আমার স্ত্রী রক্ত একদম দেখতে পারে না। কিন্তু বাজার করতে বড়ই ভালবাসে। চিকেন তার প্রিয় খাদ্য। মাংসের দোকানদার পাছে মরা বাসি পচা জিনিস গছিয়ে দেয় তাই সে দাঁড়িয়ে থেকে তরতাজা মুরগিটি বেছে তবেই সেটা কাটতে দেয়। কিন্তু মুরগির গলা কাটার সময় এলেই চোখ সরিয়ে নেবে। বঁটির কাঠের বাঁটে বসা কসাই মুন্না ছটফট করতে থাকা মুরগিটার দুই ডানা মুচড়ে ধরে ওটাকে উদ্যত ফলার সামনে নিয়ে আসার আগেই ও মুখ ঘুরিয়ে ফেলবে উল্টোদিকে। জলজ্যান্ত পাখিটাকে ওই রকম নৃশংসভাবে কাটা আর ওটার শরীর থেকে ফিনকি দিয়ে ওঠা রক্ত যাতে সচক্ষে দেখতে না হয় তার জন্য এই ব্যবস্থা।
ওকে ওইরকম করতে দেখে হাসে মুন্না। সেদিনও একইভাবে ওকে চোখ বন্ধ করে মুখ সরিয়ে নিতে দেখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল “বৌদি রোজ রোজ এরম করেন কেন বুঝি না! এসব তো সব পোলট্রির চাষের পাখি, খাইয়ে দাইয়ে বড় করা হচ্ছেই তো সব কাটা পড়ার জন্য। না কাটলে আমার পেট চলবে কী করে, আপনাদেরই বা কী করে পেট ভরবে?” রক্তপাত শেষ হলে মুখ ফেরায় আমার স্ত্রীও, মুন্নার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে “হ্যাঁ হ্যাঁ , সে তো বটেই ।”
বিধানসভা ভোটের সবে চার পর্ব তখন শেষ হয়েছে। কয়েক হাত দূরে চায়ের দোকানের বেঞ্চিতে পায়ের উপর পা তুলে খবরের কাগজ পড়ছিলেন একজন। ভোটপর্বে প্রকাশ্য দাঙ্গাহাঙ্গামা, বুথদখল, ছাপ্পা রিগিং বেনিয়মের অভিযোগের বিস্তারিত খবর পাশের ভদ্রলোককে জানাতে জানাতে কথা উঠল, এবারের ভোটের এখনও পর্যন্ত একমাত্র বলি মুর্শিদাবাদে টিয়ারুল শেখকে নিয়ে। ধোঁয়া ওঠা লিকার চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে শ্রোতা ভদ্রলোক বলে উঠলেন “যাক এবার এখনও পর্যন্ত তাহলে মাত্র এক পিস। আগের ভোটে তো শ’খানেক মতো ক্যাজুয়ালটি ছিল তাই না?”
“দাঁড়ান এখনও তো বেশ কয়েক দফা বাকি, ভোটের পরে সেন্ট্রাল ফোর্স গেলে দফায় দফায় আবার কত মরবে তার ঠিক আছে?”
“সবে তো কলির সন্ধে। এখনও রেজাল্ট বেরনো আছে, ঘোড়া কেনাবেচা, সরকার গড়া। টাউন সব থমথমে, এবার মনে হচ্ছে মারাত্মক কিছু একটা হবে। সারা বাংলা জুড়ে দাবানল হবে, রক্তবন্যা বইবে, কত বডি যে পড়বে গুনে শেষ করা যাবে না।”
ওদিকে কান আছে মুন্নার। ছাল ছাড়ানো মুরগিটাকে ন্যাংটো বাচ্চার মতো হাতের উপর নাচিয়ে নিয়ে বঁটির ধারাল ফলায় টুকরো করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে সে বলে ওঠে, “সব মুরগি, আমরা সব্বাই হলাম গিয়ে এইসব চাষের মুরগি। মুরগি মরলে দুঃখ করে লাভ আছে? দু’টাকা কেজি চাল, রেশনের চিনি কেরাসিন গম দিয়ে পুষছে, ঘর করে দিচ্ছে পাইখানা-বাত্থুম, এমনি এমনি নাকি? মারার জন্যেই তো আমাদের পোষা।”
শুনেই ছ্যাঁত করে উঠল বুকটা। ওর চোখের দিকে ফ্যালফেলিয়ে তাকিয়ে আছি, ও বলে “না না, আপনাদের কথা আলাদা। আপনারা লেখাপড়া করা মানুষ, ভাল চাকরিবাকরি করেন…।”
আমি বলি “কোথায় আলাদা, আমাদেরও তো ভোটে যেতে হয়, কেউ প্রিসাইডিং অফিসার তো কেউ মাইক্রো অবজারভার। আমাদের কপালে কী লেখা আছে কে জানে?”

