বাঙালি হিন্দুদের কাছে দুর্গাপুজো শুধুমাত্র দেবী বন্দনা নয়,তাদের কাছে এই পুজো হল একটা আবেগ, অনুভূতি এবং উচ্ছ্বাস। হিন্দুরা তাঁদের ধর্মীয় রীতিনীতি মেনে তাঁদের প্রাণের আরাধ্য দেবীকে আরাধনা করেন তাই শারদীয় দুর্গোৎসবে মেতে ওঠে বাঙালি। হিন্দু শাস্ত্রে বলা আছে ব্রহ্মই আদ্যাশক্তি জগজ্জননী দেবী দুর্গা। পূজারী সেই আরাধ্য দেবতার মৃন্ময়ী মূর্তিতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে চিন্ময়ী জ্ঞানে অর্চনা করেন। ভারত বর্ষ ছাড়াও বিদেশে বিশেষতঃ আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর এমনকি মালয়শিয়াতেও দুর্গাপূজো বহু বছর ধরে পালিত হয়ে আসছে।
বহু ধর্ম সংস্কৃতির দেশ সিঙ্গাপুরে হিন্দু সম্প্রদায় প্রতিবছর বাংলা বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী পালন করেন শারদীয়া দুর্গোৎসব। এখানে উল্লেখ্য, আমেরিকা বা অন্য অনেক দেশেই পুজো হয় শুধু সপ্তাহান্তে। কিন্তু সিঙ্গাপুরে পুজো হয় বাংলা পঞ্জিকার সময় মেনে।

ভাবতে ভাল লাগে, সিঙ্গাপুর সরকার সব ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে সম্মান জানানোর জন্য দুর্গা পুজো কমিটি গুলোকে সবরকমভাবে সহায়তা করেন। সিঙ্গাপুরে প্রায় পাঁচ- ছয়টি পুজো হয়, এর মধ্যে বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন, রামকৃষ্ণ মিশন, এবং বাংলাদেশি হিন্দু সম্প্রদায় পুজোর আয়োজন করেন। এখানে ষষ্ঠী, সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী চারদিনব্যাপী দুর্গাপুজাে হয়। দশমীর দিন দেবীবরণের মাধ্যমে পুজোর সমাপ্তি ঘটে।
সিঙ্গাপুরে দুর্গাপুজাে মহালয়ার দিন সুন্দর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যে দিয়ে আরম্ভ হয়। পঞ্চমীর দিনের “আনন্দমেলা” এই পুজোর বিশেষ আকর্ষণ। “আনন্দমেলার” জন্য আলাদা হল ভাড়া করে রন্ধন পটিয়সীরা নিজেদের হাতে বানানো জিভে জল আনা খাবারের বিক্রির ব্যবস্থা করেন। খাদ্যরসিক বাঙালি পেট পুজো করে পুজোর আমেজ উপভোগ করে উৎসবের শুভ সূচনা করেন। পুজো প্রাঙ্গনটি কয়েক হাজার বর্গফুট এলাকা জুড়ে এবং পুরোটাই শীতাতাপ নিয়ন্ত্রিত। পুজোর চার দিনব্যাপী বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ফ্যাশন শো ইত্যাদির আয়োজন করা হয়।

এখানকার বাঙালি অ্য়াসোসিয়েশন-এর দেবীর মূর্তি ফাইবারের তৈরি এবং কুমোরটুলি থেকে শিল্পীরা এসে এই মূর্তির নব অলঙ্করণ করেন। প্রতিমা এবং পিতলের মঙ্গলঘট বিসর্জন হয় না; নির্দিষ্ট জায়গায় সংরক্ষিত থাকে। পুজোর তিন দিন কমিটি কর্তৃক নির্বাচিত মহিলারা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে দেবীর ভোগ রান্নার দায়িত্ব ভার গ্রহণ করেন এবং একই রকমের শাড়ি পরিহিতা মহিলাদের দেবীর পায়ে একত্রে ভোগ নিবেদন এই পুজোর অন্যতম আকর্ষণ। পরে দর্শনার্থীদের মধ্য়ে সেই ভোগ বিতরণ করা হয়। এখানে পুজোর নির্ঘণ্ট ও সবরকম নিয়ম মেনেই কলা বউ স্নান থেকে শুরু করে কুমারী পুজো ,অষ্টমীর অঞ্জলি, সন্ধিপুজো এবং অন্যান্য আচার অনুষ্ঠান নিষ্ঠা সহকারে পালন করা হয়। পুজাের পুরোহিত এবং ঢাকিও দেশ থেকেই আসেন। সব শেষে দেবীবরণ এবং সিঁদুর খেলার মাধ্যমে দশমীর দিন মাকে বিদায় জানানো হয় এবং বিসর্জনের পরে সন্ধ্যাবেলা পুরোহিত সবাইকে শান্তির জল দিয়ে সব রকমের বাধা বিঘ্ন থেকে রক্ষা করার মন্ত্র উচ্চারণ করেন।

বাঙালি অ্যাসোসিয়েশন এর পুজোয় সদস্যদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা থাকে তবে বাংলাদেশি পুজোয় সকলের সমান প্রবেশাধিকার থাকে এবং সকল দর্শনার্থীকে ভোগ- প্রসাদ খাইয়ে আপ্যায়ন করা হয় ।সমস্ত রাস্তায় থাকে আলোর রোশনাই, যদিও নবরাত্রি এবং দীপাবলি উপলক্ষে একমাস আগে থেকেই রাস্তাগুলো রংবেরঙের আলো দিয়ে সুসজ্জিত থাকে। তাই পুজোর স্পর্শ-গন্ধ চারদিকে লেগেই থাকে।
আমরা যারা সিঙ্গাপুরে বহুবছর আছি এবং বহু বছর কলকাতার পুজো থেকে বঞ্চিত তাদের কাছে এই চারটে দিন খুশির বার্তা নিয়ে আসে। তবে পুজোর প্রাঙ্গন বা এলাকা থেকে বেরিয়ে বাইরের নিস্তব্ধতা দেখলে মনে পড়ে যায় কলকাতায় এই সময় কী দারুণ উচ্ছ্বাস আর আড়ম্বর চলছে; পাড়ায় মাইকের আওয়াজ, ঢাকের তাল, দূর থেকে ভেসে আসা রবীন্দ্র সঙ্গীত সব যেন মন প্রাণ জুড়ে থাকে এবং কানে বারবার প্রতিধ্বনিত হয়। যদিও সিঙ্গাপুরের পুজো আমাদের প্রতি বছর সেই অভাব অনেকটাই মিটিয়ে দিয়ে আসছে।

বর্তমান পরিস্থিতির জন্য বেঙ্গলি অ্য়াসোসিয়েশন সিঙ্গাপুর (বিএএস) এই বার পুজোর আয়োজন না করলেও, বাংলা ইউনিভার্সাল সোসাইটি (বিইউএস) সরকার প্রদত্ত সব রকম স্বাস্থ্য বিধি মেনে আর্য্য সমাজ মন্দিরে পাঁচ দিন পুজো করছেন। তবে পুজো হোক বা না হোক শরতের আকাশ দেখলে বাঙালি মন আগমনী সুরে মেতে ওঠে–তা সে আমার দেশের আকাশই হোক বা সিঙ্গাপুরের আকাশ।