Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

বিনয়বাবুর মৃত্যুরহস্য

অরূপ দাশগুপ্ত

নভেম্বর ৮, ২০২১

Bengali story on teenage sleuth
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

রোববার সকাল দশটা। পিকু তখনও গভীর ঘুমে। মাঝে মা এসে তিনবার ডেকে গেছেন কিন্তু কে কার কথা শোনে! পিকুর কোনও হুঁশ নেই। এমন সময় ছোটমামার ফোন। অনেকক্ষণ বাজার পর কোনওরকমে ফোনটা ধরল পিকু। হ্যালো’ বলামাত্র ওপার থেকে মামার গলা শুনে হুড়মুড়িয়ে উঠে পড়ল পিকু। “কি রে! শরীর খারাপ না তো? এত বেলা অবধি ঘুমোচ্ছিস!” সন্তু প্রশ্ন করল। – “না না তেমন কিছু নয় ! এই একটু ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। বলো মামা!” পিকু উত্তর দিল। সন্তু বলল “আসলে কৌশিক তোর খোঁজ করছিল। তুই পারলে এখনই ওর সঙ্গে একটু কথা বলে নে। পরশু ভদ্রেশ্বরে কে একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক মারা গেছেন। সেই নিয়ে ও তোর সঙ্গে একটু কথা বলতে চায়। সকাল সকাল তোকে ফোন করতে একটু ইতস্তত করছিল, তাই আমিই করলাম। তুই কথা বলে নে।” 

মামার ফোনটা কেটে পিকু কৌশিককে ফোন করল। “হ্যাঁ কৌশিক মামা বলো!” 

কৌশিক বলল – “ভাগ্নেআজ একবার এই তিনটে সাড়ে তিনটে নাগাদ সল্টলেকে আসতে পারবে? একটা ইম্পর্টেন্ট কেস নিয়ে আলোচনা করতাম।” পিকু তো এক কথায় রাজি। মাকে বলল দিদাকে জানিয়ে দিতে যে দুপুরে মামাবাড়িতেই খাবে। তাড়াতাড়ি স্নান সেরে বেরিয়ে পড়ল পিকু। দেড়টা নাগাদ সল্টলেকে পৌঁছে দেখে সবাই ওর অপেক্ষায় বসে পিকুকে দেখেই মামি মামাকে বলল “একটু দেখো না খাবারটা কতদূর?” মামা মোবাইল দেখে বলল “আরও সাত মিনিট লাগবে দেখাচ্ছে!” পিকু বুঝতে পারল ভাল কিছু আসছে খেতে বসে দেখা গেল মেনুতে রহমানিয়ার মটন বিরিয়ানী আর পসিন্দা কাবাব, আর তার সঙ্গে বাড়িতে ভাজা বেগুনী। পিকু মামীর দিকে তাকিয়ে হাসি হাসি মুখে বলল “Too good মামি!” খাওয়াদাওয়ার পর আড্ডা জমে উঠতে না উঠতেই কৌশিক পৌঁছে গেল পিকুর মামাবাড়িতে

সন্তু, কৌশিক আর পিকু গিয়ে বসল বসার ঘরে। সন্তু কৌশিকের দিকে তাকিয়ে বলল “বলতুই পিকুকে কি বলবি বলছিলিস একটুগলা খাঁকারি দিয়ে কৌশিক শুরু করল – 

বুঝলে ভাগ্নে! ঘটনাটা ঘটেছে ভদ্রেশ্বরে। অ্যাঙ্গাস জুটমিলের পাশে তিন পুরুষের বাস বিনয় মজুমদারের। উনি বিয়ে থা করেননি, বড় ভাইয়ের ছেলে সুজিত ওরফে ছোটনকে নিয়ে থাকেন। বিনয় বাবু পেশাগতভাবে স্কুল শিক্ষক ছিলেন, ওখানকারই তেলেনীপাড়া হাইস্কুলে। বছর সাতেক আগে রিটায়ার করে এখন বাড়িতে ছাত্র পড়ান আর সপ্তাহে তিনদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখান। গানটা বিনয় বাবু বরাবরই ভাল করেন। একসময় সুবিনয় রায়ের কাছে গানও শিখেছেন। 

ঘটনাটা ঘটেছে পরশু সন্ধ্যেবেলা গান শেখানোর সময়। গান শেখাতে শেখাতে হঠাৎ বিনয় বাবু মুখ থুবড়ে হারমোনিয়ামের উপর পড়ে যান আর সঙ্গে সঙ্গে তাঁর মৃত্যু হয়। ডাক্তার দেখে কার্ডিয়াক অ্যারেস্ট বলে ডেথ সার্টিফিকেট দিয়ে দিলেও বাধ সেধেছেন বিনয় বাবুর স্কুলের প্রাক্তন হেড মাস্টারমশাই হরিসাধন বিশ্বাস। হরিসাধনবাবু বিনয় বাবুর থেকে বছর চারেকের বড় – পুরনো দিনের লোক, একই পাড়ার বাসিন্দা। ওঁর বক্তব্য হচ্ছে ওইরকম সুস্থ সবল মানুষএই ভাবে কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কিছুতেই মারা যেতে পারেন না। মৃত্যুর সময় অন্তত একটু অসুস্থতা তো বোধ করবেন! ভদ্রেশ্বরের পুলিশ যেহেতু ব্যাপারটাকে কোনও গুরুত্বই দিচ্ছে না তাই হরিসাধনবাবু আমাকে রিকোয়েস্ট করেছেন আমি যদি একটু ব্যাপারটা দেখি। হরিসাধনবাবু আবার আমার বাবার খুব বন্ধু।” – কৌশিক এক নিশ্বাসে বলে গেল কথাগুলো

“তাই ভাবছি কাল সকালে একবার ভদ্রেশ্বর থেকে ঘুরে আসবো। ভাগ্নে যদি যায় আমার সঙ্গে।” কৌশিক পিকুর দিকে তাকিয়ে বলল।