পিস করা কেজিখানেক মাংস একটা প্লাস্টিকের প্যাকেটে করে আমার হাতে তুলে দেয় মুন্না। সাদা থলের তলায় জমছে লাল রক্ত। অন্য বাজারের সঙ্গে ওটাকে ব্যাগে ভরলে চুঁইয়ে পড়া রক্তে সব মাখামাখি হবে, তাই আলাদাভাবে হাতে ধরে নিয়ে যাওয়াই সেফ। স্ত্রীয়ের পাশাপাশি হেঁটে বাজার থেকে বেরচ্ছি আর মাথার ভিতর পাক খাচ্ছে মুন্নার কথাগুলো।
সত্যিই তো, আমাদের এই দেশের আম নাগরিক, ষাট শতাংশ সাধারণ ভোটার দানাপানি দিয়ে চাষ করা মুরগি ছাড়া আর কী? মুরগির আবার মানবাধিকার থাকতে পারে নাকি? তার জীবনের মূল্য সম্মান সম্ভ্রম? ওদের মৃত্যু রক্তপাতে কাতর হওয়া আদৌ কতটা যুক্তিযুক্ত? চাষ করা জলের মাছ আর মাঠের শাকসবজি ফলমূলের জীবনের অধিকার নিয়ে আবার কে কবে প্রশ্ন তুলেছে ?
স্বাধীন ভারতের রাজনীতি, ওয়েলফেয়ার স্টেট মডেলের ভজঘট সরকারি নীতির চোখে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ গরিব, পিছিয়ে থাকা, আন্ডারপ্রিভিলেজড জনগণ আজও যেন রাষ্ট্র নামক বৃহৎ এক খামারে প্রতিপালিত লাইভস্টক ছাড়া আর কিছুই না। স্বাধীনতার এত বছর পরেও তাদের আত্মোন্নতির বদলে সবসময়েই গুরুত্ব পেয়ে এসেছে তাদের সাহায্য করা, ত্রাণ দেওয়া, পাইয়ে দেওয়া, পরজীবী বা পরগাছা হিসাবে তৈরি করার মানসিকতা। আজও শয়ে শয়ে সরকারি তথাকথিত জনকল্যাণকামী প্রকল্পের বেশিরভাগই মানুষকে স্বনির্ভরতা ও আত্মবিকাশের সুযোগ দেওয়ার ব্যাপারে উদাসীন। তারা যেন চাইছে করুণা করতে, আহা রে বলে দানখয়রাতি করতে, মানুষ যেন জনপ্রতিনিধি বা রাজনীতির লোকজনের এই জাতীয় বদান্যতার জন্য তাদের কাছে আপাদমস্তক ঋণী বা কৃতজ্ঞ থাকে সেটা সুনিশ্চিত করতে, যাতে কৃতজ্ঞতাপাশে বাঁধা পড়ে জনতা তাদের প্রশ্নহীন সমর্থন আর আনুগত্য দুইই প্রদর্শন করতে বাধ্য হয় ।
এতসবের আয়োজন সবই ভোটকে মাথায় রেখে । তাই ভোটের সময় সেই প্রশ্নহীন সমর্থন আর আনুগত্যের অভাব বুঝলেই মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে হিংসা, বলপ্রয়োগ, দাঙ্গা , ফিনকি দিয়ে ওঠে রক্ত , নির্বিচারে কেড়ে নেওয়া হয় প্রাণ। এ যেন রাজনৈতিক নেতাদের স্বতঃসিদ্ধ অধিকার, আচরণের তলায় তলায় ভাবটা একেবারেই পরিষ্কার— সাধারণ মানুষ তো কিছু মরবেই, ওরা তো গণতন্ত্রের এই মহোৎসবে বলিপ্রদত্ত তাই ওদের মরাবাঁচা নিয়ে অতশত ভাবার কিছু নেই!
বছরের পর বছর এক জিনিস দেখতে দেখতে মানুষেরও যেন ব্যাপারটা গা সওয়া হয়ে গেছে। ভোট এলেই মানুষ মরবে, এটাকেই জনগণ তাদের ভবিতব্য বলে মেনে নিয়েছে। কিন্তু কেন? কথায় কথায় যাদের প্রসঙ্গ তুলে আমাদের দেশের নেতা মন্ত্রীরা লিঙ্কন থেকে ধার করে যে দিব্যি আউড়ে চলেন, আমাদের এই গভর্নমেন্ট নাকি ‘অফ দ্য পিপল, বাই দ্য পিপল, ফর দ্য পিপল’ তাদের এমন দশা হবে কেন? যাদের দয়া দাক্ষিণ্যেই পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্রের এত নামডাক, বিশ্বের দরবারে কলার উঁচিয়ে মাস্ল ফুলিয়ে বেড়ানো, তাদের প্রতি বছরের পর বছর ধরে এই প্রবঞ্চনা কেন? কবি বলে গেছেন “প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও তো জানা” কিন্তু আমাদের জানা নেই, চোখে মুখে সবজান্তা ভাব নিয়ে ঘুরলেও সত্যিই জানা নেই !
কিছুই যখন করার নেই তখন মাধ্যমিকের ছাত্রছাত্রীদের মতো আসুন আর একবার ভয়েস চেঞ্জটা প্র্যাকটিস করা যাক। অ্যাক্টিভ থেকে প্যাসিভ ভয়েসে পরিবর্তন তো অনেক হল, এবার আসুন প্যাসিভ ভয়েস থেকে অ্যাক্টিভ ভয়েস প্র্যাকটিশ করি “what can not be cured must be endured”। যাই হোক, আপাতত জরুরি কথা হল এই যে, আমাদের এই কুখ্যাত রাজ্যে কয়েক দফায় মৃত্যুর হার দেখে নির্বাচন কমিশন তো যারপরনাই খুশি। সাত ফেজ শেষ করে মৃত্যুর সংখ্যা দশের নীচে রাখতে পারলেই তাদের কাছে সেটা হবে যেন হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো বিরাট অ্যাচিভমেন্ট। বড় মুখ করে তারা বলতে পারবে এবারের বিধানসভা ভোট ছিল অবাধ ও শান্তিপূর্ণ, ব্যস তারা দায়মুক্ত।
কিন্তু সবাই তো মনে মনে জানে এগুলো আসলে কিছুই প্রমাণ করে না। বাস্তবে তো আমরা এক প্রকাণ্ড আগ্নেয়গিরির উপর বসে রয়েছি। এখনও পর্যন্ত সব শান্ত, সবকিছু আন্ডার কন্ট্রোল, কিন্তু যে কোনও মুহূর্তে এই পাহাড় প্রমাণ আত্মতৃপ্তিতে ফাটল দেখা দিতে পারে । কখন যে ফাটল বরাবর ধোঁয়া দেখা দেবে আর দেখতে দেখতে চোখের নিমেষে বিস্ফোরণ, প্রবল অগ্নুৎপাত ঘটবে, কে বলতে পারে? তারপর কী হবে দেখার জন্য আমাদের মধ্যে কারা কারা অবশিষ্ট থাকব কে জানে? যারাই থাকুক তাদের মধ্যে ‘ক্ষুধিত পাষাণ” এর সেই পাগল মেহের আলি নিশ্চয় থাকবেন আর অভ্যাস মতো চিৎকার করে বলে বেড়াবেন “তফাত যাও, তফাত যাও। সব ঝুট হ্যায়, সব ঝুট হ্যায়!”
এ যুগের অন্যতম কথাকার তমাল বন্দ্যোপাধ্যায়র জন্ম ১৯৭৮ সালে, কৃষ্ণনগরে। ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতকোত্তর, পেশা শিক্ষকতা। নিয়মিত গল্প-উপন্যাস লেখেন দেশ, আনন্দবাজার পত্রিকা, সানন্দা, আনন্দমেলা-সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। উল্লেখযোগ্য উপন্যাস - উত্তরপুরুষ, মর্মমেঘ, ভ্রান্তিডানা, ব্রাহ্মণী ইত্যাদি। ২০১১ সালে পেয়েছেন বর্ণপরিচয় সাহিত্য সম্মান, দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত 'মায়াকাচ' উপন্যাসের জন্য। ২০১৬-তে নতুন কৃত্তিবাস পুরস্কার ও ২০১৭-তে বাংলা অকাদেমি পুরস্কারে সম্মানিত।
2 Responses
অসাধরন বিশ্লেষণ
Exact analysis and very nicely described. Nothing to congratulate Tamal once more. All his writings deserve heartfelt congrats. just one question I have regarding today’s topic, whether only people of specific group become prey of election violence? As it is seen very often, literate persons also form unreasonable crowd and endangered themselves being part of violence. whether they have no responsibility to be safe and secured as their own ? only the leaders are making them danced ? If general people would have been boycotted such rally, meeting, miking etc , none could be able to make them murgi. some join being threatened, some for money and others just for fun. I think to most of the people, one kind of meaningless energy and enchantment works during election which feelings drag them sometimes upto violence and even death.
I am not talking about them who are being forced to join. It is about them who are so called educated but still don’t know how to maintain democratic right without being a part or victim of violence. This mob create violence and also become victimized. Leaders only take the opportunity of hour.