‘আই অ্যাম হিয়ার বিকজ্ অফ্ ইউ
আই সারভাইভ্ড্ বিকজ্ অফ্ ইউ
স্টিল্, দিস্ ইজ নো ওয়ে টু লিভ
নো ওয়ে টু সারভাইভ।’
সাদা কাগজে দুটো-চারটে লাইন। টেবিল থেকে বইপত্র তুলতে গিয়ে শমীকের চোখে পড়ল। দূরে কপিমেশিনের সামনে ক্যারেন তখন কাগজগুলো সাজিয়ে নিচ্ছিল। টেবিলে ওর ব্যাগের পাশে মাগাজিনের ওপর ফ্যাক্সের কাগজটা রাখা।
ক্যারেন ফিরে আসতে শমীক বলল, ‘সরি, তোমার মেসেজটা চোখে পড়ে গেল।’ ক্যারেন লেখাটা তুলে নিল। ব্যাগে রাখতে রাখতে বলল, ‘ঠিক আছে। ব্যক্তিগত কিছু নয়।’
শমীক কৌতূহল দেখাল না। হতে পারে কেউ কবিতা লেখার চেষ্টা করেছে। ক্যারেনের ফ্যাক্স নাম্বারে দু-চার লাইন পাঠিয়ে দিয়েছে। নীচে অবশ্য নামটাম নেই। হয়তো মেসেজের প্রথম পাতাটা ক্যারেন রাখেনি।
শমীক মাইক্রো-ফিল্ম সেকশনে যাচ্ছিল। ওঠার আগে ক্যারেন বলল, ‘আমার বন্ধুর লেখা। মাদার্স-ডে-র পরে পাঠিয়েছে। কাল ডে-অফ্ ছিল। আজ এসে পেলাম।’
‘মাদার্স-ডে-র জন্য লেখা? কিন্তু তোমাকে কেন?’ ক্যারেন একটু হাসল, ‘দেখছই তো, পাঠিয়েছে।’ শমীক কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে যাচ্ছে দেখে ক্যারেন বলল, ‘সকলের মার কি ফ্যাক্স নাম্বার থাকে?’
‘ঠিকানা থাকে।’
ক্যারেন মাথা নাড়ল, ‘না থাকতেও পারে। মার বদলে তার হয়তো একজন বন্ধু থাকে। তাকে মার কথা লেখা যায়।’
শমীকের ধারণা মেয়েদের বন্ধুত্বের মধ্যে আবেগ-টাবেগ একটু বেশি থাকে। ক্যারেনের কথার ভাবেও তা ধরা পড়ছে। শমীক জিজ্ঞেস করল, ‘তুমি সেই বন্ধু?’
চশমার ফ্রেমের ওপর আঙুল রেখে ক্যারেন উত্তর দিল, ‘মনে হয়।’
শমীকের আর কথা বাড়ানোর সময় নেই। জানারও কিছু নেই। ক্যারেন নিজের থেকে যেটুকু বলেছে। হয়তো কোনও দুঃখের ঘটনা আছে। কিংবা দুঃখের কবিতা দিয়েই কেউ লেখা শুরু করেছে। নর্ম্যাল ট্রেন্ড! বিষাদের লাইনটা ধরে রাখতে পারলে একরকম উৎরে যায়।
শমীক যাওয়ার সময় বলে গেল, ‘লাঞ্চের সময় দেখা হবে। আজ দুটো অ্যাসাইনমেন্ট শেষ করার কথা। কে জানে কখন উঠতে পারব।’
শুক্রবার অনেকক্ষণ শমীক অফিসে থাকল। ‘এমপায়ার নিউজ’-এর মেট্রো সেকশনের জন্য দুটো রাইট-আপ তৈরি করল। আমেরিকার ‘মেমোরিয়াল ডে’ নিয়ে সরু-সরু দু-কলম লেখার জন্যেও খাটতে হচ্ছে। ইন-ডেপথ্ রাইটিং-এর ভূত ঘাড়ে চেপে এই অবস্থা। আমেরিকার আর্মির কে কোথায় যুদ্ধে গিয়ে মারা গেছে তার হিসেব নাও। লেখো-না-লেখো ব্যাক্গ্রাউন্ড জানো। ভিয়েতনাম ভেটারেনদের দু-চারটে ডায়ালগ। এ-বছর কাছাকাছি কোথায় কোথায় প্যারেড হচ্ছে, বুড়োরা ফ্ল্যাগ হাতে করে কখন জড়ো হচ্ছে, একটু একটু করে সব ছুঁয়ে যাও।
