন্তু সবচেয়ে ভালোবাসেন ঘুমোতে।

20 Responses

  1. কলেজে পড়ার সময়টা কলুটোলায় মামার বাড়িতে ছিলাম। কৃষ্ণা, মুনলাইট, প্রভাত, গ্রেস ইত্যাদি হলগুলোয় বহু পুরনো হিন্দি ছবি দেখেছিলাম। ধর্মতলায় যমুনার মতোই বিখ্যাত ছিল সোসাইটি-ও, বিশেষ কারণে! প্রথম দিন, প্রথম শো-ও বেশ কিছু যার মধ্যে অবশ্যই ‘শাহেনশাহ’। কী মারামারি হয়েছিল, বলে বোঝানো যাবে না। আমার পার্টনার ছিল অঞ্জন পালিত, এখন স্কটিশেই কেমিস্ট্রি পড়ায়। কোত্থেকে কীভাবে টিকিট জোগাড় হয়েছিল, কখনও বলেনি। মিঠুন-শ্রীদেবীর ‘ওয়ক্ত কি আওয়াজ’, টকি শো হাউজে ঢুকলাম যখন, পর্দায় মিঠুন তরোয়াল নিয়ে দৌড়তে শুরু করেছে, আমরা সিট খুঁজতে না-দৌড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছি, উফফফ্, কী সব দিন আর রাত… আমার বেশ মুকেশপ্রীতি ছিল। ছিল কেন, আছে এখনও। মুকেশের কারণেই রাজ কাপুরের বহু ছবি ওই কৃষ্ণা আর মুনলাইটে দেখেছিলাম। এখন তো কতদিন হলে গিয়ে সিনেমা দেখিনি, মনেই পড়ে না… অভিজ্ঞতাগুলোর সঙ্গে মিল পেয়েছি বলে লেখাটা আরও ভাল লাগল, একটু মন-খারাপও হল। তবে, সত্যিই তো, স্মৃতি তো আর চলে যায় না কোথাও, আমাদের মধ্যেই থাকে, মাঝেমাঝে তাকে খুঁচিয়ে তুলতে হয়, এভাবে। চালিয়ে যান স্যর… 🙂

  2. Hebby লিখেছ. Jahar ba surasree te আমি সিনেমা দেখিনি. বাকিগুলো আছে লিস্ট এ. তবে হল এর কর্মী রা টিকিট ব্ল্যাক করত সেটা জানতাম না… Barik এর হল এ এমনি এমনি অনেক সিনেমা দেখেছিলাম. পয়সা লাগে নি.

  3. পিনাকীর রম‍্যরচনা দিনদিন উন্নত হচ্ছে। আমি নিজে আরও এক যুগ আগের মানুষ, তাই অনেকটাই (সঙ্গে কিছু যোগ-বিয়োগ) স্মৃতি ফিরিয়ে আনলো।

  4. দারুন লেখতো। বাংলা লেখা তো হারিয়েই যাচ্ছে। সেখানে তোমার অম্লমধুর লেখা দূরকৈশোরের কথা মনে পড়িয়ে দিল। স্কুলের বন্ধুদের পড়তে অনুরোধ করলাম, যাদের অনেক কেই তুমি চেনো।

  5. কতকগুলো জায়গা পড়তে পড়তে আমি নিজেকেই ওই জায়গায় নিয়ে গিয়েছিলাম। বচ্চন কেন, কোনো হিন্দি ফিল্মের ভক্ত ছিলাম না, তাই তোর experience ঠিক খাপ খায় নি, কিন্তু নিউ এম্পায়ারের ৯০ পয়সার টিকিটে পাঁচতলায় স্প্রিন্ট টানার দায়িত্ব আমার থাকতো, আর চিনাপাড়ার গুন্ডাদের সাথে যাবতীয় ক্যালাক্যালির জন্য অন্য দু – তিনজন থাকতো। আমার দাদা ছিল ছোটোখাটো, বাঙালি সমঝোতাপন্হী। ও ধীরে ধীরে চিনাদের ম্যানেজ করে নিল। তাতে অনেক বাড়তি সুযোগ পেলেও আমার কাজ বাড়লো। আগে ছজনের জায়গা রাখতাম, পরে বেড়ে দশ-বারোজন হয়ে দাঁড়ালো।
    এভাবেই DJANGO, FRIDAY THE THIRTEENTH, MAD MAX, BOND SERIES এর সব মহার্ঘ ছবি দেখা সম্ভব হয়েছিল। সঙ্গে বিফ রোল তো ছিলই। তুই আমাদের এক লহমায় সেই দিনগুলোতে নিয়ে গেলি।
    চালিয়ে যাও বৎস।

  6. আবারও এক অনবদ্য লেখা। কতো যে তথ্য পাওয়া যায় তোমার কাছে। অথচ কি সাবলীল ভাবে মজার ছলে লেখা। বন্ধুদের মজার মজার পারদর্শীতা বড্ড ভালো লাগল পড়ে। শেষের অংশের বিষয়ে বলি, সবাই আছেন। থাকেন। হয়তো সশরীরে নয়। আছেন স্মৃতিতে, অনুভবে, ভালোবাসায় আর তাদের কথা ভেবে ভালোলাগায় ।
    অপেক্ষায় রইলাম পরের লেখার জন্য ।।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com