Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

সেকুলার কেক আর যিশুদিনের গপ্পো

সুপ্রিয় চৌধুরী

ডিসেম্বর ১৮, ২০২০

Bow Barracks
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

২৪ ডিসেম্বর। সন্ধে সাড়ে ছ’টা সাতটা মতো হবে। বাতাসে শীতরাতের হিমেল কামড়। সেন্ট্রাল থুড়ি চিত্তরঞ্জন অ্যাভেনিউয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আপনি অথবা আপনারা। ট্র্যাফিক সিগন্যালের লালবাতিটা সবুজ হবার অপেক্ষায়। সেটা হওয়ামাত্র ধাঁ ধাঁ করে ফুটপাথ পেরিয়েই ঢুকে পড়া কাপালিটোলা বা ইন্ডিয়ান এয়ারলাইন্সের গায়ে সরু গলিটা দিয়ে। মধ্য কলকাতার পুরনো পাড়া। বউবাজার থানার নতুন বাড়ি, বন্দুকগলির তাড়ির ঠেক, সামনের একফালি পার্কটা, পার্কের এককোণে স্বাধীনতা যুদ্ধে বৌদ্ধ শহিদদের স্মৃতিস্তম্ভকে এপাশে ওপাশে রেখে সোজা সেঁধিয়ে যান মিটার ষাটেক লম্বা বেজায় আদ্যিকেলে লাল রঙের ব্যারাক টাইপের বাড়ি দুটোর মাঝখানের গলিটা দিয়ে। আজ্ঞে হ্যাঁ, এটাই সেই দ্য ওয়ান অ্যান্ড ওনলি ঐতিহাসিক বো ব্যারাক। তৈরি হয়েছিল সেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, ব্রিটিশ আর্মি আর আমেরিকান টমিদের থাকার প্রয়োজনে। যুদ্ধটুদ্ধ চুকেবুকে যাওয়ার পর সায়েবরা পোঁটলাপুঁটলি বেঁধেছেঁদে দেশে ফিরে গেলে যা বদলে যায় এ শহরের  ইঙ্গ-ভারতীয় অর্থাৎ অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের ঠিকানায়। অধুনা যা বিখ্যাত,  মিডিয়ায় চর্চা আর অঞ্জন দত্তের সিনেমার দৌলতে।  

[the_ad id=”266918″]

আমরা মানে গড়পড়তা বঙ্গবাবুরা, যারা এ শহরে বিদেশি ও ভারতীয় রক্তের সংমিশ্রণ বলতে শুধুমাত্র অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদেরই (ব্রিটিশ বাবা ও ভারতীয় মায়ের সন্তান) বুঝি, সেইসব মহোদয়ের উদ্দেশ্যে সবিনয়ে জানাই, ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়। ইঙ্গ-ভারতীয়রা ছাড়াও একদা আরও দু’টি মিশ্র সম্প্রদায়ের দেখা আকছার মিলত এই কল্লোলিনী তিলোত্তমায়। লুসো ইন্ডিয়ান— পর্তুগীজ ও ভারতীয় রক্তের সংমিশ্রণে সৃষ্ট মানুষ। অপরটি — ‘কিন্তলি’। কালো এবং বাদামি চামড়ার মানুষদের মিলনজাত সন্তানসন্ততিরা। যদিও নিখিল সুর মহাশয়ের লেখায় পাচ্ছি, কিন্তলিরা আসলে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানই। কিন্তু ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় দেখেছি, এ শহরের অ্যাংলো ইন্ডিয়ান সম্প্রদায়ের কাছেও এরা আলাদাভাবে কিন্তলি নামেই পরিচিত। অনেকের মতে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ লড়তে কলকাতায় আসা কৃষ্ণাঙ্গ আমেরিকান সৈন্যদল মানে টমিদের ঔরসজাত ফসল এই কিন্তলিরা। একদা এ শহরে অ্যাংলো ইন্ডিয়ানদের মতো লুসো ইন্ডিয়ান এবং কিন্তলিদেরও দেখা মিলত বহুল পরিমাণে, অবশ্যই এই বো ব্যারাকেও। সময়ের কালগ্রাসে তারা আজ অবলুপ্তপ্রায়। তবে এই প্রতিবেদনে আমার বিষয় জাতিসত্তা অথবা নৃতত্ত্বের কচকচি নয়, ফলে এসব প্রসঙ্গকে সরিয়ে রেখে আসুন একঝলক নজর চালানো যাক ব্যারাক চত্বরে। 

