অসিত বসু বাংলা থিয়েটার জগতের এক বিপ্লবী নাম। নাট্যকার-অভিনেতা-নির্দেশক উৎপল দত্তের একজন অনুগত শিষ্য ছিলেন তিনি। অসিত বসুকে “দ্য লাস্ট অফ দ্য মোহিকান” বলা হয়ে থাকে। থিয়েটার, যাত্রা, সিনেমা, ডকুমেন্টারি, পারফর্মিং আর্টের যে-কোনও ক্ষেত্রেই তিনি নিজেকে যুক্ত করেছেন।
১৯৬৫-১৯৭১ সাল পর্যন্ত উৎপল দত্তের মুখ্য সহকারী পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন অসিত বসু। তাঁর অভিনীত বিভিন্ন নাটক ও যাত্রাপালার মধ্যে উৎপল দত্তের পরিচালনায় ‘কল্লোল’, ‘অজেয় ভিয়েতনাম’, ‘তির’, ‘মানুষের অধিকারে’, ‘যুদ্ধং দেহি’, ‘দিন বদলের পালা’, ‘লেনিনের ডাক’, ‘রাইফেল’, ‘শোন রে মালিক’, ‘বর্গি এল দেশে’, ‘টিনের তলোয়ার ও ময়না তদন্ত’ প্রভৃতি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়। দীর্ঘদিন এল.টি.জি ও বিবেক যাত্রা সমাজের বিভিন্ন প্রযোজনায় মুখ্য অভিনেতা হিসেবে যুক্ত থাকার পর নিজস্ব নাট্যদল গঠন করেন ক্যালকাটা পিপলস্ আর্ট থিয়েটার।

চলচ্চিত্রে ও দূরদর্শনেও প্রযোজক-পরিচালক-চিত্রনাট্যকার-অভিনেতা হিসেবে বিভিন্ন সময় উল্লেখযোগ্য কাজ করেছেন যার মধ্যে অন্যতম দ্বিজেন বন্দ্যোপাধ্যায় অভিনীত দূরদর্শনের সেইসময়কার বিখ্যাত ধারাবাহিক ‘আবার যখের ধন’।
তাঁর রচিত নাটকগুলির মধ্যে অন্যতম ‘কলকাতার হ্যামলেট’, ‘মৃত্যুহীন প্রাণ’, ‘রাংতার মুকুট’, ‘এ মহাজাগরণ’, ‘রঙের গোলাম’, ‘চরণদাস এম.এল.এ এবং নৌটঙ্কিলাল’, ‘বিষের বাঁশি’, ‘লোহার নূপুর’, ‘হুকুমনামা’, ‘সম্রাট ১৭৯৯ ও গৌরব’।

১৯৯৬-২০০০ সাল পর্যন্ত যাত্রাসম্রাজ্ঞী জ্যোৎস্না দত্ত, সংগীত গুণীজন কথা, আগ্রা ঘরানা, বেথুন স্কুল ১৫০ বছর এবং আলোক শিল্পী তাপস সেনকে নিয়ে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ তথ্যচিত্র নির্মাণ করেন অসিত বসু।
চন্দন সেন নির্দেশিত ‘ছায়াবাজি’ নাটকে হুইল চেয়ারে বসে তাঁর অসাধারণ অভিনয় বাংলার দর্শককে আরও একবার চোখে আঙুল দিয়ে মনে করিয়ে দেয় তিনি ঠিক কোন জাতের অভিনেতা।
আরও পড়ুন: রাজধানীর বুকে প্রথম বইয়ের প্রকাশ: আমার স্বপ্ন উদ্যাপনের ডায়েরি
গত ৭ মার্চ এই কিংবদন্তি নাট্যব্যক্তিত্ব ৮০ বছর পূর্ণ করলেন। প্রখ্যাত নট-নাট্যকার-নির্দেশক শ্রী অসিত বসুর জীবন ও শিল্পকর্ম নিয়ে একটি তথ্যচিত্র ‘দ্য শো-ম্যান’ নির্মাণ করেছেন মাধবী বর্মণ, যার প্রদর্শন হয়ে গেল নন্দন- ৩ প্রেক্ষাগৃহে গত ৯ মার্চ।

সংস্কৃতি কর্মী ও বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের উপস্থিতিতে, অসিত বসুর প্রায় ষাট বছরের কাছাকাছি শিল্পজীবনকে ফিরে দেখার সুযোগ হল। মঞ্চ, যাত্রা, চলচ্চিত্র, টেলিভিশন, তথ্যচিত্রসহ অভিনয় শিল্পের নানা শাখায় জীবন জুড়ে বিচরণ করেছেন তিনি এবং এখনও সেই যাপনই করে চলেছেন। এই বিশাল কর্মকাণ্ডকে কোনও একটা ৩০ কিম্বা ৬০ মিনিটের তথ্যচিত্রের পরিসরে ধরে ফেলা অসম্ভব, কিন্তু পরিচালক এবং কলাকুশলীদের আন্তরিক প্রচেষ্টায় অসিত বসুর দীর্ঘ শিল্পজীবন যাপনের একটা অনবদ্য নির্যাস ভবিষ্যতের জন্য সংরক্ষিত হয়ে থাকল।
এই তথ্যচিত্রটি দেখার পরে বর্তমানের এবং ভবিষ্যতের সর্বক্ষণের নাট্যশিল্পীরা অনুপ্রাণিত তো হবেনই, শিখতেও পারবেন অনেককিছু। শুধুমাত্র শিল্পকে ভালবেসে ব্যক্তিগত সুখ স্বাচ্ছন্দ্যকে উপেক্ষা করে একজন প্রকৃত শিল্পী কেমন করে তাঁর জীবন যাপন করেন, অসিতবাবুর মতো জীবন্ত কিংবদন্তিরা তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। তবে, বিনিময়ে সমাজের কিম্বা রাষ্ট্রের তো খেয়াল রাখার, দায়িত্ব নেওয়ার, আরও সম্মান-ভালোবাসা জানানোর কথা ছিল শিল্প ও শিল্পীর প্রতি। কিন্তু কেউ কথা রাখে না ও রাখেনি। এই মনোভাবের প্রতিধ্বনিই যেন শোনা যায়, প্রদর্শনীর পরে শমীক বন্দ্যোপাধ্যায়-এর বক্তব্যে। যদিও অসিতবাবুর মতো জাত শিল্পীরা সেসবের পরোয়া না করেই কাজ করে যান। অনুষ্ঠানে অসিত বসু সম্পর্কে তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নেন অভিনেতা চন্দন সেন, কুন্তল মুখোপাধ্যায়, শেখর চক্রবর্তী, কৌশিক বোস, জয়রাজ ভট্টাচার্য, পাপিয়া অধিকারী ও অন্যান্যরা।
*ছবি ঋণ: মাধবী বর্মণ
*তথ্যঋণ: রজত মল্লিক
*স্থিরচিত্র সহায়তা ও ডি.ও.পি: বেদত্রয়ী দত্ত মুদ্রা
মৌলিক‚ ভিন্নধর্মী ও সময়োপযোগী - এমনই নানা স্বাদের নিবন্ধ পরিবেশনের চেষ্টায় আমরা। প্রতিবেদন বিষয়ে আপনাদের মতামত জানান 'কমেন্ট' বক্সে | নিয়মিত আপডেট পেতে ফলো করুন - https://www.facebook.com/banglaliveofficial
One Response
বাঃ, তোমার সমালোচনা টি পড়ে খুব ভালো লাগলো। যে সব বিষয় গুলি তে আলোকপাত করা গেলনা আশাকরি ভবিষ্যতে অন্য কোনো গবেষকের হাত ধরে সেগুলি উঠে আসবে।