রান্নায় স্বাদ আনতে কী লাগে? একবাক্যে সকলে উত্তর দেবেন, মশলা। সে হলুদ, জিরে, ধনে, তেজপাতার মতো রোজকার আটপৌরে মশলাই হোক কিংবা সুগন্ধী জায়ফল, জয়ীত্রি কিংবা এলাচ, লবঙ্গ, দারচিনি! মশলা ছাড়া রান্নায় না আসবে স্বাদ না সুগন্ধ। তাই বাঙালি গিন্নির রান্নাঘরের তাকে এইগুলো খুঁজে পাওয়া খুব একটা দুঃসাধ্য কাজ নয়। আর শুধুই কি স্বাদ? খাবারের পুষ্টির নিরিখেও মশলার গুরুত্ব অপরিসীম।
এখন একটা প্রশ্ন অনিবার্যভাবেই উঠতে পারে। স্বাস্থ্যসম্মত খাবার বলতেই সাধারণত আমরা বুঝি, তাতে তেল-মশলার পরিমাণ কম রাখতে হবে যথাসাধ্য। তাহলে মশলার গুণাগুণ নিয়ে এত কথা বলার মানে কী? মানে একটাই, সমস্ত মশলাই যে একসঙ্গে একই রান্নায় ব্যবহার করতে হবে, প্রথমত তার কোনও মানে নেই। দ্বিতীয়ত, রান্না ছাড়াও এই মশলাগুলি ব্যবহার করা যায় এবং তাতে অসীম উপকারও পাওয়া যেতে পারে।
এক এক মশলার এক এক গুণ। এবং তাদের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হল, শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে তোলা। আজকের এই কোভিডকালে ইমিউনিটি বাড়াবার বড়ি খুঁজতে হন্যে হয়ে এ দোকান সে দোকান না-ঘুরে সোজা রান্নাঘরের তাকের দিকে চাইলেই পেয়ে যাবেন মোক্ষম সমাধান!
এমনই কিছু রোজকার ব্যবহার্য মশলার কথা জানাচ্ছি আমরা।
১. জিরে – বাঙালির ঘরে মাছের ঝোল ভাত হল স্টেপল ফুড। আর সেই মাছের ঝোলে জিরের অমোঘ ফোড়নটি না পড়লে আক্ষরিক অর্থেই বাঙালির ভাত হজম হবে না। হলুদ, কাঁচালঙ্কা আর দিয়ে ফোড়ন দিয়ে জ্যান্ত মাছের পাতলা ঝোল বাঙালির অন্যতম কমফর্ট ফুড এমনকী পেটের রোগের পথ্যিও বটে।
আদতে মিশর এবং অন্যান্য ভূমধ্যসাগরীয় এলাকা থেকে আগত হলেও এখন জিরে উৎপাদিত হয় ভারতেই। ভারতীয় আয়ুর্বেদজ্ঞ পণ্ডিতেরা তো সেই কবেই বলে গেছেন জিরের অ্যান্টিব্যাকটিরিয়াল ক্ষমতার কথা। শরীরের তিনটি প্রধান দশা- পিত্ত, বায়ু ও কফ, সবেতেই জিরের প্রয়োগ অব্যর্থ। হজমেও সাহায্য করে জিরে।

জিরেতে রয়েছে প্রচুর আয়রন। রোজ সকালে গোটা জিরে (বা শুকনো গুঁড়ো করা জিরে) ভেজানো এক গেলাস জল আপনার শরীর ডিটক্স করার মোক্ষম দাওয়াই। জিরের আয়রন শক্তির মাত্রা বজায় রাখে, শরীরে রক্ত চলালচল বাড়িয়ে সেলুলার স্তরে অক্সিজেনের পরিমাণ বাড়ায়। ফলে আপনি সারাদিন ঝরঝরে থাকবেন। উপরন্তু জিরে ফ্যাট কাটার হিসেবেও খুবই কাজের। যাঁরা দ্রুত ওজন কমানোর চেষ্টা করছেন, তাঁদের জন্য জিরে ভেজানো জল অব্যর্থ। এছাড়াও জিরে কিডনি আর লিভারের জন্য খুব ভাল। জিরেতে ম্যাগনেশিয়াম, ক্যালশিয়ামের মতো নানা খনিজ পদার্থ রয়েছে। রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ফলে শরীরের যে কোনও প্রদাহ কমাতে, মানসিক চাপ কমাতে, ভাল ঘুমের জন্যে জিরের ব্যবহার অত্যাবশ্যক।