Bow Barrcks
টুনি আলোর রোশনাই, আর সাউন্ড বক্সে বিদেশি গানবাজনা। বড়দিন বো ব্যারাকে। ছবি সৌজন্য – whatshot.com

সামনে সিমেন্টবাঁধানো চওড়া পাকা গলির মাঝখানে বিশাল স্টেজ। টুনি আলোর রোশনাই। বিশাল ডিজে সাউন্ডবক্সে উদ্দাম ওয়েস্টার্ন মিউজিক। একটু বাদেই বুড়ো সান্টা সেজে পাড়ার কুচোকাঁচাদের গিফট বিলোবেন এবাড়ি ওবাড়ির বুড়ো আঙ্কল আর গ্র্যান্ডপার দল। ফলে বেজায় ভিড় স্টেজের সামনে। সুরের তালে তালে কোমর দুলছে আট থেকে আশি প্রায় প্রত্যেকের। স্টেজের হাত দশেক দূরে দেড়মানুষ উঁচু ক্রিসমাস ট্রি। সারা গায়ে খুদে খুদে চাইনিজ এলইডির মালা, রঙবেরঙের বল, তুলো তুষারের পেঁজা, বল্গা হরিণ, চুমকির তারা, মাইক্রো সাইজ়ের সান্টা পুতুল ইত্যাদি ইত্যাদি। ব্যারাকের এককোণে পর্ক ডাম্পলিং, ফ্রায়েড চিকেন মোমো, সুইট বাও আর এক্লেয়ার স্যুপের পসরা সাজিয়ে বসা গাউন-পরিহিতা ব্যারাক আন্টিরা। 

[the_ad id=”266919″]

রাস্তার দু’পাশে দুটো ব্যারাকের গায়ে নির্দিষ্ট ব্যবধানে তিনটে তিনটে (নাকি চারটে?) করে সর্বমোট ছ’-ছ’টা দরজা।  ঢিমে বাল্বের আলোয় আধো অন্ধকার গলি। দোতলা তিনতলায় উঠে যাবার চওড়া চওড়া সিঁড়ি। গোটা সিঁড়ি আর গলিপথ জুড়ে একটা নোনাধরা স্যাঁতস্যাঁতে, বেজায় পুরনো পুরনো গন্ধ। সিঁড়ি ভেঙে করিডরে উঠলেই আমূল বদলে যাওয়া চিত্রপট। নিট অ্যান্ড ক্লিন ঝাড়পোঁছ করা করিডর জুড়ে টিউবলাইটের স্নিগ্ধ আলো। বাইরে ডিজে সাউন্ডবক্সের গর্জন অনেকটাই ক্ষীণ এখানে। দু’পাশে সারি সারি পুরনো ফ্ল্যাট। জর্জিনা, ইভলিন, আগাথা, লিন্ডা, সুজানা আন্টিরা। প্রায় সব্বাই সত্তর পেরিয়েছেন কমপক্ষে। কেউ কেউ আশিও। কেউ সোয়েটার বুনছেন কাঁপা কাঁপা হাতে। কেউ যিশুর ফটোর সামনে রাখা মোমদানে মোমবাতিটা বসিয়ে দিচ্ছেন সযত্নে। পাশে চেয়ারের গদিতে শুয়ে থাকা বুড়ো ফক্স টেরিয়ার কুকুরটা। টেবিলে ঝুলনের মতো সাজানো যিশুর জন্ম, খড়ের আস্তাবল, ভেড়ার পাল আর মেষপালকের দল। সুতোয় ঝোলান রাংতার তারা। পাশে উটের লাগাম ধরে দাঁড়িয়ে থাকা সেই তিন মরুবাসী সন্ত। এরাই তো প্রথম তারায় দেখেছিলেন রাজাধিরাজের আগমনবার্তা। সব মিলিয়ে ছোট্ট একটুকরো বেথেলহেম এইমুহূর্তে বো ব্যারাকের এই ছোট ছোট আস্তানাগুলোয়। 

