সে দিন গেছো বন্ধুদের আড্ডা। শুধু আড্ডা তো হয় না, তাই ভোজনের ব্যবস্থাও হয়েছে। বড় ইলিশ আনা হয়েছে। প্রত্যেকবার গন্ধতেই হাজির হয় অমরনাথদা, এবারে সেই সুযোগ দেওয়া হয়নি। আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সবে কাঞ্চন এসেছে, তার মধ্যে দেবদাসের ফোন, “বাবুদা, যেতে পারছি না। আটকে গেছি।“
—- “ঠিক আছে, তবে ইলিশটা মিস করলে, মনে হচ্ছে ভালোই হবে।”
— “কী আর করা যাবে! ভাগ্যে নেই। আচ্ছা একটা কথা, ফ্ল্যাটের জানালায় কিছু সাকুলেন্ট লাগিয়েছি– এচিভেরিয়া, হাওয়ার্থিয়া, জেড প্লান্ট। হবে তো? সকালে আটটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত রোদ পায়।”
— “হবে। মাটি ঠিক আছে তো? সাকুলেন্টের ক্ষেত্রে ওটা গুরুত্বপূর্ণ।”
দেবদাস মূলত গোলাপের লোক। ওর বাবা পুলিশে কাজ করতেন, কোয়ার্টারের বিশাল ছাদ। প্রাণ খুলে গোলাপ করেছে। একটা ১২ ইঞ্চির একটু বড় পটে একসঙ্গে ২০০ মতো মন্টেজুমা ফুটেছিল একসময়। সে এখন থাকে ৮০০ স্কোয়্যার ফুটের ফ্ল্যাটে। জানালা সম্বল। দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানো।

কাঞ্চন সব শুনে বলল, “উনি তো ঘরে পাতাবাহারি গাছও লাগাতে পারেন।”
— “আসলে কী জানো, পাতাবাহারি বলতে সাধারণত আমরা যাদের চিনি, যেমন কোলিয়াস, ক্রোটন ইত্যাদি, তাদের প্রচুর রোদ লাগে। তারা ঘরের ভেতর ভালো হবে না। ঘরের ভেতরের জন্য অবশ্য কিছু গাছ আছে, যাদের আমরা ইন্ডোর প্লান্টস (Indore Plants) বা হাউস প্লান্টস বলি। সেগুলো করা যায়।”
— “রোদ ছাড়াই হয়?”
— “তা আবার হয় নাকি? সব গাছের আলো লাগে সালোকসংশ্লেষ করার জন্য। তবে কারও বেশি কারও কম। এই ইনডোর গাছের জন্য সকালের ২ ঘণ্টা রোদ যথেষ্ট, তারপর আধা আলোয় চলে যায়।”
— “তাহলে তো আমিও লাগাতে পারি।”
— “পারোই তো। ঘরের শোভা বাড়বে, গাছও করা হবে, প্রকৃতিকে কিছুটা হলেও উপভোগ করা। আসলে কী জানো, আজকাল তো বেশিরভাগই এপার্টমেন্টের বাসিন্দা, তাদের গাছ করার জায়গা ওই জানালার ধাপ, অথবা ঘরের ভেতর। ভাগ্য ভালো হলে বারান্দা। যেখানেই হোক, যতটাই হোক, কিছু গাছ করলে পলিউশান কমবে, দৃষ্টির মাধ্যমে মানসিক শান্তি আসবে আর সর্বোপরি শিশুদের ভালোবাসা বাড়বে গাছের প্রতি।”

—- “যে সব গাছ ঘরের ভেতর করা যায়, তাদের মাটিও কি আলাদা হবে?”
—- “সেটা হতেই হবে। বুঝতে হবে প্রকৃতিতে তার পরিবেশে কী ছিল। গাছের ছায়ায় থাকে, ঝির ঝিরে নরম আলো, সেই সঙ্গে গাছের পাতা পড়ে মাটির মেজাজও আলাদা। সেই পরিবেশ তোমাকে দিতে হবে। অন্তত যতটা পারা যায়। সাধারণভাবে বলা যায় দো-আঁশ মাটি ৫০%, পুরনো গোবর সার অথবা ভার্মিকমপোস্ট ২০%, পাতা সার ২৫% , কাঠকয়লা গুঁড়ো ৫%। এই মিশ্রণ ১০ ইঞ্চি টবে ধরবে এমন পরিমাণের সঙ্গে মেশাতে হবে হাড় গুঁড়ো ১৫০ গ্রাম। পাতা সার না পেলে গুঁড়ো কোকোপিট ব্যবহার করা যায়।”
— “কতদিন পর টব বদল করব?”
– “একবছর পর রি-পট করবে”… বলতে বলতে ঘরে ঢুকল অরবিন্দ দা। নিশ্চয়ই ঘাপটি মেরে আগের কথা কিছু শুনেছে। “ডাক্তার (উনি আমাকে ওই নামেই ডাকেন), একটু আটকে গিয়েছিলাম, তাই দেরি হল। হ্যাঁ যা বলছিলাম, যেহেতু এখানে আলাদা সার দেওয়া হবে না, তাই বছর বছর রি-পট করে খাবার যোগান দিতে হবে।”
— “মাঝে তরল সারও দেব না? দিলে ক্ষতি কী?”
— “নাইট্রোজেন সার বেশি হলে গাছে বৃদ্ধি তাড়াতাড়ি হবে, সেটা এই সব গাছের ক্ষেত্রে ক্ষতিকারক, সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যায়। এ ছাড়াও ঘরের ভেতর তরল সার দিলে দুর্গন্ধ হবার কথা। তবে, গাছ যখন ঘরের বাইরে থাকবে তখন হালকা করে তরল সার দেওয়া যেতে পারে।”
— “জল কতটা দেব?”
— “সকালে জল দেবে। ওপরের মাটি শুকিয়ে গেলে তার পর জল দেবে। আর একটা জিনিস খেয়াল রাখতে হবে। আমরা যেমন আজকে জমায়েত হয়েছি, আড্ডা দিচ্ছি, অথবা পরিবারে একসাথে বাস করছি, সে রকম প্রকৃতিতে গাছেরাও কাছাকাছি থাকে, তাই একা না রেখে কয়েকটা গাছ পাশাপাশি রাখা ভালো। আর প্রকৃতিতে, অথবা বাগানে ওরা যে আর্দ্রতা পায়, সেটা ঘরে পাবে না, তাই মাঝে মাঝে জল স্প্রে করে সেটা কিছুটা পূরণ করা উচিৎ।” (Indore Plants)

কাঞ্চনের আগ্রহ জেগেছে, “আর কিছু করা দরকার?”
— “অবশ্যই। গাছেদেরও প্রসাধন করতে ইচ্ছা হয়, তাই মাঝে মাঝে তুলো ভিজিয়ে পাতা পরিষ্কার করলে ভালো দেখাবে, চকচক করবে। আর আমাদের যেমন সপ্তাহে ৬ দিন কাজ করার পর ১ দিন ছুটি দরকার। মাঝে মাঝে ছুটিতেও যাই। এদেরও তেমন ছুটি দরকার। ঘরের ভেতর থেকে থেকে হাঁপিয়ে ওঠে। এদের আবার ছুটি একটু বেশি হলেই ভালো। ৭ দিন ঘরের ভেতরে, ২১ দিন বাইরে। বাইরে মানে চড়া রোদে নয়, আলো আঁধারি জায়গায়।”
চিত্রিতার প্রবেশ প্লেটে ইলিশ ভাজা নিয়ে। সুবাসে ম ম করছে, “নাও খেতে খেতে গল্প কর।”
— “আহা আহা, ইলিশ ভাজার গন্ধ, কেরানির, থুরি ডাক্তারের গিন্নির ভাঁড়ার সরস সর্ষের ঝাঁঝে। এলো বর্ষা, ইলিশ উৎসব।” কবিতা আউরাতে আউরাতে অমরনাথ’দার প্রবেশ। হোক নিমন্ত্রিত, তবুও আগে আসবে না, খাবারের গন্ধের সঙ্গে অমরনাথদার আসার একটা সমাপতন থাকবেই। সঠিক সময়ে আগমন। “অমন বড় বড় চোখ করে দেখছ কী? বুঝতে পেরেছি। গাছই করছ শুধু, কবিতা পড়া হয় না। আরেহ এটা বুদ্ধদেব বসুর কবিতা, বুঝেছ?” বলে প্লেট থেকে একটা বড় মাছের পেটি তুলে নিল। “তা তোমাদের পাতাবাহারি থামালে কেন? তা চিত্রিতা, তুমি ইলিশ পাতুরি আবার পাতাবাহারির পাতা দিয়ে কোরোনা। সে বড় বিতিকিচ্ছিরি ব্যাপার হবে।”
— “অমরনাথদা, আপনি খাচ্ছেন খান না! যেটা জানেন না সেটা নিয়ে বলেন কেন?”
— “কী! আমি জানি না? শোনো তবে হাউস প্লান্টের নাম, যেগুলো কাঞ্চন সহজেই করতে পারবে, ডাইফেনবেকিয়া, এগ্লাওনেমা, মানি প্লান্ট, এরিকা পাম… কী ঠিক তো?”
— “ঠিকই, তবে এদের সব প্রজাতি সহজে হয় না…”
— “ সহজে হয়, এমন কিছু প্রজাতির নাম বলুন বাবুদা।” কাঞ্চনের আর্তি।
— “বললে মনে থাকবে না, আমি বরং লিস্ট করে দেব। বাড়ি যাবার সময় নিয়ে নিও। ঝুলন্ত বাস্কেটে করা যায়, এমন কিছু গাছেরও নাম দেব। ওগুলো তোমার যে বক্স জানালা আছে, সেখানে ওপর থেকে ঝুলিয়ে দিতে পার।”

অমরনাথদা বলে উঠলেন,”আপনার সঙ্গে আগে আলাপ হয়নি অরবিন্দ বাবু।”
— “হ্যাঁ আমারই ভুল। অরবিন্দদা ছিলেন পার্কস এন্ড গার্ডেন্সের সুপেরিন্টে্ন্ডেন্ট। আর অমরনাথ দা হলেন…”
— “সেটা বলতে হবে না, আমি বুঝে গেছি। উনি ফুড টেস্টার আর তোমাদের সিধু জ্যাঠা…”
— “এটা বলেছেন বেশ। আচ্ছা আপনার কাজের সুবাদে অফিস সাজাবার জন্য গাছ সাজাতে হয়। সেখানে বাড়ির মতো অত যত্ন নেওয়া সম্ভব নয়, সেখানেও কি একই গাছ ব্যবহার করা যায়?”
— “প্রশ্নটা ভালোই করেছেন। তবে ওখানে একটু শক্তপোক্ত গাছ লাগবে। মানে লড়াকু গাছ আর কি। বাবুদা যে গাছের লিস্ট দেবে, তাতে আমি আলাদা দাগ দিয়ে দেব, তাতেই হবে। তবে এটা ঠিক, অফিসের ক্ষেত্রে গাছ রোটেট করা সহজ, জায়গা থাকার জন্য, যেটা সাধারণ বাড়িতে অসুবিধাজনক। তবে বাবুদা যেটা বলেছে, গাছ ভালো রাখতে রোটেট করাতেই হবে।”
বলতে বলতে বিশ্বজিত হাজির, “ইস দেরি হয়েই গেল, আড্ডাটাই মিস হয়ে গেল। তবে মনে হয় হাউজ প্লান্ট নিয়ে কথা হচ্ছিল। সিঙ্গোনিয়াম আর স্যান্সিভেরা যেন বাদ না যায়।”
— “তোমার দেরি হতেই পারে, গার্ডেন কন্সালটেন্ট। তবে আড্ডা পরেও চলবে। তুমি কি আর কিছু বলবে কাঞ্চনকে?”
— “হ্যাঁ, মনেস্টেরা আর মানি প্লান্ট যদি টবে করা হয়, তাহলে তাদের লতিয়ে ওঠার জন্য সাপোর্ট দিতে হবে। কাঠির ওপর মস অথবা নারকেল ছোবড়া জড়িয়ে দিতে হবে দড়ি দিয়ে।”

— “ঘরে চাইনিজ ব্যাম্বু আছে, বাঁশ গাছের অন্য প্রজাতি রাখা যায়?”
বিশ্বজিত হেসে ফেলল, “আরেহ, ওটা বাঁশ নয়, ওটা ড্রাসিনার এক প্রজাতি। ড্রাসিনা হাউজ প্লান্ট।”
— “ঘরে করার জন্য এই সব গাছ নিরাপদ তো?”
— “খুব ভালো প্রশ্ন। ডাইফেনবেকিয়া, যার পাতা খুবই বাহারি, হাউস প্লান্ট হিসাবেও উপযোগী, কিন্তু ঘরে না রাখলেই ভালো। এর নির্যাস বিষাক্ত, যা বাড়ির ছোটদের জন্য অথবা পোষ্যদের পক্ষে নিরাপদ নয়।”
চিত্রিতার ডাক এল, “চলে এস, খাবার তৈরি। ঠান্ডা হয়ে গেলে ভালো লাগবে না। অনায়াসে খেতে পারো, এগুলো নিরাপদ। খেতে খেতেই কথা বল।”
অমরনাথদা প্রথমেই সব কটা আইটেম চেখে নিয়ে বলে উঠল, “দারুণ। এখন কোনও কথা নয়। স্বাদ গন্ধ উপভোগ কর। চিত্রিতা, তোমার রান্না করার মধ্যে ভালোবাসা আছে, ঐটা না থাকলে এই স্বাদ আসে না।”
সবাই সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়ল, খালি অরবিন্দদা বললেন, “একেবারে ঠিক বলেছেন। ভালোবাসা। ঐটা গাছেদেরও লাগে, ভালোবাসলে, ওরাও প্রতিদান দেয়।”
কাঞ্চনের বোধ হয় পরম উপলব্ধি হল, গাইতে লাগল কিশোর কুমারের গান, “এ জীবন, প্রেমেরই পাতাবাহার…”


স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, পাহাড়িয়া এবং ভ্রামণিক, আলোকচিত্র শিল্পী (জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত), ললিত কলা একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত (অনার মেন্সান), ‘Federation International de la Arte Photograhoque’ থেকে Excellence Honors প্রাপ্ত (EFIAP)। এছাড়াও তিনি একজন প্রকৃতি প্রেমিক ও পুষ্পপ্রেমিক। ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পুষ্প প্রদর্শনীর বিচারক। ওঁর লেখা প্রকাশিত বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়।
10 Responses
সহজ ভাষায় তথ্য সমৃদ্ধ সুন্দর উপকারী লেখা।
Beautiful write up
ধন্যবাদ সি ঘোষ।
খুব ভালো লাগল পড়ে। সংক্ষিপ্ত সীমিত পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ লেখা।
দারুণ উপযোগী লেখা, মনোগ্রাহী আলোচনার মাধ্যমে! সবথেকে ভাল লাগল শেষের তালিকাটা, কেননা মনে মনে ভাবছিলাম এরকম একটা কিছু চেয়ে নেব লেখকের কাছ থেকে 😃
জরুরি সময়উপযোগী লেখা। এখানে যে biophilic design -এর ইঙ্গিত দেয়া হয়েছে সেটাকে আরও জনপ্রিয় করতে, এটা একটা সিরিজ হলে Better হয় বলে আমার মনে হয়।
ধন্যবাদ সি ঘোষ।
ধন্যবাদ প্রান্তিক।
বহুমুখী প্রতিভা ও অসাধারণ দক্ষতায় এই সুলেখক একাধারে করে চলেছেন ডাক্তারি, বিশ্বভ্রমন, গাছের সঙ্গে সখ্যতা, উঁচুমানের ছবিতোলা, আরও কি কি। তার সঙ্গে অতি সুচারুভাবে পারিবারিক দায়িত্ব পালন। (আচ্ছা এই মানুষদের জন্য দিনে কি ২৪ ঘন্টার চেয়ে কিছুটা বেশি বরাদ্দ থাকে!) এরকম একটা লেখা সেই লিখতে পারে তার মধ্যে শুধু বিষয়ের জ্ঞান নয়, সঙ্গে মিশে আছে গাছ ও মানুষের প্রতি অগাধ ভালোবাসা।
অকুন্ঠ অভিনন্দন।
স্বপন, আমি আপ্লুত। বন্ধু হিসাবে তোমার এই প্রশংসা আমাকে বিব্রত করছে।