এইমুহুর্তে পিকুর কোনও কাজ ছিল না, তাই আপত্তির কোনও প্রশ্নই নেই।পিকু রাজি হয়ে গেল। 

ঠিক হল পরেরদিন সকালে সাড়ে সাতটায় হাওড়া স্টেশনে বড় ঘড়ির তলায় দুজনে মিট করবে। কৌশিক সন্তুকে রিকোয়েস্ট করল যদি লোকাল থানায় একটু  বলে দেয়। সন্তু সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে ভদ্রেশ্বর থানার ওসি জীবন হালদারকে জানিয়ে দিল ব্যাপারটা ফোন রেখে সন্তু বলল   “তোদের জন্যে স্টেশনে গাড়ি থাকবে। ভদ্রেশ্বরে পৌঁছে জীবন বাবুকে একটা ফোন করে আমার রেফারেন্স দিবি তাহলেই হবে।” 

সন্ধ্যে হয়ে এসেছে ততক্ষণে – কৌশিক উঠে পড়ল পিকু বলল “তুমি এগোও, দিদার সঙ্গে দেখা করে আমিও বেরিয়ে পড়ব।“ কিন্তু মামাবাড়ি বলে কথা! অত সহজে ছাড়া পাওয়া গেল না। মামি বার বার করে বলল রাত্রে খেয়ে যেতে। “তাড়াতাড়ি দিয়ে দেব। কী খাবি বল। চাইনিজ খাবি?” এই শুনে পিকু কি আর না বলতে পারে! চিকেন ফ্রায়েড রাইস, গার্লিক চিকেন আর স্প্রিং রোল দিয়ে তাড়াতাড়ি ডিনার সেরে পিকু রওনা দিল বাড়ির দিকে। শোভাবাজার থেকে মেট্রোয় টালিগঞ্জ সেখান থেকে অটোতে বাড়ি। বাড়ি ফেরার পথে সারাটা রাস্তা পিকু শুধু ভাবতে ভাবতে এল হরিসাধন বাবু কেন ভাবছেন যে বিনয় বাবুর মৃত্যুটা অস্বাভাবিক! 

পরদিন ভোরে সময় মতো পিকু আর কৌশিক দেখা করল হাওড়া স্টেশনে। ব্যান্ডেল লোকাল ধরে সাড়ে আটটার মধ্যেই ভদ্রেশ্বরে পৌঁছে গেল। সকাল থেকে কিছুই খাওয়া হয়নি। কৌশিকরা স্টেশন থেকে বেরিয়ে সামনেই দেখল “টিফিন ঘর” আর তার পাশেই “সত্যনারায়ণ মিষ্টান্ন ভাণ্ডার”। সত্যনারায়ণে ঢুকে কৌশিক চারটে করে কচুরি আর একশ গ্রাম করে গরম বোঁদের অর্ডার দিল। প্রথম রাউন্ড শেষ করে আরও দুটো করে কচুরি আর চা খেয়ে কৌশিক জীবন হালদারকে ফোন করল। জীবন বাবু তো বিগলিত হয়ে স্যার ট্যার বলে পুরোটা গুলিয়ে ফেলে শেষে বললেন “আপনারা সত্যনারায়ণে দাঁড়ান, আমি গাড়ি পাঠাচ্ছি।” মিনিট পনেরর মধ্যেই পুলিশের জিপ এসে গেল। 

ঘটনাটা ঘটেছে ভদ্রেশ্বরে। অ্যাঙ্গাস জুটমিলের পাশে তিন পুরুষের বাস বিনয় মজুমদারের। উনি বিয়ে থা করেননি, বড় ভাইয়ের ছেলে সুজিত ওরফে ছোটনকে নিয়ে থাকেন। বিনয় বাবু পেশাগতভাবে স্কুল শিক্ষক ছিলেন, ওখানকারই তেলেনীপাড়া হাইস্কুলে। বছর সাতেক আগে রিটায়ার করে এখন বাড়িতে ছাত্র পড়ান আর সপ্তাহে তিনদিন সন্ধ্যেবেলা বাড়িতে রবীন্দ্রসঙ্গীত শেখান। গানটা বিনয় বাবু বরাবরই ভাল করেন। একসময় সুবিনয় রায়ের কাছে গানও শিখেছেন। 

জীবন বাবুর সঙ্গে আলাপ করে বেশ ভাল লাগল পিকুর। ভদ্রলোক বেশ মাইডিয়ার গোছের। আর চেহারাটা ভারি অদ্ভুত এবং মজার। বিশাল একটা শরীরের ওপরে ছোট্ট একটা মুণ্ডু বসানো! তাতে  একটাও চুল নেই, শুধু দুটো ছোট ছোট চোখ, একটা থ্যাবড়া নাক, তাতে প্রায় দেখা যায়না এইরকম দুটো ফুটো আর ফুটো দুটোর ঠিক নীচে এক স্কোয়্যারসেন্টিমিটারের একটা কুচকচে কালো গোঁফ।

স্যারের ভাগ্নে বলে কথা! – জীবন বাবু পিকুকে এত খাতির করতে লাগলেন যে মনে হচ্ছিল পারলে কোলে নিয়ে বসে থাকেন। খুব দুঃখ পেলেন জেনে যে পিকুরা স্টেশনেই জলখাবার খেয়ে এসেছে। সিগারেট টানতে টানতে জীবন বাবু কৌশিককে পরিষ্কার বলেই দিলেন “এটা একটা স্বাভাবিক মৃত্যু। এর মধ্যে কোনও রহস্যের ছিটেফোঁটাও নেই। আরে সেরকম কিছু থাকলে আমি কি আর খুঁজে বার করতাম না! এই অঞ্চলের সব রহস্যের সমাধান তো আমিই করি। আসলে বিনয় বাবু হরিসাধনবাবুর ঘনিষ্ঠ বলে উনি একটু বেশি ইমোশনাল হয়ে পড়েছেন। যাই হোক, আপনারা দেখুন – যা সাহায্যের প্রয়োজন হবেআমাকে বলবেনআমি সবকিছুর ব্যবস্থা করে দেব। আসলে বুঝতেই তো পারছেন, এখানকার লোকাল লোকেদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যাওয়া একটু মুশকিলতার ওপর হেডমাস্টারমশাই মান্যিগন্যি মানুষ – তাই কিছু পাওয়া যাবেনা জেনেও পোস্টমর্টেম করতে পাঠিয়েছি।  রিপোর্ট আজ রাত্রেই এসে যাবে। “