এখন ক্রমে কমে আসছে ব্যারাকবাড়ির ওয়াইন ব্যবসা। ছবি সৌজন্য – goodhousekeeping.com

আর এইসব আস্তানার কোনও কোনওটাতেই পাওয়া যায় অলৌকিক সেই দুই স্বর্গীয় পদ ! প্রথমটি খাদ্য, অপরটি পানীয়। আগাথা, সুজানা আন্টিদের হাতে জাদুকরি দিয়ে বানানো ওয়াইন আর এক্স-মাস কেক। আজ থেকে বছর বিশেক আগেও চার ধরনের ওয়াইন পাওয়া যেত বো ব্যারাকে। গ্রেপস, লিচি, ব্ল্যাকবেরি আর জিঞ্জার। লিচি আর ব্ল্যাকবেরি বানানো বন্ধ হয়েছে অনেকদিন। সুজানা আন্টিদের মতে ওগুলোয় অনেক ফৈজত। এই জেনারেশনের কেউ আর এ ব্যাপারে উৎসাহী নয় তেমন একটা। শেখার আগ্রহও নেই একদম। ফলে অগতির গতি ওই গ্রেপস আর জিঞ্জার। হতাশ শোনায় জর্জিনাদের গলা। “প্রবলেম ইজ়, আমাদের মতো হাতেগোনা এই ক’টা বুড়ি কবরে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এই এথনিক আর্টটাও মাটির তলায় চলে যাবে!” 

[the_ad id=”270084″]

এদানি ভিশুয়াল মিডিয়া আর কাগজপত্রে লেখালেখির দৌলতে এখানকার মদিরাই প্রচার পেয়েছে বেশি। ফলে খানিকটা আড়ালে চলে গেছে কেক। লিন্ডা আন্টিদের সেই আদ্যিকেলে ব্রিটিশ হ্যামার মাস্টার ইলেক্ট্রিক ওভেনে বানানো মিক্সড ফ্রুট্ট, প্লাম, ওয়াইন আর প্লেন স্পাঞ্জ কেক। অ্যানাদার ম্যাজিক ক্রিয়েশন ! ফলে টুয়েন্টি ফোর্থ নাইটে বো-ব্যারাক পরিদর্শনে গেলে আপনার পছন্দের তালিকায় ওয়াইনের পাশাপাশি অবশ্যই থাক কলকাতার অন্যতম সেরা হোম মেড কেক। দেয়ার ইজ় নো আদার অপশন। 

প্রসঙ্গত মনে পড়ল, বো ব্যারাকের পাশাপাশি এলিয়ট রোড, বেডফোর্ড লেন, রিপন স্ট্রিট, মারক্যুইস স্ট্রিট অঞ্চলেও সুজানা আন্টিদের মতো এরকম কয়েকজন কেক ও মদিরা রন্ধনপটিয়সী ছিলেন। আজ থেকে বছর পনেরো আগে যখন শেষবার তাঁদের দেখি, তখনই তাঁরা প্রায় প্রত্যেকে সত্তরের কোঠা পেরিয়েছেন। ফলে তাঁদের হাতের জাদু আজও এ ধরাধামে বিরাজমান কিনা সেটা জানা নেই। 

Cake
বো ব্যারাকে তৈরি বড়দিনের ফ্রুট কেক, প্লাম কেক। ছবি সৌজন্য – facebook.com

বলি অনেকক্ষণ তো ঘোরাঘুরি হল অ্যাংলো মহল্লাগুলোয়। চলুন এবার শহরের বাঙালি ক্রিশ্চান পাড়াগুলোয় ঢুঁ মারা যাক। মধ্য কলকাতার এন্টালি, তালতলা, বউবাজার। সারপেন্টাইন লেন, লর্ডপাড়া, তালতলা লেন, ক্রিক রো, সুরেশ সরকার রোড, পানবাগান, ছাতুবাবু লেন, অনরেট সেকেন্ড লেন, এরকম অসংখ্য অলিগলি। অগুন্তি বাঙালি ক্রিশ্চান পরিবার। পরি ডিকস্টা, মেরি বিশ্বাস, শুক্লা হিগিন্স, প্রণতি গোমস আর নীলিমা মণ্ডলদের ঘরে ঘরে মিক্সড ফ্রুট কেকের পাশাপাশি দুধপুলি, চিতুই পিঠে আর নতুন গুড়ের পায়েস। অনেকেই আবার নিজে হাতে বানানো কেক-মিক্স দিয়ে এসেছেন পাড়ার বেকারিগুলোয়। বেকিংটা হবে বেকারির ওভেনে। সময়মতো গিয়ে নিয়ে আসতে হবে সেগুলো। মুঠোফোনে তাগাদা লাগাচ্ছেন বারবার। 

