Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বাজুবন্দ খুলে খুলে যায়… ওগো মোর গীতিময়!

সংগ্রামী লাহিড়ী

অক্টোবর ২৯, ২০২১

Sandhya Mukhopadhyay
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close
[বিখ্যাত বাংলা ঠুংরি ‘বাজুবন্দ খুলে খুলে যায়’, যা আসলে ভৈরবী ঠুংরি ‘বাজুবন্দ খুল খুল যায়’-এর বাংলা রূপ, গাইলেন সংগ্রামী লাহিড়ী]

ঠক ঠক ঠক। সদর দরজায় কে যেন ঘনঘন কড়া নাড়ছে। সাড়া দিতে না দিতেই আবার শব্দ। এবার আরও জোরে। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ জ্ঞানেন্দ্রনাথ দাশগুপ্ত দরজা খুলে দেখলেন দাঁড়িয়ে আছেন বন্ধুবর ডাক্তার বিশ্বনাথ মণ্ডল। কলকাতা কর্পোরেশনের কাউন্সিলর। দৃশ্যতই খুব উত্তেজিত। হাঁফাচ্ছেন। বন্ধুকে প্রায় ঠেলেই ঢুকে এলেন ভেতরে।
– বুঝলে, আজ একটা ব্যাপার হয়েছে।
– আরে বোসো, বোসো। এত উত্তেজনা কীসের? তোমার তৈরি সেই মাথা ঠান্ডা করার তেলটা নিয়ে আসব নাকি? মাখবে একটু?
জ্ঞানেন্দ্রনাথ উত্তেজিত বন্ধুকে শান্ত করার চেষ্টা করেন। 

দেশের ও দশের উপকার করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ডাক্তার সম্প্রতি বানিয়েছেন এক অভিনব মাথা ঠান্ডা রাখার তেল। সেই তেল মেখে জ্ঞানেন্দ্রনাথের বাড়ির সবার ঠান্ডা লেগে সর্দি হয়ে গিয়েছে। তারা বিদ্রোহ করেছে, কেউই আর তেল মাখতে রাজি নয়। এই সুযোগে যদি তেলের বোতলটা বন্ধুবরকে ফেরত দেওয়া যায়!
– না না, ওসব তেল টেল পরে হবে। বিশ্বনাথ অধৈর্য।
– উফ, কী শুনে এলাম! এমন গলা আগে আর শুনিনি!
জ্ঞানেন্দ্রনাথ আন্দাজ করলেন ডাক্তার নিশ্চয়ই কোনও গানের আসর থেকে আসছেন। বিশ্বনাথ গানপাগল। বিশেষ করে ক্ল্যাসিক্যাল গানের আসর পারতপক্ষে বাদ দেন না। ডাক্তারির থেকেও গানের নেশাই বেশি। ডাক্তার বলে চললেন,
– বুঝলে, আজ যে আসরে গিয়েছিলাম, সেখানে স্টেজে উঠল একটা বাচ্চা মেয়ে। নতুন মুখ। কালোমতো,  রোগা, অতি সাধারণ চেহারা, দুই বিনুনি বাঁধা। শাড়ির আঁচলখানা গায়ে জড়িয়ে স্টেজে বসল। আমি ভাবলাম, এ আবার কী ক্ল্যাসিক্যাল গাইবে? চেহারা দেখে গাইয়ে বলে মনেই হয় না!

Geetasri Sandhya
উস্তাদ বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের কাছে নাড়া বেঁধেছিলেন সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

– আহা, চেহারার সঙ্গে গানের কী সম্পর্ক? জ্ঞানেন্দ্রনাথ ফোড়ন কাটেন।
– একদম ঠিক বলেছ! ডাক্তার সোজা হয়ে বসলেন।
– কী বোকাই যে বনে গেলাম আজ! তানপুরা মিলিয়ে নিয়ে মেয়েটা সুর ছাড়ল। সেই ভয়েস থ্রো শুনে তো আমি মোহিত! নিখুঁত, গোল আওয়াজ। যেমন মিষ্টি গলা, তেমনই টোনাল কোয়ালিটি। এমনটি আমি আগে আর শুনিনি।
– বটে? জ্ঞানেন্দ্রনাথ উৎসুক হলেন,
– নাম কী মেয়েটির?
– সন্ধ্যা। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। শুনলাম বড়ে গোলাম আলি খান সাহেবের ছাত্রী। উফ, ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠ আর সুর। তার সঙ্গে সূক্ষ্ম কাজ! এ মেয়ে অনেকদূর যাবে, এই বলে দিলাম তোমায়।
ডাক্তার মোহাবিষ্ট, গানের সম্মোহন থেকে বেরোতে পারছেন না যেন।

