আসলে লাইফস্টাইল বলতে কিন্তু অনেক কিছু বোঝায়। সকালে উঠে একটু এক চিলতে বারান্দার সবুজ পাতায় জল দেওয়া, একটু কম চিনি বা চিনি ছাড়া দুধ ছাড়া চা, একটু ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ তারপর রোজনামচা। আর এর কোনোটার জন্যই কিন্তু অ্যাডিডাসের স্পোর্টসওয়্যার বা শ্যু পরে হাতে বটল নিয়ে এসি জিমে যাওয়ার দরকার নেই। নিখরচায় মেশিন ছাড়াও দিব্যি ব্যায়াম করা যায়, যেমন ফ্রি হ্যান্ডস, যোগাসন, নাচ ইত্যাদি। শুধু শরীরচর্চা নয়, মনের যত্ন, মনের চর্চা নেওয়াও সমান গুরুত্বপূর্ণ। তবে মনের কষ্ট, শোক, দুঃখের লাগাম আমাদের হাতে অধিকাংশই থাকে না। আমরা যারা অত্যন্ত আবেগপ্রবণ মানুষের কথায়-আচরণে-ব্যবহারে আমাদের মনে ইমপ্যাক্ট পড়ে। কেউ কষ্ট দিলে আমরা ভেঙে পড়ি, আবার একদিন উঠে দাঁড়ানোর দায়িত্বটাও আমাদেরকেই নিতে হয়।
মন ভালো রাখার জন্য লাইফস্টাইলের মতো হবিটাও কিন্তু একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ। আমরা হবি বলতে সাধারণত বই পড়া, গান শোনা, ছবি আঁকা, নাচ করা, বাগান করা, ভ্রমণ বা নানা রকমের নতুন নতুন রেসিপি উদ্ভাবন করা বুঝি। আমার নিজের এই উপরোক্ত সবগুলোই খুব প্রিয়। কিন্তু একদিন আমার এই হবির তালিকায় যুক্ত হল ফুড আর্ট (Food art)।
তাহলে সংক্ষেপে গল্পটা বলি। শুরুটা হল কীভাবে? হয়তো আমার জীবনের বাস্তব ঘটনাগুলো প্যাশনের সাথে সাথে মোটিভেটও করতে পারে।

আজ থেকে প্রায় পাঁচ-ছয় বছর আগে একদিন আমি রান্না করতে গিয়ে গ্যাস টেবিলে রাখা সবজিগুলোকে নানাভাবে ভিসুয়ালাইজ করি। এটা ছিল প্রথম ঘটনা। এরপর একদিন প্লেটে খাবার সাজাতে গিয়ে মাথায় চট করে একটা আইডিয়া আসে। যেহেতু আমি ছবি আঁকি তাই ভাবলাম খাবার দিয়েও ছবি আঁকলে কেমন হয়! ব্যাস যেমন ভাবনা তেমন কাজ।
সবথেকে বেশি ফুড আর্ট করেছি লকডাউনের সময়। আমার বাড়ির সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন— বাবা, মা আর আমি। মা ভীষণই অসুস্থ, বেডবাউন্ড গত কয়েক বছর ধরে। হুইল চেয়ারেও বসানো যায় না। একজন মানুষ যার কাছে অদেখাই থেকে যায় বাইরের প্রকৃতি, আকাশ। সত্যি কথা বলতে, অসুস্থ মা’র জন্য প্লেটে স্যালাড ব্রেড ফল দিয়ে সিনারি বানাতে বানাতেই ফুড আর্ট নিয়ে প্যাশনটা জন্ম নেয় আমার।
কোভিডকালে যেমন প্রচুর ছবি এঁকেছি ঠিক তেমন প্লেটের মধ্যেও প্রচুর শিল্পকর্ম করেছি। নিজে দুবার কোভিড আক্রান্ত হয়েছি। বহু সমস্যাও এসেছে। কিন্তু আমার মনোবল কেউ ভেঙে দিতে পারেনি। একটু ঠিক হতেই নতুন উদ্যমে বসে পড়তাম ফুড আর্ট করতে। একদিন বুঝলাম এটাই আমার প্যাশন, ভালবাসা, নেশা। কেউ চাইলে এই ফুড আর্ট পেশাও হতে পারে।
যেকোনও সৃষ্টিশীল কাজ সৃজনশীল ও পারফেকশনিস্ট হতে শেখায়, মানসিক অবসাদও দূর করে। বই পড়া, বাগান করা, রান্না করা, ও ঘরের আনুসঙ্গিক কাজের পাশাপাশি মনের খিদে মেটাত এই ফুডআর্ট আর ছবি আঁকা। তখন জিনিসপত্র আনা মানে সারাদিন স্যানিটাইজ করা, একটুও যাতে অপচয় না হয় সেদিকে খেয়াল রাখা আবশ্যিক ছিল। আমি এমনকি ফেলে দেওয়া সবজির খোসা দিয়েও আর্ট করে ফেলতাম।

একদিন আমার ইচ্ছে হল আমার ছোটবেলার আনন্দমেলা, শুকতারার চরিত্রদের নিয়ে ফুড আর্ট করার। সবার প্রথমেই মনে এল শ্রী নারায়ণ দেবনাথের সৃষ্ট চরিত্রগুলো— যেমন বাঁটুল দি গ্রেট, হাঁদা-ভোঁদা, নন্টে ফন্টে…
গত ২০২১ সালে পদ্মশ্রী পুরস্কার পান নারায়ণ দেবনাথ। এই ঘটনার ঠিক একবছর আগেই আমি বানিয়ে ফেলেছি তাঁর সৃষ্ট কার্টুন চরিত্রগুলো, যেমন— হাঁদা ভোঁদা, বাঁটুল ও বাচ্চু বিচ্ছু, নন্টে ফন্টে আর কেল্টুদাকে। ছেলেবেলায় ও কিশোর বয়সে আনন্দমেলার পাশাপাশি প্রায় সকলেই শুকতারা এবং কিশোরভারতী পড়েছে। শুকতারার মূল আকর্ষণ ছিল নারায়ণ দেবনাথের গল্পগুলো। কার্টুনের পাশাপাশি গল্পের লেখাগুলোও এমন মজার ছিল যে ছুটির দিনে দুপুরে গোগ্রাসে পড়তাম। রাত্রেও মশারির মধ্যে মাথার পাশে আনন্দমেলা বা শুকতারা নাহলে ঘুমই আসত না।
প্রথমে শুকতারা বা কিশোর ভারতীতে বেরোলেও পরবর্তীকালে দেব সাহিত্য কুটির থেকে বই আকারে প্রকাশিত হয় এই লেখাগুলি।
১. প্রথমেই আসি হাঁদা ভোঁদা প্রসঙ্গে—
হাঁদা ভোঁদা প্রথম প্রকাশ পায় ১৯৬২ সালে। হাঁদা একটু রোগা আর বেশি ওপরচালাক আর ভোঁদা একটু মোটাসোটা সরল সিধে। হাঁদা সবসময় ভোঁদাকে আর ভোঁদা সবসময় হাঁদাকে জব্দ করার চেষ্টা করত, কিন্তু আখেরে ভোঁদার কোনও ক্ষতি হত না। আবার দুজনে খুব বন্ধুও ছিল। এদের আবার এক পিসেমশাই ছিলেন। এমনই নানা রকমের মজার ঘটনা নিয়ে ছিল এই কমিকস।
এখানে যে ফুডআর্টটা করা হয়েছে, তাতে হাঁদা ল্যাম্পপোস্টের মাথায় আর ভোঁদা প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে দূর থেকে ষাঁড়ের গুঁতোর ভয়ে। আমি এটা বানিয়েছি ছাতুমাখা, ফুড কালার, পিঁয়াজকলি, ধনেপাতা, পালং শাক দিয়ে।

২. বাঁটুল দি গ্রেট
১৯৬৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয় বাঁটুল দি গ্রেট। বাঁটুলের চেহারা ছিল বিশাল পালোয়ানের মতো। আর তাকে হেনস্থা করার জন্য বাচ্চু বিচ্ছু দুই শয়তান সারাদিন কুবুদ্ধি ভাঁজত, আখেরে অবশ্য বাঁটুলেরই জয় হত। বাঁটুলের পোষা কুকুর হল ভেদো আর উটপাখির নাম উটো। বাঁটুল প্রচণ্ড দেশপ্রেমিক এবং সে ভারতের হয়ে খেলে অলিম্পিকে সোনাও জেতে। তার গায়ে এমন জোর যে তাকে কেউ আঘাত করলে আদৌ লাগত না, উল্টে ছিটকে বেরিয়ে যেত। অথচ বাঁটুলের মন খুব নরম, কারও বিপদ দেখলেই সে এগিয়ে যেত।
এখানে সেই বাঁটুল আর বাচ্চু বিচ্ছুর ছবি ফুটিয়ে তুলেছি এই ফুড আর্টটিতে, এটা তৈরি করেছি কুমড়ো, বেগুন, বিটের রস, গাজর, সবজি, চিজ ইত্যাদি দিয়ে।

3. নন্টে ফন্টে
নন্টে ফন্টে লেখা হয় প্রথম ১৯৬৯ সালে।
নন্টে ফন্টে দুই কিশোর ছেলে এক মফস্বলের বোর্ডিং স্কুলে পড়ত। সেখানে বারবার ফেল করা তাদের থেকে বয়সে অনেকটা বড় কেল্টুদা নামের একটি বিচ্ছু সারাদিন ওদের পিছনে লেগে থাকত হেনস্থা করার জন্য। আর একটি চরিত্র ছিল বোর্ডিং-এর সুপারিনটেনডেন্ট স্যার।
এক্ষেত্রেও প্রথমে কেলটুদা নানা বদমাইশির ফাঁদ ছড়ালেও শেষকালে নন্টে ফন্টে দুজনে মিলে কেলটুদাকেই জব্দ করত।
এই ফুড আর্ট করেছি আটামাখা, হলুদ গুঁড়ো, ফুড কালার, আর নুডলস দিয়ে।
নারায়ণ দেবনাথের সব মজার কমিকসেরই কিন্তু মরাল ছিল। সেটা হল দিন শেষে ভালো, সরল, সৎ মানুষের জয় আর বদমাইশ, বিচ্ছু, ক্ষতিকারক, পাজিদের পরাজয়।
শ্রী নারায়ণ দেবনাথ ১৯২৫ সালের ২৫ নভেম্বর জন্মগ্রহণ করেন এবং ২০২২ সালের ১৮ জানুয়ারি ইহলোকের মায়া ত্যাগ করেন। রেখে গেছেন অজস্র কার্টুন, যা আজ অবধি বাংলায় জনপ্রিয়তার নিরিখে সর্বসেরা। কয়েক প্রজন্ম কাটিয়ে দিয়েছে শুকতারা-কিশোরভারতী সম্বল করে শুধুমাত্র এই জনপ্রিয় কমিকসগুলো পড়বে বলে।
আমার সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি আমি এই মহান ইলাসট্রেটর শিল্পী কার্টুনিস্ট স্টোরিটেলারের কাজগুলোর ওপর ফুড আর্ট করেছিলাম ওঁর জীবদ্দশায়, এমনকি পদ্মশ্রী পাওয়ার আগেই। তখনও আমার রাজ্যে এই নিয়ে কেউ ফুড আর্ট করেননি।
আমার করা একটি স্কেচও দিলাম একটি শ্রী নারায়ণ দেবনাথের প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য জানিয়ে।

এছাড়াও সত্যজিৎ রায় সিরিজ,কলকাতা সিরিজ, টিনটিন সিরিজ সহ বিভিন্ন ফিকশানাল ও কমিকাল চরিত্রের ওপর প্রচুর কাজ একসময় আমি করেছি যা দেশে ও বিদেশের বিপুল সংখ্যক বাঙালির কাছ থেকে অনেক ভালোবাসা পায়। পরবর্তীকালে এক এক করে সেসব নিয়ে আসব সকলের জন্য। সঙ্গে ফুড আর্ট সংক্রান্ত কিছু টিপসও দিয়ে দেব।
বাড়িতে সামার ভেকেশানে বা এমনি ছুটির দিনে বাচ্চাদের ফুড আর্ট শেখালে সৃজনক্ষমতা সৃষ্টিশীল কাজের আনন্দ, মনোযোগ ও কল্পনাশক্তি বাড়ে। এমনকি বড়রাও হাউসপার্টি বা বন্ধুদের গেট টুগেদারে প্লেটকে সাজিয়ে পরিবেশন করলে তাও হতে পারে মনে রাখার মতো। নিজের মনকে ভালো রাখতে, চারপাশের ঘটে যাওয়া কলুষিত সমাজের নিম্নগামীতা থেকে দূরে সরিয়ে নিজের শিল্পসত্ত্বাকে উজ্জীবিত করতেও ফুড আর্টের জুড়ি নেই। মানুষের মধ্যে আজকাল EQ বড় কমে যাচ্ছে। একটি শিশুকে মেধাচর্চার পাশাপাশি সমানভাবে এমপ্যাথেটিক কাইন্ড হতে শেখানোর পাঠ যেমন বাড়িতেই গড়তে হবে, তেমনই সেটা করতে গিয়ে মনের বিকাশের দিকেও সঠিক খেয়াল রাখতে হবে। গঠনমূলক কাজে অনুপ্রেরণা দেওয়া বাড়ির লোকেরই আবশ্যিক কর্তব্য। শুধু মোবাইল গেম নয়, একটু রং তুলি, একটু ফুড আর্ট, একটু মজার বই এসবও ওদের হাতে তুলে দিন। আপনারাও সামিল হন সঙ্গে, এতে মন শিশুসুলভ থাকবে,আপনাদের বন্ডিং আরও বাড়বে।

ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikimedia Commons, Pxhere,
আঁকা, ফুড আর্ট ও রান্নাবান্না সৌমীর প্যাশন। গাছপালা, প্রকৃতি ভালোবাসেন। যেকোনও সৃজনশীল কাজে আনন্দ পান। বিজ্ঞাপণ ও বিপণন নিয়ে পড়াশুনা করেছেন। লেখালেখি করতে পছন্দ করেন।
2 Responses
Bhison bhison valo laglo.. Borabor er motoi… Aro onek onek safollo kamona kori
Anek anek dhonyobad 🙏🙏