আর ঠিক সেই সময় এখান থেকে অনেকটা দূরে, দক্ষিণ শহরতলির (অধুনা পিনকোড কলকাতা) প্রান্তে ঠাকুরপুকুর, জোকা, ক্যাওড়াপুকুর, ভাসা, কবরডাঙার মতো আধা মফস্বল ক্রিশ্চান পাড়াগুলোয় নতুন জামা ফ্রক পরে, হাতে খেজুরপাতা দুলিয়ে, বাংলা ক্যারল গেয়ে বাড়ি বাড়ি ঘুরবে বিল্টু, পিটার, জুলি, শম্পা, কেনেথ আর টুকটুকিরা। “আলোর পরশ ধরার ’পরে ছড়ায়ে / ওই আসেন শান্তিরাজ, ধন্য মোরা ধন্য… ।” গান শুনে দরজা খুলবেন বড়রা। টুকটুকিদের হাতে ছোট ছোট রঙবেরঙের ঝোলা। সবার ঝোলায় ভরে দেবেন  চকলেট আর খেলনা। তারপর প্রস্তুত হবেন প্রেয়ারে যাওয়ার জন্য। আধা শহর, আধা মফসসলের খুব সাদামাটা চার্চে বাংলায় সারারাত বাইবেল পাঠ করে শোনাবেন বুড়ো পাদ্রিবাবা। আদিম, কিন্তু কখনওই পুরোনো না-হয়ে যাওয়া চিরকেলে সেই  শান্তির বাণী। 

বো ব্যারাকের পাশাপাশি এলিয়ট রোড, বেডফোর্ড লেন, রিপন স্ট্রিট, মারক্যুইস স্ট্রিট অঞ্চলেও সুজানা আন্টিদের মতো এরকম কয়েকজন কেক ও মদিরা রন্ধনপটিয়সী ছিলেন। আজ থেকে বছর পনেরো আগে যখন শেষবার তাঁদের দেখি, তখনই তাঁরা প্রায় প্রত্যেকে সত্তরের কোঠা পেরিয়েছেন। ফলে তাঁদের হাতের জাদু আজও এ ধরাধামে বিরাজমান কিনা সেটা জানা নেই। 

কবি জয় গোস্বামী বলেছিলেন — কলম অশরীরী। কখন যে কোথায় নিয়ে যাবে, অনেক সময় লেখক তা নিজেও জানে না। কথাটা অমোঘ সত্যি। আর সেই উক্তিকেই মান্যতা দিয়ে দক্ষিণ শহরতলি থেকে কলম  আবার ফিরে আসছে মধ্য কোলকাতায়। ছুটে বেড়াচ্ছে বড়রাস্তা আর অলিগলিতে। আবার সেই নিউ মার্কেট, ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, ধুকুরিয়াবাগান, ইলিয়ট রোড, রিপন স্ট্রিট, বেনেপুকুর, তালতলা, এন্টালি, লর্ডপাড়া, ক্রিক রো… এলাকার পর এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে থাকা নাহুম, সালদানহা, রেইনবো, বড়ুয়া, ফ্লুরিজ, কুকি জার, নিউ মার্কেটের কেক গলি, সেই কবে বন্ধ হয়ে যাওয়া ম্যাক্স ডি গামা আর ওয়েস কনফেকশনার্স… নাম জানা, না-জানা আরও অসংখ্য ছোট বড় বেকারি। 

এই এক অদ্ভুত জিনিস- কেক। আক্ষরিক অর্থেই সেকুলার। সাহেবপাড়ার প্রাচীন বড়ুয়া বেকারি যেমন। ছবি সৌজন্য – getbengal.com

