Generic selectors
Exact matches only
Search in title
Search in content
Post Type Selectors

রিভিউ: রাজা রবি বর্মা: দুজন পরিচালক, দুটি ছবি 

অমৃতা বেরা

মার্চ ২৪, ২০২৩

review of 2 movie
review of 2 movie
Bookmark (0)
Please login to bookmark Close

জামশেদপুর নিবাসী ড: বিজয় শর্মা হিন্দি ভাষার একজন উল্লেখযোগ্য সমালোচক, সিনেমা বিশেষজ্ঞ, বিশ্ব সাহিত্যের পণ্ডিত এবং প্রাক্তন অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। শীর্ষস্থানীয় হিন্দি পত্রপত্রিকায় তাঁর লেখা গল্প, নিবন্ধ, বইয়ের সমালোচনা, ফিল্ম রিভিউ, অনুবাদ প্রকাশিত হয়েছে। ‘কথাদেশ’ নামের প্রতিষ্ঠিত হিন্দি পত্রিকার দুটি বিশেষ সংখ্যার অতিথি সম্পাদনাও করেছেন তিনি। ‘হিন্দি সাহিত্য জ্ঞানকোষ’ তৈরি করায় সহযোগিতা করেছেন।

হিন্দি ভাষায় লেখা এই ফিল্ম রিভিউটি বাংলায় অনুবাদ করেছেন অমৃতা বেরা। অনুবাদ পত্রিকা ও ভাষা সংসদের যৌথ ব্যবস্থাপনায় ‘সোনালী ঘোষাল সারস্বত সম্মান’ (২০২৩)-এ ভূষিত করা হচ্ছে অমৃতা বেরাকে। ‘প্রবাসে অনুবাদ চর্চা সম্মান’ পাচ্ছেন তিনি।


শিল্পী ও তাঁর সৃজনের গল্প যখন অন্য কোনও ক্যানভাসে খোদাই করা হয়, তখন সে কাহিনির মধ্যে অনেক পরিবর্তন ঘটে যায়, সত্য ও কল্পনার মিশেলে গড়ে ওঠে একটি নতুন শিল্পকর্ম। সাম্প্রতিককালে নির্মিত দুটি ছবিতে ঠিক এই ব্যাপারটিই ঘটেছে২০০৮ সালে কেতন মেহতা হিন্দিতে ‘রং রসিয়া’ ছবিটি তৈরি করেছিলেন। বেশ কয়েক বছরের প্রতীক্ষার পর ছবিটি একেবারে হালে সিনেমা হলে মুক্তি পেয়েছে। আর ২০১০ সালে পরিচালক লেনিন রাজেন্দ্রন মালয়লম ভাষায় ‘মকর মাইয়া’ নামে একটি ছবি তৈরি করেনঘটনাচক্রে, দুই পরিচালকের ছবির বিষয়বস্তুই কেরলের প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী রাজা রবি বর্মার জীবন ও শিল্প। সম্প্রতি আমি দুটি ছবিই দেখেছিছবি দুটির মূল গল্প এক হলেও এই দুই পরিচালকের ছবির ট্রিটমেন্টের মধ্যে আকাশ-পাতাল পার্থক্য রয়েছে। আমার চোখে একটি ছবি পলকা শিশিরবিন্দুর মতো, আর অন্যটি শিলাবৃষ্টির মতো। ‘মকর মাইয়া’-কে আমার শিশিরবিন্দুর মতো বায়বীয় ও কোমল মনে হয়েছে, আর অন্যদিকে ‘রং রসিয়া’-কে মনে হয়েছে খুব উচ্চকিত, ভয়াবহ শিলাবৃষ্টির মতো। তবে কিনা শিলাবৃষ্টিরও নিজস্ব সৌন্দর্য থাকে, যদিও তা অনেক কিছুকে ধ্বংস করে দেয়। একথাও সত্যি যে দুটি ছবিতেই রাজা রবি বর্মার জীবনের ছবি আঁকা হয়েছে বাস্তবতা আর কল্পনার রঙের মিশেলে। দুই পরিচালকই তাঁদের স্বক্ষেত্রের সুপরিচিত ব্যক্তিত্ব, তাই দুজনের কাজ যে পরস্পরের থেকে ভিন্ন ধরনের হবে, দুজনের কাজই যে মৌলিক হবে, সেকথা বলাই বাহুল্য।

Raja Ravi Varma
রাজা রবি বর্মা

কেতন মেহতার প্রতি আমার যথেষ্ট শ্রদ্ধা আছে। তাঁর ‘মির্চ মসালা’, ‘আর ইয়া পার’, ‘মায়া মেমসাব’, ‘হিরো হীরালাল’, কিংবা ‘হোলি’-র মতো ছবিগুলির কথা কে-ই বা ভুলতে পারে! তাঁর চলচ্চিত্র পরিচালনার সূত্রপাত ১৯৭৫ সালে। ‘সরদার’ (সরদার বল্লভভাই প্যাটেল), ‘মঙ্গল পান্ডে’-র মতো ঐতিহাসিক ছবিও তিনি তৈরি করেছেন। ‘মির্চ মসালা’-র মতো ছবি নারী-সংহতি ও ক্ষমতায়নের অতুলনীয় দৃষ্টান্ত। নাসিরুদ্দিন শাহ, ওম পুরি, সুপ্রিয়া পাঠক, দিনা পাঠকদের সেরা অভিনয়ের নমুনা এ ছবিতে ধরা আছে। জমকালো সেট কেতন মেহতার ছবিগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ‘মায়া মেমসাব’ ছবিটি গুস্তাভ ফ্লবেয়ারের সুবিখ্যাত উপন্যাস ‘মাদাম বোভারি’ অবলম্বনে তৈরি। ‘মায়া মেমসাব’ ও ‘আর ইয়া পার’ ছবির নায়িকা দীপা সাহি তাঁর স্ত্রীও বটে। ‘হিরো হীরালাল’ হালকা চালের হাস্যরসের মধ্যে দিয়ে গুরুতর একটি বিষয়কে তুলে ধরে এবং অভিনেতা নাসিরের অন্য একটি দিকের সঙ্গে দর্শকদের পরিচয় করিয়ে দেয়। এই ছবিতে কোনও জমকালো সেট নেই, তা সত্ত্বেও এটি একটি সেরা মানের চলচ্চিত্র। তিনি ‘রং রসিয়া’ ছবিটির প্রযোজকও বটে। টিভি সিরিয়াল বা তথ্যচিত্রও পরিচালনা করেছেন কেতন মেহতা। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক স্তরের বেশ কয়েকটি পুরস্কার ও সম্মান তাঁর ঝুলিতে আছে। তবে তাঁর সর্বশেষ ছবি ‘রং রসিয়া’ সম্পর্কে আমার কিছু অভিযোগ আছে। 

অন্যদিকে মালয়ালি চিত্র পরিচালক লেনিন রাজেন্দ্রন কমিউনিস্ট পার্টির সক্রিয় সদস্য। ১৯৮১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ওয়েনাল’ (দ্য সামার) ছবিটির মধ্যে দিয়ে রাজেন্দ্রন চলচ্চিত্র পরিচালক হিসেবে তাঁর যাত্রা শুরু করেন। এখনও পর্যন্ত তিনি পনেরটি ছবি তৈরি করেছেন এবং বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারও পেয়েছেনলেনিন রাজেন্দ্রনও একাধিক ঐতিহাসিক ছবি তৈরি করেছেন। উনিশ শতকের ত্রাভাঙ্কোরের সুপণ্ডিত ও সঙ্গীতকুশলী মহারাজাকে নিয়ে তিনি ‘স্বাতী তিরুনাল’ ছবিটি তৈরি করেছেন। প্রখ্যাত অভিনেতা প্রেম নাজিরের জীবন অবলম্বনে তৈরি করেছেন ‘প্রেম নাজিরিনে কাণানিল্লা’ (প্রেম নাজিরকে দেখা যায় না)। ‘মকর মাইয়া’ ছাড়া তাঁর পরিচালিত অন্যান্য চলচ্চিত্রের তালিকায় আছে ‘চিল্ল’ [দ্য ফ্র্যাগমেন্ট (ভগ্নাংশ)], ‘মীনমাসতিল্লে সূর্য’ [মিড-সামার সান (মধ্য-গ্রীষ্মের রৌদ্র)], মাষক্কাল মেঘম’ (বর্ষার মেঘ), ‘পুরাবৃত্তম’ [দ্য পাস্ট(অতীত)], ‘বচনম [দ্য ওয়ার্ড (শব্দ)], ‘দৈবত্তিন্টে বিকৃতিকাল’ [দ্য উইকেড ওয়েজ অফ গড (ইশ্বরের অপকর্মের পন্থা)], ‘কুলাম’, ‘মষা’ [দ্য রেন (বৃষ্টি)], ‘অন্যর’ [দ্য আউটসাইডার (বহিরাগত)], ‘রাত্রি মষা’ [নাইট রেন (রাত্রির বৃষ্টি)] ও ‘এডওয়াপ্পতি’ [দ্য মনসুন (বর্ষাকাল)]-এর মতো ছবি। 

Ketan Mehta & Lenin Rajendran
কেতন মেহতা-লেনিন রাজেন্দ্রন

হ্যাঁ, তো কথা হচ্ছিল ‘মকর মাইয়া’ ও ‘রং রসিয়া’ নিয়ে। একটি যদি সেলুলয়েডে রচিত কবিতা হয়, তাহলে অন্যটি যেন বিভিন্ন সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রশ্ন বিষয়ক বিতর্ক। একটির পরিবেশ পুরোদস্তুর ঐতিহাসিক, আর অন্যটিকে পরানো হয়েছে আধুনিকতার পোশাককেতন মেহতা তাঁর রাজা রবি বর্মাকে নানান আধুনিক প্রসঙ্গের সঙ্গে যুক্ত করেছেন, দলিত ও নারীদের প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন, শিল্প ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে দীর্ঘ বিতর্কের অবতারণা করেছেন। মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর নেমে আসা আক্রমণ সম্পর্কে কথা বলেছেনছবিটি বেশ কিছু জায়গায় বড্ড বেশি উচ্চকিত হয়ে পড়ে, রাজা রবি বর্মা ছবির নেপথ্যে সরে যান এবং অন্যান্য নানা বিষয় সামনের সারিতে এসে দাঁড়ায়।  

‘মকর মাইয়া’ বিষয়ের সঙ্গে অত্যন্ত সংলগ্ন একটি ছবি। এই ছবিতে চিন্তা ও সৃষ্টির অপূর্ব সমন্বয় ঘটেছে। ‘মকর মাইয়া’ কথাটির আক্ষরিক অর্থ হল ক্যাপ্রিকর্নের (পৌষ মাসের) কুয়াশা (মিস্ট অফ ক্যাপ্রিকর্ন)ভারতে অন্যতম রাজ্য হওয়া সত্ত্বেও কেরলের খুব অল্প জায়গাতেই শীত পড়ে। পৌষের কুয়াশা সেখানে একটি দুর্দান্ত অনুভূতি এনে দেয়, ঠিক যেমন অনুভূতি জড়িয়ে আছে উত্তর ভারতের শিশিরের মধ্যে, বসন্ত ঋতুর মধ্যতবে উত্তর ভারতে পৌষের নাম মুখে আনা মাত্রই প্রেমচন্দের ‘পুস কি রাত’ ও তার সঙ্গে জড়িত ভয়ঙ্কর শীতের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে ওঠে, প্রাণে কাঁপুনি ধরায়। সেই কারণেই এই ছবিটির জন্য আমার পছন্দসই নাম ‘পৌষের কুয়াশা’ নয়, পৌষের শিশির। কোনও শিল্পীর জীবনের জটিলতাকে তুলে ধরার জন্য কুয়াশা লাগসই শব্দ বটে, কিন্তু তাঁর অনুভূতিকে শুধুমাত্র শিশিরের মধ্যে দিয়েই অনুভব করা যেতে পারে, কারণ শিল্পীর ব্যক্তিত্ব শিশিরের মতোই সূক্ষ্ম ও ভঙ্গুর।

Makaramanju film
ছবির নায়কের চরিত্রে সন্তোষ শিবন

রাজা রবি বর্মা ছিলেন একজন চিত্রকর, তিনি ভারতের বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি ও দেবদেবীদের (বিশেষ করে দেবীদের) ছবি এঁকেছেন। সেসব ছবি ক্যালেন্ডারের রূপ ধরে আজও ঘরে-ঘরে বিরাজমান। লেনিন রাজেন্দ্রন তাঁর ছবির নায়কের চরিত্রে সন্তোষ শিবনকে নিয়েছেন। সন্তোষ শিবন নিজেই একজন প্রখ্যাত সিনেম্যাটোগ্রাফার। আর ঠিক এখানেই লেনিন রাজেন্দ্রন কেতন মেহতাকে স্রেফ কিস্তিমাত করে দিয়েছেন। রাজা রবি বর্মার ভূমিকায়, অর্থাৎ একজন চিত্রশিল্পীর ভুমিকায় অভিনয়ের জন্য রণদীপ হুডার নির্বাচন দর্শকের মনে কাঁটার মতো খচখচ করে। হুডা খুবই ভালো অভিনেতা, তবে এই ভূমিকার জন্য মানানসই নন। তাঁকে কোনও দিক থেকেই চিত্রশিল্পী বলে মনে হয়নি। শিল্পীর মধ্যে যে ধরনের স্নিগ্ধতা, কোমলতা, তরলতা থাকা প্রয়োজন, তা তাঁর মধ্যে আগাগোড়াই অনুপস্থিত। পর্দায় মারামারির দৃশ্যে তিনি খুব মানানসই হতে পারেন, কিন্তু প্রেমের অনুভূতি তুলে ধরার দৃশ্যে তিনি মোটেই তেমন জমাতে পারেন না, ঠিক যেমন কোনও নরম মুহূর্তের চলচ্চিত্রায়নে ওম পুরি তেমন কোনও অভিঘাত তৈরি করতে সক্ষম হন না। চরিত্রের পক্ষে মানানসই অভিনেতা বাছাই একটা জরুরি বিষয়। অভিনেতার দেহসৌষ্ঠব, তাঁর মুখাবয়বের ধরন, ওঠা-বসার ধরন, হাঁটাচলার ভঙ্গিমা ইত্যাদি ছবির চিত্রনাট্যের সঙ্গে মানানসই হওয়া চলচ্চিত্রের (এবং নাটকেরও) সাফল্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শর্ত। সব অভিনেতা সব ধরনের চরিত্রের সঙ্গে খাপ খান না। সবাই নাসিরউদ্দিন শাহ নন, যিনি যে কোনও ছাঁচে, যে কোনও চরিত্রে মানানসই হয়ে উঠতে পারবেন। 

লেনিন রাজেন্দ্রন তাঁর ছবির নায়কের চরিত্রে সন্তোষ শিবনকে নিয়েছেন। সন্তোষ শিবন নিজেই একজন প্রখ্যাত সিনেম্যাটোগ্রাফার। আর ঠিক এখানেই লেনিন রাজেন্দ্রন কেতন মেহতাকে স্রেফ কিস্তিমাত করে দিয়েছেন। রাজা রবি বর্মার ভূমিকায়, অর্থাৎ একজন চিত্রশিল্পীর ভুমিকায় অভিনয়ের জন্য রণদীপ হুডার নির্বাচন দর্শকের মনে কাঁটার মতো খচখচ করে। হুডা খুবই ভালো অভিনেতা, তবে এই ভূমিকার জন্য মানানসই নন। তাঁকে কোনও দিক থেকেই চিত্রশিল্পী বলে মনে হয়নি।

কেতন মেহতা হিন্দি ছবির নিরিখে অনন্য একটি বিষয়কে তুলে ধরেছেন। তিনি ঐতিহাসিক কালকে বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত করেছেন। শিল্প ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার উপর আক্রমণ আজকের ঘটনা নয়, অতীতেও তা ঘটত। রাজা রবি বর্মাকেও এর মুখোমুখি হতে হয়েছিল। শিল্পীর কাল্পনিক জগৎ এবং বাস্তব জগতের মধ্যে অনেক পার্থক্য। এই পার্থক্যকে ছবিতে খুব জোরালোভাবে তুলে ধরা হয়েছে। ‘রং রসিয়া’ ভালো ছবি। কিন্তু এ ছবিকে ভালো বলা আপনার পক্ষে ততক্ষণই সম্ভব যতক্ষণ না আপনি ‘মকর মাইয়া’ দেখছেনমালয়লম ছবিটি দেখার পর না চাইলেও আপনি অন্তত একবার দুটি ছবির মধ্যে তুলনা করতে বাধ্য হবেন। ইংরেজিতে বলা হয়ে থাকে ‘কম্প্যারিজন ইজ হেল’, কিন্তু ইচ্ছায় হোক কিংবা অনিচ্ছায়, তুলনা করার পথ আপনাকে ধরতেই হবে।

Raja Ravi Varma Painting
রাজা রবি বর্মার ছবি

যেহেতু দুটি ছবিই একজন চিত্রশিল্পীর জীবন ও কর্মের সঙ্গে যুক্ত, তাই দুটি ছবিতেই রঙের অজস্র বাহার, দৃষ্টিসুখের ছড়াছড়ি। ক্যানভাসের পাশাপাশি জীবন জুড়েও রং, ছবির গোটা পরদাটাই রঙে ভরপুর– যেন সেলুলয়েডে তুলি (ক্যামেরা) দিয়ে ছবি আঁকা হয়েছে। রাজা রবি বর্মা ভারতীয় চিত্রকলাকে বরাবরের মতো বদলে দিয়েছিলেন, যদিও তাঁর বিরুদ্ধে বিদেশি শিল্পশৈলীকে ভারতীয় শিল্পের উপর আরোপ করার অভিযোগ উঠেছিল। কেতন মেহতা তাঁর ছবিতে একটি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন– রাজা রবি বর্মা শিল্পকে প্রাসাদ এবং মন্দিরের গণ্ডি থেকে বের করে জনতার মধ্যে নিয়ে এসেছিলেন। তিনি ফটোগ্রাফি ও ছাপাখানারও গোড়াপত্তন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, ছবিতে এ-ও দেখানো হয়েছে যে রাজা রবি বর্মার আনুকূল্য/আর্থিক সহায়তাতেই ধুন্ধিরাজ গোবিন্দ ফালকে ভারতে চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেছিলেন। কেতন মেহতা তাঁর ছবিটি রঞ্জিত দেশাইয়ের মারাঠি ভাষায় রচিত রাজা রবি বর্মার জীবনী অবলম্বনে তৈরি করেছেন। এ ছবিতে মত প্রকাশের স্বাধীনতা, ধর্মীয় গোঁড়ামি, বর্ণপ্রথা, শ্রেণি বৈষম্য, নারীর অনুভূতির উপর আঘাত, শিল্পীর দ্বিধা ইত্যাদি বেশ কয়েকটি বিষয়ের উপর একসঙ্গে দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়েছে। ছবিটিতে দেখানো হয়েছে যে নারী নিজেকে বাধাহীনভাবে সঁপে দেয়, কিন্তু শিল্পীর কাছে শুধু তাঁর শিল্পই অগ্রাধিকার পায়। নারীর সমর্পণ তাঁর কাছে সহজ-স্বাভাবিক ঘটনা, কিন্তু সেই সম্পর্কের বাঁধনে জড়িয়ে পড়ার কথা সে স্বপ্নেও ভাবে না। নারীর মনে কিন্তু প্রতিদানের আকাঙ্ক্ষা থাকে। 

সিনেম্যাটোগ্রাফির কাজ দুটি ছবিতেই প্রশংসনীয়‘মকর মাইয়া’-র সিনেম্যাটোগ্রাফার হলেন সুবিখ্যাত, একাধিক পুরস্কার ও স্বর্ণপদকপ্রাপ্ত মধু আম্বাটএই ছবিটির জন্যও তিনি সেরা সিনেম্যাটোগ্রাফারের পুরস্কার পেয়েছেন। অনিল মেহতাও ‘রং রসিয়া’-তে ক্যামেরাকে যথাযথভাবে ব্যবহার করেছেন। ছবিটির রংদার অংশগুলি তিনি যে দক্ষতার সঙ্গে ক্যামেরায় ধরেছেন, সেই একই দক্ষতার সঙ্গে তিনি শিল্পীর অন্তর্দ্বন্দ্ব ও তাঁর চরিত্রের অন্ধকার দিকটিকে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন।

Rang Rasiya color Poster
'রং রসিয়া'

লেনিন রাজেন্দ্রনের রবি বর্মা শুধু একজন দক্ষ চিত্রশিল্পীই নন, চিত্রকলায় ব্যবহৃত যাবতীয় উপকরণের নির্বাচন, পরিকল্পনা ও এমনকী নির্মাণ প্রক্রিয়াতেও তিনি আগ্রহীছবিতে তিনি কখনও মডেলকে পরানোর শাড়ির পাড়ে নিজের পছন্দসই রং দিচ্ছেন, আবার কখনও তার গয়নার ডিজাইনে স্বহস্তে মণি বসাচ্ছেন। কখনও আবার তাঁকে আয়নার কোণ ধরে মডেলের উপরে এসে পড়া আলো-ছায়ার ভারসাম্য ঠিক করতে দেখা যায়। আবার কখনও তিনি সঙ্গীতের সঙ্গে যুগলবন্দি করে গান রচনা করেন‘আহ কো চাহিয়ে এক উমর আসর হোনে তক…’ গজলও তাঁর সুরেই তৈরি। মালয়ালি বন্দিশে ছবির মেজাজটি শুরু থেকেই গড়ে ওঠে। ‘রং রসিয়া’-তেও নারীর মধ্যে দেবীর অনুভূতি জাগিয়ে তোলার জন্য রাজা রবি বর্মাকে কিছু বিশেষ আয়োজন করতে দেখা যায়। 

রাজা রবি বর্মার স্ত্রী দুটি ছবিতেই আছেনকেতন মেহতার ছবিতে তিনি বেচারি গোছের মহিলা, সংসার আর সন্তানের খাঁচায় বন্দি। রাজা রবি বর্মা তাঁকে ঘরে ফেলে রেখে আমোদ-ফুর্তি করে বেড়ান। লেনিন রাজেন্দ্রন কিন্তু শিল্পীর স্ত্রী ভাগীরথীর (লক্ষ্মী শর্মা) অন্ধকার দিকটিতেও আলো ফেলেছেন। ঈর্ষার বশে এই মহিলা এক নিরীহ মেয়ের হত্যাকারী হয়ে ওঠেন। কিন্তু সারল্যের ভান করে তিনি সাফল্যের উপহার হিসাবে স্বামীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করার অভিনয় করেন। স্বামী রবি বর্মা তাঁর সত্য জানেন। স্বল্পভাষী রবি বর্মা নিজের স্ত্রীর ক্রিয়াকলাপের কথা তাঁর মুখের উপরেই বলে দেন। নিরীহকে হত্যা করার এই ঘটনাটির সঙ্গে সঙ্গে এই দম্পতির জীবনের সমস্ত সুখ, যাবতীয় আনন্দ নষ্ট হয়ে যায়। সেই দিনই রবি বর্মা বাড়ি ছেড়ে বম্বে চলে যানকেতন মেহতা রবি বর্মার বাড়ি ছাড়ার অন্য কারণ দেখিয়েছেনমেহতার কাছে নারীর প্রশ্নটিই প্রধান হয়ে উঠেছে। 

রাজা রবি বর্মার স্ত্রী দুটি ছবিতেই আছেনকেতন মেহতার ছবিতে তিনি বেচারি গোছের মহিলা, সংসার আর সন্তানের খাঁচায় বন্দি। রাজা রবি বর্মা তাঁকে ঘরে ফেলে রেখে আমোদ-ফুর্তি করে বেড়ান। লেনিন রাজেন্দ্রন কিন্তু শিল্পীর স্ত্রী ভাগীরথীর (লক্ষ্মী শর্মা) অন্ধকার দিকটিতেও আলো ফেলেছেন।

ভাগীরথী যে নির্দোষ মেয়েটিকে খুন করায়, সেই নিরীহ দাসিকন্যার চরিত্রে মালয়ালি অভিনেত্রী নিত্যা মেননকে এক সুন্দর কবিতার মতো লাগেতাঁর চোখ, ভঙ্গিমা, দ্বিধা-সঙ্কোচ, সারল্য, চলাফেরা, সমস্ত কিছুই দর্শককে মুগ্ধ করে। নিত্যা মেননের জন্ম ১৯৮৮ সালে। তিনি সুগায়িকাও বটে। বেশ কিছু ছবিতে (মালয়লম, তামিল, কন্নড়, তেলেগু) তিনি গান গেয়েছেন। নিত্যা মেনন ইংরেজি, হিন্দি (ছোটি মা এক অনোখা বন্ধন), কন্নড়, তেলেগু, তামিল ও মালয়লম ভাষার ছবিতে কাজ করেছেন। একইভাবে কার্তিকা নায়ার নর্তকী সুগন্ধা বাই তথা উর্বশীর চরিত্রের প্রতি পুরোপুরি সুবিচার করেছেন। সুগন্ধা বাই রাজা রবি বর্মার মডেল হন, কিন্তু একদিন নিজের অর্ধনগ্ন ছবি দেখে তিনি খুব রেগে যান ও হতাশ হয়ে পড়েন। রবি বর্মার উদ্দেশ্য সম্পর্কে তিনি সন্দিহান হয়ে ওঠেন। এ ঘটনার জেরে রবি বর্মা তাঁকে পুরাণের পুরুরবা-উর্বশীর কাহিনি শোনান। এখান থেকেই ছবির গল্প নতুন মোড় নেয়, দুটি সমান্তরাল গল্প ছবির মধ্যে পাশাপাশি চলতে থাকে। একটি গল্প রবি বর্মা ও তাঁর মডেল সুগন্ধা বাইয়ের, আর অন্য গল্পটি রাজা পুরুরবা ও উর্বশীর। এই দুই কাহিনির সমাবেশ ঘটানোর মধ্যে দিয়ে পরিচালক তাঁর ছবিতে নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন। এর ফলে ছবিটি তার বিষয়বস্তুর সঙ্গে সংলগ্ন হয়ে ওঠে। ভারতীয় পুরাণকাহিনি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়াটা এ ছবিকে বোঝার অন্যতম শর্ত হয়ে ওঠে। সুগন্ধা বাই শিল্পীর অনুপ্রেরণা হয়ে ওঠেন, আর উর্বশী হয়ে পড়েন পুরুরবার প্রেমে পাগলকিন্তু দৈব তার খেলা খেলে যায়, উর্বশীর নিয়তির সঙ্গে জুড়ে যায় অভিশাপ।

কার্তিকা নায়ারের জন্ম ১৯৯২ সালে। এটি সবে তাঁর তৃতীয় চলচ্চিত্র এবং মালয়ালি ভাষায় প্রথম ছবিএ ছবিতে অভিনয়ের জন্য তিনি ‘কেরল স্টেট ফিল্ম ক্রিটিক অ্যাওয়ার্ড ফর দ্য বেস্ট ডেবিউ’, ‘ওয়ানিতা ফিল্ম অ্যাওয়ার্ড ফর বেস্ট ডেবিউ’, ও ‘সীমা অ্যাওয়ার্ড ফর দ্য বেস্ট ফিমেল ডেবিউ’ পুরস্কার পেয়েছেন। অভিনেতার ভূমিকায় এটি সন্তোষ শিবনের প্রথম ছবি। কিন্তু তাঁর অভিনয়-প্রতিভার জোরকে অস্বীকার করার কোনও উপায় নেইছবিতে তিনি রাজা রবি বর্মা ও রাজা পুরুরবার দ্বৈত ভূমিকায় ও পাশাপাশি ছবির তিন অভিনেত্রীর সঙ্গে খুবই সাবলীল অভিনয় করেছেন।

Raja Ravi Varma portrait

‘মকর মাইয়া’ ছবিতে রাজা রবি বর্মার যুগকে শিল্প নির্দেশক গোকুলদাস চমৎকারভাবে জীবন্ত করে তুলেছেন। সেই সময়কার বাতিস্তম্ভ ও আসবাবগুলি দর্শকদের অন্য ভুবনে নিয়ে যায়। অভিনেতাদের পোশাকও ছবিটিকে তার ঐতিহাসিক প্রেক্ষিতের জোগান দেয়। এ ছবিতে ইংরেজি বা হিন্দি সাবটাইটেল নেই, কাজেই মালয়লি নয় এমন কারোর পক্ষে ছবিটি দেখা ও বোঝা বিশেষ সহজ কাজ নয়। আমার সৌভাগ্য যে আমার বন্ধু সত্য এই ছবিটি শুধু আমার পাশে বসে দেখেইনি, উপরন্তু ছবির প্রতিটি সংলাপ আমার জন্য অনুবাদ করে দিয়েছে। দুটি ছবি নিয়ে আমাদের মধ্যে জমাটি আলোচনাও হয়েছে। ভাষার ব্যবধান সত্ত্বেও ছবিটি দেখা যায়, উপলব্ধি করা যায়। রাজা রবি বর্মা এখানে স্বল্পভাষী ব্যক্তি, আর ছবির অন্যান্য চরিত্রদেরও খুব বেশি কথা বলার দরকার পড়েনিছবির বিষয় চিত্রশিল্প এবং সেই বিষয়কে এখানে দৃশ্য-মাধ্যমে চমৎকারভাবে জীবন্ত করে তোলা হয়েছে। বলাই বাহুল্য যে এ ছবি রাজ্যস্তরে এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিস্তর প্রশংসা ও সম্মান আদায় করেছে। 

‘রং রসিয়া’-তে নীতি ও ধর্মের স্বঘোষিত ঠিকাদারেরা রাজা রবি বর্মাকে অসম্মান করে। বম্বেতে এসে তিনি বরোদার মহারাজার পৃষ্ঠপোষকতায় নিজেকে মেলে ধরেন। অনুপ্রেরণার সন্ধানে গোটা দেশের উত্তর-পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে ভ্রমণ করেন এবং একজন সফল শিল্পী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হনব্যবসায়ী গোবর্ধন দাসের (পরেশ রাওয়াল) ও জনৈক জার্মানের সহায়তায় তিনি একটি ছাপাখানা খোলেন এবং তাঁর আঁকা ছবির লক্ষ লক্ষ কপি ছাপা হতে থাকে‘রং রসিয়া’ ছবির প্রধান চিন্তার বিষয় হল, একজন চিত্রকর এত পরিশ্রম করে যে শিল্প নির্মাণ করেন, তা আসলে তিনি কাদের জন্য করেন? আর পাঁচজন চিত্রশিল্পীর মতো রাজা রবি বর্মা রাজা-মহারাজাদের প্রতিকৃতি এঁকে এবং সেগুলিকে রাজপ্রাসাদের দেওয়ালে টাঙিয়ে সন্তুষ্ট হন না। চিত্রশিল্পকে তিনি অভিজাত শ্রেণির খপ্পর থেকে বের করে এনে সাধারণ মানুষের কাছে সহজলভ্য করে তোলেনএর ফলাফলটি দেখা যায় ছবির শেষের দিকে, যেখানে জনৈক শিল্পী রাস্তায় এক দেবতার ছবি আঁকছেন। যাদের মন্দিরে প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল, তাদের জন্য ঈশ্বরকে মন্দিরের বাইরে বের করে এনে রবি বর্মা তাঁকে অচ্ছুতদের ঘরে প্রতিষ্ঠা করেনকিন্তু মৌলবাদীরা তাঁকে আদালতে টেনে নিয়ে যায়। তারপর শুরু হয়ে যায় হিন্দি ছবির মার্কামারা আদালতি দৃশ্য, সেখানে দীর্ঘ বাক-বিতণ্ডা চলে। ধর্মের আড়ালে রবি বর্মাকে আক্রমণ করা হয়, শিল্প ও তার মর্যাদা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক চলেরবি বর্মার বিরুদ্ধে আনা হয় অশ্লীলতা ও নারী-নির্যাতনের অভিযোগে। এসব ঘটনা ঐতিহাসিক ছবিটিকে বর্তমানের সঙ্গে যুক্ত করেছেএখানে সুগন্ধা বাইয়ের চরিত্রে আছেন নন্দনা সেনহিন্দি ছবির ঐতিহ্যের বিপরীতে হেঁটে তিনি বেশকিছু সাহসী ও বলিষ্ঠ দৃশ্যে অভিনয় করেছেন। ঘনিষ্ঠ দৃশ্যগুলিতে নন্দনা সেন খুবই সাবলীল অভিনয় করেছেন, যার জন্য তিনি প্রশংসার দাবি রাখেন। বিক্রম গোখলে, শচীন খেড়কার ও আশীষ বিদ্যার্থীর মতো অভিনেতারাও এ ছবিতে আছেন। তবে নন্দনা সেনের অভিনয় পরদায় গভীর অভিঘাত তৈরি করেকেতন মেহতা সুগন্ধাকে দিয়ে আত্মহত্যা করান, লেনিন রাজেন্দ্রন অবশ্য তাঁকে গল্পের শেষ অবধি বাঁচিয়ে রাখেনকেতন মেহতা রাজা রবি বর্মার জীবন ও কর্মকে সমসাময়িক প্রেক্ষিতে হাজির করেছেন। এ ছবি নিজেই দীর্ঘদিন ধরে সেন্সরশিপের সঙ্গে লড়াই করেছে, তাই তার মুক্তি পেতে বেশ কয়েক বছর সময় লেগেছে। ছবি মুক্তির ঠিক আগে নায়ক-নায়িকার অন্তরঙ্গ মুহূর্তের একটি দৃশ্য ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তা নিয়ে বিস্তর শোরগোল হয়েছে। 

‘রং রসিয়া’-তে হিন্দি ছবির আর একটি বৈশিষ্ট্যও হাজির, সেটি হল গানের প্রাচুর্যগান ‘মকর মাইয়া’-তেও আছে, কিন্তু তা চিত্রনাট্যের অনুসারী এবং শ্রুতিমধুর। ছবির সঙ্গীত পরিচালক রমেশ নারায়ণ, গান লিখেছেন কেএন পানিকার, কে জয়কুমার ও চন্দ্রন নায়ারপানিকারের ‘মেলে মেলে …’ গানটি এতটাই শ্রুতিমধুর যে ভাষা না জানলেও তা উপভোগ করা যায়। ‘রং রসিয়া’ ছবিতে সুর দিয়েছেন সন্দেশ শান্ডিল্য, আর গানের কথা মনোজ মুন্তাসিরের। ছবির গানগুলি আদপেই ঠোঁটে উঠে আসার মতো নয়, আবার ছবি দেখার সময়ও সেগুলি মনে কোনও অভিঘাত তৈরি করে না। এমনকী ছবির শীর্ষক সঙ্গীত ‘রং রসিয়া …’ শুনেও মনে হয় তা ছবির গায়ে তাপ্পির মতো সেঁটে আছে। তবে এই ছবিটি আরও একটি বিষয়কে চিহ্নিত করেছে। সেটি হল, শিল্পকর্ম শেষ হওয়ার পর যে কোনও প্রকৃত শিল্পী তার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে দূরে সরে যান এবং তাঁর পরবর্তী সৃষ্টির দিকে ঘুরে দাঁড়ানঅতীতের মধ্যে তিনি আটকে থাকেন না। সেই কারণেই ছবির কাজ শেষ হওয়ার পর মডেলের প্রতি শিল্পীর যাবতীয় আসক্তিরও অবসান ঘটে। এখানেই শিল্পী আর তাঁর মডেলের মধ্যে পার্থক্য। মডেলের কিন্তু শিল্পীর কাছে আরও কিছু প্রত্যাশা থেকে যায়প্রতিদান না পেয়ে সে তখন অত্যন্ত অস্বাভাবিক পদক্ষেপ নেয়, আবার তার এই পদক্ষেপে সমাজেরও অংশীদারি থাকে। সমাজ মডেলে নিচু চোখে দেখে, তাকে কটাক্ষ করে, উপহাস করে‘মকর মাইয়া’-তেও সমাজের ঠিকাদাররা সুগন্ধা বাই ও তাঁর মাকে ভয় দেখানোর চেষ্টা করেসুগন্ধা বাইয়ের চিন্তা নিজেকে নিয়ে নয়, বরং রাজা রবি বর্মার জন্য। তার কারণ ধর্ম ও নৈতিকতার এই ঠিকাদাররা এ হুমকিও দেয় যে, ফের যদি কখনও সুগন্ধাকে রবি বর্মার সঙ্গে দেখা যায়, তাহলে তারা রবি বর্মাকেও নিকেশ করে দেবেঅন্যদিকে এসব কথা না-জেনেই রবি বর্মা সুগন্ধার অপেক্ষায় থাকেন, সুগন্ধার অনুপস্থিতিতে তাঁর শিল্পকর্ম থেমে আছে। তাই রাজা রবি বর্মার ছোট ভাই যখন সুগন্ধাকে ডাকতে যায়, তখন তিনি বুকে পাথর চাপা দিয়েও মুখ বুজে থাকেন। ছবির শেষের দিকে সুগন্ধা প্রায় নিঃশব্দে বাড়ি থেকে বেরিয়ে পড়েন, তা কি রাজা রবি বর্মার কাছে যাওয়ার উদ্দেশ্যে, নাকি…সেকথা স্পষ্ট নয়। পরিচালক কোনও সুনিশ্চিত বিন্দুতে ছবি শেষ করেননি, এরপর কী ঘটতে চলেছে তা তিনি দর্শকদের কল্পনার উপর ছেড়ে দিয়েছেন। ‘রং রসিয়া’-র মতো এ ছবিতে কোনও বিদেশি মহিলা শিল্পীকে বাতলে দেন না যে শিল্পী কী ছবি আঁকবেন, আর কী আঁকবে না।

‘রং রসিয়া’ শুরু হয় বম্বে থেকে। সেখানে রাজা রবি বর্মার ছবিগুলি নিলামে উঠেছে, কোটি কোটি টাকায় বিক্রি হচ্ছে সেসব ছবিবাইরে জড়ো হওয়া জনতা শিল্পের বিরোধিতা করছে, ছবিতে কালো রং ছুঁড়ছে, স্লোগান দিচ্ছে, ছবিগুলি পায়ে দলে দিচ্ছে। দুই ছবির শুরুর দৃশ্য দুই পরিচালকের দৃষ্টিভঙ্গি স্পষ্ট করে দেয়। কেতন মেহতার মনোনিবেশ করেছেন শিল্পের স্বাধীন প্রকাশ ও নারীবাদের উপর, আর লেনিন রাজেন্দ্রন মনোযোগ দিয়েছেন রবি বর্মা ও তাঁর চিত্রশিল্পের প্রতি। ‘মকর মাইয়া’-তে রাজেন্দ্রন রবি বর্মার গোটা জীবনকে ধরেননি, তাঁর জীবনের একটি বিশেষ কালখণ্ডকে বেছে নিয়েছেন – যে সময় রবি বর্মা অপ্সরা উর্বশী ও রাজা পুরুরবাকে নিয়ে একগুচ্ছ ছবি আঁকছিলেন। এই কাজটি তাঁর সেরা শিল্পকর্ম, তাঁর মাস্টারপিস। সুগন্ধা বাই তাঁর মডেল, কিন্তু তাঁদের সম্পর্ক চিত্রকর ও মডেলের সম্পর্কের থেকে অনেক বেশি গভীর হয়ে ওঠেবছর কয়েক আগে রাজেন্দ্রন রাজা রবি বর্মাকে একটি নাটকও পরিচালনা করেছিলেন। সেই সূত্রেই তিনি এই শিল্পী সম্পর্কে গবেষণা ও পড়াশোনা করেন, আর তখনই এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণের অনুপ্রেরণা পান। একজন শিল্পীর বেদনা তিনি অনুভব করতে পেরেছিলেন। রাজা রবি বর্মা ধনী পরিবারের সন্তান, কিন্তু নিজের শিল্পজনিত অস্থিরতায় তিনি পরিবার ত্যাগ করেন। তাঁকে সইতে হয় সমাজের অবহেলা, অভিযোগ, সমালোচনা ও আক্রমণ। তবু সব আঘাত সহ্য করেও তিনি রং-তুলির সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক বজায় রাখেনএকথা সত্যি যে আদালতের মামলায় তাঁর জয় হয়, কিন্তু সে মামলা চলাকালীন তাঁর শিল্পী মনটি কতদূর আহত হয়েছিল এবং তার ফলে তাঁর শিল্প কতটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল, সেকথা শুধু একজন সহৃদয় মানুষের পক্ষেই বোঝা সম্ভব। সেই কারণেই রাজা রবি বর্মার গোটা জীবনকে না-ধরে রাজেন্দ্রন তাঁর ছবির জন্য একটি বিশেষ সময়কে বেছে নিয়েছেন। যে সময়পর্বে শিল্পীর জীবনে বিভিন্ন সংবেদনের বিস্ফোরণ ঘটছিল, ঠিক সেই সময়টিকেই তিনি নির্বাচন করেছেন এবং শিল্পীর সৃজনশীল মুহূর্তগুলিকে পরদায় তুলে ধরেছেন। ভারতবর্ষে শিল্পীদের নিয়ে খুবই কম ছবি তৈরি হয়, প্রায় হয় না বললেই চলে। সেই নিরিখে কেতন মেহতা এবং লেনিন রাজেন্দ্রন দুজনেই অভিনন্দন ও ধন্যবাদের যোগ্য।

 

 

ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Picryl, Public Domain,

Author Amrita Bera

দিল্লি নিবাসী। মূলত অনুবাদ কর্মী। হিন্দি-ইংরাজি-বাংলা তিন ভাষাতেই পারস্পরিক অনুবাদ করেন। শিল্পের অন‍্যান‍্য মাধ‍্যম সম্পর্কেও উৎসাহী। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় নিয়মিত।

Picture of অমৃতা বেরা

অমৃতা বেরা

দিল্লি নিবাসী। মূলত অনুবাদ কর্মী। হিন্দি-ইংরাজি-বাংলা তিন ভাষাতেই পারস্পরিক অনুবাদ করেন। শিল্পের অন‍্যান‍্য মাধ‍্যম সম্পর্কেও উৎসাহী। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় নিয়মিত।
Picture of অমৃতা বেরা

অমৃতা বেরা

দিল্লি নিবাসী। মূলত অনুবাদ কর্মী। হিন্দি-ইংরাজি-বাংলা তিন ভাষাতেই পারস্পরিক অনুবাদ করেন। শিল্পের অন‍্যান‍্য মাধ‍্যম সম্পর্কেও উৎসাহী। পেয়েছেন একাধিক পুরস্কার। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় হিন্দি, বাংলা ও ইংরেজি অনুবাদ প্রকাশিত হয় নিয়মিত।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Subscribe To Newsletter

কথাসাহিত্য

সংস্কৃতি

আহার

বিহার

কলমকারী

ফোটো স্টোরি

উপন্যাস

Banglalive.com/TheSpace.ink Guidelines

Established: 1999

Website URL: https://banglalive.com and https://thespace.ink

Social media handles

Facebook: https://www.facebook.com/banglaliveofficial

Instagram: https://www.instagram.com/banglalivedotcom

Twitter: @banglalive

Needs: Banglalive.com/thespace.ink are looking for fiction and poetry. They are also seeking travelogues, videos, and audios for their various sections. The magazine also publishes and encourages artworks, photography. We however do not accept unsolicited nonfiction. For Non-fictions contact directly at editor@banglalive.com / editor@thespace.ink

Time: It may take 2-3 months for the decision and subsequent publication. You will be notified. so please do not forget to add your email address/WhatsApp number.

Tips: Banglalive editor/s and everyone in the fiction department writes an opinion and rates the fiction or poetry about a story being considered for publication. We may even send it out to external editors/readers for a blind read from time to time to seek opinion. A published story may not be liked by everyone. There is no one thing or any particular feature or trademark to get published in the magazine. A story must grow on its own terms.

How to Submit: Upload your fiction and poetry submissions directly on this portal or submit via email (see the guidelines below).

Guidelines:

  1. Please submit original, well-written articles on appropriate topics/interviews only. Properly typed and formatted word document (NO PDFs please) using Unicode fonts. For videos and photos, there is a limitation on size, so email directly for bigger files. Along with the article, please send author profile information (in 100-150 words maximum) and a photograph of the author. You can check in the portal for author profile references.
  2. No nudity/obscenity/profanity/personal attacks based on caste, creed or region will be accepted. Politically biased/charged articles, that can incite social unrest will NOT be accepted. Avoid biased or derogatory language. Avoid slang. All content must be created from a neutral point of view.
  3. Limit articles to about 1000-1200 words. Use single spacing after punctuation.
  4. Article title and author information: Include an appropriate and informative title for the article. Specify any particular spelling you use for your name (if any).
  5. Submitting an article gives Banglalive.com/TheSpace.ink the rights to publish and edit, if needed. The editor will review all articles and make required changes for readability and organization style, prior to publication. If significant edits are needed, the editor will send the revised article back to the author for approval. The editorial board will then review and must approve the article before publication. The date an article is published will be determined by the editor.

 

Submit Content

For art, pics, video, audio etc. Contact editor@banglalive.com