Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

প্যানডেমিক ডায়রি: পর্ব ৬

Cyclone Amphan
চারিদিকে জল থৈ থৈ করছে
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

আগের গল্প পড়তে: [] [] [] [] []

উড়ান 

ভোরবেলা স্কুটির ঘটঘট আওয়াজে চমকে উঠলাম। কাল কেটেছে আমফানের রাত। যদ্দূর দেখা যায় জল থৈ থৈ। আমার সিঁড়ির প্রথম ধাপ জলে ডুবে। আর এক ধাপ জল উঠলেই একতলা জলমগ্ন। জলঢোঁড়া সাপ মহানন্দে ঘোরাফেরা করছে চাতালে।
– দিদি, ঠিক আছ তুমি?
– মণি! কীভাবে এলে?
– আর বোলো না। ঘরে জল ঢুকেছে। খাটের উপর বাসনকোসন, আলমারি সব তুলেছি।
– তোমার বাচ্চা?
– ক্লাবে দিয়ে এলাম। ক্লাবঘর উঁচু। ওখানে খিচুড়ি পাবে দুবেলা।
মণির চোখে উৎকণ্ঠা। দোতলা থেকেই চেঁচিয়ে বললাম,
– আজ ঘর ঝাড়পোঁছের দরকার নেই। কিছু লাগবে তোমার? ওষুধ টষুধ?
– হাজার টাকা ধার দেবে দিদি? তেল ভরব স্কুটিতে।
জলঢোঁড়া সাপটা মণির স্কুটির আওয়াজে পালাল। মণিকে কখনও এত উদভ্রান্ত দেখিনি।
– বুড়ো বাপ মা মরে যাবে গো দিদি। ঝড়ে ঘর ভেসে গেছে। ভাইবউটা পোয়াতি।
– সে কী! তুমিই তো বললে ভাই তোমার সব জমিজমা কেড়ে নিয়েছে। তোমার টাকায় কেনা। ফের  ধার দেবে?
– যাব।
মণির গলার সুরে জেদ। ফের চমকে উঠলাম।

– যাবে? তুমি কি পাগল মণি? বুকসমান জল বসিরহাটে। ট্রেন চলছে না। লকডাউনে কোনও গাড়িঘোড়া নেই।
– ভ্যান ট্যান লাগবে না। স্কুটি নিয়েই যাব।
বিদ্যুতবিহীন কাল রাত থেকে এমনিই দরদর করে ঘামছি। মণির উত্তর পেয়ে কালঘাম ছুটে গেল।
– তোমার মাথাটা গেছে। ডুবে মরবে।
– এখনও ঠিক আছে দিদি। টাকাটা দিলে ভালো হয়। তোমার জন্য নিচের কল থেকে দু’বালতি জল তুলে দিই?
এই নাছোড়বান্দা স্বভাবের জন্যই মণিকে আমার ভাল লাগে। যখন স্কুটি কিনেছিল ব্যাঙ্ক থেকে ধারদেনা করে, গ্যারান্টার হয়েছিলাম।
– কী হবে মণি? তুমি লোন শোধ করতে না পারলে?
মণির চোখে বিজলির চমক দেখেছিলাম।
– বদনামের ভয় পাচ্ছ? মণি বেইমান নয় যে পিছন থেকে ছুরি মারবে। না খেয়েও লোন শোধ করব।
পঁচিশ বছরের এই চকচকে ইস্পাতকে বাগ মানাতে পারেনি মণির বর বাপি। লাল রঙের স্কুটিটা যেদিন কিনে ঘরে তুলেছিল, সেদিনই বাপি ঘর ছেড়ে চলে যায়।
– কাজটা ভাল করনি মণি। বাপিকে আটকানো উচিত ছিল। ও রাগ করেছে বলে তুমিও গোঁ ধরে থাকবে?
– কুঁড়ের ধার একটা। শুধু ঘরে শুয়ে থাকে আর আমার পয়সায় খায়।
মণির চোখে জল চিকচিক করছিল।
– কত ভাল ইলেকট্রিকের কাজ জানে তবু খাটবে না, কিছু না। নয়তো ইলেক্টিরি লাইনে কম পয়সা?