এ কাহিনি পঞ্চাশের দশকের। তখন সদ্য স্বাধীন হয়েছে দেশ। সেখান থেকে কাট করে চলে আসি আজকের দিনে, নতুন মিলেনিয়ামে। প্রবীণ গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে সম্প্রতি এক ইন্টারভিউতে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, তাঁর কোনও অপূর্ণ ইচ্ছা আছে কিনা। বাংলা গানের ‘প্রাইমা ডোনা’ একটুও না ভেবে জানিয়েছিলেন, উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের আরও কিছু লং প্লেয়িং ডিস্ক করার স্বপ্ন দেখেছিলেন। হয়নি। এটুকু অপ্রাপ্তি রয়ে গেছে অনেক পাওয়ার মাঝে। 

তাঁর বলা কথাটির পটভূমিকা বুঝতে গেলে আবার পিছিয়ে যেতে হবে সেই চল্লিশ আর পঞ্চাশের দশকে, যখন ডাক্তার বিশ্বনাথ মণ্ডল সন্ধ্যার গান প্রথম শুনেছিলেন, যখন গানের এক রূপকথার কাহিনি লেখা হচ্ছিল একটু একটু করে। যাত্রা তখন সবে শুরু হয়েছে। কালো, রোগা মেয়েটির রক্তেই সংগীতের উত্তরাধিকার। মেয়েটি বাবার কাছে শুনেছে, তাদের মুখোপাধ্যায় বংশের আদি পুরুষ রামগতি মুখোপাধ্যায়ের কথা। বিরাট মাপের গাইয়ে ছিলেন তিনি। পুত্র সারদাপ্রসাদও বাবার পথেই হেঁটেছেন। উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের চর্চা ছিল তাঁর। সারদাপ্রসাদের নাতি নরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়েরও সুন্দর গানের গলা। খুব ভালো ভক্তিমূলক গান গাইতেন। হেমপ্রভা দেবীর সঙ্গে বিয়ে হল তাঁর। 

১৯৩১ সালের আশ্বিন মাসে প্রকৃতি সেজেছে শরৎরানির সাজে। শ্যামল ঘাসে শিশিরবিন্দু, পুজোর আনন্দ ঝরে পড়ছে সাদা শিউলি ফুলের সঙ্গে। উৎসবের মাঝে নরেন্দ্রনাথ ও হেমপ্রভা দেবীর কোলে এল তাঁদের ষষ্ঠ সন্তানটি। আদর করে নাম দেওয়া হল সন্ধ্যা, যে নাম একদিন গানের জগতে প্রবাদ হয়ে যাবে।  হেমপ্রভা দেবী ভালো টপ্পা গাইতেন। সূক্ষ্ম কারুকাজ অনায়াসে খেলে যেত গলায়। ছোট্ট সন্ধ্যা বসে বসে শোনে। শুনে শুনেই গলায় তুলে নেয় গান।

এমন বাড়ির মেয়ে যে গানই গাইবে, সে আর বেশি কথা কী? দাদা দিদিদের প্রশ্রয়ে আর উৎসাহে সেই ছোট্টবেলাতেই গল্পদাদুর আসরে গান গাওয়া হল। গান গেয়ে পারিশ্রমিক মিলল পাঁচ টাকা। বালিকা সন্ধ্যার আনন্দ আর ধরে না। চোদ্দো বছর বয়েস হবার আগেই এইচএমভি থেকে বেরলো রেকর্ড। সারা বাংলা মুগ্ধ তার মিষ্টি গলার আওয়াজে। ছায়াছবিতে গানের সুযোগ আসতেও দেরি হল না। নিউ থিয়েটার্সের ব্যানারের সিনেমায় প্রথম প্লে-ব্যাক। সঙ্গীত পরিচালক রবীন চট্টোপাধ্যায় সন্ধ্যাকে গাওয়ালেন ‘সমাপিকা’ ছবিতে। প্রখ্যাত সুরকার রাইচাঁদ বড়াল ডাক পাঠালেন তাঁর সুরে ‘অঞ্জনগড়’ ছবিতে গাইবার জন্যে। সে ছবি বাংলা ও হিন্দি দু’টো ভাষাতেই তৈরি হয়েছিল। সন্ধ্যাও বাংলা আর হিন্দি- দুই ভাষাতেই গাইলেন। 

\সেই শুরু। তারপর আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। ‘অগ্নিপরীক্ষা’ ছবিতে সন্ধ্যার গলায় গাওয়া গানগুলিতে পর্দায় লিপ দিলেন সুচিত্রা সেন। অনুপম ঘটকের সুরে ‘গানে মোর কোন ইন্দ্রধনু’ কালের সীমানা পেরিয়ে কিংবদন্তী হয়ে গেল। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ও সুচিত্রা সেন- এক ঐতিহাসিক জুটির জন্ম হল। সুচিত্রাকে নায়িকা করে একের পর এক সুপারহিট সিনেমা, প্লেব্যাকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়। মুখচ্ছবি আর গান মিলেমিশে একাকার। এতটাই, যে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান শুনলে মনে ভেসে ওঠে সুচিত্রা সেনের মুখ। অতি অল্প বয়েসেই হয়ে উঠলেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী গায়িকা।  

Sandhya Mukhopadhyay Classical singer
লঘু সংগীতের রানি বলে যিনি পরিচিত, সেই তিনিই খাঁটি শাস্ত্রীয় সংগীতেও কুশলী

বলতে ভুলেছি, মাত্র বারো বছর বয়েসেই তিনি অল বেঙ্গল মিউজিক কনফারেন্স আয়োজিত সঙ্গীত প্রতিযোগিতায় ভজনে প্রথম হন। পনেরোয় পা দিতে না দিতেই ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষার প্রথম পুরস্কারটি তাঁর ঝুলিতে। সন্ধ্যা তখন সবরকমের বাংলা গান গাইছেন। লোকসংগীত, কীর্তন, ভজন যেমন আছে, তেমনই সমান দক্ষতায় গাইছেন রবীন্দ্রসঙ্গীত আর নজরুলগীতি। এই পর্যন্ত বলে একটু থামা যাক, একটু ফিরে দেখা যাক। বাংলা আধুনিক গানের রানি তিনি, চলচ্চিত্রের প্লে-ব্যাক গানের সোনার মুকুটখানি তাঁরই মাথায়। এ তো সবারই জানা। কিন্তু এইটুকু পরিধিতেই কি তাঁকে সবটা ধরা যায়? যায় না। কেন, সেকথাই বলি। 

আমার বেড়ে ওঠা সত্তর ও আশির দশকে। শাস্ত্রীয় সংগীতের শিক্ষার্থী হিসেবে আমার সাঙ্গীতিক বোধ, চেতনা ও শ্রবণ লালিতপালিত হয়েছে প্রধানত অল ইন্ডিয়া রেডিও, অর্থাৎ আকাশবাণীর প্রশ্রয়ে। আকাশবাণী থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক পত্রিকা ‘বেতার জগৎ’ ছিল আকর্ষণের কেন্দ্রে। কারণ আগামী দু’সপ্তাহের পুরো প্রোগ্রাম লাইনআপ সে পত্রিকায় দেওয়া থাকত। কলকাতা ‘ক’ চ্যানেলে সকাল সাড়ে আটটা, রাত ন’টা উচ্চাঙ্গসংগীতের প্রাইম স্লট। সেই স্লটে প্রায়ই থাকে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নাম। তিনি আকাশবাণীর উচ্চাঙ্গসংগীতের সর্বোচ্চ গ্রেডে। নামটি দেখামাত্রই অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা, কখন তাঁর মধুক্ষরা কণ্ঠে শুনব খেয়াল, ঠুংরি। তিনসপ্তক জোড়া গলার রেঞ্জ, সুর তাতে পাকাপোক্ত আসন নিয়েছে, কখনওই একচুলও নড়ে না। সেই ঈশ্বরী কণ্ঠে তিনি শুরু করবেন আলাপ। একে একে আসবে প্রথা মেনে রাগ বিস্তার, সরগম, তানের ফুলঝুরি। গায়কির সবরকম কলাকৌশল দেখাবেন তিনি, গানের মাধুর্য কিন্তু কোনও অবস্থাতেই একতিলও ক্ষুণ্ণ হবে  না। শেষে গাইবেন একটি শ্রবণমনোহর ঠুংরি। মাতিয়ে দিয়ে যাবেন, ভাসিয়ে নেবেন আপামর শ্রোতাকে।

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় শাস্ত্রীয় সংগীতের প্রতিষ্ঠিত শিল্পী। সত্যি বলতে কি, একমাত্র শিল্পী, যিনি লঘুসঙ্গীত, অর্থাৎ বাংলা আধুনিক গান এবং পাতিয়ালা ঘরানার খেয়াল-ঠুংরি-হোরি-দাদরা দুই ধারাতেই সমান দক্ষ, সমান স্বচ্ছন্দ। মুখোপাধ্যায় বাড়ির সাঙ্গীতিক ঐতিহ্য মেনে ছোট্ট সন্ধ্যা বরাবরই শিখেছেন ক্লাসিক্যাল গান। প্রেরণা দিতেন বড় দাদা-দিদিরা। বিশেষ করে বড়দা রবীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের নামটি আসে সবার আগে। শিল্পী নিজেই বলেছেন, “আমার বড়দা আমার গানের সবথেকে বড় সমালোচক ছিলেন।” সেই বড়দার অভিভাবকত্বের ছায়ায় বিভিন্ন গুরুর কাছে উচ্চাঙ্গসংগীতের শিক্ষা চলছিল। গুরু যামিনী গঙ্গোপাধ্যায় টানা ছয় বছর হাতে ধরে শিখিয়েছেন, সুখেন্দু গোস্বামীর কাছে ‘গীতশ্রী’ পরীক্ষার আগে গানের ক্লাস করেছেন। চিন্ময় লাহিড়ীও কিছুদিন তালিম দিয়েছেন। 

কিশোরী সন্ধ্যা কিন্তু মুগ্ধ পাতিয়ালা ঘরানার গায়কিতে। রেকর্ডে শুনেছেন বড়ে গোলাম আলির মাখনের মতো মোলায়েম গলার ঠুংরি, খেয়াল, বিদ্যুতের মতো তান। খুব ইচ্ছে খাঁ সাহেবের কাছে তালিম নেন। খাঁ সাহেব মাঝে মাঝেই কলকাতায় আসেন। ওঠেন কলকাতার প্রসিদ্ধ সংগীতজ্ঞ জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষের ডিকসন লেনের বাড়িতে। ছাত্রছাত্রীদের তালিমও দেন। মীরা বন্দ্যোপাধ্যায় (তখন চট্টোপাধ্যায়) ইতিমধ্যেই তাঁর শিষ্যা হয়েছেন। সন্ধ্যা বড়দাকে বললেন সে ইচ্ছের কথা। সময় নষ্ট না করে রবীন্দ্রনাথ হাজির হলেন জ্ঞানবাবুর বাড়ি। খাঁ সাহেব রাজি হয়ে গেলেন শেখাতে। সন্ধ্যার আনন্দ আর ধরে না। 

আনুষ্ঠানিকভাবে গান্ডা বেঁধে সন্ধ্যা খাঁ সাহেবের শিষ্যা হবেন। ১৯৪৯ সালের এক শীতের সকালে সমস্ত উপচার সাজিয়ে নিয়ে হাজির হলেন ডিকসন লেনের বাড়িতে। বিরাট এক গোল ট্রেতে নানাবিধ উপকরণ। তার মধ্যে থেকে মোটা লালসুতো তুলে নিয়ে খাঁ সাহেব বেঁধে দিলেন সন্ধ্যার হাতে। মুখে দিলেন একটু ছোলা আর গুড়। গান্ডা বাঁধা হল। গুরু-শিষ্যা বাঁধা পড়লেন এক সংগীতময় বন্ধনে, যে বন্ধন পরবর্তীকালে অজস্র সোনা ফলাবে। পিতৃপ্রতিম গুরুকে শিষ্যা এখন থেকে ‘বাবা’ বলেই ডাকবেন, আর গুরুপত্নীকে ‘মা’। তাঁরাও দুজনে সন্তানস্নেহে ঘিরে নিলেন প্রতিভাময়ী নবীন শিক্ষার্থীটিকে। 

Ustad Bade Gulam Ali Khan and Sandhya
উস্তাদ বড়ে গোলাম আলির সঙ্গে গীতশ্রী সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়

বাবা এবার গান গাইতে বললেন। সন্ধ্যা নার্ভাস। এত বড় ওস্তাদের সামনে তিনি কী করে গাইবেন? ভরসা যোগালেন জ্ঞানপ্রকাশ, অভয় দিলেন গুরু স্বয়ং। সন্ধ্যা ধরলেন জৌনপুরী রাগ। কিছুক্ষণ শোনার পর গুরু সেটিই শেখাতে লাগলেন। শুরু হল লম্বা, কঠিন পথ। কঠিন কেন? সন্ধ্যা ততদিনে বিভিন্ন গুরুর কাছে তালিম পেয়ে এসেছেন, বিভিন্ন গায়কিতে, বিভিন্ন আঙ্গিকে। পাতিয়ালা ঘরানার গানের চরিত্র, রস, স্বরক্ষেপণ ঠিকঠাক আয়ত্তে আনতে তাঁর অনেক সময় লেগেছিল। গুরু তা বুঝেছিলেন। তাই শিষ্যাকে সস্নেহে বললেন, “যত পারো শোনো। শুনে শুনে তবেই তো কান তৈরি হবে। এক ভাগ সিখনা তো তিন ভাগ সুননা।”

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে আছে সে সব দিন। সকাল সাড়ে-দশটা এগারোটা নাগাদ গিয়ে উপস্থিত হতেন বাবার কাছে। তারপর শুধু গান আর গান। রাত আটটা নটা পর্যন্ত চলে শিক্ষা, রেওয়াজ। দুপুরের খাওয়া গুরুর আতিথ্যে। মীরাও আসতেন একই সময়। পরবর্তীকালের প্রখ্যাত উচ্চাঙ্গসংগীতের শিল্পী মীরা ও সন্ধ্যা হলেন সতীর্থ। বাবা বসেন সুরমণ্ডলটি নিয়ে। পায়ের কাছে মীরা ও সন্ধ্যা। গেয়ে গেয়ে শেখান দুই ছাত্রীকে। ছাত্রীদু’টি অতি উৎসাহী। গুরু গলা থেকে কিছু বার করলেই হল, সঙ্গে সঙ্গে নিজেরা সেটি গাইতে শুরু করে দেবে। ব্যাপারস্যাপার দেখে গুরু সস্নেহে বললেন, “ওরে তোরা আগে শোন ভালো করে, তারপর তো নিজেরা গাইবি! ইয়ে দো বিল্লিয়াঁ বৈঠি হ্যায়, হাম আ করনেসে হি খা জায়েগি!”  

আমার গুরু সঙ্গীতাচার্য অমিয়রঞ্জন এমনই এক দিনে গিয়ে পড়েছিলেন ডিকসন লেনে। কী এক কাজ ছিল জ্ঞানবাবুর সঙ্গে। জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ বেরিয়ে এসে কথা বলছেন, হঠাৎ ভেতর থেকে ভেসে এল ঐশ্বরিক সুর। সঙ্গীতাচার্য চমকে উঠলেন। 
– খাঁ সাহেব না?
জ্ঞানবাবু ঘাড় নাড়লেন। হ্যাঁ, তিনিই। সঙ্গীতাচার্য ততক্ষণে সম্মোহিত। 
– একটু শুনতে পাওয়া যায় না? 
জ্ঞানবাবু বললেন, “আচ্ছা, চলুন।” নিয়ে গেলেন ভেতরে গানের ঘরে। খাঁ সাহেব বসে আছেন সুরমণ্ডলটি কোলে নিয়ে। দুপাশে দুই শিষ্যা- সন্ধ্যা ও মীরা। গুণকেলি রাগের তালিম চলছে। খাঁ সাহেব একটু একটু করে গাইছেন, দুই শিষ্যা মন দিয়ে শুনে সেগুলি গলায় তুলে নিচ্ছেন। সঙ্গীতাচার্য আর জ্ঞানপ্রকাশ বসে বসে শুনছেন।  

কিছুক্ষণ পর খাঁ সাহেব একটু বিরতি নিলেন। সুরমণ্ডলের ওপর আঙুলগুলি অলস চালে চলছে। হঠাৎই সবাইকে অবাক করে দিয়ে কোনো মুখড়া ছাড়াই আচমকা ধরে দিলেন, ‘আয়ে না বালম ক্যা করু সজনি…।’ সেই বিখ্যাত সিন্ধু ভৈরবীর ঠুংরি। ঘরের কয়েকটি মানুষের প্রত্যাশার শেষ সীমাটুকুও পেরিয়ে গেল। সংগীতের সাক্ষাৎ ঈশ্বর যেন নেমে এসেছেন সামনে। প্রিয় না আসার বেদনা গলে গলে পড়ছে সিন্ধু ভৈরবীর কোমল ঋষভের টানে, সম্মোহনের জাল বিছিয়ে দিচ্ছে। ক্ষণিকের বিভ্রমে যেন উঁকি দিয়ে যায় রাতজাগা দুটি ক্লান্ত চোখ – ‘তড়পত বিতি মোহে, উনবিনা রতিয়া…’ সঙ্গীতাচার্যের নিজের মুখে আমি শুনেছি এ অভিজ্ঞতার কথা। রোমাঞ্চিত হয়েছি।

Sandhya Mukhopadhyay Tanpura
নিয়মিত উচ্চাঙ্গসংগীতের রেওয়াজ সন্ধ্যার কণ্ঠে এনে দিয়েছিল সূক্ষ্ম কাজের জড়োয়া অলংকার

সংগীতের সেই ঈশ্বরের পায়ের কাছে বসে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় করলেন উচ্চাঙ্গসংগীতের সাধনা। এমনি সময়েই ডাক্তার বিশ্বনাথ মণ্ডল তাঁকে শাস্ত্রীয় সংগীতের এক আসরে প্রথম শোনেন। যে গল্প গোড়াতেই বলেছি। সেভাবে দেখতে গেলে শাস্ত্রীয় সংগীতের জগতে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের কাজটা অনেক বেশি শক্ত ছিল। তাঁর সমসাময়িক প্রসূন ও মীরা বন্দ্যোপাধ্যায়, জগদীশ প্রসাদ, মুনাব্বর আলি- এঁরা সবাই খাঁ সাহেবের কাছে খেয়াল-ঠুংরির তালিম নিয়েছেন, রেওয়াজ করেছেন এবং উচ্চাঙ্গসংগীতশিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। একমুখী, নিবিড় অনুশীলন, সাধনা। 

সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় যখন খাঁ সাহেবের কাছে তালিম নিচ্ছেন, ততদিনে তিনি লঘু সংগীত ও চলচ্চিত্রের প্লে-ব্যাক গায়িকা হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত। বেঙ্গল ফিল্ম জার্নালিস্ট অ্যাসোসিয়েশন BFJA পুরস্কার পেয়েছেন। নিয়মিত তাঁকে আধুনিক ও ফিল্মের গান রেকর্ড করতে হয়। সে গানগুলির চলন, স্বরক্ষেপণ, অনুভূতি, রসবোধ একেবারেই অন্যরকম। রবীন চট্টোপাধ্যায়, রাইচাঁদ বড়ালের মতো পথিকৃৎ সুরকার তাঁকে হাতে ধরে শিখিয়েছেন চলচ্চিত্রে গান গাওয়ার কৌশল। দুটো ভিন্ন ধারার শিক্ষা একই সঙ্গে আত্মস্থ করা সহজ নয়। এ যেন দু’হাতে সম্পূর্ণ আলাদা দুই গায়নশৈলী নিয়ে জাগলিং। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় ম্যাজিশিয়ানের মতো ঠিক এই কাজটাই করে দেখিয়েছেন।  

Sandhya Mukhopadhyay now
রেওয়াজে কোনওদিন ফাঁকি দেননি

নিজের আত্মজীবনীতে বলেওছেন সে কথা। রেওয়াজে কোনওদিন ফাঁকি দেননি। গলাই তো সম্পদ, তাকে মেজেঘষে না রাখলে চলে? নিয়মিত উচ্চাঙ্গসংগীতের রেওয়াজ সন্ধ্যার কণ্ঠে এনে দিয়েছিল সূক্ষ্ম কাজের জড়োয়া অলংকার। আরও মায়াময় হয়ে উঠেছিল তাঁর গান। তবে যখন উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে গাইবার থাকত, তার আগে অন্তত পনেরোদিন কোনও লঘুসঙ্গীত গাইতেন না। মনকে আত্মস্থ, একমুখী করে নিতেন সিরিয়াস গানের আগে।

ছাত্রীর গানের ওপর কড়া নজর রাখতেন বাবা বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেব। আসরের পরে ভুলগুলো বলে বলে শুধরে দিতেন। কোথায় কোন স্বরে জোর পড়বে আর কোথায় আসবে মোলায়েম কোমলতা, শ্রোতাদের সঙ্গে গায়কের সুরের সেতুটি কেমনভাবে বাঁধতে হবে, হাতে ধরে শিখিয়ে দিতেন।  

এই সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়কে আমরা নিয়মিত শুনতে পেতাম আকাশবাণীর ন্যাশনাল প্রোগ্রামে, ভারতের প্রধান কনফারেন্সগুলিতে। লঘুসংগীতের রানি তাঁর মধুমাখা কণ্ঠে সমান উৎকর্ষের সাক্ষ্য রেখে যেতেন খেয়াল, ঠুংরিতে। উচ্চাঙ্গসংগীতের আসরে তাঁকে শোনা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ১৯৬৮ সালে বড়ে গোলাম আলি প্রয়াত হবার পর সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় তাঁর ভাইয়া, অর্থাৎ খাঁ সাহেবের পুত্র মুনাব্বর আলি খাঁ-র শিষ্যত্ব নেন, যিনি এক হিসেবে সতীর্থও বটে। একইসঙ্গে বাবার পায়ের কাছে বসে তালিম পেয়েছেন। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের নিরহংকার, অকপট উক্তি, মুনাব্বর ভাইয়ের কাছে শেখবার পরই যেন তিনি পাতিয়ালা ঘরানাকে ঠিকমতো বুঝতে পারলেন।

মুনাব্বর আলি খাঁ-র যত্নে তাঁর উচ্চাঙ্গসংগীতের সাধনা এক অন্য মাত্রায় পৌঁছেছিল। ১৯৭১-এ প্রথম ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের লং প্লেয়িং রেকর্ড বেরলো। তার আট বছর বাদে ঠিক করলেন বড়ে গোলাম আলি খাঁ সাহেবের প্রবাদ হয়ে যাওয়া ঠুংরিগুলি বাংলায় গাইবেন। সেখানেও পথের দিশারী মুনাব্বর আলি। তাঁরই পরিচালনায় সন্ধ্যার কণ্ঠে চারখানি বাংলা ঠুংরি মাইলস্টোন হয়ে গেল। সাধারণ শ্রোতার কানেও তা সমান জনপ্রিয়। এটাই মুনাব্বর আলি-সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় জুটির সাফল্য। পাতিয়ালা ঘরানার ওস্তাদি গানকে আপামর জনতার কাছে পৌঁছে দেওয়া। সংগীতের বিশ্বজনীন আবেদনটিকে ব্যবহার করে খেয়াল-ঠুংরির ডালি সাজিয়ে সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় অনায়াসে শ্রোতার মননে ঢুকে পড়লেন, রাজত্ব করলেন। সুরের সে রাজত্ব অক্ষয়, অবিনশ্বর।   

