মাঝে-মাঝে ভাবি শান্তিনিকেতনে এখন ‘অন্য হাট’-এর চেহারা দেখলে শ্যামলীদি কী বলতেন? ধুলো ধোঁয়া ভিড় বিস্তার— সব মিলিয়ে সে-হাটে এখন নরক গুলজার। দেখেশুনে শ্যামলীদির মুখে নিশ্চিত কোনও কথাই যোগাত না। আজ থেকে বছর-পঁচিশ, কি তারও আগে শ্যামলীদি যখন এই হাটের পরিকল্পনা করেছিলেন, তখন কি এই পরিণামের কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবতে পেরেছিলেন? ভাবতে পারলে কি আরও দূরে সরে যেতেন তিনি, দুর্গমতম কোনও জায়গায়, ধুলো উড়িয়ে বাবুদের গাড়ি যেখানে পৌঁছয় না, সপ্তাহান্তে তাঁদের ফুর্তির ফোয়ারা যেখানে উচ্ছল হয়ে ওঠে না?
অথচ এই হাট যখন শুরু হয়েছিল তখন সত্যিই ভারি নিভৃত নির্জনতা ছিল এই সোনাঝুরিবনে। আসতে হত পায়ে-পায়ে অনেকটা রাঙামাটির পথ পেরিয়ে। আদি যুগে এই হাট হত প্রতি শনিবার, দুপুর পেরিয়ে, খোয়াইয়ের ধারে। ছোট্ট একটুখানি জায়গা, দীর্ঘ গাছের ছায়ায় তা নরম হয়ে থাকত। এখানে আসতেন, পসরা সাজিয়ে বসতেন তাঁরাই, যাঁরা স্বয়ং হাতে-কলমে কোনও-না-কোনও কাজের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। নিজের হাতে কিছু-না-কিছু বানাতেন তাঁরা। আর তাঁদের সন্ধানে তখন ঐ রাঙামাটির পথ উজিয়ে আসতেন মুষ্টিমেয় অনুরাগীর দল। শ্যামলীদির উদ্দেশ্যই ছিল তা-ই, যে এখানে একদল শিল্পী-কারিগর তাঁদের কাজ নিয়ে আসবেন, অনুরাগীরা তা দেখবেন, পছন্দ হলে সংগ্রহ করবেন, আর এভাবে তাঁদের মধ্যে প্রচলিত ঘেরাটোপের বাইরে এক বিকল্প সংযোগের সম্ভাবনা সৃষ্টি হবে, তৈরি হয়ে উঠবে এক বিকল্প সংলাপের অবসর।

আজকের ‘অন্য হাট’-এ এই ভাবনার সুদূরতম কোনও রেশও কি চোখে পড়া সম্ভব? শিল্পী বা কারিগরদের কোনও স্থানই আজ সেখানে নেই। বদলে তা দখল করে নিয়েছে রাজ্যের দালাল আর দোকানদার, নানা কিসিমের মধ্যস্বত্বভোগী সেখানে আজ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। ক্রেতা হিসেবে যারা আসছে তারাও দালাল বা শহুরে কোনও বুটিকের মালিক, এখান থেকে গাড়ি বোঝাই করে তারা ‘মাল’ তুলে নিয়ে যাচ্ছে শহরে, ঢের বেশি দামে বিক্রির জন্য। ক্রমে হয়তো গাছপালা সব কেটে, খোয়াই ধ্বংস করে এখানে গড়ে উঠবে মার্কেট কমপ্লেক্স, একদা যেমন খোয়াইকে বেড় দিয়ে হাউসিং কমপ্লেক্স তৈরির পরিকল্পনা ছিল, রীতিমতো আদালতে হলফনামা দিয়ে জানানো হয়েছিল খোয়াই বলে কোনও কিছুর অস্তিত্বই নাকি সেখানে নেই। তখন সে-অনাচার রুখে দেওয়া গিয়েছিল শ্যামলীদির মতো আরও অনেকের সক্রিয়তায়। কিন্তু আজ? নিকটাগত এই ভবিষ্যৎ রুখবে কে?
