সিনেমা এবং মঞ্চাভিনয়ের অসাধারণত্বে আত্মনিবেদিত সৌমিত্র কবিতায় যে কীরকম অসম্ভবের যাপন ধরে রেখেছেন সে কথা অনেকেই খেয়াল করেননি। শুধু কি সম্পর্ক, শুধু কি প্রেমার্তি-ই তাঁর কবিতায় দিব্যোন্মাদ বাক্যসকল জাগিয়ে তোলে? নাকি জীবনের অনুষঙ্গে চিরপ্রবাহিণী সময় স্বাক্ষর রেখে যায় তাঁর লেখায়? সৌমিত্র নিজেই লিখেছেন:
“একসময় একটি কবিতায় আমি লিখেছিলাম, ‘আমার স্মৃতি আর এক সমুদ্র যা দিনে দিনে চিত্রার্পিত হয়েছে”।
যখনই কুয়াশার মধ্যে চাঁদ-ডোবা অন্ধকারে তিনি হারিয়ে গিয়েছেন তখন আত্মপ্রদর্শনী নয়, সৌমিত্রর কবিতায় উঠে এসেছে জীবনকে ফুটিয়ে তোলার প্রয়াস। কবির ভিতর-বাহির এবং চারপাশ, বিভিন্ন বন্ধুর সঙ্গে তাঁর যাপন, সবকিছু মিলিয়েই সৌমিত্রর ব্যক্তিগত নক্ষত্রমালা। ভাঙাচোরা সময়ের ভগ্নস্তূপে যে সব উজ্জ্বলতা চুপ করে আছে তাদের খুঁজতে খুঁজতে তাঁর অক্ষরগুলো কথা হয়ে ওঠে আর রেখাগুলি ছবি। গাজনের মেলা, ভরা কোটালের নদী, লেঠেলদের হামলা সবকিছু তিনি প্রত্যক্ষ করেন। প্রাচীন প্রত্ন স্তূপের রহস্যে নিঃসঙ্গ অন্বেষণ চালান মুহূর্তগুলির ভাঙা গড়ায় তিনি জন্মান্তর দেখতে পান। ম্রিয়মাণ মুখগুলো তাঁর স্বপ্নকে শেষ করতে পারে না।
কবিতার প্রেক্ষিতে কাব্যিক অভিজ্ঞান ধারণ করার সামর্থ্য আমাদের আজও গড়ে উঠল না। বাংলা কবিতার বিশাল পাঠকবৃত্তে সৌমিত্র অকৃত্রিমভাবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। শক্তি চট্টোপাধ্যায় তাঁর বই ছাপাতে উদ্যোগ নিয়েছেন, সত্যজিত্ রায় তাঁর কবিতার বইয়ের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়েছেন। আর্কেটাইপ, মিথ, রূপক, উপমা সবই এসেছে তাঁর কবিতায় কিন্তু সমকালীন প্রত্যেকের থেকে সৌমিত্রর পথ ভিন্ন। হয়তো সেটা তাঁর জীবনের বহুমাত্রিকতা থেকে এসেছে। বহুবর্ণ মৃত্যু, শুভ্র আর্তনাদ আর ছদ্মবেশী পৃথিবী ছাড়িয়ে তাঁর দৃষ্টি এগিয়ে যায় উল্কার টুকরোতে। ফুল যেভাবে বিকশিত হয় সেরকমই সৌমিত্র-র কবিতা জীবনের বহুবর্ণ সুষমায় বিন্যস্ত। আধুনিক বিশ্বের চিন্তাগুলিও তাঁর কবিতায় ছায়া ফেলেছে। যখনই কবিতায় সুন্দরকে তিনি প্রত্যক্ষ করেন তখনই তার পাশেই নিরন্ন মানুষের মুখ কৃষ্ণপক্ষের মতো জেগে থাকে। প্রস্তরীভূত পুরাণ-প্রতিমা তাঁর কবিতায় আসে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠার জন্য। যখনই বাচ্যার্থের অতিরিক্ত কোনো ব্যঞ্জনা আবিষ্কারের জন্য আমরা তৎপর হয়ে উঠি তখন কবির অস্ত্র আমাদের সামনে ভঙ্গিল পর্বত অতিক্রমের স্পর্ধা জোগায়। তাঁর সময়ের অন্যতম পূর্বাচার্যরা তাঁর চিদাকাশে সদর্থক অন্তর্ঘাত ঘটান অনেক সময়। অমীমাংসিত যা কিছু পাঠকের সঙ্গে আলাপ জমাতে পারে, অপেক্ষা যে নিজেকে আত্মসাৎ ও আক্রমণ করতে পারে সৌমিত্রর কবিতা সেই কথা নতুন করে ভাবতে শেখায়।