কৌশিক জানাল হরিসাধনবাবুর সঙ্গে দেখা করে তারপর তারা একবার বিনয় বাবুর বাড়িতে যেতে চায় আর একটু ছোটনের সঙ্গে কথা বলতে চায়। পুলিশের গাড়িতে নয়, হেঁটে বা রিক্সায় যাবে। জীবনবাবু বললেন বিনয় বাবুর ঘরে পুলিশ তালা দিয়ে রেখেছে। কৌশিকরা যখন ওখানে যাবে ওঁকে যেন ডেকে নেয়।

থানা থেকে বেরিয়ে কৌশিকরা প্রথমে হরিসাধন বাবুর বাড়িতে গেল। থানা থেকে হাঁটা পথ। বাড়ি চিনতে কোনও অসুবিধেই হল না। 

হরিসাধন বাবু কৌশিকদের দেখে বেজায় খুশি। পিকু প্রণাম করতে গেলে প্রণাম নিলেন না। বললেন “এত সহজে চট ক’রে যেকোনও লোকের সামনে মাথা নিচু কোরও না বাবা! আর ভাল ক’রে না জেনে বুঝে কারওর পায়ের ধুলোও মাথায় নিও না। বয়োজ্যেষ্ঠ হলেই যে তাঁর জীবনের চলার পথ অথবা তার জীবনদর্শন তোমার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে এমন কোনও গ্যারান্টি নেইযদি পরে সম্মান করতে না পারো? মিছিমিছি মনে কষ্ট পাবে!”

সত্যিই তো এইভাবে তো কখনও ভেবে দেখেনি! দারুন ইমপ্রেস্ড হ’লো পিকু।

হরিসাধনবাবু আর কিছু  বলার আগেই কৌশিক জিজ্ঞাসা করল “জ্যাঠামশাই আপনার বিনয় বাবুর মৃত্যুটা অস্বাভাবিক লাগছে কেন?” 

হরিসাধন বাবু বলতে শুরু করলেন “তোমাকে সবটা খুলেই বলি তাহলে – বিনয় যেদিন চলে গেল সেদিন বিকেলেই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল ওকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল খুব বিপদের মধ্যে আছে, বেঁচে থাকলে সাক্ষাতে সব বলবে। সেইটে শোনার পর থেকেই আমার মনটা খুব অস্থির অস্থির লাগছিল। কী এমন ঘটল যে বিনয় মৃত্যু ভয় পেতে শুরু করলতারপর শুনলাম এই দুঃসংবাদ। সেদিন রাত্রে যখন বিনয় গান শেখাচ্ছিল তখনই তাঁর মৃত্যু হয়। ছাত্রছাত্রীদের সামনেই ঘটে ঘটনাটা।

“আমরা কি সেই সময় উপস্থিত ছিল এমন কোনও ছাত্র বা ছাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে পারি?” কৌশিক জিজ্ঞাসা করল। – “নিশ্চই পারো! আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। আর হ্যাঁ, তোমরা দুপুরে আমার এখানে খাবে কিন্তু।” হরিসাধন বাবুর  স্বরে এমন কিছু ছিল যে কৌশিকদের না বলার কোনও সাহস হলো না। 

ঝুমা বলে একটি মেয়েকে ডেকে হরিসাধনবাবু বললেন “দ্যাখ তো মা, সেদিন তোর যেসব বন্ধুরা বিনয়ের কাছে গান শিখছিল তাদের ডেকে আনতে পারিস কিনা!” ঝুমা ঘাড় নেড়ে চলে গেল। জানা গেল মেয়েটি হরিসাধনবাবুর নাতনি, বছর পনেরো বয়স হবে। হরিসাধন বাবু বললেন ঝুমাও বিনয়ের কাছেই গান শিখত। ঘটনাচক্রে সেদিন ও যায়নি। কথাবার্তা বলতে বলতে ঘন্টাখানেকের মধ্যে ঝুমা জনা পাঁচেক মেয়ের সঙ্গে ঘরে ঢুকল। সেদিন সন্ধ্যায় ওই ক’জনই বিনয়বাবুর কাছে গান শিখতে গেছিল। 

বিনয় যেদিন চলে গেল সেদিন বিকেলেই ওর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আমার। খুব নার্ভাস দেখাচ্ছিল ওকে জিজ্ঞাসা করাতে বলল খুব বিপদের মধ্যে আছে, বেঁচে থাকলে সাক্ষাতে সব বলবে। সেইটে শোনার পর থেকেই আমার মনটা খুব অস্থির অস্থির লাগছিল। কী এমন ঘটল যে বিনয় মৃত্যু ভয় পেতে শুরু করলতারপর শুনলাম এই দুঃসংবাদ। সেদিন রাত্রে যখন বিনয় গান শেখাচ্ছিল তখনই তাঁর মৃত্যু হয়। ছাত্রছাত্রীদের সামনেই ঘটে ঘটনাটা।

পিকু অনেক অনুরোধ করল তাদের সেদিনের ঘটনাটা বলার জন্য, কিন্তু তার অনুরোধ সত্বেও মেয়েগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। কেউ কিচ্ছু বলছে না, সবাই যেন একটু ভয় পাচ্ছে শেষ পর্যন্ত হরিসাধন বাবু আশ্বস্ত করাতে মিনি বলে একটি মেয়ে মুখ খুলল। 

মিনি বলল “সেদিন প্রথম থেকেই স্যার একটু অন্যমনস্ক ছিলেন। স্যার নিজে হারমোনিয়াম বাজিয়ে আমাদের গান তুলিয়ে দিতেন। সেদিন প্রথমে ‘এরে ভিখারী সাজায়ে কি রঙ্গ তুমি করিলে ‘ গানটা শিখিয়ে স্যার বললেন ‘আজ আর গান শেখাবো না। আজ তোদের ছুটি।’