মাত্র সিকি শতকেই ‘অন্য হাট’-এর এই বিপর্যয় দিয়ে বোধহয় আজকের এই সময়কেও খানিকটা বুঝে নেওয়া যায়। যেমন, শিল্পী-কারিগররা তো দূর অস্ত, এমনকী অল্প পুঁজির কারবারি যারা এ হাটে ‘দাদা’ ধরে কোনক্রমে আজও টিঁকে আছে, মার্কেট কমপ্লেক্স হলে তাঁরা স্থানচ্যুত হবেন। স্থান পাবেন তাঁরাই যাঁদের ওই কমপ্লেক্সে দোকান সাজানোর পুঁজি আছে। এভাবে ছোট-ছোট সমস্ত জায়গাই ক্রমে বৃহৎ পুঁজি দখল করে নেবে। গ্রামে আর সেদিন কোনও হাট বসবে না, কারণ গ্রামে উৎপাদিত পণ্য আর গ্রামে থাকবে না। সরাসরি উৎপাদন ব্যবস্থায় বৃহৎ পুঁজি আজ থাবা বসিয়েছে। পণ্য সব তারাই কিনে নেবে, তারাই বিক্রি করবে, তার জন্য দরকারে তারা যে দেশের আইন পর্যন্ত বদলে দিতে পারে, কৃষি আইনে তার প্রাথমিক মহড়া হয়ে গেছে।

এক্ষেত্রে আজ তারা পিছু হঠলেও অদূর ভবিষ্যতে তারা ফের ফিরে আসবে। শহরে পাড়ার ছোট-ছোট দোকানগুলো ইতিমধ্যেই ধুঁকছে। বৃহৎ ভার্চুয়াল দোকানে প্রয়োজনের সব কিছুই এখন সুলভ, অর্ডার দিলেই ‘আলপিন থেকে এলিফ্যান্ট’ পর্যন্ত যদি সরাসরি আপনার ঘরে পৌঁছে যায় তবে আপনি কেন আর বাইরে বেরোবেন! এমনকী প্যানডেমিকের ধুয়ায় দোকান-বাজার সব কিছু বন্ধ রেখে তারও মহড়া যে হয়ে যায়নি, তারই বা নিশ্চয়তা কোথায়? এতদিন যারা অনলাইন কেনাকাটায় তেমন সড়গড় ছিলেন না, বলুন তো এই দু’বছরে তারা কি এতে বেশ খানিকটা অভ্যস্ত হয়ে যাননি? বা ধরুন, কিছুকাল আগে পর্যন্ত যে-সমস্ত বিল তারা অকুস্থলে গিয়েই পেমেন্ট করেছেন, উপায়ান্তর না দেখে আজ কি তার অনেকটাই অনলাইনে সারছেন না?
বাড়ির সামনে ফ্ল্যাটের বাসিন্দা এক পরিবারের চার সদস্য সত্যি সত্যি গত দু’বছরে নিজেদের ফ্ল্যাটের বাইরে প্রায় পা রাখেননি, দিনের মধ্যে চোদ্দোবার তাদের দরজায় কড়া নেড়েছে কোনও-না-কোনও অনলাইন সার্ভিসের ছেলেরা। নিজেদের তাঁরা সংক্রমণের হাত থেকে বাঁচাচ্ছেন ঠিকই, কিন্তু তাঁদের বাঁচাতে গিয়ে এই ছেলেরা তো সংক্রমিত হতে পারে, সে-কথা কি তাঁরা একবারও ভেবেছেন? নাকি এরা রোবট, সংক্রমিত হওয়ার ভয় নেই? নাকি সত্যি একদিন এই কাজ করবে রোবটেরা? আমরা জানি না।
বয়স্ক লোকেরা দেখবেন প্রায়ই বলেন যে একটা জিনিস হাতে নিয়ে না দেখে বুঝব কী করে তা কেমন? অবশ্য হাতে নিয়ে দেখলেই যে সব সময়ে একটা জিনিশের ভালো-মন্দ বোঝা যায় তা নয়, তবু নিছক ছবি দেখে সে-সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার চেয়ে হাতে নিয়ে দেখাটা ঢের নিশ্চয়তার। প্রাথমিক বোধে স্পর্শের একটা গুরুত্ব আছেই। যেমন আছে ঘ্রাণের, যে-কোন জন্তুই কোন জিনিশ সম্পর্কে প্রাথমিক সিদ্ধান্ত নেয় শুঁকে, এমনকী আমরাও অনেক সময়ে তা করি। তবে কি এ সমস্ত ইন্দ্রিয়ের ব্যবহার একদিন কমে যাবে, বা তার দরকারই থাকবে না? ক্রমশ প্রকৃতিচ্যুত আমরাও হয়ে উঠব এক-একটি রোবট?
যন্ত্রই আজ সব কিছু অধিকার করে নিচ্ছে, মানুষের প্রয়োজন ফুরিয়ে আসছে ক্রমে। মানুষী শ্রমের অনেকটাই অনেক কাল যন্ত্র নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে, এর পর ‘আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স’ এসে গেলে যন্ত্র চালানোর জন্যেও মানুষের বুদ্ধির আর তেমন কোন প্রয়োজন থাকবে না মনে হয়। যন্ত্রের চাবি কার কাছে, সেটাই তখন গুরুত্বপূর্ণ।

শ্যামলীদি এই সব নিয়ে অনেক আগে থেকে ভেবেছেন, এই নিয়ে ছবি এঁকেছেন, নিজের খরচে ছোট-ছোট বই প্রকাশ করেছেন, নিজেই তা প্রচার করেছেন। এবং তার জন্য এদেশের প্রান্তে-প্রত্যন্তে ঘুরে বেড়িয়েছেন। যেখানেই দেখেছেন দু-চারজন লোকও বিকল্পের সন্ধানে একজোট হয়েছে— সে একটা স্কুল হতে পারে, নির্দিষ্ট বিষয়ে কোন পত্রিকা হতে পারে, একটা চিকিৎসালয় হতে পারে, কৃষিখামার হতে পারে, বা হতে পারে প্রকৃতিবাদী কোন আন্দোলনের সূচনা— সেখানেই দৌড়ে গেছেন তিনি, যোগ দিয়েছেন সেখানে, মতবিনিময় করেছেন, এবং একই ধরনের কাজ অন্যত্র যারা করছেন পরস্পরের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ ঘটিয়ে দিয়েছেন। প্রকৃত অর্থেই শান্তিনিকেতনের মেয়ে ছিলেন তিনি, নিজের ঘরের চৌহদ্দি পেরিয়ে বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগের সূত্র খুঁজে নিতে কোনদিন তাঁর কোন অসুবিধে হয়নি।
আসন্ন যে-ভবিষ্যতের আশঙ্কায় তিনি একদা ছুটে বেড়িয়েছেন, আজ যখন তা ক্রমেই বাস্তব হয়ে উঠেছে, তখন আমরা তাঁর উত্তরাধিকার বহন করতে পারব কি না তা আমাদেরই ওপর নির্ভর করছে।
*ছবি সৌজন্য: Tripadvisor, shutterstock
সন্দীপন ভট্টাচার্য বাংলা বই প্রকাশনার সঙ্গে যুক্ত। যুক্ত অর্থে বইপ্রকাশের অনেকগুলো পর্যায় তিনি নিজের হাতেই করেন। প্রুফ দেখা থেকে প্রচ্ছদ তৈরি পর্যন্ত। আর অল্পবিস্তর লেখেন, অনুবাদ করেন, ছবি আঁকেন। নিজের সম্পর্কে বলতে অস্বস্তিবোধ করেন।
5 Responses
খুব সুন্দরভাবে খাঁটি কথাগুলো বলেছেন সন্দীপনবাবু। রাস্ট্র বা সমাজ যে উৎসাহ নিয়ে বিজ্ঞানের অপব্যবহারের কাজে উঠেপড়ে লেগেছে তার সিকিভাগ উৎসাহও যদি প্রকৃতি আর মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে খরচ করতো তাহলে হয়তো মানুষ নামের জন্তুটি এই পৃথিবীতে আরও কয়েক হাজার বছর সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকতো।
প্রশ্নটা মনে হয় সত্যিই প্রাসঙ্গিক “বিজ্ঞান! আশীর্বাদ না অভিশাপ!”
খুব সুন্দরভাবে খাঁটি কথাগুলো বলেছেন সন্দীপনবাবু। রাস্ট্র বা সমাজ যে উৎসাহ নিয়ে বিজ্ঞানের অপব্যবহারের কাজে উঠেপড়ে লেগেছে তার সিকিভাগ উৎসাহও যদি প্রকৃতি আর মানব সভ্যতাকে বাঁচিয়ে রাখতে খরচ করতো তাহলে হয়তো মানুষ নামের জন্তুটি এই পৃথিবীতে আরও কয়েক হাজার বছর সুস্থ্যভাবে বেঁচে থাকতো।
প্রশ্নটা মনে হয় সত্যিই প্রাসঙ্গিক “বিজ্ঞান! আশীর্বাদ না অভিশাপ!”
বিজ্ঞান অভিশাপ হতে পারে না। কিন্তু বিজ্ঞান কে যথেচ্ছ ভাবে ব্যাবহার করলে বিজ্ঞান এর কি দোষ ? মোবাইল ফোন থেকে ইন্টারনেট পর্যন্ত এই যে যোগাযোগের এতো বিশাল আয়োজন, সেটা কার হাতে পড়ছে, কে কিভাবে ব্যাবহার করছে সেটাই আসল। আর, শান্তি নিকেতন আর হাট নিয়ে বলা বৃথা। কলকাতা বইমেলায় দেখুন না ফুড স্টল , চুড়ি বেলোয়ারী জিনিস, ইমিটেশন গহনা, আচার ইত্যাদি’র দিকে তাকালে তো মনে হবেনা পুস্তক মেলা না সবলা মেলা।রুচি… দাদা …রুচির অভাব। কুরুচি, নিম্ন রুচি ছেয়ে গেছে পুরো সমাজ সংস্কৃতি ভাষা খাওয়া সব কিছু তে। সোনাঝুরি বা বাদ যাবে কেন?
শ্যামলী খাস্তগীরের বাবা প্রথিতযশা শিল্পী সুধীর রঞ্জন খাস্তগীর। বিশ্বভারতীর চীনা ভবনের প্রতিষ্ঠাতা তান উন-শানের পুত্র তান লী’র স্ত্রী তান শ্যামলী খাস্তগীর পরিবেশবিদ।
এই লেখা যদি তাদের কাছে যারা এখনো লড়ছে তবেই সার্থক