জীবন ও কল্পনাকে একসুতোয় বেঁধে নিলেও সত্য যে বাস্তবের থেকে উজ্জ্বল এ কথা সৌমিত্রর কবিতায় বার বার উঠে আসে। জীবনের বাঁকে কোথায় যে অশনি-সংকেত রয়েছে সৌমিত্র তা খুঁজতে বের হন। প্রান্তবাসী মানুষদের সঙ্গে একাত্মতায় সৌমিত্র হেঁটে চলেন অনিশ্চয়ের পথে। ক্ষমতা আর ক্ষমতাহীনতাকে রাষ্ট্রীয় পরিসরে অনেকবার সৌমিত্র তাঁর লেখায় নিজের মতন করে বুঝতে চেয়েছেন।
শুধু প্রেয়সীর নাম খুঁজতে চাওয়া কিংবা নক্ষত্রের মধ্যে নবীন কিশোরের মুখ দেখতে পাওয়া নয়, কুয়াশার মধ্যে হেঁটে যেতেও ভারী অদ্ভুত তৃপ্তি পান কবি। চিরজীবী আলোয় ছায়াপথই হয়ে ওঠে তাঁর প্রেম। তিনি বিশ্বাস করেন জীবনের বেশির ভাগটাই স্মৃতি— তার মধ্য দিয়েই মানুষের জীবনের বেলা পড়ে আসে। তাঁর কবিতার ল্যান্ডস্কেপে মৃত্যুর বিষণ্ণতা ফুটে ওঠে। সমস্ত ক্ষতির মধ্যে ভোরবেলাকার সুর ভেসে আসে। সৌমিত্র যে ভারতবর্ষকে প্রত্যক্ষ করেন সেখানে ক্ষুধা ছুটে যায় দাবানলে তাড়া খাওয়া জন্তুর মতন। নকশাল আন্দোলনে বন্দুকের গুলিতে যে সমস্ত যুবকেরা অকালে ঝরে গেছে তারা জলপ্রপাতের হুংকারে ফিরে আসে আবার। অরক্ষিত অশ্বমেধের ঘোড়ার প্রতিও কবির সমবেদনা আমাদের প্রাণিত করে। স্ফটিকের মতো স্বচ্ছ জলে এই কবির ব্যক্তিগত অক্ষরগুলি জ্বলে উঠেছে। বড় কোনো অগ্নিকাণ্ড শুরু হবার আগে, আঘাটার দিকে জীবন চলে যাবার আগে সৌমিত্র সংবেদী হয়ে বন্ধুর পাশে দাঁড়াতে চান। যারা মারা গেছে, কবির বুকের ভেতর জেগে থাকে তাদের আদল। কার্তুজ, রাজনীতি, সবই মুহূর্তে বিক্রি হয়। সৌমিত্র আপশোসের পাঁচালি লেখেন।
[the_ad id=”270088″]
তারা নিভে যায়। এক শতাব্দীর কষ্ট বুকে নিয়ে কবি পাথরের মতো বসে থাকেন। বিরাট কোনো আয়নায় মুখ দেখতে দেখতে দুঃখগুলি পর্বততরঙ্গের মতো মাথা তোলে। কখনও কখনও মফস্বল শীতের দুপুরে দুঃখ থেকে মুক্তি চান কবি। সৌমিত্রর কবিতার ভাষা অভ্যস্ত মানুষের মুখের চৌচির দশা দেখে আর্তনাদ করে ওঠে। কংক্রিটের জঙ্গলের বাইরে একটা অভিনব আকাঙ্ক্ষা তাঁকে সপ্তর্ষিমণ্ডলের কাছে নিয়ে যায়। ডাহুকের ডাক আর চিতল হরিণের অন্বেষণ তবুও জারি থাকে। কলিজা ছিন্ন করে যারা, তাদের থেকে মুখ ফিরিয়ে পিশাচসিদ্ধের মতো পদ্মবীজের মালা জপ করেন এই কবি। আত্মবিচ্ছিন্ন হওয়ার দুঃখে তখন বুদ্ধগয়া কেঁদে ওঠে।
জীবনের বাঁকে কোথায় যে অশনি-সংকেত রয়েছে সৌমিত্র তা খুঁজতে বের হন। প্রান্তবাসী মানুষদের সঙ্গে একাত্মতায় সৌমিত্র হেঁটে চলেন অনিশ্চয়ের পথে। ক্ষমতা আর ক্ষমতাহীনতাকে রাষ্ট্রীয় পরিসরে অনেকবার সৌমিত্র তাঁর লেখায় নিজের মতন করে বুঝতে চেয়েছেন।
যতক্ষণ না গন্তব্যের গান বেজেছে ততক্ষণ তিনি তাঁর কবিতার ষড়জটি ধরে রেখেছেন। মহাপৃথিবীর সব কিছু— এই সন্ধ্যা, রামধনু, আত্মহারা বেলাশেষ, গভীর আগুনের সমান্তরালে কবি হেঁটে চলেন। সদাচার, বিশ্বাস, প্রত্যয় সবকিছু অন্তিম অবধি তিনি আঁকড়ে থেকেছেন। যা আমাদের প্রত্যেকের আত্মার ভেতর থেকে নিত্য উৎসারিত হয় তা কবির কাছে কর্ম নয় চিন্তা নয় এক বিস্ময়, এক চমৎক্রিয়া। সৌমিত্রর কবিতায় মায়া আছে। জাগর কিংবা ঘুমঘোরে প্রকৃতির চারপাশে বস্তুসকলের নিজস্ব সংবেদনকে তিনি বুঝতে চেয়েছেন। মানুষহীন অবিরাম সময়ে নিহিত চৈতন্য বয়ে যায়। ইন্দ্রিয়ত্বর ঊর্ধ্বে উঠে সৌমিত্র সেই বিষয়গুলি ধারণ করতে চান।
লিখনকালীন অতৃপ্তিগুলি নিয়ে তিনি বার বার খাণ্ডবদাহন লিখে চলেন। সমাজে প্রতিনিয়ত যে কুরুক্ষেত্র চলছে সেই চিরায়ত সত্য তুলে ধরেন। ব্যবসায় গণেশ উল্টে যায়, মানুষের ব্যথা লোপাট হয়ে যায়, রক্তমাখা শূন্যতায় ভরে থাকে তাঁর হৃদয় তবুও দিব্য ডাকহরকরার মতন তিনি জীবনকে বরণ করে নেন। তিনি জানেন অজ্ঞাতবাস একদিন শেষ হবে। মানুষের পাপবিদ্ধ হৃদয়েও তো প্রতিবছর শরৎকাল আসে। চন্দনের চিতাও একদিন সব ক্ষতি মুছে দেবে তখন সৌমিত্র বলে উঠবেনঃ
“এক চিলতে গলি তারই নাম সুখ
তারই অন্ধকারে
আমি স্পর্শ করেছিলাম তোমার দিব্য চিবুক”








ঐশিক দাশগুপ্তর জন্ম ১৯৮৮ এবং বেড়ে ওঠা মেদিনীপুর শহরে৷ শিক্ষা প্রেসিডেন্সি কলেজ ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে৷ বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর৷ সাহিত্য ও জরুরি অবস্থা নিয়ে পিএইচ ডি৷ সম্পাদিত পত্রিকা ‘হান্ড্রেড মাইলস’৷ বর্তমানে গভর্নমেন্ট জেনারেল ডিগ্রি কলেজ, নারায়ণগড়-এ অধ্যাপনারত৷
প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ 'কুশপাতার দেয়াল' ,'অপ্রাপণীয়'। প্রবন্ধ সংগ্রহ 'বাংলা সাহিত্যে জরুরি অবস্থার প্রতিফলন'।
One Response
ভালো লাগল লেখাটি। খুব দরকার ছিল।