২৪ রাতের বিকিকিনি শেষ। লাভক্ষতির হিসেবনিকেশ। পরের দিন অর্থাৎ বড়দিনে জমিয়ে বিক্কিরিবাট্টার আশা। তারপর কেক-কারিগর স্টিফেন ফার্নান্ডেজ, আলিভাই, জয়সওয়াল ভাইদের দিনকয়েকের ছুটি। মাঝেমাঝে অবাক হয়ে ভাবি এই এক অদ্ভুত জিনিস — কেক। আক্ষরিক অর্থেই যাকে বলে — সেকুলার।  ডেভিড নাহুম, মিসেস সালদানহা, স্টিফেন ফার্নান্ডেজ, আলি ভাই, রোশন সিং নেগি, চঞ্চল বড়ুয়া, শিউলাল জয়সওয়াল, হিন্দু, মুসলিম, ক্রিশ্চান, বৌদ্ধ, শিখ, ইহুদি, বাংলা, হিন্দি, উর্দু, ইংরিজি, গুরুমুখী… সব যেখানে মিলেমিশে একাকার, আমার এই বেজায় ভালবাসা আর অহংকারের শহর কলকাতায় ! 

[the_ad id=”270085″]

ওদিকে তখন পার্ক স্ট্রিট বেজায় জমজমাট। ঠাসাঠাসি ভিড়। এ ফুট থেকে ও ফুটজোড়া আলোকমালা। লম্বা লাইন হোটেল-রেস্তোরাঁ আর মধুশালাগুলোর সামনে। লাল সান্তা টুপি, আলো জ্বলা শিং, ভুভুজেলা বাঁশি, লাল নীল গ্যাস বেলুন, বাচ্চা কাঁধে ছোট পরিবার, লুম্পেন ইভ টিজ়ার, বেহেড মাতাল, ভিড় সামলাতে গলদঘর্ম ট্র্যাফিক সার্জেন্ট, সায়েবপাড়ার বড়দিন দেখতে দলবেঁধে আসা মফসসলের মানুষ,  আর একটু পরেই রাত বারোটা। ঢং ঢং… সেন্ট পলস চার্চে ঘণ্টাধ্বনি, খিদিরপুর ডকে জাহাজের ভোঁ। কানফাটানো বাজির আওয়াজ… সেই মাহেন্দ্রক্ষণ ! লাখো মানুষের ভিড় ফেটে বেরনো প্রবল শব্দব্রহ্ম নামক বিস্ফোরণ — ‘মেরি ক্রিসমাস !’ 

দু’পাশে সারি সারি পুরনো ফ্ল্যাট। জর্জিনা, ইভলিন, আগাথা, লিন্ডা, সুজানা আন্টিরা। প্রায় সব্বাই সত্তর পেরিয়েছেন কমপক্ষে। কেউ কেউ আশিও। কেউ সোয়েটার বুনছেন কাঁপা কাঁপা হাতে। কেউ যিশুর ফটোর সামনে রাখা মোমদানে মোমবাতিটা বসিয়ে দিচ্ছেন সযত্নে। পাশে চেয়ারের গদিতে শুয়ে থাকা বুড়ো ফক্স টেরিয়ার কুকুরটা। টেবিলে ঝুলনের মতো সাজানো যিশুর জন্ম, খড়ের আস্তাবল, ভেড়ার পাল আর মেষপালকের দল। সুতোয় ঝোলান রাংতার তারা।