আমরা বেরতে যাব তার আগেই মুষলধারে বৃষ্টি নামল। স্যার তখন আবার আমাদের ডেকে বললেন ‘এই বৃষ্টিতে তোরা বেরস না। ওপরে এসে বস।‘ আমরা সবাই আবার গান শেখার ঘরে গিয়ে বসলাম। স্যারও এসে হারমোনিয়াম নিয়ে বসলেন। নিজেই গাইতে শুরু করলেন ‘আমারে তুমি অশেষ করেছ, এমনি লীলা তব!’ এই গানটা গাইতে গাইতে হারমোনিয়ামটা কেমন একটা লক হয়ে গেল। অনেক চেষ্টা করেও কয়েকটা রিড কিছুতেই বসল না। চিনুকে স্যার বললেন পাশের ঘরে একটা নতুন হারমোনিয়াম আছে সেটা নিয়ে আসতে। 

চিনু আর বুলু গিয়ে নতুন হারমোনিয়ামটা নিয়ে এলে স্যার জিজ্ঞাসা করলেন আমাদের কোনও গানের অনুরোধ আছে কিনা। বাইরের ঘরে তখন প্রচণ্ড বেসুরে ছোটন কাকু চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়’ গানটা করছিল। স্যার বিরক্ত হয়ে বললেন দরজাটা বন্ধ করে দিতে। বলে নিজেই ওই গানটা ধরলেন। সেদিন যেন স্যার অন্য কোনও জগতে পৌঁছে গেছিলেন। শুরু করলেন ‘তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়, কোন খানে রে কোন পাষাণের ঘায়।’ পাষাণের ঘায়ে বলার সঙ্গে সঙ্গে স্যার লুটিয়ে পড়লেন। আমরা সবাই ভয় পেয়ে স্যারের মাথায় জল ছিটোতে লাগলাম। কিন্তু কোনও সাড়া নেই – তাই দেখে 

আমরা তাড়াতাড়ি ছোটন কাকুকে ডাকলাম। স্যারের ডান হাতটা হারমোনিয়ামের রিডের ওপর, আর বাঁ হাতটা বেলোতে ধরা। মাথাটা হারমোনিয়ামের ওপর পড়ে গিয়েছিল। ছোটনকাকু তখনই স্যারকে পাঁজাকোলা করে নীচে নিয়ে গেল, বলল তোরা চলে যা আমি কাকাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছি। আমরা স্যারের বাড়ি থেকে বেরিয়েই ঝুমাকে ফোন করে ঘটনাটা জানালাম দাদুকে জানানোর জন্যে।” 

এই অবধি শোনার পর হরিসাধন বাবু বললেন, “আমি খবরটা পেয়ে সেই রাত্রেই সোজা হাসপাতালে যাই। গিয়ে শুনি বিনয় আর নেই। ডাক্তাররা বলছেন সাডেন কার্ডিয়াক অ্যাটাক। কিন্তু ডাক্তারদের যুক্তি আমি মানতে পারলাম না। সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল বিনয়ের মৃত্যুভয়ের কথাটা। আমি জীবন বাবুকে ফোন করে সবটা বললাম আর এও অনুরোধ করলাম যেন বিনয়ের ঘরটায় এখুনি তালা মারার ব্যবস্থা করেন। বাড়িতে ফিরেও সুস্থ থাকতে পারলাম না। শুধুই বিনয়ের কথাটা মনে পড়তে লাগল। পরদিন সকালে থানায় গিয়ে বড় বাবুকে আমার সন্দেহের কথা জানালাম, কিন্তু জীবনবাবু একেবারেই গুরুত্ব দিলেন না। বললেন যেহেতু সরকারি হাসপাতাল থেকে ডেথ সারটিফিকেট ইস্যু করে দিয়েছে ওঁর আর কিছুই করার নেই। তাই তোমায় ফোন করলাম। 

এর মধ্যে আমরা কয়েকজন বিনয়ের এক্স কলিগরা থানায় অ্যাপিল করলাম যাতে বিনয়ের বডিটা অন্তত পোস্টমর্টেম করার ব্যাবস্থা করা হয়। জীবন বাবু তাতেও রাজি না হওয়ায় আমরা এস পিকে দিয়ে বলিয়ে বডি পোস্টমর্টেম করতে পাঠালাম। আজ রিপোর্ট আসবে।” কথাগুলো বলতে বলতে হরিসাধন বাবু কেমন হাঁপিয়ে পড়লেন। কৌশিক জলের গ্লাসটা এগিয়ে দিল। 

মিনিকে পিকু জিজ্ঞাসা করল “আচ্ছা তোমরা সবাই তো নিশ্চই মোবাইল ব্যবহার করো! এই ঘটনাটা ঘটার সময় কেউ কি কোনও ছবি তুলেছিলে?” সবাই চুপ। পিকু বুঝিয়ে বলল “যদি কেউ তুলে থাকো তাহলে আমার সঙ্গে শেয়ার করো, কথা দিচ্ছি কেউ জানবে না, যদি না তোমরা কাউকে বলো! আর আরেকটা জিনিষ,  সেদিনকার ক্লাসের পুরো অডিও রেকর্ডিংটা  আমার চাই। সেটা দিতে নিশ্চই কোনও আপত্তি নেই তোমাদের!” 