জিরের সঙ্গী ধনে এবং মৌরিও জিরের মতোই উপকারী। ধনেতে রয়েছে পটাশিয়াম, আয়রন, ভিটামিন এ, কে, ফলিক অ্যাসিড ও প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। জিরের মতো ধনেও হজমের গোলমালে অত্যন্ত উপকারী। ধনে শরীরের খারাপ কোলেস্টোরোল কমিয়ে ভাল কোলেস্টোরল বাড়াতে সাহায্য করে। মৌরিবাটা দিয়ে কইমাছের ঝোল বাঙালির প্রিয় ডেলিকেসি। মৌরির সুগন্ধে তাকে বহুযুগ ধরে মুখশুদ্ধি বা মাউথ ফ্রেশনার হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন ভারতীয়রা। মৌরিতেও আছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। এবং শরীরকে ডিটক্সিফাই করতে, হজমশক্তি বাড়াতে মৌরির জুড়ি নেই।

২. গোলমরিচ – গোলমরিচের মতো উপকারী মশলা খুব কম আছে। গোলমরিচের প্রধান উপাদান, যার বৈজ্ঞানিক নাম পিপারিন, তাতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট। ফলে নিয়মিত গোলমরিচের ব্যবহারে অনেক ক্রনিক রোগ থেকে উদ্ধার পাওয়া যায়। সে ইউরিক অ্যাসিডের সমস্যাই হোক বা হৃদরোগ, দাঁত ব্যথাই হোক বা সর্দিকাশি, পিপারিনের প্রভাবে গোলমরিচ এই সমস্ত রোগেই কাজ দেয়। আর রান্নায় গোলমরিচের ব্যবহার কোনও বাঙালিকেই নতুন করে বলার নেই। শুধু বাঙালিই বা কেন? যে কোনও ভারতীয় তথা দক্ষিণ এশীয় রান্নায় গোলমরিচের ব্যবহার থাকবেই।
৩. দারচিনি – রান্নায় দারচিনির ব্যবহার বহুল প্রচলিত। গরম-মশলার অন্যতম একটি উপাদান দারচিনি। অনেকে চায়ে ফুটিয়েও খান। তবে প্রাচীনকাল থেকেই এর আরও একটি পরিচয় ওষধি হিসেবে। প্রদাহ-রোধকারী এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টে পরিপূর্ণ দারচিনির মধ্যে রয়েছে সিনামালডিহাইড নামে একটি অত্যাবশ্যকীয় তেল যা ভাইরাল, ব্যাকটিরিয়াল ও ফাংগাল ইনফেকশন প্রতিরোধ করার ক্ষমতা রাখে।
এটি ডায়াফোরেটিক, ডাইউরেটিক এবং কারমিনেটিভ হিসেবে পরিচিত। অরুচি হলে মুখে স্বাদ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রেও উপযোগী। হজমশক্তি বাড়ায় দারচিনি। এর বাইরের আস্তরণ শরীরের ফ্যাট সেল ভাঙতে সাহায্য করে। তাই হাই ক্যালোরি খাবার খেলে হাতের কাছে রাখুন দারচিনিগুঁড়ো। পলিসিস্টিক ওভারিয়ান সিনড্রোমের রোগীরাও দারচিনি ব্যবহারে উপকার পেতে পারেন।
৪. লবঙ্গ ও এলাচ – গলা ব্যথা হলে ছোট্ট কৌটোর থেকে বের করে এক কুচি লবঙ্গ মুখে রাখার চল মা দিদিমার আমল থেকে চলে আসছে। ফলে শুধু গরম মশলার এক সুগন্ধী উপাদান হিসেবে নয়, লবঙ্গের অন্যতম কার্যকারিতা ব্যথা উপশমকারী এবং প্রদাহ নিরোধক হিসেবে। দাঁত ব্যথায় লবঙ্গ তেলের উপকারিতার কথা জানেন না, এমন মানুষ হাতে গোণা যাবে। খুব কার্যকরী অ্যান্টিবায়োটিক এবং অ্যান্টিসেপটিক হিসেবে কাজ করে লবঙ্গের তেল।

ঠান্ডা লাগার ধাত থাকলে বা গলা খুসখুস করলে আদা ও লবঙ্গ ফুটিয়ে চা বানিয়ে খেলে ম্যাজিকের মতো কাজ হবে! আর সঙ্গে যদি মেশাতে পারেন কয়েকফোঁটা পাতিলেবুর রস, তাহলে তো আর কথাই নেই। এছাড়া মাথাভার, বমিভাব কমাতে চাইলেও জল বা চায়ে ফুটিয়ে খেতে পারেন লবঙ্গ। প্যারাসাইটিক ইনফেকশনের উপশমেও এটি খুব ভাল কাজ করে। এতে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন কে, ফাইবার, আয়রন, ম্যাগনেশিয়াম ও ক্যালশিয়াম।
চা হোক বা পিঠে পায়েস, এলাচের মিষ্টি সুঘ্রাণ ব্যতীত কোনওটাই ভাবা যায় না। এলাচ হজমে সহায়ক বা কারমিনেটিভ, যেজন্য মুখশুদ্ধির মশলাতে, পানের মশলায় এলাচ দেওয়া হয়। মোচড় দিয়ে পেট ব্যথা, বা গা বমিভাব, গ্যাসের সমস্যা কমাতেও ছোট এলাচ কাজে দেয়৷ এছাড়াও এলাচ ওজন কমাতে সাহায্য করে৷
৫. মেথি-সরষে-হলুদ – রোজকার আটপৌরে মশলার কৌটোতে এদের স্থান হলেও ভেষজ ওষধি হিসেবেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই ত্রয়ী। মেথিও কারমিনেটিভ হিসেবে খুব ভাল কাজ দেয়। সারারাত মেথি জলে ভিজিয়ে সকালে সেই জল খেলে পেটের রোগ দূর হয় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। কিডনির অসুখ, ভিটামিনের ঘাটতি, মুখের আলসার, ফোঁড়া, ব্রংকাইটিস, চামড়ার নিচে কোষের ক্ষত (সেলুলাইটিস), যক্ষ্মা, দীর্ঘস্থায়ী কাশি, চুল পড়া থেকে শুরু করে বেরিবেরি, ক্যান্সারের মতো মারণ রোগের উপশম হিসেবেও মেথির ব্যবহার বহুল প্রচলিত। আর মেথির পরোটা যে অতি উপাদেয় তা উত্তর ভারতীয় রেস্তোরাঁর দৌলতে বাঙালির আর জানতে বাকি নেই!

প্রাচীন আয়ুর্বেদশাস্ত্র রাইসরষের একাধিক ভেষজ গুণের উল্লেখ মেলে। কৃমি, শ্বেতী, ব্রণ, অরুচি প্রভৃতি নানা প্রকার অসুখের উপশমে সরষের ব্যবহার করা হত। এ ছাড়া ব্যথা কমাতেও রাইসরষে বেটে লাগালে উপকার পাওয়া যায়।
বিয়ের কনেকে হলুদ মাখানোর রীতি থেকেই স্পষ্ট যে ত্বকের জেল্লা বাড়াতে আর তাকে মসৃণ করে তুলতে হলুদের জুড়ি নেই। শারীরিক সক্ষমতা বাড়াতে হলুদ মেশানো দুধ খাওয়ার রীতিও রয়েছে ভারতে। কোভিডের সময়েও অনেকে বলছেন হলদি-দুধে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অনেকটা বাড়ে। আর ঝালে ঝোলে অম্বলে হলুদ না দিলে তো রান্নাই হবে না এদেশের হেঁশেলে। আর পুষ্টিগুণের কথাই যদি ধরেন, তাহলে তো বলে শেষ করা যাবে না। হলুদে রয়েছে প্রোটিন, ডায়েটারি ফাইবার, নিয়াসিন, ভিটামিন সি ও কে, পটাসিয়াম, ক্যালসিয়াম, আয়রনের মতো খনিজপদার্থ। আর্থ্রাইটিসের ব্যথাতেও হলুদ খুব কার্যকরী।
তবে এখানেই কি মশলার ভাঁড়ার শেষ? মোটেই নয়। বাংলা তথা ভারতীয় মশলার ভাণ্ডারে উপাদানের কোনও অভাব নেই। আর তেমনই বিচিত্র তাদের গুণাবলি। হিং থেকে শুরু করে জয়িত্রী, জায়ফল সকলেরই নাম রয়েছে এই তালিকায়। ফলে মশলা যে খালি রান্নারই শোভা আর স্বাদবর্ধন করবে, তা নয়। শরীর সুস্থ রাখতে আজই ডায়েটে যোগ করুন মশলাপাতি!
*তথ্যসূত্র: Indiatimes, NDTV, আনন্দবাজার পত্রিকা, Readers Digest
*ছবি সৌজন্য: Amazon, gyanherbal, readersdigest
মৌলিক‚ ভিন্নধর্মী ও সময়োপযোগী - এমনই নানা স্বাদের নিবন্ধ পরিবেশনের চেষ্টায় আমরা। প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | নিয়মিত আপডেট পেতে ফলো করুন - https://www.facebook.com/banglaliveofficial