Cyclone Amphan
বুড়ো বাপ মা মরে যাবে গো দিদি। ঝড়ে ঘর ভেসে গেছে…

চুপ করে ছিলাম। আগুনে ঘি দিতে নেই।
– আমাকে তো সংসারটা টানতে হবে বলো। স্কুটিটা কিনেছি বলে দশবাড়ি কাজ করতে পারছি। ছেলেটার পড়ার খরচ, গ্যাস, ঘরভাড়া, নিজের কিছু শখ আহ্লাদ আছে। কোনও খরচাই দেয় না।
– আমার চেম্বারে একটা এসি বসাতে হবে। গরমে রোগীদের কষ্ট হয়।  বাপিকে আসতে বোলো তো।
মণি চোখ উল্টে বলেছিল,
– তাকে কোথায় পাব! দেখগে কোথায় বসে মাল খেয়ে ফুর্তি করছে! গুণের তো শেষ নেই।
মণির নির্লিপ্তভাব চোখমুখে ফুটে উঠেছিল। ঝাঁটা ফেলে দিয়ে তারপর আমার কাছে এসে নিচু গলায় বলেছিল,
– আসলে হিংসে । বুঝলে? ওকে বাদ দিয়েই যে সব চালিয়ে নিচ্ছি একা।
– যাহ, হিংসে হতে যাবে কেন? ঠোকাঠুকি কোন সংসারে না হয়..
– না গো, আজ এক মাস হল আলাদা। তারাপীঠে গেছে। অন্য মেয়েছেলে আছে বোধহয়। আমিও দেখব কত জেদ।

কাজ হয়ে গেলে সাবান দিয়ে হাতপা ধুয়ে মণি প্রসাধন করত আমার চেম্বারের আয়নায়। ওটুকুই ওর বিলাসিতা। সিঁদুরের টিপ, গোলাপি লিপস্টিক। সিঁথিতে মোটা করে ভ্যাদভেদে সিঁদুর। সোপ অপেরার নায়িকাদের মতো। এখন মণির সালোয়ার কামিজ জলে ভিজে চুপচুপে। কোনও আপত্তি শুনল না। দু’বালতি জল তুলে, পাউরুটি সেঁকে, চা করে মুখের সামনে দিয়ে গেল।
– এক কাপ খেয়ে যাও মণি। এদ্দূর যাবে!
– সময় নেই গো দিদি।
মণির স্কুটি স্টার্ট দিয়েছে জলের মধ্যে ঢেউ তুলে। হঠাৎ দেখলাম বাপিকে। প্যান্ট গোটানো হাঁটু অবধি। মাথা গামছায় জড়ানো। গায়ের টি শার্ট জলে জবজবে। ওদের বাক্যালাপ যে ক্রমশ চড়া সুরে উঠবে, সে আশংকা সত্যি হল।
– একদম না।
– আরে, তোর সঙ্গেই তো যাব।
– উঁহু! তোমার মতলব ভাল না, আমার কাছে টাকাকড়ি কিচ্ছু নেই।
– ভুল বুঝছিস। আমার কাজ আছে। সত্যি!
– মিথ্যুক! ফালতু বগ্গাবাজি করছ। এই তুমি যাবে না চিল্লাব?
– দ্যাখ বউ, না জেনে চেঁচাস না। ঝড়ে যেমন গাছ পড়েছে, তেমনই কারেন্টের পোল ভেঙেছে । অগুন্তি জায়গায় ট্রান্সফরমারে আগুন লেগেছে। এখন যদি সেগুলো মেরামত না করেই কারেন্ট দেওয়া হয় তাহলে শক খেয়ে মুড়িমুড়কির মতো মানুষ মরবে। লোক দরকার এখন।
মণির দু’চোখে আগুন জ্বলে উঠল।
– ও হো হো! ভারী আমার কাজের লোক রে! কেন, গত বছর যখন বলেছিলাম, বসিরহাটের ইলেক্টিরি বোর্ডে লোক নেবে, গেসলে? তখন তো বললে গেরামের লোকের কারেন্ট লাগে কীসে?