রাত পৌনে একটা। একটু আগের দমচাপা ভিড় উধাও এই মুহূর্তে পার্ক স্ট্রিটে। নির্জন রাস্তায় পড়ে থাকা ফাটা বেলুন, ভাঙা ভুভুজেলা বাঁশি, তোবড়ানো সান্তা টুপি, ফুটের ধারে মাতালের বমি, ঝাঁপ ফেলতে ব্যস্ত পান সিগারেটের দোকান আর হোটেল-রেস্তরাঁগুলো। শীতরাতের ঠান্ডা কামড়টা থেকে থেকে বাড়ছে বাতাসে। পার্ক হোটেলের লম্বা গাড়িবারান্দার নীচে গুটিগুটি পায়ে এসে বসল রাজুয়া, মুন্নি, সালমা, পূজা, ভোঁদু আর  শাহরুখরা। পাশে ল্যাজ নাড়তে নাড়তে বসে পড়লো ভুল্লুও। ওদের সঙ্গেই শোয় ফুটপাথে, এনজিও-র দেওয়া একই কম্বলের তলায়, তেলচিটে আর বেজায় ক্লান্ত মুখ সবার। হাতে না-বিকোন সান্তা টুপি, বেলুন, ভুভুজেলা বাঁশি আর স্ট্রবেরির প্যাকেট। সবার ছেঁড়া, ময়লা জ্যাকেট, সোয়েটার আর ফাটা জিন্স প্যান্টের পকেট থেকে একে একে বেরিয়ে আসছে সেই মহার্ঘ বস্তুটি। ছোট ছোট টুকরোয় কাটা যিশুদিনের সেকুলার কেক ! চার্চে প্রেয়ারে যাবার আগে দিয়ে গ্যাছেন রয়েড স্ট্রিটের বুড়ি ফিলোমিনা আন্টি। প্রতিবারই আসেন বাতের ব্যথা নিয়ে কোঁকাতে কোঁকাতে। এবারও অন্যথা হয়নি। “তুম জিও হাজ়ারো সাল আন্টি অওর তুমহারা ইয়ে কেক ! মেরি ক্রিসমাস!” সোল্লাসে চেঁচিয়ে উঠল শাহরুখ। খিলখিল হাসিতে এ ওর গায়ে ঢলে পড়ল রাজুয়া, সালমা, মুন্নিরা। ‘ভোউউউউউ’ – আকাশের দিকে তাকিয়ে লম্বা একটা হাঁক ছাড়ল ভুল্লু। নির্জন পার্ক স্ট্রিটে শীতরাতের নিস্তব্ধতা খানখান করে সেইসব উদ্দাম হাসি আর চিৎকার ছুটে চলে গেল তিরগতিতে কাল মহাকালের সীমানা পেরিয়ে ! 

পুনঃ প্রতিবেদনটি লেখার সময় ঘুরেফিরে একটি প্রশ্নই জাগছে মনে। বছরের পর বছর ধরে চলে আসা এই বাস্তব দৃশ্যপট, এই অতিমারীর আবহে একই রকম থাকবে তো ? মুন্নি, রাজুয়া, শাহরুখদের হাতে এবারও পৌঁছবে তো ফিলোমিনা আন্টির এক্সক্লুসিভলি এক্স-মাস অ্যান্ড সেকুলার কেক ? প্রশ্নগুলো কিন্তু রয়েই গেল।                

Author Supriyo Chowdhury

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

Picture of সুপ্রিয় চৌধুরী

সুপ্রিয় চৌধুরী

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।
Picture of সুপ্রিয় চৌধুরী

সুপ্রিয় চৌধুরী

জন্ম ও বেড়ে ওঠা উত্তর কলকাতার পুরোনো পাড়ায়। বহু অকাজের কাজী কিন্তু কলম ধরতে পারেন এটা নিজেরই জানা ছিল না বহুদিন। ফলে লেখালেখি শুরু করার আগেই ছাপ্পান্নটি বসন্ত পেরিয়ে গেছে। ১৪২১ সালে জীবনে প্রথম লেখা উপন্যাস 'দ্রোহজ' প্রকাশিত হয় শারদীয় 'দেশ' পত্রিকায় এবং পাঠকমহলে বিপুল সাড়া ফেলে। পরবর্তীতে আরও দুটি উপন্যাস 'জলভৈরব' (১৪২২) এবং 'বৃশ্চিককাল' (১৪২৩) প্রকাশিত হয়েছে যথাক্রমে পুজোসংখ্যা আনন্দবাজার এবং পত্রিকায়। এছাড়া বেশ কিছু প্রবন্ধ এবং দু চারটি ছোটগল্প লিখেছেন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা আর লিটিল ম্যাগাজিনে। তার আংশিক একটি সংকলন বই আকারে প্রকাশিত হয়েছে 'ব্যবসা যখন নারীপাচার' শিরোনামে। ২০১৭ সালে পেয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমি পুরস্কার।

One Response

  1. তোমার হৃদয় টা সালা ফুটোস্কোপ দিয়ে দেখতে মন চায়, কত পরতে এতো ভালোবাসা লুকিয়ে রেখেছো ? তোমার লেখায় কলকাতা বিশ্বের দরবারে এক অসামান্য ভালোবাসার শহর হয়ে রইলো “City of Compassion “.

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস