আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫]
অস্ট্রেলিয়ার পঞ্চাশ হাজার বছরের অবিচ্ছিন্ন সভ্যতা
প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে পৌঁছতে আমার বাড়ি থেকে গাড়িতে ঘন্টা দুয়েক লাগে। এদেশের মানুষ সমুদ্র, বেলাভূমি বড় ভালবাসে। দীর্ঘদিন থাকতে থাকতে আমারও বোধহয় কিছুটা ছোঁয়াচ লেগেছে। থেকে থেকে নোনা জলে পা ভিজিয়ে আসি তাই।
যখনই যাই, প্রশান্ত মহাসাগরের দিকে তাকিয়ে নিজেকে কেমন যেন তুচ্ছ মনে হয় দিগন্তবিস্তৃত বিশালতার পরিপ্রেক্ষিতে। ছোটখাট চাওয়া-পাওয়া, রাগ-ভালবাসা এসব বড়ই অর্থহীন লাগে।
***
অস্ট্রেলিয়া পূব-পশ্চিম-উত্তর-দক্ষিণে সমুদ্রবেষ্টিত। দেশটার বিশালতা ও জনশূন্যতার জন্য মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে। ভৌগোলিক বিস্তার যাই হোক না কেন, দক্ষিণ গোলার্ধের এই দেশটা পুরনো পৃথিবীর কাছে কার্যত অচেনা ছিল মাত্র আড়াইশ বছর আগেও। ততদিনে পলাশীর যুদ্ধ জিতে ইংরেজ বাংলায় জাঁকিয়ে বসেছে। আমেরিকার স্বাধীনতা ঘোষণা, ফরাসী বিপ্লব অনতিদূর।
সেইদিক দিয়ে বিচার করলে অস্ট্রেলিয়ার সামাজিক বা রাজনৈতিক ইতিহাস রীতিমত নতুন। তবে মানুষ এ দেশে পা রেখেছে কমপক্ষে পঞ্চাশ হাজার বছর আগে। মহাভারতের যুদ্ধের বহু বহু আগে। সে এক কৌতূহলোদ্দীপক কাহিনি।
বছর কুড়ি আগে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের বিষয়ে এক আলোচনাসভায় আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম। সেখানে এক বিশিষ্ট Aboriginal (আদিবাসী) নেতার সঙ্গে আলাপ হয়। নিজের পরিচয় দিলাম জন্মসূত্রে ভারতীয় বলে। ভদ্রলোক করমর্দন করে হেসে জানালেন “আমিও ভারতীয়”।

ওঁর ভারতীয়ত্ব দাবির পেছনে দুটি কারণ আছে।
ভূগোলের ছাত্রদের কাছে হয়তো এটা পরিচিত তথ্য, কিন্তু অনেকে নাও জানতে পারেন ধরে নিয়ে কিছু তথ্য দিচ্ছি সুদূর অতীত সম্পর্কিত।
পৃথিবীর জন্ম আজ থেকে সাড়ে চারশ কোটি বছর আগে।
কীভাবে তা সহজ ভাষায় জানাবার মতো বিদ্যে আমার নেই। ধরে নিতে হবে কিছু একটা ঘটেছিল। তবে তিরিশ কোটি বছর আগেও পৃথিবীতে বিভিন্ন মহাদেশ বলে কিছু ছিলনা। পৃথিবীর সম্পূর্ণ স্থলভাগ ভূগর্ভস্থ তপ্ত লাভার উপর ভাসমান ছিল। আজকের মহাদেশগুলি জড়াজড়ি করে পৃথিবীর বুকে ছিল Pangaea নামে একটিমাত্র স্থলভাগ।
সময়ের সঙ্গে এই ভাসমান স্থলভাগ কয়েক টুকরোয় ভেঙে বিভিন্ন দিকে ছড়াতে থাকে। ব্যাপারটা কিছুটা অবিশ্বাস্য লাগলেও একটা অঙ্কের হিসাব দিলে বুঝতে হয়তো সহজ হবে। এই বিস্তারের সময়কাল অন্তত কুড়ি কোটি বছর। কোনও স্থলাংশ বছরে যদি এক সেন্টিমিটার করেও সরতে থাকে, দশ কোটি বছরে তার যাত্রা হবে ১০০০ কিলোমিটার! মোটামুটি ২০ কোটি বছর আগে উপরোক্ত Pangaea ভূখন্ড দুই অংশে বিভক্ত হয়ে – আজকের উত্তর আমেরিকা, ইউরোপ ও এশিয়ার বৃহৎ অংশ নিয়ে তৈরি হয় লরেসিয়া (Laurasia) এবং ভারত সহ বাকি স্থলভাগ নিয়ে গণ্ডওয়ানা (Gondwana)।
ভদ্রলোকের ভারতীয়ত্ব দাবির প্রথম কারণ – ভারতের দক্ষিণের একাংশ আর আজকের অস্ট্রেলিয়ার পশ্চিমাংশ একেবারে গায়ে গায়ে।
১০ কোটি বছর আগে অস্ট্রেলিয়া সহ বিভিন্ন মহাদেশগুলি আজকের পরিচিত জায়গার কাছাকাছি চলে এসেছে। এই continental drift কিন্তু আজও চলেছে। অস্ট্রেলিয়া বছরে সাত সেন্টিমিটার করে উত্তরাভিমুখী। এই গতিতে চললে হয়ত এক কোটি বছরে অস্ট্রেলিয়া চিন মিশে যাবে!
আদিবাসী নেতা নিজেকে ভারতীয় বলেছিলেন আরও একটা কারণে। সেটি অবশ্য অপেক্ষাকৃত নতুন – চার হাজার বছর আগের। ওই সময়ে নাকি দক্ষিণ ভারত থেকে কিছু মানুষ অস্ট্রেলিয়াতে আসেন। আজকের কিছু Aboriginal দের এবং ভারতীয় তামিলদের DNA-র মধ্যে নাকি ভালরকম মিল আছে। আমার দেখা কিছু আদিবাসীদের অনায়াসে তামিল বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।
***
দশ কোটি বছর আগে মানুষ বলে কোনও প্রাণী এই পৃথিবীতে ছিল না।
৫০ থেকে ৬০ লক্ষ বছর আগে ভূমণ্ডলীয় শীতলকরণের (global cooling) ফলে সাহারার দক্ষিণে আফ্রিকার (sub-Saharan Africa) অংশে বনাঞ্চলের (tropical forest) জায়গা নিল বৃক্ষহীন তৃণভূমি (Savannahs)।
এই প্রাকৃতিক পরিবর্তনের সঙ্গেই এল এক বিবর্তন– সৃষ্টি হল নানা জাতের মাংসাশী (carnivore) এবং সর্বভুক (omnivore) প্রাণীর। এই প্রাণীগুলির একটি হল hominine – আধুনিক মানুষের পূর্বপুরুষ।

বিবর্তিত হতে হতে আজ থেকে দেড় লক্ষ বছর আগে আবির্ভাব হল Homo sapiens দের- (homo= মানুষ, sapiens=প্রাজ্ঞ) মানে আমরা। এই কৌতূহলোদ্দীপক যাত্রা জটিল।
মোদ্দা কথা হল, আমাদের সবার পূর্বপুরুষ হল ৫০ লক্ষ বছর (আবিষ্কৃত fossils এর ভিত্তিতে) আগে বিরাজ করা এক চারপেয়ে প্রাণী, যার খটমট নাম হল Ardipithecus Ramidus!
দেড় লক্ষ বছর আগে পূর্ব আফ্রিকা থেকে Homo Sapiens দের যাত্রা শুরু। ধীরে ধীরে তারা ছড়িয়ে পড়ল পৃথিবীর নানা প্রান্তে। মানুষ না বলে ‘মানুষরা’ বলাই বোধ হয় ভাল – কারণ একই সঙ্গে আমাদের এক জ্ঞাতি নিয়ান্ডারথালরাও ছিল। ছিল Homo Erectus রাও।
এই ছড়িয়ে পড়াটা এক দিনে হয়নি। হয়েছে হাজার হাজার বছর ধরে। বছরে একশ মিটার এগোলেই দশ হাজার বছরে হাজার কিলোমিটার রাস্তা অতিক্রম করা সম্ভব। ধরে নিচ্ছি বছরে একশ মিটারের চেয়ে কিছুটা বেশিই এগোতে হয়েছে খাদ্যান্বেষণের প্রয়োজনে। সুতরাং কমবেশি দেড় লক্ষ বছর আগে জাত আধুনিক মানুষদের সময়ের সঙ্গে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়া খুব একটা অবাক করেনা।
মহাসাগরের মাঝে কয়েকটি দ্বীপ বাদে (নিউজিল্যান্ড, ম্যাডাগাস্কার, হাওয়াই ইত্যাদি) আজকের সব মহাদেশেই মানুষ পৌঁছে গেছে মোটামুটি ৫০,০০০ বছর আগে। এর মধ্যে অস্ট্রেলিয়াও আছে।
অধিকাংশ স্থানেই মানুষ গেছে স্থলপথে। ব্যতিক্রম শুধু অস্ট্রেলিয়া, জাপান, ইন্দোনেশিয়া, আমেরিকা। এই দেশগুলিতে পৌঁছতে সাগর পেরোতে হয়েছে।
সেটা কীভাবে সম্ভব হল?
***
সহজ করে বললে, মানুষের বিবর্তনের সঙ্গে প্রকৃতিও থেমে থাকেনি। সর্বশেষ তুষার যুগে সমুদ্র ছিল অনেক নিচুতে – স্থলভাগ ছিল অনেক বেশি। এর ফলে আমেরিকা বা ইন্দোনেশিয়াতে পৌঁছোনর জন্য সাগর পেরোতে হয়নি। পায়ে হেঁটেই সেখানে গেছে মানুষ। বিস্তীর্ণ সাগর লঙ্ঘন করতে হয়নি।

কিন্তু অস্ট্রেলিয়া? সমুদ্র যতই নীচে থাকুক না কেন, দেশটার উত্তর প্রান্তে পৌঁছতে অন্তত ৯০ থেকে ১৫০ কিলোমিটার সমুদ্র পাড়ি দিতে হয়েছে। মানব ইতিহাসের কোনও কালেই (মানে বিগত দুই লক্ষ বছরে) এশিয়া এবং অস্ট্রেলিয়া একই স্থলভাগের অন্তর্গত ছিলনা। তর্কাতীতভাবে বলা যায়, ৫০ হাজার বছর আগে বর্তমানের মাত্র কয়েক লক্ষ প্রায় সমস্ত আর্থসামাজিক বিচারে পিছিয়ে থাকা আদিবাসীদের পূর্বপুরুষরা নৌকা বেয়ে বর্তমানের উত্তর অস্ট্রেলিয়াতে পা রাখে। কলম্বাস ম্যাগেলানের বহু আগে তারাই পৃথিবীর প্রথম নাবিক!
সম্পূর্ণ ভিন্ন একটা তত্ত্ব অবশ্য শোনা যায়। যা হল কেবলমাত্র আফ্রিকাতেই আধুনিক মানুষের বিবর্তন হয়নি। একই সঙ্গে পৃথিবীর অন্য স্থানেও সমান্তরাল ভাবে বিবর্তন হয়েছে। এই বিতর্কে আলোকপাত করার মতো জ্ঞান আমার নেই। ‘Out of Africa’ তত্ত্বটাই সঠিক ধরে নিচ্ছি এই লেখায়।
***
কীভাবে মানুষ প্রথমবার এবং পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়াতে এসেছিল তার একটা আংশিক উত্তর পাওয়া যায়। আসার একমাত্র উপায় জলপথে নৌকা বেয়ে। কবে এসেছিল সে উত্তরও পাওয়া যায় প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটগুলিতে পাওয়া জিনিসপত্র বা হাড়গোড় থেকে।
একটা প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসবিদরা কেবলমাত্র অনুমানের ভিত্তিতে দিতে পারেন – সেটা হল মানুষ কেন এসেছিল এই জনশূন্য দেশে। আসাটা পরিকল্পিত হতে পারে,অথবা স্রেফ কোনও দুর্ঘটনার ফলে। কয়েকজন মানুষ হয়তো ভিঙিতে মাছ ধরতে গিয়ে কোন অপ্রত্যাশিত ঝড় বা স্রোতের সম্মুখীন হয়ে ভাসতে ভাসতে অস্ট্রেলিয়ার তীরে এসে পৌঁছয়।
এও হতে পারে পরিযায়ী পাখিদের অস্ট্রেলিয়ার দিকে উড়ে যেতে দেখে, বা বজ্রপাত সৃষ্ট দাবানলের ধোঁওয়া দেখে কিছু অনুসন্ধিৎসু দুঃসাহসী অভিযাত্রী আন্দাজ করেছিল অনতিদূরে কোথাও ডাঙা আছে। জনসংখ্যার চাপ এবং খাদ্যাভাবও এই অভিযানগুলির সম্ভাব্য অনুপ্রেরণা হতে পারে।
এই আসাটা এক বারে হয়নি। হাজার হাজার বছর ধরে এই আগমন হয়েছে।
যে ব্যাপারটা সবিশেষ উল্লেখযোগ্য সেটা হল এই মানুষদের সৃষ্ট সভ্যতা ও সংস্কৃতি ৫০ হাজার বছর ধরে অপ্রতিহত রয়েছে। এই সভ্যতার গতি এবং ধারা হয়েছে পুরনো পৃথিবীর চেয়ে ভীষণরকম অন্যরকম।
কিন্তু দিনের শেষে এরাই হল প্রথম অস্ট্রেলিয়ান। মাত্র আড়াইশো বছর আগে দেশটাকে জবরদস্তি দখল করা বৃটিশরা নয়।
তথ্যসূত্র:
-
The Story of Australia; Robert Lewis in Association with National Museum Australia ; Published by Random House Australia 2017.
-
The Times Complete History of the world : Richard Overy.
-
Take me back : A trip through history from the Stone Age to the digital age.
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।