নদীটির নাম শিলাবতী। লোকের মুখে মুখে আদরের নাম শিলাই। ফাল্গুনের দুপুরে গা এলিয়ে শুয়ে আছে যেন শীর্ণ, শান্ত এক রমণী। চারপাশের রক্তাভ শিলাস্তূপ, রুক্ষ বন্ধুর প্রস্তর-প্রাচীর যে এরই উন্মাদ প্রণয়ের ফল, দেখে বোঝা মুশকিল।
পশ্চিম মেদিনীপুরের শালবনির কাছে গনগনি এক শিলায়িত বিস্ময়। না, গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সঙ্গে এর তুলনার কোনও অর্থ হয় না । কিন্তু তুলনা করার প্রয়োজনই বা কী? আমাদের ঘরের কাছে এই বিচিত্র রূপময় ভূ-প্রকৃতির ঐশ্বর্য কিছু কম আকর্ষণীয় নয়। দূর থেকে যখন প্রথম তাকে দেখলাম, মনে হল আদিগন্ত এক গৈরিক তরঙ্গ স্তম্ভিত হয়ে আছে। পাথরের বুকে এই উদ্ধত গনগনে আগুনের তরঙ্গ দেখেই হয়তো কেউ নাম রেখেছিল গনগনি।

ধাপে ধাপে নামতে নামতে আবিষ্কার করলাম তার নানা স্তরে নানা ভঙ্গিমা। কোথাও মাথায় জটাজুটধারী এক সন্ন্যাসীর মাথা। কোথাও খাড়া খাঁজকাটা প্রাচীরের বিভঙ্গ। মাঝে মাঝে দু’একটা কাজুবাদামের গাছ। আর অনেক নিচে শান্ত শিলাবতী। উঁচু মালভূমি থেকে একটা সরু এবড়ো-খেবড়ো সিঁড়ি নেমে গেছে বটে নদী-উপত্যকার দিকে। কিন্তু না হলেও ক্ষতি ছিল না। উৎসাহী পথিকের জন্য সে তার পাথুরে পথের মায়া বিছিয়েই রেখেছে।
বস্তুতঃ পশ্চিমের মালভূমি অঞ্চলের রুক্ষ ভৈরবমূর্তির প্রকৃত মহিমা উপলব্ধি করার জন্য প্রশস্ততম সময় রৌদ্রতপ্ত দ্বিপ্রহর। যত কষ্টই হোক না কেন, এই সুবিস্তীর্ণ রক্তিমায় তার দীপ্ত ভ্রূকুটি যেমন প্রখর, এমন আর কোনও সময়ে নয়। তার সবটুকু মহিমা উপলব্ধি করা চাই বইকি! তবে বর্ষা নামলে যৌবনোচ্ছল নদী আর মৌনী পাথরের বিচিত্র যুগলবন্দি কোন ছন্দে বাজে, তা দেখার ইচ্ছে রয়ে গেল।

আমরা ভেবেছিলাম এখানে সূর্যাস্ত দেখব। কিন্তু কালবৈশাখী ঘনিয়ে এল গনগনির আকাশে; অস্ত যাবার অনেক আগে সূর্য চলে গেল মেঘের আড়ালে। তারও এক স্বতন্ত্র গরিমা। আসলে এ এমন এক ক্যানভাস যার উপর যে কোনও রঙ তার সবটুকু মাধুর্য নিয়ে ফুটে ওঠে। সে দ্বিপ্রহরের রৌদ্রতপ্ত গেরুয়া হোক অথবা গোধূলির করুণ কোমল সোনালি। এমনকি মেঘ-ধূসর ম্লানিমাও তাকে মানিয়ে যায়।
গনগনি গড়বেতার কাছে। এর পরে আমাদের গন্তব্য ছিল পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথির কাছে মনচাষা পল্লী নিকেতন। পর্যটনের পরিভাষায় এর একটি গালভরা নাম আছে– ইকো-ট্যুরিজ়ম ভিলেজ। কিন্তু এই ছায়া-সুনিবিড় শান্তিনীড়ের জন্য পল্লী নিকেতন নামটিই উপযুক্ত মনে হয়। আজকাল হয়তো অনেকেই এভাবে কৃত্রিম গ্রাম বা খামার বাড়ি করে পর্যটকদের আহ্বান করেন। তবে এই গ্রামটিতে যতটা সম্ভব কৃত্রিমতা পরিহার করার প্রয়াস লক্ষ্য করা গেল।

বাঁশ এবং বেত ছাড়া কিছুই ব্যবহার করা হয়নি। এমন কি আসবাব, বসার বেঞ্চি, সবকিছু বাঁশের তৈরি। খাটের উপর শিকে ঝোলানোর মত দড়ি দিয়ে বাঁশের ছোট লাঠি বেঁধে তোয়ালের বদলে নতুন গামছা। খাটে শুয়ে উপর দিকে তাকালে চোখ চলে যায় অনেক উঁচু ছুঁচলো হয়ে যাওয়া সিলিং-এর দিকে। যেন হারিয়ে যেতে হয়। অল্প আলোয় অনভ্যস্ত শহুরে চোখ মুহূর্তের অস্বস্তি কাটিয়ে স্নিগ্ধ আরাম পায়। এই কম আলোর একটা বাস্তব কারণ পোকামাকড়ের থেকে সুরক্ষা। খাটের একধারে মশারি সুন্দর করে মুড়িয়ে ঝোলানো। রাতে ওখানকার ভবানী, গীতারা যত্ন করে টান টান করে মশারি টাঙিয়ে বিছানার চারপাশে গুঁজে দেবে। সন্ধে হলে ঘরে দিয়ে যাবে ধুনো।
মনচাষার খাবার জায়গাটি দেখার মতো। মস্ত দাওয়ায় প্রচুর বসবার চেয়ার টেবিল, দেয়ালে আলপনা, কুলো, ঝুড়ি আটকানো। এক টুকরো দেয়াল আছে, তাতে কেউ ইচ্ছে করলে নিজের আঁকা ছবি টাঙিয়ে দিতে পারে। কাগজ পেনসিল রাখা আছে। আমাদের একজন তখনই ছবি এঁকে টাঙিয়ে দিলেন। ভাত খাবার বন্দোবস্ত কাঁসার থালায়। এমন নতুন কিছু নয়, তবে সন্ধেবেলায় ছোট ছোট ধামা করে মুড়ি বেগুনির পাশে পুষ্ট একটি কাঁচালঙ্কা চোখ এবং রসনা উভয়ের পক্ষেই বড় তৃপ্তিদায়ক।

শয়নকক্ষের চারদিকে বারান্দা। তার রেলিং, মেঝে, তাতে বসার বেঞ্চি বলা বাহুল্য বাঁশের। সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে একটি নদী। মেদিনীপুরের সব নদীর মতো এরও জল ঘোলা। তবে রাতে তাকে বেশ রুপোলি দেখায়। শুধু এই কারণেই এখানে পূর্ণিমায় আসতে হবে। আমাদের কুটিরের নিচে ছিল একটি ঢেঁকি। ঠিক যেমন ‘অশনি-সংকেত’-এ দেখেছি। ইচ্ছে হলে তাতে চড়েও নেওয়া যায়। যখন বাঁশের গেট পেরিয়ে ঠেলাগাড়ির মতো দেখতে ট্রলিতে মাল তুলে নিয়ে যাওয়া ভবানীর পিছন পিছন রিসেপশন-কাম ডাইনিং লাউঞ্জে গিয়ে হাজির হয়েছিলাম তখনি এই সবুজে-বাদামিতে আঁকা পল্লী-বাটিকাটি আমাদের আপন করে নিয়েছিল একটি দিন, একটি রাতের জন্য। আপনাদেরও নেবে, এ কথা বলতে পারি।
*ছবি সৌজন্য: লেখকের সংগ্রহ এবং Facebook
ইংরেজি সাহিত্যে লেডি ব্রাবোর্ন কলেজের মেধাবী ছাত্রী সুতনুকা কর্মজীবন শুরু করেছিলেন আজকাল-এ সাংবাদিকতা দিয়ে, গৌরকিশোর ঘোষের সাহচর্যে। কাজ করেছেন সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়, হামদি বে, তপেন চট্টোপাধ্যায়ের মতো কিংবদন্তীদের সঙ্গে। পরে সরকারি স্কুলে ইংরেজি সাহিত্যের মাস্টারিতে মনোনিবেশ করেন। তবে কবিতার সঙ্গে তাঁর ওঠাবসা-ভালোবাসায় ছেদ পড়েনি কখনও। কবিতা ছাড়াও লিখেছেন প্রবন্ধ, ছোটদের ইংরেজি শেখানোর কলাম, ছোটগল্প। বর্তমানে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন দেশ-বিদেশ ঘুরে আর অজস্র বই পড়ে।
One Response
সুতনুকাদির লেখার আমি পরম ভক্ত। আরও অনেক লেখা পড়তে চাই