সবাইকে চুপ করে থাকতে দেখে ঝুমা বলে উঠলো “এ্যাই পম্পা! তুই তো তুলেছিলি ছবি, দ্যাখা!” অনেক জোরাজুরি করার পর পম্পা ফোনটা পিকুকে দিল। পিকু ভাল করে ছবিটা দেখে, পম্পার ফোন থেকেই ছবিটার একটা ফটো তুলে নিল। মিনি ক্লাসের পুরো অডিও রেকর্ডিংটাও পিকুর সঙ্গে শেয়ার করল। ফোনটা ফেরত দেওয়ার পর মিনিরা সবাই চলে গেলে পিকু হরিসাধন বাবুর কাছে জানতে চাইল ছোটন এখন কোথায়। 

“বাড়িতেই হবে।” হরিসাধন বাবু উত্তর দিলেন। 

“আর হারমোনিয়ামটা? “ 

সেটাও বাড়িতেই হবে!” হরিসাধন বাবু জানালেন। 

এইসব করতে করতে প্রায় একটা বেজে গেল। হরিসাধন বাবু বললেন “চলো এবার খেয়ে নাও। তারপর বিনয়ের বাড়িতে নিয়ে যাব।” 

খুবই সাধারণ আয়োজন। ডাল, আলুভাজা, পুঁইশাক আর কাতলা মাছের ঝোল। খাওয়া হলে ওরা তিনজনে হেঁটেই বিনয় বাবুর বাড়ি পৌঁছে গেল। ততক্ষণে কৌশিক জীবন বাবুকেও ডেকে নিয়েছে। ছোটন বাড়িতেই ছিলো। সেইই ওদের দোতলায় নিয়ে গেল।

পুরনো হলেও বাড়িটার মধ্যে কেমন একটা মন ভাল করে দেওয়ার ব্যাপার আছে। সামনের বারান্দা থেকে অপূর্ব দৃশ্য। শ’খানেক ফুট দূরেই গঙ্গা। বর্ষার মেঘের ছায়া পড়েছে জলের উপর, ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে, হাল্কা হাওয়া। দূরে দুটো পাল তোলা নৌকো। গঙ্গার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে পিকু একটু অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিল। কৌশিকের ডাকে সম্বিত ফিরে পেয়ে ভিতরে গেল। বারান্দার লাগোয়া ঘরটাই বিনয় বাবুর গান শেখানোর ঘর। বেশ কিছু পুরনো দিনের আসবাব। ঘরে বসবার সেরকম কোনও ব্যবস্থা নেই শুধু একটা বড় ফরাস পাতা আর একপাশে হারমোনিয়াম রাখা। হারমোনিয়াটা নতুন। এটা বাজিয়েই বিনয়বাবু গান শেখাচ্ছিলেন। হারমোনিয়ামটা ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল পিকু। হারমোনিয়ামটা দেখেই বোঝা গেল সেই অবস্থাতেই পড়ে আছে। সেদিনের পর কেউ আর আসেনি যে এই ঘরেপিকু ছোটনকে জিজ্ঞাসা করল ঘটনার সময় উনি কোথায় ছিলেন। 

“আমি বাইরের বারান্দায় ছিলাম। দরজা তো বন্ধ ছিল তাই কিছু দেখতে পাইনি। মেয়েদের চেঁচামেচি শুনে ঘরে ঢুকে দেখি এই কাণ্ড। সঙ্গে সঙ্গে কাকার পালস্ ধরে দেখলাম খুব ফিবল। রিক্সা ডেকে সোজা হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। মিনিট দশেক বেঁচে ছিলেন, তারপর সব শেষ।” বলতে বলতে ছোটনের চোখ ছলছল করে উঠল। 

বারান্দার লাগোয়া ঘরটাই বিনয় বাবুর গান শেখানোর ঘর। বেশ কিছু পুরনো দিনের আসবাব। ঘরে বসবার সেরকম কোনও ব্যবস্থা নেই শুধু একটা বড় ফরাস পাতা আর একপাশে হারমোনিয়াম রাখা। হারমোনিয়াটা নতুন। এটা বাজিয়েই বিনয়বাবু গান শেখাচ্ছিলেন। হারমোনিয়ামটা ভাল করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখল পিকু। হারমোনিয়ামটা দেখেই বোঝা গেল সেই অবস্থাতেই পড়ে আছে। সেদিনের পর কেউ আর আসেনি যে এই ঘরেপিকু ছোটনকে জিজ্ঞাসা করল ঘটনার সময় উনি কোথায় ছিলেন। 

পিকু হারমোনিয়ামটার অনেকগুলো ছবি তুলল, নানান অ্যাঙ্গেল থেকে। তাছাড়া সবদিক থেকে ঘরেরও ছবি নিল। এইসব করে ওরা যখন হরিসাধন বাবুর বাড়িতে ফিরল তখন চারটে বাজে। একটু চা খেয়ে কৌশিক বলল “এবার আমরা উঠি জ্যাঠামশাই। আমরা যোগাযোগ রাখব। আর জীবন বাবুকে বলা আছে, পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা পেলে উনি ভবানী ভবনে পিকুর মামা শান্তনুকে কপি পাঠিয়ে দেবেন।” 

হরিসাধন বাবুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে কৌশিক আর পিকু থানায় গিয়ে জীবন বাবুর সঙ্গে দেখা করে বলল ওরা ফিরে যাচ্ছে, দরকার হলে ফোনে যোগাযোগ করবে। আর উনি যেন অবশ্যই পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা তাড়াতাড়ি পাঠিয়ে দেন।  কৌশিকরা না বলা পর্যন্ত  বিনয় বাবুর ঘরের তালা যেন না খোলা হয়। জীবন বাবু ড্রাইভারকে ডাকতে গেলে কৌশিকরা মানা করল, জানাল ওরা রিক্সায় চলে যাবে, গাড়ি লাগবে না। 

ভদ্রেশ্বর থেকে বর্ধমান লোকাল লেট করাতে হাওড়া পৌঁছতে প্রায় পৌনে আটটা বেজে গেলো পিকুদের। পিকু দশটা নাগাদ বাড়িতে পৌঁছনো মাত্র কৌশিকের ফোন, ” জীবন বাবু ফোন করেছিলেন, ” পোস্টমর্টেম রিপোর্ট অনুযায়ী মৃত্যু বিষ থেকে হয়েছে। ভেরি হাই ডোজ অফ Botulinum toxin. বাকি কথা আর নেক্সট স্টেপ নিয়ে কাল আলোচনা করব।” পিকুকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কৌশিক ফোনটা কেটে দিল। পিকু আবার ফোন করল কৌশিক কে ” কিভাবে পয়জন করেছে কিছু বলতে পারলো?” কৌশিক জানাল“হ্যাঁ বলেছে পয়জন ইনজেক্ট করা হয়েছে।” পিকুর মাথা এবার পুরো গুলিয়ে গেল। অতগুলো ছাত্রীর সামনে কী করে ইনজেক্ট করবে! তাহলে কি ছাত্রীরাই? ইম্পসিবল!! 

রাতের খাবার খেয়ে পিকু ওপরে নিজের ঘরে চলে এল। বাইরে তখন মুষলধারে বৃষ্টি পড়ছে। প্রথমে অনেকবার ছবিগুলো দেখল। তারপর সেদিনের ক্লাসের পুরো অডিও রেকর্ডিংটা ভাল করে বারে বারে শুনল। কিছুই অস্বাভাবিক মনে হলো না। কে ইনজেক্ট করল! কিভাবে ইনজেক্ট করল! কিছুই মাথায় আসছে না। আবার শুনলো শেষ গানটা, “তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়!” পিকু নেট ঘেঁটে গানটার পুরো কথা খুঁজে বার করল। ভাল করে বোঝার চেষ্টা করল বিনয় বাবু এই গানটাই কেন গাইলেন? 

হঠাৎ মনে পড়ল মিনি বলেছিল এই গানটা শুরু করার আগে ছোটনও বাইরে বসে এই গানটাই গাইছিল। দুজনেই বা কেন একই সঙ্গে এই গানটাই গাইবে? কোনও রকম যোগ আছে কি এর মধ্যে! কিন্তু যদি থেকেও থাকে তাহলেও বিষ ইনজেক্ট করার সঙ্গে তার কি সম্পর্ক! পিকু বিনয়বাবুর ঘরের ছবিগুলো আবার ভাল করে দেখে বোঝার চেষ্টা করল, অন্য কোনও ভাবে কি কোনও দিক থেকে কিছু ছুঁড়ে বা কিছু দিয়ে ইনজেক্ট করা সম্ভব! সেরকম কোনও সম্ভাবনা খুঁজে পেল না। পিকুর মাথা কাজ করছে না। কোনও সূত্রই খুঁজে পাচ্ছে না যা দিয়ে বোঝা যায় বিনয় বাবুকে কি ভাবে পয়জন ইনজেক্ট করা হল। 

বৃষ্টি অনেকক্ষণ থেমে গেছে। বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা ভাব। সামনের ফাঁকা জমিতে জমা জলে ব্যাঙেদের গানের আসর বসেছে। ওদের কোনও তাল জ্ঞান না থাকলেও সুর জ্ঞান যথেষ্ট আছে। একটা কাঠামো মেনেই গানটা গায়। পিকু জানেনা কোলা ব্যাঙ আর সোনা ব্যাঙের গানের মধ্যে সুরের কি তফাৎ। নিশ্চই আছে, নইলে ওরা নিজেদের চেনে কী ভাবে! আমাদেরও তো বিভিন্ন গানের সুরের কাঠামো আলাদা। আর তাই তো প্রতিটি গানের মুডও আলাদা। কী যেন বলে এই সুরের কাঠামো কে! যা দেখে মা আগে হারমোনিয়ামে বিভিন্ন রবীন্দ্রসঙ্গীতের সুর বাজিয়ে গাইতো? মনে পড়ে গেলো, স্বরলিপি। স্বরলিপি দেখেই তো হারমোনিয়ামের বিভিন্ন রিড টিপে গানের সুর বাজানো হয়। বিনয় বাবুও তো ওইভাবেই নিশ্চই গান শেখাতেন। আর সেদিনও একই নিয়মই ফলো করছিলেন! কিন্তু তাতেই বা কি হয়েছেসেটাই তো স্বাভাবিক। পিকু আর কিছুই ভাবতে পারছিল না। বিছানায় শুয়ে সে ঘুমিয়েই পড়ল। 

সকালে উঠেই কি মনে হতে কৌশিককে ফোন করল পিকু। 

“কৌশিক মামা! “ 

“হ্যাঁ বলো”! কৌশিক জবাব দিল।

“যদিও কিছুই কংক্রিট বুঝতে পারছি না, তাহলেও আজ কি একবার ভদ্রেশ্বর যাওয়া যায়!” পিকু জিজ্ঞাসা করল।কৌশিক বলল দশটা সাতান্নতে একটা বর্ধমান লোকাল আছে। ওটা ধরা যেতে পারে। সেইমতো ওরা দুজনে তাড়াতাড়ি স্নান খাওয়া সেরে, হাওড়া থেকে ট্রেন ধরে পৌনে বারোটা নাগাদ ভদ্রেশ্বর পৌঁছে গেল। স্টেশনে নেমেই পিকু বলল “থানায় যাব, দ্যাখো জীবন বাবু আছেন কিনা!” 

কৌশিক একটা ব্যাপার লক্ষ্য করল পিকু যেন কিরকম একটু অন্যমনস্ক থাকছে। বোধহয় বিনয় বাবুর ব্যাপারটা নিয়ে চিন্তিত। কৌশিকও ওকে বিরক্ত করল না। থানায় পৌঁছতেই তো জীবন বাবু একেবারে গদগদ। সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি শুনে মাখন টোস্ট, অমলেট আর চা আনতে বললেন। 

“একবার বিনয় বাবুর বাড়ি যাওয়া যাবে?” পিকু জানতে চাইলো। 

“নিশ্চই! এক্ষুনি যাবে?” জীবন বাবু উঠে দাঁড়ালেন। তিনজনে জীবন বাবুর জিপে বিনয় বাবুর বাড়িতে পৌঁছে সোজা ওপরে উঠে ওঁর গানের ঘরে পৌঁছে গেলো। পিকু হারমোনিয়ামটা ভাল করে একটু দেখলো, বাজানোর চেষ্টাও করল। ছোটন পাশেই দরজায় দাঁড়িয়ে ছিল। পিকু জিজ্ঞাসা করল ” আচ্ছা বলতে পারেন এই হারমোনিয়ামটা কতদিনের পুরোনো আর কোথা থেকে কেনা হয়েছিল!?”  ছোটন একটু থতমত খেয়ে উত্তর দিলো “এইতো যেদিন কাকা মারা গেলেন সেদিনই দুপুরে ডেলিভারি দিয়ে গেল। আর কাকা সবসময় নতুনপাড়ার “হারমোনি”র থেকেই  হারমোনিয়াম সারাতেন। এটাও বোধহয় ওখান থেকেই কেনা।” 

সব শুনে পিকু জীবন বাবুকে জিজ্ঞাসা করল “হারমোনিয়ামটা কি একটু থানায় নিয়ে যাওয়া যায়?” “অবশ্যই!” বলে জীবন বাবু ড্রাইভারকে ডেকে হারমোনিয়ামটা গাড়িতে তুলিয়ে নিলেন।

গাড়িতে উঠেই পিকু জীবন বাবুকে বলল একবার যদি “হারমোনি”র মালিককে যন্ত্রপাতি নিয়ে থানায় আসতে বলেন। কিন্তু কোনওরকম ভয় দেখাবেন না।”

থানায় পৌঁছেই জীবন বাবু যথারীতি অর্ডার করে দিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হারমোনির মালিক পুলিনবাবু এসে হাজির। ভীষণ গোবেচারা ধরনের মানুষ। কৌশিক একটু কথাবার্তা বলার পর পিকু জিজ্ঞাসা করল “এই হারমোনিয়ামটা কি আপনাদের বানানো? “ 

“আজ্ঞে হ্যাঁ”। পুলিন বাবু উত্তর দিলেন।

“আপনিই বানিয়েছেন না আপনার কারিগর?” পিকু জিজ্ঞেস করল।

“না আমিই বানিয়েছি”! পুলিনবাবু বললেন। 

“আপনি তো তাহলে হারমোনিয়াম বাজাতেও পারেন! “পিকু বলল। 

পকেট থেকে একটা কাগজ বার করে পিকু পুলিন বাবুর দিকে এগিয়ে দিয়ে বলল “এটা একটু বাজিয়ে শোনাবেন?” কৌশিক জিজ্ঞেস করাতে, পিকু জানাল “তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায়” গানের স্বরলিপি। পুলিন বাবু প্রথম লাইনটা বাজিয়ে থেমে গেলেন। পিকু জিজ্ঞেস করল “কি হল বাজান!” পুলিন একটু ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে বললেন “এরপরটা ঠিক বুঝতে পারছি না।” 

পিকু বলল “আচ্ছা আপনি শুধু ‘মা পা দা পা’ এই চারটে স্বর বাজান। “পুলিন বাবু চুপ করে রইলেন। কৌশিক এবারে একটু ধমকের স্বরেই বলল। তাতেও পুলিন বাবু চুপ। এইসব দেখে জীবন হালদার বাজারে নামলেন। দুটো ধমক দিতেই পুলিন বাবু হাউমাউ করে কেঁদে ফেললন “আমি কিচ্ছু করিনি বিশ্বাস করুন”! সুজিত বাবু বললেন তাই। জীবন বাবু এইবারে প্রচণ্ড এন্থু পেয়ে গেলেন। জোর ধমক দিয়ে উঠলেন – “সুজিত বাবু কী বললেন, বলুন!” 

পিকু আর কৌশিক জীবন বাবুকে বোঝালেন এখানে বকাবকি করলে হবে না। 

পিকু পুলিন বাবুকে বলল “‘মা পা দা পা’ পরপর বাজালে হারমোনিয়ামে কি হয় সেটা তো একটু বুঝিয়ে দিন আর নয়ত ওই কটা স্বর বাজিয়ে শোনান।”পুলিন বাবু কিছুই করছেন না দেখে পিকু পুলিন বাবুকে হারমোনিয়ামটাই খুলতে বলল। 

হারমোনিয়াম খোলার সময় পুলিন বাবুর হাত কাঁপছে দেখে কৌশিক বলল “আপনি এইরকম করছেন কেন? আপনাকে তো কিছু বলা হয়নি!” 

হারমোনিয়াম খোলা হলে পিকু পুলিন বাবুকে সরিয়ে নিজে ঝুঁকে পড়ে দেখতে লাগলো। অবাক হয়ে একটা জিনিষ লক্ষ্য করল,হারমোনিয়ামটার বেলোর ঠিক আগে যেখানটায় বাঁহাতের কব্জিটা রেস্ট করে, তার ঠিক তলায় কভারটা তুললে একটা ছোট্ট প্লাস্টিকের সিরিঞ্জের মত জিনিষ। সিরিঞ্জের মুখে একটা বড়ো সূঁচ লাগানো। আর সিরিঞ্জের নীচে একটা প্রেসার স্প্রিং যেটা হারমোনিয়ামের চারটে রিডের সঙ্গে টেনশন দিয়ে আটকানো। মেকানিজমটা হচ্ছে, যদি ওই চারটে রিড প্রেস করা হয় তাহলে ওই স্প্রিংয়ে চাপ পড়বে আর সুঁচটা সোজা ওপরের দিকে বেরিয়ে আসবে। আবার রিড ছেড়ে দিলে টেনশন রিলিজ হলে সূঁচ ভিতরে ঢুকে আসবে। পুরো ব্যাপারটা পিকুর কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। শুধু একটাই ব্যাপার জানার আছে, ওই চারটে রিড “মা পা দা পা” কিনা। পুলিন বাবুকে জিজ্ঞাসা করতে উনি মাথা নেড়ে সায় দিলেন। 

তার মানে ওই শেষ চারটে স্বর হল “কোন পাষাণের ঘায়”।

কৌশিক আর জীবন বাবু কিরকম অবাক হয়ে পিকুর দিকে চেয়ে রইল। পিকু বুঝিয়ে বলল “মা পা দা পা” হচ্ছে বিনয় বাবুর গাওয়া শেষ গানের সেই অংশের স্বরলিপি যেটা গাইতে গাইতে বিনয় বাবুর মৃত্যু হয়। 

 জীবন বাবুকে পাশের ঘরে ডেকে কৌশিক আর পিকু বোঝাল এখুনি পুলিন বাবু আর ছোটনকে পুলিশ কাস্টোডিতে নেওয়া দরকার। জীবন বাবু সেই মতো ব্যবস্থা করলেন। 

 কৌশিক আর পিকু জীবন বাবুর জিপটা নিয়ে বেরিয়ে প্রথমেই স্টেশনে পৌঁছল। প্রচণ্ড ক্ষিদে পেয়েছে, মাথা আর কাজ করছেনা। ‘সোনালী হোটেল এ্যান্ড রেসটুরেন্টে মুগের ডালঝুরিঝুরি আলু ভাজা আর পাঁঠার  মাংসের ঝোল দিয়ে ভাত খেয়ে দুজনেরই প্রাণ শান্ত হল। 

তিনটে বেজে গেছে দেখে কৌশিক হরিসাধন বাবুকে একটা ফোন করল। হরিসাধন বাবু বললেন উনি বাড়িতেই আছেন ওরা যখন খুশি আসতেই পারে। 

পিকুর কাছে সবটা শুনে হরিসাধন বাবু তো ধন্য ধন্য করতে লাগলেন। “ধন্য তোমার বুদ্ধি বাবা! ধন্য! তুমি জীবনে অনেক উন্নতি করো এই কামনা করি। তোমায় আশির্বাদ করার মত অভিজ্ঞতা বা বুদ্ধি কোনওটাই আমার নেই!” হরিসাধন বাবু এবার একটু ইমোশনাল হয়ে পড়লেন। 

এসব শুনে পিকু ভীষণ লজ্জায় পড়ে গেল। জোর করে হরিসাধন বাবুকে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করল। হরিসাধন বাবুর দুটো মাত্র প্রশ্ন, কে এবং কেন? ওরা তিনজনে সোজা থানায় এসে পৌঁছালে জীবন বাবু কৌশিককে বললেন “স্যার! সব বের করে ফেলেছি। 

মাথা হচ্ছে ছোটন বাবু আর এক্সিকিউট করেছেন পুলিন বাবু। সবটাই বাড়িটার লোভে। অনেক বলা সত্বেও বিনয় বাবু নাকি ছোটনের নামে বাড়িটা লিখে দিচ্ছিলেন না। বিনয় বাবুর বক্তব্য ছিলো, ওনার অবর্তমানে বাড়ি তো ছোটনই পাবে। তাই তাড়াহুড়োর কি আছে। কিন্তু ছোটনের তর সয়নি। কোনও এক প্রোমোটারের কাছে মোটা টাকার অফার পেয়ে বিনয় বাবুকে সরিয়ে দেওয়ার ফন্দি করে। প্রথমে বিনয় বাবুকে বোঝায়, পরে হুমকিও দেয়। কিন্তু কোনওটাতেই কাজ না হওয়ায় শেষে এই কীর্তি।” 

পিকু জিজ্ঞাসা করল “কিন্তু হারমোনিয়ামের মধ্যে বিষ ভরা ইনজেকশনের সিরিঞ্জ রাখার এই অভিনব আইডিয়াটা কোথা থেকে পেলেন।” ছোটন জানাল “সমাদ্দারের চাবি”! 

“মানে ফেলুদা! উরেব্বাস! কি সাংঘাতিক!” কৌশিক বলে উঠল।

সব শুনে পিকু বুঝল সেদিন বারান্দায় বসে ছোটনের “তরী আমার হঠাৎ ডুবে যায় গানটা গাওয়ার অর্থ হল বিনয় বাবুকে ওই গানটা গাওয়ার জন্যে প্ররোচিত করা। ছোটন জানত গান পাগল বিনয়বাবুর কানে গানের কলিটি ঢুকিয়ে দিতে পারলে উনি নির্ঘাত ওই গানটিই গাইবেন। “এসব ভেবেই ছোটনবাবু চান্সটা নিয়েছিলেন –আর এক চান্সেই বাজিমাত” অল্প হেসে পিকু বলল।

পিকুর এই সাফল্য দেখে জীবন বাবু তো বুঝেই উঠতে পারছিলেন না পিকুকে কি বলে সম্বোধন করবেন। শেষে তিনবার ঢোক গিলে পিকুকে  বললেন “বুঝলেন স্যার! এই গোয়েন্দাগিরি ব্যাপারটা আমার বরাবরই ফেভারিট! তবে অভ্যেস নেই তো! তাই প্র্যাক্টিস করা হয় না।”

 আমার স্ত্রী তো সবসময় বলে “কি তুমি সারাক্ষণ চোর ছ্যাঁচোড়ের পিছনে ঘুরে মরো! একটু ফেলুদার মতো হতে পারোনা ?”

Author Aroop Dasgupta

পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।

Picture of অরূপ দাশগুপ্ত

অরূপ দাশগুপ্ত

পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।
Picture of অরূপ দাশগুপ্ত

অরূপ দাশগুপ্ত

পড়াশোনা করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের রেডিয়ো ফিজিক্স বিভাগে। পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন তথ্য প্রযুক্তিকে। প্রায় এগারো বছর নানা বহুজাতিক সংস্থার সাথে যুক্ত থাকার পর উনিশশো সাতানব্বইতে তৈরি করেন নিজের তথ্যপ্রযুক্তি সংস্থা। বর্তমানেও যুক্ত রয়েছেন সেই সংস্থার পরিচালনার দায়িত্বে। কাজের জগতের ব্যস্ততার ফাঁকে ভালবাসেন গান-বাজনা শুনতে এবং নানা বিষয়ে পড়াশোনা করতে। সুযোগ পেলেই বেড়াতে বেরিয়ে পড়েন আর সেই অভিজ্ঞতা ধরে রাখেন ক্যামেরায়।

One Response

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস