মানুষের জীবন ভারী অদ্ভুত। সে বার বার নিজের মতো করে বেড়ে উঠতে চায় বটে কিন্তু চাইলেই তো আর সব কিছু সে পেরে ওঠে না! কত না সামাজিক শৃঙ্খলায় তার শৈশব ঢেকে যায় প্রতিদিন। তার আর তখন আস্ত একটা ঝাঁকড়া চুলো গাছ হওয়া হয়ে ওঠে না। একথা আমি বেমালুম লিখে ফেললাম বটে, তবু আনিয়াকে দেখতে দেখতে আমার অমন একখানা গাছের মতো মনে হয়। যে তার খুশি মতো ডালপালা ছড়িয়ে দিয়েছে এই আলো হাওয়া আর আকাশের সান্নিধ্যে। আনিয়ার পুরো নাম অবশ্য আনিয়া সোফি ব্রিঙ্কম্যান (Anja Sophie Brinkmann)। আস্ত একটা গাছের মতো ওকে মনে হলেও অত বড় নাম ধরে তো ডাকা যায় না, তাই ওকে আনিয়া বলেই ডাকি।
পঞ্চাশ পেরনো আনিয়ার জীবনকে যত দেখি, ততই ভাবি পৃথিবীর কত না সম্ভাবনায় মানুষ নিজেকে উৎসর্গ করছে প্রতিদিন।
কোথাকার কোন পড়ে থাকা ভাঙা ডাল, শুকনো পাতা, মানুষের ফেলে দেওয়া অনাবশ্যক কত কিছু দিয়ে ও এমন চমৎকার আসবাব বানায়, জানলা বানায়, দরজা বানায়— অবাক হয়ে দেখি কেবল। সেসব আসবাবের রকমসকম খুব যে আমাদের চেনা আসবাবের মতো তা তো নয়! আর চেনা ছকের মধ্যে জীবনের নকশা বুনে দেওয়ার ইচ্ছেও নেই আনিয়ার। বরং ছকভাঙা জীবন ওকে ডাকে। প্রতিদিন ডাকে। সে জীবন সামাজিক পরিমাপ, পরিমিতির বাইরে গিয়ে বাঁচতে শেখায়। এই সামাজিক মাপ কি আমাদের মনের মধ্যে প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট এককের অঙ্ক বুনে দেয়নি সেই শৈশবের ইস্কুলবেলা থেকে! সে শিখিয়েছে, দরজার চেহারা হয় চৌকো, সে শিখিয়েছে রান্নাঘরের তাক হয় সরু লম্বা। এই শিখে উঠবার মধ্য দিয়ে আমাদের কত না ভাবনার জগৎ মরে গেছে অগোচরেই। আমরা সবাই তাই একরকম করে ভাবি, একরকম চোখে তাকাই। আমাদের আস্তিনের মাপ, ডালের বাটি, জানলার পর্দা সবই নির্দিষ্ট পরিমাপে বাঁধা। এই পরিমাপের যে মনোজাগতিক শৃঙ্খল তার ওপারে দাঁড়িয়ে ভাবতে পেরেছে আনিয়া।

অন্তত আমার তো তেমনই মনে হয়েছে ওর কাজ দেখে। ওর বানানো ত্যাড়াব্যাঁকা একখানা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আমি কেবল মুগ্ধই হয়েছি। পড়ে থাকা কাঠের টুকরো, কাঁটাগাছের ডাল এসব দিয়েও এমন একখানা দরজা বানানো যায়! সেই দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আনিয়া প্রশ্ন তুলেছে— দরজা কি কেবল চৌকোই হতে হয়! সমান সমান আয়তকার বা বর্গাকৃতি দরজার নকশা থেকে সরে এসে এই যে ওর ভাবতে পারা, এর মধ্যে আমি বিরাট একখানা সম্ভাবনার স্বাদ পাই। আমার কেবলই মনে হয়, ওই দরজাখানা কোন সে অ্যালিসের গল্পে ঢুকে পড়বার রাস্তা যেন। সে রাস্তায় চলতে গিয়ে আমার মনে পড়ে অবন ঠাকুরের কথা। কাটুমকুটুমের কথা। শিল্পের কত না সম্ভাবনার কথা তিনি তো সেই কবেই বলেছেন।
জীবনের ঝরাপাতায় কত না তুচ্ছ বিষয়ে সেসব অসামান্য রূপকথারা পড়ে আছে মানুষের অপেক্ষায়। এবড়োখেবড়ো খোঁচা বেরনো একটা কাঠের পাটা তাই ওর হাতের গুণে মাছ হয়ে ওঠে, পাখি হয়ে ওঠে। ডালপালা ছড়ানো একখানা শুকনো ডাল ও সাজিয়ে দিতে চায় মানুষের রান্নাঘরে, শোবার ঘরে। সে ডালে মানুষেরা জামা ভাঁজ করে রাখে, টুপি ঝুলিয়ে রাখে। রান্নাঘরের মধ্যে মনে হয় আস্ত একখানা গাছ তার হাত পা মেলে মানুষের সঙ্গী হতে চায়। আনিয়ার এই ভাবনার মধ্যে আসলে ভিন্নতর এক ধরনের যাপনের ইচ্ছে প্রাণ পাচ্ছে প্রতিদিন। স্টাইল ম্যাগাজিনের পাতা ওকে স্পর্শ করবে না কোনওদিন আমি জানি। ও হয়তো তেমনটা চায়ও না। ও কেবল কাজের আনন্দে কাজ করে যায় একা একা। ধ্যান, যোগাসন আর কুড়িয়ে পাওয়া অনাবশ্যক উপাদানের স্পর্শে কোন সে ভারতবর্ষকে ছুঁতে চায় আনিয়া? ওর এই যাপন আমায় মুগ্ধ করে। একজন শিল্পীর মধ্যে আমি তখন কেবল একজন কবিমানসকেই খুঁজে পাই না, খুঁজে পাই এককজন দার্শনিককে। আমেরিকান মনস্তত্ত্ববিদ পল একমানের কথা মনে পড়ে যায় আমার। শিশুদের মনোজাগতিক প্রশ্নের জগৎ, কল্পনার জগৎকে আমরাই কি মেরে ফেলিনি প্রতিদিন! মানুষের ভাবনায় লাগাম পড়ানোর কী বেলাগাম চেষ্টা আমাদের! সেও তো একরকমের তাসের দেশের গপ্পো। নয় কি!

আনিয়ার জীবনের গল্প তাই সাহস জোগায়। যে সাহসে ভর করে মানুষ নিজের মতো করে ভাবতে পারে যা কিছু। যে সাহসে ভর করে ল্যাম্পশেড থেকে চেয়ার টেবিল বানিয়ে ফেলা যায় নিজের ইচ্ছে মতো। একজন শিশুর মনোজগতের মতো সেসব আসবাবের মধ্যে মিলেমিশে থাকে কল্পনার উড়ান। একেকদিন অবশ্য এসব কাজ ফেলে রেখে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়ে ও। অ্যালিকান্তের পথে পথে কফি আর চকোলেট ফেরি করে। সাইকেল ঘণ্টি বাজিয়ে বাজিয়ে মানুষের কাছে পৌঁছে যায়। একজন পঞ্চাশ পেরনো মানুষের কী আশ্চর্য যাপন! আনিয়া আসলেই কেমন করে বুনতে শিখেছে এমন একখনা জীবনের গদ্য! সেকথা আমার জানতে ইচ্ছে করে। জিজ্ঞেসও করেছিলাম ওকে। আনিয়ার কথায় – ‘… life is a mystery. Lot of things we can’t craft with our rational mind…’ (জীবন এক রহস্যের নাম। অনেক কিছুই আমরা যুক্তি দিয়ে বুঝতে পারি না…)। আসলে আনিয়া যাকে র্যাশনাল মাইন্ড বলতে চায় সেই মনোজগতের দিকেই তো মানুষের চলতে চাওয়া প্রতিদিন। নুয়ে পড়া শিরীষগাছের ডালখানাকেও আমি তাই বেঁধে সোজা করে দিই সকালবেলায় উঠে। আনিয়া আসলে এমন করে ভাবে না। ভাবে না বলেই ওর সাইকেলের ঘণ্টি ওর কুড়িয়ে আনা যাবতীয় কাঠকুটো, এই সমস্ত নিয়ে ও পৌঁছে যেতে চায় জীবনের কাছে, বিশ্বের কাছে। নীহারিকার কত না জানা গল্প ওকে মুগ্ধ করে। এই মুগ্ধতা ওর অজানার প্রতি, এই বিস্ময়বোধ ওর প্রতিদিনের সঙ্গী। পৃথিবীর পাঠশালায় ও যে একজন মনযোগী ছাত্রী সে কথা আমি বেশ টের পাই। ক্ষ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশপাথার। আর আমাদের আনিয়া? ওকেও কি আমরা ক্ষ্যাপা বলেই চিহ্নিত করব! সেই কি আমাদের সামাজিক নিক্তি! সে নিক্তির মাপ যদি ফুরিয়ে যায়, সে মাপে যদি ওকে মেপে ওঠা না যায়! তখন?
তখন আর কী, নুয়ে পড়া ডালে কাপড় ভাঁজ করে রাখতে রাখতে টের পাব আনিয়া পৃথিবীর মেয়ে। মাটির মেয়ে। জীবনের গানে ও কেবল প্রতিদিন ভরে নিতে চাইছে ওর পত্রপুটখানি। পৃথিবী তো দীনা নয়, আনিয়ার করতলখানি তাই প্রতিদিন ভরে উঠছে জীবনেরই গানে।
ছবি সৌজন্য: অমৃতা ভট্টাচার্য
অমৃতা ভট্টাচার্য (জ.১৯৮৪-) শান্তিনিকেতনের জল হাওয়ায় বড়ো হয়েছেন। পাঠভবনে তাঁর পড়াশোনা। পরে বিশ্বভারতীর বাংলা বিভাগ থেকে বাংলা উপন্যাসে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে গবেষণা করেছেন। পড়িয়েছেন জগদ্বন্ধু ইনস্টিটিউশনে এবং পরে চারুচন্দ্র কলেজে। বর্তমানে স্বেচ্ছাবসর নিয়ে বিভিন্ন অঞ্চলের দেশজ রান্না নিয়ে কাজ করছেন। স্বপ্ন দেখেন পুঁজির প্রতাপের বাইরে অন্যরকম জীবনের, খানিকটা যাপনও করেন তা। যে হাতে শব্দ বোনেন সেই হাতেই বোনেন ধান, ফলান সব্জি। দেশ-বিদেশের নানা-মানুষের অন্যরকম জীবন দেখতে ভালোবাসেন। তাঁর লেখা স্মৃতিগ্রন্থ ‘বেঁধেছি কাশের গুচ্ছ ’ এবং 'রেখেছি পত্রপুটে' পাঠকের সুসমাদর পেয়েছে।