এমনই একটি বিখ্যাত বাংলা ঠুংরি ‘বাজুবন্দ খুলে খুলে যায়’, যা আসলে ভৈরবী ঠুংরি ‘বাজুবন্দ খুল খুল যায়’এর বাংলা রূপ, সেটি গাইবার চেষ্টা করলাম নিজের গলায়। এখানে রইল সে গান। শেষে পাঠকের কাছে একটি প্রশ্ন রাখি। এ লেখার শিরোনামটি নিয়ে অনেক মাথা ঘামালাম। সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বলতে আমাদের মনে কোন গানটি আগে আসে? তাঁর তুমুল জনপ্রিয় বাংলা গানগুলি? নাকি তাঁর গাওয়া ঠুংরি, শাস্ত্রীয় সংগীতের লং প্লেয়িং রেকর্ড, আকাশবাণীর ন্যাশনাল প্রোগ্রাম? ‘ওগো মোর গীতিময়’, নাকি ‘বাজুবন্দ খুলে খুলে যায়?’ সন্ধ্যা যদি শুধু ক্ল্যাসিক্যালই গাইতেন, তাহলে কী হত? অনেক ভেবেও মীমাংসা করতে পারিনি। সবরকম গানেই সমান উৎকর্ষ, সমান আবেদন। তাই তাঁকে নিয়ে লেখার এমন প্রথাভাঙা শিরোনাম। তিনি যে সব প্রথার ঊর্ধ্বে, তাঁর তুলনা একমাত্র তিনিই। 

*তথ্যঋণ: 
শ্রীসুজন দাশগুপ্ত
সঙ্গীতাচার্য অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়
abnews24.com পত্রিকাকে দেওয়া সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার
অল ইন্ডিয়া রেডিওকে দেওয়া সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের সাক্ষাৎকার
জ্ঞানপ্রকাশ ঘোষ: তহজীব-এ-মৌসিকী 

*চিত্রঋণ: Alchetron, Pinterest, Facebook, Discogs
*ভিডিওঋণ: Youtube, Saregama

Author Sangrami Lahiri

সংগ্রামী ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কনসালট্যান্ট। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে চর্চা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর এ গ্রেড শিল্পী। লেখালেখির অভ্যাসও ছোট্টবেলা থেকে, বাবা-মা'র উৎসাহে। বর্তমানে কর্মসূত্রে নিউ জার্সির পার্সিপেনি শহরে বসবাস। তবে বিদেশে বসেও সাহিত্যচর্চা চলে জোর কদমে। নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি' ও 'অবসর' পত্রিকার সম্পাদক। এছাড়া ‘উদ্ভাস’, ‘প্রবাসবন্ধু’, টেকটাচটক, ‘গুরুচণ্ডা৯’, 'ইত্যাদি ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকা।

Picture of সংগ্রামী লাহিড়ী

সংগ্রামী লাহিড়ী

সংগ্রামী ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কনসালট্যান্ট। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে চর্চা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর এ গ্রেড শিল্পী। লেখালেখির অভ্যাসও ছোট্টবেলা থেকে, বাবা-মা'র উৎসাহে। বর্তমানে কর্মসূত্রে নিউ জার্সির পার্সিপেনি শহরে বসবাস। তবে বিদেশে বসেও সাহিত্যচর্চা চলে জোর কদমে। নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি' ও 'অবসর' পত্রিকার সম্পাদক। এছাড়া ‘উদ্ভাস’, ‘প্রবাসবন্ধু’, টেকটাচটক, ‘গুরুচণ্ডা৯’, 'ইত্যাদি ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকা।
Picture of সংগ্রামী লাহিড়ী

সংগ্রামী লাহিড়ী

সংগ্রামী ইঞ্জিনিয়ার, পেশায় কনসালট্যান্ট। শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে চর্চা। অল ইন্ডিয়া রেডিওর এ গ্রেড শিল্পী। লেখালেখির অভ্যাসও ছোট্টবেলা থেকে, বাবা-মা'র উৎসাহে। বর্তমানে কর্মসূত্রে নিউ জার্সির পার্সিপেনি শহরে বসবাস। তবে বিদেশে বসেও সাহিত্যচর্চা চলে জোর কদমে। নিউ জার্সি থেকে প্রকাশিত 'অভিব্যক্তি' ও 'অবসর' পত্রিকার সম্পাদক। এছাড়া ‘উদ্ভাস’, ‘প্রবাসবন্ধু’, টেকটাচটক, ‘গুরুচণ্ডা৯’, 'ইত্যাদি ই-ম্যাগাজিনের নিয়মিত লেখিকা।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস