বিজ্ঞানের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার ‘নোবেল প্রাইজ’ সম্পর্কে কম-বেশি আমরা সবাই পরিচিত। প্রত্যেক বছর এই দুর্লভ সম্মান নিজের কীর্তিতে অর্জন করেন হাতে-গোণা কিছু গবেষক-লেখক-বৈজ্ঞানিক। অন্যদিকে, গণিত বিজ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত কিনা তা নিয়ে অনেক বিতর্ক থাকলেও বিজ্ঞানের চালিকাশক্তি হিসাবে গণিতের বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে তর্কের জায়গা নেই। আমরা অনেকেই জানি যে গণিতে নোবেল প্রাইজ দেওয়া হয় না। কেন দেওয়া হয় না, সেই সম্পর্কেও বাজারচলতি সরস গল্পের অভাব নেই মোটেই। তাহলে গণিতশাস্ত্রের দক্ষতার সর্বশ্রেষ্ঠ স্বীকৃতি কী? এই সহজ প্রশ্নের সঠিক উত্তর হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা। তাই আমার আজকের ছোট্ট লেখাটিতে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু এই প্রশ্নটিই।
গণিতে পারদর্শী না হলে বিজ্ঞানের অধিকাংশ গূঢ় তত্ত্বকথা আমাদের কাছে প্রাণহীন তথ্যের মতো নির্জীব আচরণ করে, কাছের বন্ধুর মতো হাসিখুশি ও খোলামেলা হয়ে উঠতে পারে না। মোবাইল ফোন থেকে সাজানো ঘরের কোণ— জীবনে বিজ্ঞানের ভূমিকা সম্পর্কে আমরা সবাই ভীষণ সচেতন, বিশেষতঃ এই করোনা অতিমারীর সময়ে। তাহলে বিজ্ঞানের প্রাণের দোসর গণিতকে জীবন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার চেষ্টা যে আমাদের জন্য ভালো কোনও বার্তা বহন করতে পারে না, তা বলাই বাহুল্য। এই লেখার শিরোনামের দিকে চোখ রাখলেই আমরা দেখতে পাচ্ছি, গণিতশাস্ত্রের সর্বশ্রেষ্ঠ পুরস্কারটির নাম হল ফিল্ডস মেডাল। কৌতুকভরে অনেকেই একে ‘‘গণিতের নোবেল প্রাইজ’’ হিসাবে ডাকনামে অভিহিত করলেও দুই পুরস্কারের মধ্যে মিলের পাশাপাশি অমিলও রয়েছে বেশ খানিকটা। হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন, নোবেল প্রাইজের মতোই ফিল্ডস মেডালের নামের মধ্যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে রয়ে গিয়েছেন এক বরেণ্য গণিতসাধক—কানাডার গণিতজ্ঞ ‘‘জন চার্লস ফিল্ডস’’।

গণিতের এই অতিবিশিষ্ট মহতী সম্মাননা স্থাপনের পিছনে কেবলমাত্র অর্থসাহায্য করেই ক্ষান্ত হননি ফিল্ডস সাহেব, নিজের মতো করে গভীর চিন্তাভাবনা করেছেন পুরস্কার প্রদানের নিয়মাবলি এবং সুযোগ্য প্রাপককে সসম্মানে চিহ্নিত করার জটিল প্রক্রিয়াটি নিয়ে। তাঁর এই সুদূরপ্রসারী ভাবনা এবং তার সঠিক রূপায়নের কারণেই হয়তো ফিল্ডস মেডাল প্রাপকদের যোগ্যতা এবং তাঁদের চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া নিয়ে বিতর্কে মেতে উঠতে দেখা যায় না আন্তর্জাতিক গণিতমহলকে। অন্যদিকে, নোবেল প্রাইজের গরিমাকে বিন্দুমাত্র খাটো না করেই এই কথা বলা অতিশয়োক্তি হবে না, যে নোবেল প্রাপকদের তালিকা নিয়ে দীর্ঘস্থায়ী বিতর্কের নজির রয়েছে দেশ-বিদেশের বিজ্ঞানীদের মধ্যে, ব্যতিক্রমী হলেও তাই বিতর্ক পিছু ছাড়েনি নোবেল প্রাইজের। আমাদের একান্ত আপন সত্যেন্দ্রনাথ বসু অথবা জগদীশচন্দ্র বসু যে যোগ্য হওয়া সত্ত্বেও নোবেল প্রাইজ থেকে বঞ্চিত হয়েছেন, একথা শুধু আমরাই নই, সারা পৃথিবীর বিজ্ঞানীরা মনে-প্রাণে জানেন এবং মানেন। এমনতর অভিযোগ যে ফিল্ডস মেডালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সেকথা সগর্বে স্বীকার করেন প্রায় সমস্ত গণিতবিদ।

আন্তর্জাতিক গণিত সংস্থান (International Mathematical Union) প্রতি চারবছর অন্তর এই ফিল্ডস মেডাল প্রদান করে থাকেন চল্লিশ বছরের কমবয়সী সুযোগ্যতম গণিতবিশারদদের। দেশ-জাতি-ধর্ম-বর্ণের তুচ্ছ সীমারেখাকে সম্পূর্ণ অস্বীকার করে পুরস্কারপ্রাপকদের বেছে নেওয়া হয়, কেবলমাত্র গণিতবিদ্যায় তাঁদের কালজয়ী অবদানের তাৎপর্যের কথা মাথায় রেখে। ১৯৩৬ সালে সূচনা হওয়ার পর থেকেই নিজ বৈশিষ্ট্যে গণিতবিশ্বে কুলীনতম হয়ে উঠতে সময় লাগেনি এই দুর্লভ সম্মানের। কেবলমাত্র বিশুদ্ধ গণিতে প্রবাদপ্রতিম দক্ষতা ও যুগান্তকারী অবদান রাখাই বিবেচ্য হয়ে থাকে এই পুরস্কার প্রদানের ক্ষেত্রে। আমাদের সমাজজীবনে চলার পথে সাহায্য করে মূলত ফলিত গণিত, কিন্তু ফলিত গণিতের গুরুত্ব অপরিসীম হলেও তার প্রয়োগপ্রাচুর্যের সম্ভাবনার প্রাণশক্তি লুকিয়ে রয়েছে বিশুদ্ধ গণিতের ধ্রুপদী ও বিমূর্ত গবেষণার অন্তহীন গভীরতা ও বৈচিত্রের মধ্যে। বিশুদ্ধ গণিতের আপাত জটিল দুরূহতা নয়, তার মর্মস্পর্শী সৌন্দর্যই তাই বিবেচিত হয় ফিল্ডস মেডাল প্রাপকদের চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে। চল্লিশ বছরের বেড়াজাল নিয়ে মনোযোগী পাঠকের ভ্রূকুঞ্চন স্বাভাবিক হলেও, তরুণ গণিতসাধককে উৎসাহিত করাই একমাত্র উদ্দেশ্য এক্ষেত্রে।
এক ঝলকে ফিল্ডস মেডাল : জানা, অজানা দু’চার কথা—
- প্রদান করা হয় বিশুদ্ধ গণিতে, অনূর্ধ্ব চল্লিশ গবেষকরাই কেবল হতে পারেন সম্ভাব্য প্রাপক।
- ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে সূচনা হয় এই পুরস্কারের। প্রথমবারের বিজয়ীরা ছিলেন লার্স আলফর্স এবং হেসে ডগলাস।
- পুরস্কার প্রদানের দায়িত্বে রয়েছে International Mathematical Union। চার বছর অন্তর আয়োজিত International Congress of Mathematicians নামের অনুষ্ঠানে।
- কেবলমাত্র একজন মহিলা গণিতজ্ঞকে ফিল্ডস মেডেল প্রদান করা হয়েছে এত বছরের ইতিহাসে। তিনি ইরানের প্রতিভাময়ী মারিয়ম মির্জাখানি, সম্মানিত হয়েছেন ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে, সিওল ICM অনুষ্ঠানে।
- মোট ৬০ জন গণিতজ্ঞ এই দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হয়েছেন। এই তালিকায় নেই কোনও ভারতীয় নাগরিক, তবে রয়েছেন জন্মসূত্রে ভারতীয় দুই প্রতিভা : মঞ্জুল ভার্গব ও অক্ষয় ভেঙ্কটেশ।
‘‘চালসে পড়লেই আলসে’’— এমন কোনও কথা বলতে চাওয়া হচ্ছে না আদৌ এখানে! বস্তুতপক্ষে, আর পাঁচটা পেশার মতোই গণিতচর্চার ক্ষেত্রে বয়স কেবলমাত্র একটা সংখ্যাই, আলাদা কোনও গুরুত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই তার ওপর, বিশেষ করে যদি প্রতিভা ও সম্ভাবনার বিচার করতে হয়। তবে একইসঙ্গে একথাও সর্বজনস্বীকৃত সত্য যে, একজন গণিতবিদ তাঁর সর্বোত্তম সৃষ্টি স্থাপনের সর্বোচ্চ সম্ভাবনার সবথেকে কাছাকাছি অবস্থান করেন তরুণ বয়সেই। অনস্বীকার্যভাবেই এর ব্যতিক্রম রয়েছেন একাধিক, কিন্তু তাঁদের বিরল উপস্থিতি কেবলমাত্র এই সাধারণ নিয়মটিকেই মোটের উপর স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। চল্লিশ বছরের এই সীমারেখা তাই প্রতিভাবান গণিত গবেষককে নিরুদ্যম করে না, বরং তাঁকে অনিবার্যভাবেই অনুপ্রাণিত করে প্রবলতর উৎসাহ ও অধ্যবসায় নিয়ে গণিত-সাগরে অবগাহন করতে।
এখানে আরও বলে রাখা ভাল, চল্লিশ পেরনো গণিতের গবেষকদের জন্য রয়েছে আরও অনেক পুরস্কার ও স্বীকৃতি, যেগুলি প্রত্যেকটিই নিজের গুরুত্ব ও মর্যাদায় যথার্থ অর্থেই গগনচুম্বী। সামগ্রিক গবেষণার গুরুত্ব বিবেচনা করে প্রদান করা হয় যে ‘‘আবেল প্রাইজ’’ (নামে নোবেলের সঙ্গে মিল লক্ষ্যণীয়!) তাকে গুরুত্ব না দেওয়ার মতো ভুল কোনও গণিতবিদই করেন না, ভবিষ্যতেও করবেন না তর্কাতীতভাবেই। তবুও গণিতজগতের সর্বোচ্চ সম্মান হিসাবে প্রশ্নাতীতভাবে ফিল্ডস মেডাল-কে চিহ্নিত করতে দেরি করেন না তাঁদের প্রায় কেউই। এতদূর পড়ে ওঠার পর যে অনিবার্য প্রশ্নটি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে আমাদের মনে, সেটি হল ফিল্ডস মেডাল প্রাপকদের তালিকায় কি রয়েছেন কোনও ভারতীয়? দুর্ভাগ্যজনক হলেও একথা সত্য, যে এখনও পর্যন্ত কোনও ভারতীয় নাগরিক এই দুর্লভ সম্মানের অধিকারী হননি। যদিও এই প্রসঙ্গে মঞ্জুল ভার্গব এবং অক্ষয় ভেঙ্কটেশ— এই দুই গণিতজ্ঞের নামোল্লেখ করতেই হয়— যাঁদের সঙ্গে ভারতের আক্ষরিক অর্থেই নাড়ীর টান রয়েছে।

ফিল্ডস মেডালজয়ী এই দুই কৃতী গণিতজ্ঞ তাঁদের অনন্যসাধারণ গবেষণার মধ্য দিয়ে আমাদের নিরন্তর অনুপ্রাণিত করে চলেছেন। ২০১৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিওলে যে বিশেষ অধিবেশনে শ্রী মঞ্জুল ভার্গব ফিল্ডস মেডালের সম্মানে ভূষিত হয়েছিলেন, সেখানে সশরীরে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল এই প্রতিবেদকের। ভারতীয় নাগরিক না হলেও, প্রফেসর ভার্গবের সম্মানিত হওয়ার খবর যে ভারতীয় গণিতমহলে এক বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ আলোড়ন তৈরি করেছিল, এ সত্য আঁচ করতে গবেষণার দরকার পড়ে না আদপেই।
ভারতীয় গণিত নিয়ে যে কোনও আলোচনায় অবিসংবাদিতভাবে উঠে আসে যে প্রবাদপ্রতিম বিস্ময় প্রতিভার কথা তিনি নিঃসংশয়ে শ্রীনিবাস রামানুজন। ভারতীয় এই বিরলতম সাধক আমৃত্যু প্রথাগত গণিত পড়াশোনা ছাড়াই অন্তঃস্থিত মননের গভীরতায় উদ্ভাসিত করেছেন গণিতশাস্ত্রের বিচিত্রতর শাখাপ্রশাখা। তবুও, শ্রেষ্ঠত্বের শিরোপায় ভূষিত হবেন কোনও ভারতীয় নাগরিক— ভারতবাসী হিসাবে আমাদের এই আকাঙ্ক্ষা নিঃসন্দেহে স্বাভাবিক। গণিতবিদরা গবেষণায় মগ্ন থাকেন সৃষ্টির আনন্দে, স্বীকৃতি পাওয়া – না পাওয়া বিশেষ বিচলিত করে না তাঁদের প্রায় কাউকেই। এমনই কোনও এক সৃষ্টিশীল গণিতবিদের হাত ধরে ভারতে আসবে বহুপ্রার্থিত ফিল্ডস মেডাল, এমন আকাঙ্ক্ষা আমাদের নিরন্তর। হয়তো বা সে আশা পূর্ণ হবে অদূর ভবিষ্যতের কোনও এক ঝকঝকে সুন্দর গণিতময় সুপ্রভাতে।
ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Indiatimes, Abelprize.no
ভিডিও সৌজন্য: abelprize.no এবং Youtube
দেবমাল্য সাঁই গণিত-গবেষক। ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স, বেঙ্গালুরুতে তিনি পোস্ট ডক্টরাল ফেলো হিসেবে কর্মরত। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতে স্নাতক দেবমাল্য জগদীশ বসু ন্যাশনাল সায়েন্স ট্যালেন্ট সার্চ প্রোগ্রামেও অংশ নিয়েছেন। গণিত ও বিজ্ঞান বিষয়ত লেখালেখি তাঁর পছন্দের। আর ভালোবাসেন ফুটল। মোহনবাগানের একনিষ্ঠ সমর্থক।