Tsunami of gushing water
গঙ্গার চোখ টিভির দিকে। বাইরে প্রবল ঝড়

রাগে খোঁপা খুলে মণির কোঁকড়ানো চুল ছড়িয়ে পড়েছে পিঠে। হেলমেট পরতে পরতে ব্যঙ্গের সুর টেনে বলল,
– হ্যাঁ গো, গেরামে আর কারেন্ট লাগে কীসে। চাষের ডিপ টিউবওয়েল, শ্যালো পাম্প তো  বড়লোকদের ফুঁয়ে চলে। বাচ্চারা পড়ে ঘুঁটের বিজলিবাতিতে। যাও যাও।
– সে তুই যতই রাগিস না কেন, আজ আমাকে নিয়ে তোকে যেতেই হবে। ইন্টারনাল ওয়্যারিংয়ের কাজ। সবাই জানে না। বসিরহাট থেকে আজ ফোন করেছিল বড় অফিসার। চাকরিটা ছেড়ে দিলেও ঠিক মনে রেখেছে। বলল, বাপি একবার আসতে পারবে, বড্ড দরকার। লাখ লাখ লোক অন্ধকারে। ‘ইন্টারনাল ওয়্যারিং!’ শব্দটা গেঁথে গেল। 

তারপরই দেখলাম জল কেটে লাল স্কুটি ভোঁ করে ছুটে বেরিয়ে গেল। মণিকে দুহাতে জড়িয়ে পিছনের সিটে বাপি। মাথার উপর ফ্যানটা হঠাৎ ঘুরে উঠল আর টিউবলাইটটা জ্বলে উঠল। এই বিস্তীর্ণ ধ্বংসের মধ্যেও দু’দিনের মাথায় বিদ্যুৎ এল শেষ পর্যন্ত? ছুটে গিয়ে পাম্প চালালাম। একফোঁটা জল ছিল না। অলক্ষে থাকা আমাদের পাড়ার বাপিদের মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। সো প্রিভিলেজড উই আর।   সমাজের প্রতিটি মানুষের ইন্টারনাল ওয়্যারিংটা যদি এভাবেই ঠিক করা যেত!

সুন্দরী 

তাইলে তুমি আমায় বাড়ি যেতেও দিবা না?
বাড়ি?
হো হো করে হেসে উঠল লোকটা।
– বাড়ি থাকলে তো ফিরবি। সব উড়ে যাচ্ছে ঝড়ে। তাছাড়া তরে নেবে কে?
শ্যামবর্ণা তণ্বীর চোখে ভয়। সিঁটিয়ে গেল সরাইখানার দেওয়ালে।
আমি তোমার বিয়া করা বউ নই?
এরে বিয়া কে বলল? মালাবদল আর সিন্দুর দিলেই বিয়া? তুই তো একটা পোকায় কাটা মাইয়া!
গঙ্গার চোখে আর জল নেই। দুমাস ধরে ঝরতে ঝরতে শুকিয়ে খটখটে। এই লোকটার জন্য গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে এল সে! পাক্বা প্রেমের অভিনয়! বেচে দেওয়ার তালে। জেনে ফেলেছে গঙ্গা। প্রেমিক না ছাই! আড়কাঠি। ফিরবার পথ নেই! তার গা শিরশির করছে। লুকিয়ে ভোররাতে বজ্জাত লোকটার মোবাইল থেকে মেসেজ পাঠিয়েও দিয়েছে বোন যমুনার কাছে। যমুনা কলকাতায় এক বাড়িতে খাওয়া পরার কাজ করে। তারা মানুষ ভাল। পুলিশকে নিশ্চয়ই খবর দিয়েছে এতক্ষণে। না দিলে? গঙ্গার বুক ধড়ফড় করে উঠল।

তুমি আমায় এমনভাবে ঠকাইলা!
গঙ্গা চিৎকার করে উঠতেই লোকটা এসে ওর মুখ চেপে ধরল।
চিল্লাবি তো লাশ ফেলে দেব।
এই সেই প্রেমিক যে একটা ঘর, বিছানায় নতুন চাদর, আলনায় নতুন সালওয়ার কামিজের স্বপ্ন দেখিয়েছিল! দেবের মতো পাগলু ড্যান্স দেখাবে আর মাংসভাত খাওয়াবে বলে শপথ করেছিল! গঙ্গা  আঠেরো বছরের সুন্দরী। তাজা, চিকণ। শ্যাম্পুর অভাব। তাও রেশমি চুল। গায়ে শেফালির গন্ধ। টিকোলো নাক। দোয়েলের স্বর। এমন সরেস সুন্দরীকে বেচে কত টাকা পাওয়া যাবে সেই স্বপ্নে মশগুল ছিল পথের প্রেমিক। সমস্যা বাধাল আচমকা লকডাউন। মার্চের বাইশ থেকে। জনতা কার্ফু। নয়তো এতক্ষণে মুম্বই দিয়ে আসার কথা ছিল মেয়েটাকে। সব ভেস্তে গেল। সেই থেকে এই সরাইখানায় কাটছে গঙ্গার জটাজূটময় জীবন। তালাবন্ধ শহরে দিনরাত এই লোকটার সঙ্গে অসহ্য লাগে। এর থেকে মরে যাওয়া ভাল। হাতের সামনে কাটারি পেলে নিজের গলায় পোঁচ দিত গঙ্গা। 

Girl trafficking
সরেস সুন্দরীকে বেচে কত টাকা পাওয়া যাবে সেই স্বপ্নে মশগুল ছিল পথের প্রেমিক

বাড়ি ফিরেই বা হবে কী? বাবার লোভে চকচক চোখ একদম এই লোকটার মতোই।  যমুনার মতোই গঙ্গাকেও একবাড়িতে কাজে দিয়েছিল। সেখানে বুড়ো মালিকটা অসভ্যতা করত। বাবা মাস গেলে শুধু মাইনে আনতে যেত। কোনওদিন তার একটা অনুযোগও কানে তোলেনি। কন্যাশ্রীনা কিসের জন্য টাকা পাওয়া যাবে শুনে তাকে কাজ থেকে ছাড়িয়ে আনল বাবা। হোটেলের ঘরে টিভিতে  দেখাচ্ছে বিরাট এক ঘূর্ণিঝড় ধেয়ে আসছে তাদের পাথরপ্রতিমার দিকে। মনখারাপ ভাইটার জন্য। বড্ড ছোট। আর মায়ের জন্যও। ঝড়ে ঘর ভেসে গেলে আর কী বাঁচবে মা, ভাই! কিন্তু সুন্দরীদের লড়াই কাকে বলে তা জানে তারা। জঙ্গলের মেয়েরা। জান দেবে তবু মান দেবে না। 

আয়লার সময় দেখেছে গঙ্গা। তখন সে ছিল নবছরের বালিকা। শিকড় দিয়ে ঝড়ের দাপট থামিয়ে দিয়েছিল সুন্দরীরা। সঙ্গে ছিল গেঁওয়া। আয়লার দস্যুতাকে রোধ করতে পারেনি কংক্রিটের বাঁধও। কিন্তু সুন্দরী গাছেরা মাটি কামড়ে পড়ে থাকে। তাই এদের বাঁধন থেকে মাটি কাড়তে পারেনি বন্যার জল। নয়তো কলকাতা শহর টহর সব ডুবে সমুদ্দুরে ভেসে যেত। আহা! আপনজনের গোড়াও যদি এমন মজবুত হত! গঙ্গার বুক টনটন করে। তাকে কেউ ভালবাসে না। বাবা না, মা-ও না। কেউ নয়।

ঠকঠক শব্দে কড়া নাড়ল কে? লোকটা উঠে বসল। তাকে নির্দেশ দিল বাথরুমে লুকিয়ে পড়তে। গঙ্গা বাথরুমে ঢুকেই শুনতে পেল দরজা ভাঙার আওয়াজ। থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে উঁকি দিল গঙ্গা। পুলিশ! এদের মধ্যে দুজন মহিলা পুলিশও আছে। যমুনার প্রতি কৃতজ্ঞতায় চোখে জল এল গঙ্গার। একেই বলে মায়ের পেটের বোন।
বেরিয়ে এসো মেয়ে। ভয় নেই।
গঙ্গা পাংশুমুখে বেরিয়ে এল।
কোথায় থাকো?
পাথরপ্রতিমা শুনেই চমকে গেল পুলিশের দল।
ভয়ংকর পরিস্থিতি ওখানে। ডিজাস্টার শুরু হয়েছে। এসপ্তাহটা বরং ওকে হোমে রেখে দিই কী বলেন ম্যাডাম?
গঙ্গার চোখের সামনে আড়কাঠি গ্রেফতার হল।তবুও স্বস্তি পেল না গঙ্গা। গোটা পাথরপ্রতিমা নাকি ভেসে যাবে, এমন শক্তিশালী এই সাইক্লোন আমফান। যাবে কোথায় সে? বাড়ি ফিরতে হবে তো? গরম ভাতের থালা সামনে নিয়ে স্থানু বসে আছে গঙ্গা। আজ দুর্যোগ, তাই হোমের বদলে থানার লকআপে বসে একা। মহিলা কনস্টেবল তাকে এক বাটি ডাল, আলুসেদ্ধ দিয়ে গেলেন।
খেয়ে নাও মেয়ে।

গঙ্গার চোখ টিভির দিকে। বাইরে প্রবল ঝড়। আকাশটাকে কে যেন একটা মস্ত তরোয়াল দিয়ে ফালা ফালা করে চিরছে আর সাঁই সাঁই আওয়াজে কেটে যাচ্ছে বাতাস। থানার ঘুলঘুলি দিয়ে বাইরে তাকাল সে। নারকেল গাছগুলো বেঁকে নুয়ে পড়ছে। আহা! কী কষ্ট হচ্ছে ওদের। রোজ অমন নুয়ে পড়ে চাষের ধান কেটেছে মা। তারপর কোমর ব্যথা নিয়েই তাদের রাঁধাবাড়া করেছে দিনের পর দিন। টিভির স্ক্রিনে ঝড়ের ছবি। রাডার না কি একটা যন্ত্র তুলেছে অনেক উঁচু আশমান থেকে। ঝড় যেভাবে আসছে, গুঁড়িয়ে যাবে গ্রাম। ভাত আর মুখে রুচছে না। গঙ্গা চুপ করে বসে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়ল। 

Amphan
ঝড়ার দাপটে নারকেল গাছগুলো বেঁকে নুয়ে পড়ছে

গোটা দেড়দিন থানার মধ্যে কাটিয়ে দিয়েছে গঙ্গা। সেদিন রাতেই বিজলি চলে গেছে। তাদের অবশ্য কোনওদিনই বিদ্যুৎ ছিল না। কুপি আর লম্ফ। অসুবিধেও হয়নি তাই। মহিলা কনস্টেবল বললেন, পাথরপ্রতিমায় যাওয়ার প্রশ্নই নেই। বড় বড় গাছ পড়ে গেছে রাস্তায়। মোবাইলে সেই রাডারের ছবি দেখাল পুলিশ দিদি। ঘূর্ণিঝড় এবং জলোচ্ছ্বাসকে নাকি আটকে দুর্বল করে দিয়েছে ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট। এই দুশো কিলোমিটার যদি ঐ ভয়ানক বেগে ছুটে আসত আমফানভেঙে চুরমার হয়ে যেত কলকাতা।
ম্যানগ্রোভ কী ম্যাডাম?
সুন্দরী গাছ। যারা বুক পেতে মাটি আগলায়। কলকাতার এখানেও প্রচুর গাছ উপড়েছে। ভেঙে পড়েছে।
থানার জানলা দিয়ে দেখতে পেল গঙ্গা, কাঠচেরাই করাত এনে গাছের গুঁড়ি কাটছে কিছু লোক। গাছটা হাউমাউ করে কেঁদে কঁকিয়ে চিৎকার করছে। কেউ কী শুনতে পাচ্ছে না? গঙ্গা তো জানে  কুড়ুলের ঘায়ে গাছগুলোর কেমন কষ্ট হয়। এই আমগাছটা তার মায়ের বয়সী হবে। কীভাবে দায়ের কোপ দিয়ে দড়ি বেঁধে টানছে! সর্বংসহা মায়ের জন্য গঙ্গা স্থানকাল ভুলে ডুকরিয়ে উঠল।
কী হল রে?
ম্যাডাম আমি বাড়ি ফিরব।
বেমক্কা বায়না করিস না। এখন যাওয়া হবে না।
মহিলা কনস্টেবল কড়াসুরে বললেন।

ঝড়ের চারদিন বাদে আজ গঙ্গা পাথরপ্রতিমা ফিরছে। কোত্থেকে আবির্ভূত হয়েছেন শিবের মতো একজন পুলিশ অফিসার। মহিলা কনস্টেবল বললেন তাদের মতো বহু মেয়েকেই নাকি উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে গ্রামে। তবে আপাতত থাকতে হবে রিলিফ ক্যাম্পে। ভ্যানে উঠেই দেখতে পেল গঙ্গা, প্রচুর চেনামুখ। সুফিয়া, রাখী, পদ্মা, নাফিসা, রিনা। সার সার সুন্দরী। যাত্রাপথে দেখতে পেল গঙ্গা, সেনাবাহিনীর তরতাজা তরুণের মতো পাতা মেলে শহিদ হয়ে শুয়ে আছে হাজারে হাজারে সবুজ গাছ। টাটকা রক্ত পড়ছে তাদের গা থেকে। চুঁইয়ে চুঁইয়ে। শহরের মানুষ বোঝে না, জানেও না। গ্রামের লোকই কী বোঝে ? তাহলে সুন্দরীরা দিনের পর দিন এভাবে বেহাত হয়ে যেত

Storm Devastation
ঝড় আসতেই থাকবে। সমুদ্দুরের দেবতা ক্ষেপে গরম হয়ে গেছে।

রিলিফ ক্যাম্পে একজন শহুরে তরুণী তার নাম জানতে চাইল। সরকারি অফিসার। গঙ্গা ব্লাউজের ভিতর থেকে আধার কার্ড বার করে দিতে চমৎকৃত হলেন।
– বাহ, তোমাকে তো একদম মিস শেফালির মতো দেখতে! নাচতে জানো বুঝি?
নাহ।
বড় কষ্টের জীবন কাটিয়ে গেছেন গো। খুব গুণী শিল্পী আর তেমন সুন্দরী ছিলেন মিস শেফালি। 
অচেনা তরুণীটির হাত ধরে হঠাৎ চিৎকার করে কেঁদে উঠল গঙ্গা।
আমাদের বাঁচান দিদি। আমরা মরে গেলে সবাই কিন্তু ডুবে যাবে।
নাফিসা, রিনা, সুফিয়া সবাই ফুঁপিয়ে উঠল। হঠাৎ শিবের মতো সুন্দর পুলিশ অফিসার এসে বললেন,
গঙ্গা দাস কে আছ? তোমার বাবা নিতে এসেছে, যাও।
গঙ্গা দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
যাব না স্যার। বলে দিন, আমি এখানেই থাকব।
যাবি না মানে? এমনিই মুখ পুড়িয়েছিস তুই…
বাবা হতভম্ব।
তাহলে আর নিচ্ছ কেন ঘরে বাবা!
কয়েক সেকেন্ড নীরবতা। বাবা সুর বদলে বলল,
তোর মা কষ্ট পাচ্ছে। নইলে আসতাম না। পঞ্চায়েত হুজ্জুতি করবে তুই ফিরলে। খাপ বসাবে। কত টাকা জরিমানা চাইবে কে জানে!
গঙ্গা কান্না চাপল। তার বয়স আঠেরো। সে জানে, এক একটা সুন্দরী গাছ সত্তর বছর অবধি বেঁচে সাগরদ্বীপকে রক্ষা করে।
শোনো বাবা, মাকে বোলো মহাপ্রলয় আসছে। ঝড় আসতেই থাকবে। সমুদ্দুরের দেবতা ক্ষেপে গরম হয়ে গেছে।  কিন্তু এভাবে যদি আমাদের  মেরেই ফেলতে থাকো তবে…
আর কিছু বলতে পারল না গঙ্গা। গলা বুজে এল। উত্তাল বঙ্গোপসাগরের ঢেউ গর্জন করে আছড়ে পড়তে লাগল পাড়ে। মাটি খসে বাঁধ ভেঙে পড়ল। শোঁ শোঁ ঝড়ে কেঁপে উঠল তাবৎ সুন্দরবন।

 

*ছবি সৌজন্য: Mumbai Mirror, News18, CNN, Hindustan times, NYTimes

পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।

Picture of দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।
Picture of দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

দোলনচাঁপা দাশগুপ্ত

পেশায় ডাক্তার দোলনচাঁপা নতুন প্রজন্মের লেখকদের মধ্যে পরিচিত নাম। মূলত গল্প এবং উপন্যাস লেখেন বিভিন্ন ছোটবড় পত্রপত্রিকায়। 'চন্দ্রতালের পরীরা' এবং 'ঝুকুমুকু' তাঁর লেখা জনপ্রিয় কিশোরসাহিত্যের বই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস