অস্ট্রিয়া যাওয়ার কিছুদিন আগে বিক্রম শেঠের ‘An Equal Music’ উপন্যাসটা পড়েছিলাম। প্রেমে-বিরহে দারুণ জমে গিয়েছিল কাহিনিটা। পিয়ানো-ভায়োলিনের সুরে মাইকেল আর জুলিয়ার ভালবাসার জন্ম অস্ট্রিয়ায়। এটা একেবারে কাকতালীয়। অস্ট্রিয়া যাব বলেই যে বইটা কিনেছিলাম তা নয়। কিন্তু অস্ট্রিয়ায় বেড়াতে গিয়ে এদেরই মতন আমিও ডুব দিলাম মোজার্ট-বিথোভেনে। যদিও ক্লাসিক্যাল মিউজিকের কিছুই জানি না, তবু অস্ট্রিয়ায় গিয়ে সুরের প্রেমে আমার একেবারে হাবুডুবু অবস্থা। সে প্রসঙ্গেই দুচার কথা লিখছি।
চলুন প্রথমে জালৎস্বুর্গ যাই, মোজার্টের জন্মস্থানে। তখন ইউরোপ জুড়ে দারুণ তাপপ্রবাহ। জালৎস্বুর্গ শহরে এত গরম কখনও পড়ে না। হোটেলে এয়ারকন্ডিশনার নেই। বুঝতেই পারছেন কীরকম হাঁসফাঁস অবস্থা। সারাদিন ঘুরে ঝলসে হোটেলে ঢোকামাত্র, দূরের পাহাড় থেকে ঝেঁপে বৃষ্টি এল। বাড়ির ছাদে-জানালায় রিমঝিম তা-ধিন তা-ধিন । আমি বৃষ্টির গন্ধ নিতে নিতে একখান ভিডিও করে ফেলি। তার সঙ্গে সঙ্গতে জুড়ে দিই আমজাদ আলি খানের মেঘ ও মিয়াঁ কি মালহার। বৃষ্টির সুর আর খাঁ সাহেবের বাজনায়— মোজার্টের পিয়ানো মিলেমিশে একাকার।
এই আমি ডুবতে শুরু করলাম।

জালৎস্বুর্গের কালো পাথরের পুরনো গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে, জালৎস্ নদীর ব্রিজ ছাড়িয়ে গেট্রিডেগেসে চলে গিয়েছিলাম। নদীর একদিকে পাহাড় (অ্যাল্পস), দু’পাশে পুরনো হেরিটেজ বাড়ি, চার্চ, গম্বুজ, ফুলের বাগান। খুব সুন্দর এই প্রাচীন শহর। পথের ধারে বেঞ্চে বসে দুটি ছেলে আইসক্রিম খেতে খেতে ভাঙা ভাঙা ইংরাজিতে আড্ডা দিচ্ছে। বোধহয় দুজনেই টুরিস্ট। গেট্রিডেগেসে গিজগিজ করছে বহুতল বাড়ি, কাফে, রেস্টুরেন্ট, বুটিক। একটা লাল-হলুদ বাড়ির সামনে টুরিস্টদের লম্বা লাইন। সবাই সেজেগুজে, টিপটপ। বেশ একটা খুশির ঢেউ বইছে।
১৭৫৬-এ এই বাড়িতেই জন্মেছিলেন Wolfgang Amadeus Mozart। এটা মোজার্ট ভক্তদের তীর্থস্থান। ভিতরে ঢুকে দেখি শিশু মোজার্টের ছোট্ট পিয়ানো আর ভায়োলিন। চারিদিকে ছড়ানো অজস্র চিঠি, ফ্যাক্স, পারিবারিক পেন্টিং। এই সব জুড়ে এক জিনিয়াসের জীবনের ছবি পেলাম। মাত্র ৩৫ বছরে কী অবিশ্বাস্য কাজ করেছেন! ৬০০-র বেশি কম্পোসিশান, ১৫টা কন্সার্ট, ২১টা অপেরা, ১২টা ভায়োলিন, ২৫টা পিয়ানো ইত্যাদি। আশ্চর্য যে, প্রত্যেকটাই নিঁখুত চয়ন, ত্রুটিহীন, মাস্টারওয়ার্ক। অপেরা, কন্সার্ট, সিম্ফনি, চেম্বার, সোলো, সনাটা সবেতেই সমান দক্ষতা। এইজন্য মোজার্ট এক এবং অদ্বিতীয়। মোজার্টের জীবন ওঁর সৃষ্টির মতন বিচিত্র। পরস্পরবিরোধী তথ্যে ভরা। কোনটা সত্যি, কোথাও বা কল্পনা। প্রায় ২০০ বছরেরও আগের কথা। সে সময় শিল্পী বলতেই মনে হয় যেন পৃথিবী থেকে বিচ্ছিন্ন, গভীর সাধনায় নিমগ্ন একটি মানুষ। এ ব্যাপারেও মোজার্ট আমাকে চমকে দিয়েছেন। ওঁর বিলাসবহুল জীবনে অভিজাত মহলে রোজকার ওঠাবসা ছিল। প্রচুর আয়, তার চেয়েও বেশি খরচ। শেষটা আর্থিক টানাটানির মধ্য দিয়ে গেলেও, ব্যক্তিগত জীবন ওঁর সৃজনশীলতায় কোনও ছায়া ফেলতে পারেনি। বিস্ময়কর দ্রুততায় একের পর এক কালজয়ী সৃষ্টি করে গেছেন।

গেট্রিডেগেসের এই বাড়িতেই শিশুকাল থেকে বাবার কাছে সংগীত শিক্ষা। এরপর ৬ বছরের মোজার্ট, ১০-এর নানার্লকে নিয়ে ইউরোপে পাড়ি দিলেন বাবা লিওপোল্ড। ছোট্ট ভাই-বোন জুটি লন্ডন, প্যারিস সহ নানান শহরে বাজিয়ে হইচই ফেলে দেয়। সবার কাছে এরা তখন “child prodigies”। এরপর নানার্লের কী হল জানা নেই, কিন্তু সুরকার মোজার্টের যাত্রা চলতেই থাকল। মাত্র ১৩ বছর বয়সে প্রথম অপেরা লিখে ফেললেন তিনি। সে সময় খুব বড়লোকরা সুরকারদের স্পনসর করত। ১৭ বছরের মোজার্ট জালৎস্বুর্গের আর্চবিশপ কলোরাডোর কোর্টে মিউজিক লিখতে শুরু করলেন। কিন্তু বাঁধাধরা কাজে ভীষণ বিরক্ত হয়ে একদিন তিনি কলোরাডোকে জানালেন “I am quitting”, সদ্য তরুণ মোজার্টের এই আস্পর্ধায় জ্বলে উঠলেন কলোরাডো, বললেন “No, you can’t quit. You are fired”— ভেবে দেখুন কী কাণ্ড? মোজার্ট অবশ্য এই অপমানে একটুও ঘাবড়ে না গিয়ে ভাগ্যান্বেষণে চলে গেলেন বড় শহর ভিয়েনায়।
আরও পড়ুন- অন্য ভ্রমণ: নোভা স্কটিয়া
তিনি বুঝেছিলেন, বৃহত্তর সৃষ্টির জন্যই তাঁর জন্ম। ১৮’ শতকে সংগীতের পিঠস্থান ছিল ভিয়েনা। এখানকার রাজারা নিজেরাই ছিলেন সংগীতে পারদর্শী ও পৃষ্ঠপোষক। ইউরোপে তখন ‘Music city’ বলে ক্রমশ ছড়িয়ে যাচ্ছে ভিয়েনার নাম। নানা জায়গা থেকে গুণীজনেরা এসে কাজ করছেন। লিওপোল্ড ছেলেকে কড়া চিঠি পাঠালেন, “জালৎস্বুর্গে ফিরে এসে আর্চবিশপের সাথে মিটমাট করে নাও”। মোজার্ট কিন্তু নিজের সিদ্ধান্তে অনড়। জীবনের শেষ ১০টা বছর ভিয়েনা থেকেই নিজের সেরা কাজগুলো করে ফেললেন তিনি। সেই গল্প পরের পর্বের জন্য তোলা থাক। আবার জালৎস্বুর্গে ফিরে আসি।

এই শহরের হৃদপিণ্ডে শুধু একজনই। জালৎস্বুর্গে এসে থেকে অলিতে গলিতে, মিউজিয়ামে শুধুই মোজার্টকে দেখছি। খুব ইচ্ছে ছিল, রাজপ্রাসাদে বসে বাজনা শুনব। মিরাবল প্যালেসে এসেছি। চারিদিকে দারুণ কেতাদুরস্থ লোক দেখে বেশ ঘাবড়ে গেছি। আমাদের নিতান্ত সাদামাটা পোশাক। ভাগ্যিস জিন্স পরিনি।
কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাতটায় দরজা খুললো। রাজাবাড়ির ছোট্ট চেম্বার হলের ছাদে, দেওয়ালে জমকালো সোনালি কাজ করা। মাথার উপরে ঝাড়বাতি, লাল সিল্কে মোড়া চেয়ার। একপাশে পিয়ানো আর স্বরলিপি রাখবার স্ট্যান্ড। এই চেম্বারে ছোট্ট মোজার্ট বাবার সাথে বাজিয়েছিলেন। ঠিক আটটায় দরজা বন্ধ হল। প্রবেশ করলেন এক অপূর্ব সুন্দরী, লালিত্যময়ী নারী আর দুই সুদর্শন যুবক। যাঁরা সংগীতের সঙ্গে থাকেন তাঁদের চেহারায় বোধহয় এমনই প্রশান্তি থাকে। সব কোলাহল থেমে গেল। এঁরা মোজার্ট-বিথোভেনের সুরে পিয়ানো-ভায়োলিন-চেলোর সঙ্গত ধরলেন। পিয়ানো, চেলো ভায়োলিনের সঙ্গে খেলছে। কখনও একসাথে, কখনও এক বাদ্যযন্ত্র অন্যকে পথ ছেড়ে দিচ্ছে। মৃদু আলোয়, মন্ত্রমুগ্ধ দর্শকদের মধ্যে সুর উঠছে-নামছে। চোখ বুজে মনে হল যেন কেউ খুব শুদ্ধ হয়ে দেবী সরস্বতীর আরাধনা করছে। বাজনা থেমে যেতে এক মুহূর্তের স্তব্ধতা। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে একসাথে দীর্ঘ হাততালি দিলাম। শিল্পীদের আমরা শুধু এইটুকুই দিতে পারি।

রাত ১০টায় মিরাবেল প্যালেস থেকে হেঁটে হোটেলে ফিরছি। নদীর দুপাশে তখনও অনেক মানুষ। ফোর্ট, চার্চগুলো ভারি স্নিগ্ধ আলোয় মাখা। আকাশের পূর্ণ চন্দ্র জালৎস্ নদীর কালো জলে রূপালি রং ঢেলেছে। রাতের জালৎস্বুর্গ খুবই রূপবতী। আমার ভিতরের সব কোলাহল থেমে গিয়ে শুধু সুরের এক নিষ্পাপ মায়াবী সুগন্ধ ছেয়ে আছে। মন অপূর্ব আনন্দ আর শান্তিতে ডুব দিয়েছে। সেই শান্তি এতই গভীর যে কোনও কিছু আমাকে আর স্পর্শ করতে পারবে না।
ছবি সৌজন্য: লেখক, Wikipedia
কাকলির জন্ম এবং পড়াশুনা কলকাতায়। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান স্নাতকোত্তরের ছাত্রী, পেশায় রিসার্চ ফেসিলিটেটর। বিভিন্ন ইউনিভার্সিটি, কলেজ, ফাউন্ডেশানে রিসার্চ স্ট্র্যাটেজি এবং গ্রান্ট ডেভালেপমেন্টের কাজ করেন। বর্তমানে তিনি কানাডার ক্যালগেরি শহরের অধিবাসী। ঘুরেছেন নানা দেশ, ভালবাসেন সৃষ্টিশীল কাজ। লেখা তাঁর বহুদিনের ভালোবাসা। তার লেখায় ছুঁয়ে থাকে প্রকৃতি, প্রেম, পূজা আর মানুষের কাহিনি; কিছু গভীর অনুভবের আর অনুপ্রেরণার উপলব্ধি। গল্প ছাড়াও লেখেন প্রবন্ধ আর ভ্রমণ কাহিনি। তাঁর বেশ কিছু লেখা দেশ, সাপ্তাহিক বর্তমানে এবং অন্য পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে।
2 Responses
খুব সুন্দর ! বহু বছর আগে আমার কলেজ জীবনে ২ সপ্তাহ অস্ট্রিয়া তে ছিলাম। একটা ছোট্ট শব্দ, Concerto , কনচারটো হবে, কনসার্ট নয়। 🙏🏾
অনেক ধন্যবাদ। কনসার্ট শব্দটা change করে দেবার জন্য editorial team এর কাছে অনুরোধ জানালাম।