অন্য লেখাটা শেষ মুহূর্তে ঘাড়ে এসে পড়েছে। গ্যাস-স্টেশনের পাঞ্জাবি মালিকের ছ’টা খুনের মামলার ফলো-আপ। বব স্মিথ ইনভেস্টিগেটিভ রিপোর্টিং করছিল। হঠাৎ হানিমুনে গিয়ে বসে আছে। এখন ধিলন মামলার ফলো-আপ করছে শমীক। পুলিস রিপোর্ট, কোর্ট হিয়ারিং, খুন হওয়া লোকগুলোর বাড়ির লোকজনদের স্টেটমেন্ট— সব দেখে শুনে লেখাটা তৈরি করতে হচ্ছে। আগের দিন স্যানফোর্ডের গুরদোয়ারায় গিয়েছিল। ধিলন সম্পর্কে ভয়ে কেউ কিছু বলতে চাইছে না। সুখবিন্দর আর যশপাল সিং নামে যে দুজন গ্যাস-স্টেশন অ্যাটেনডেন্ট খুন হয়েছে, ওরা ওই গুরদোয়ারাতে যেত। ধিলনের গ্যাস-স্টেশনে ওরা আর কাজ করতে চাইছিল না। কিছুদিন ধরে কেউ ওদের থ্রেট্ন্ করছিল। ওরা পুলিসে জানিয়েছিল। তারপরেই খুন হল। ধিলন সম্পর্কে শমীকের কাছে আরও খবর আছে। দু-কলাম জায়গা পাওয়াতে স্টোরিটা সাজিয়ে নিল।
মাঝে সুদেষ্ণার ফোন এল। শমীক তখনও অফিস থেকে ওঠেনি দেখে তাড়া দিল, ‘উঠে পড়ো। এত বৃষ্টির মধ্যে রাত কোরও না।’ শমীক ঘড়ি দেখল। দশটা বেজে গেছে। বলল, ‘হয়ে গেছে। আর মিনিট কুড়ি।’
‘তার মানে বাড়ি আসতে সাড়ে এগারোটা।’
‘তুমি ওয়েট কোরও না। শুয়ে পড়ো।’
‘নীল এখনও ফেরেনি। এই ওয়েদারে গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। উইক-এন্ড এলেই হুজুগ।’
শমীক হাসল, ‘গেছে কোথাও পার্টি করতে।’
সুদেষ্ণার বিরক্তি প্রকাশ পেল, ‘কে জানে? বলল তো মুভিতে যাওয়ার প্ল্যান।’
‘তাহলে কাছাকাছি মল্-এই গেছে। এসে যাবে একটু বাদে।’
‘ভয় করে। নতুন লাইসেন্স পেয়ে এত বাড়াবাড়ি করছে।’
‘তুমি বাড়ি বসে চিন্তা করে কিছু করতে পারবে? শুধু শুধু টেনশন কোরও না।’
একটু চুপ করে থেকে সুদেষ্ণা বলল, ‘সেই, চিন্তা করে লাভ নেই। আসলে অভ্যেস, ছাড়তে পারি না। তোমার ব্যাপারেও তাই। কল করব না ভেবেও করলাম।’
শমীক হেসে ফেলল, ‘বেশ করেছ। তবে এখন দেরি করিয়ে দিচ্ছ। আর কথা বললে কাজ শেষ করতে পারব না।’
সুদেষ্ণা ফোন রেখে দিল।
শমীক যখন বাড়ি ফিরল, তখনও বৃষ্টি থামেনি। নীল গ্যারাজে গাড়ি তুলে দিয়েছে। বোধহয় খানিক আগেই ফিরেছে। বেসমেন্টে ওর ঘরে আলো জ্বলছে। দোতলা অন্ধকার। শমীক ওপরে উঠল। প্যাসেজের আলো নেভানো। সুদেষ্ণার ঘরের দরজা বন্ধ। এক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে থেকে শমীক নিজের ঘরে ঢুকল। জামাকাপড় বদলে শুতে যাওয়ার আগে ওর মনে হল সুদেষ্ণা জেগে আছে।
সুদেষ্ণার দরজায় হাত রাখতে দরজা খুলে গেল। বাইরে রিমঝিম বৃষ্টির শব্দ। নিভে যাওয়া মোমবাতির মৃদু গন্ধে ঘর ভরে আছে। অন্ধকারে অস্পষ্ট অবয়ব। শমীক দরজায় দাঁড়িয়ে। সুদেষ্ণা আলো জ্বালল না। শমীককে ঘরে ডাকল না। শুধু জিজ্ঞেস করল, ‘কিছু খুঁজছ?’
‘জেগে আছ কিনা দেখতে এলাম।’
শমীক বিছানার কাছে যেতে সুদেষ্ণা উঠে বসল। অন্ধকারে তার হাতের স্পর্শ। শমীক তাকে চুম্বন করেছিল। বাসনার সেই তীব্র আবেগ, উষ্ণ শ্বাস, উত্তপ্ত চুম্বনে আচ্ছন্ন সুদেষ্ণা বুকের মধ্যে নিরন্তর শব্দহীন এক গোপন কান্না অনুভব করছিল। এই সান্নিধ্য তাকে স্থির থাকতে দেয় না। কেন মনে হয়, শমীক তাকে ছেড়ে চলে যাবে। ক্রমশ যেন দূরে সরে যাচ্ছে। অথচ আজ এই মুহূর্তে কী গভীর আশ্লেষে বেঁধে রেখেছে। গ্রহণ আর প্রত্যাখ্যানের এই খেলায় নিরন্তর টানাপোড়েনে সুদেষ্ণা ক্লান্ত। আজ সে নিজেকে স্থির রাখতে চেষ্টা করছিল।
হঠাৎ শমীক ওকে ছেড়ে দিল। কয়েক মুহূর্ত চেয়ে থেকে বলল, ‘আজ তোমার কী হয়েছে?’ সুদেষ্ণা ঝড়ের আভাস পেল। ভাঙনের শব্দ যেন এক ক্ষণভঙ্গুর সম্পর্ক ভেঙেচুরে দিয়ে যাচ্ছে। তবু দুর্বার দেহবাসনার পুনরাবর্তে ভেসে যাওয়ার মুহূর্তে দুর্বল প্রতিরোধের মতো গায়ের চাদরটা টেনে নিল।
ছুটির দিনে শমীক দেরিতে ঘুম থেকে ওঠে। আজ আর বেশিক্ষণ ঘুমনো গেল না। মাঝে মাঝে গাড়ির আওয়াজ। লোকজনের গলা। শমীক উঠে পড়ল। জানলার ব্লাইন্ড সরাতে সামনে দু-তিনটে গাড়ি দেখতে পেল। উলটোদিকের বাড়ির সামনে লোকজন ঘুরছে। ডরোথিরা গ্যারাজ সেল্ দিয়েছে।
নীচে এসে সুদেষ্ণার সাড়াশব্দ পেল না। নীলও নেই। শমীক কফি নিয়ে ফ্যামিলি রুমে এল। সুদেষ্ণা নিশ্চয়ই উলটোদিকের ড্রাইভ-ওয়েতে গেছে। শমীক জানলা দিয়ে দেখছিল। ডরোথি ওর বুড়ি মাকে নিয়ে পুরনো জিনিসপত্র সাজিয়ে বসেছে। বেশ কয়েকটা ফার্নিচার। ওপাশে টেবিলের ওপর ফুলদানি, ল্যাম্প, আরও কী সব রয়েছে। হ্যাঙারে ঝোলানো জামাকাপড়। কারা পরে কে জানে? দুটো একটা গাড়ি এসে থামছে।
শর্টস্ পরা মোটামতো দুই মহিলা একটা ‘চেস্ট-অফ ড্রয়ার্স’ কিনে ধরাধরি করে ভ্যানে তুলছিল। ডরোথির বর এসে হাত লাগাল।

শমীক ঠিক ধরেছে। সুদেষ্ণা ওখানে। ফুল-ফুল ছাপ দেওয়া লং স্কার্ট আর সাদা হ্যাট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চোখে সানগ্লাস। ঠোঁটে তামাটে লিপস্টিক। আজকাল একটু ওজন বেড়েছে। গাল, চিবুক ভারী দেখায়। গলায় সূক্ষ্ম খাঁজ। এক জেনারেশন আগের ইটালিয়ান মেয়েদের মতো চেহারা। হাবভাবটাও মেলে।
শমীককে বাইরের দরজায় দেখতে পেয়ে সুদেষ্ণা দূর থেকে হাসল। ডরোথিদের হ্যাঙারে ঝোলানো জামাকাপড়ের পাশ দিয়ে ওদিকে চলে গেল। ফার্নিচারের পেছন থেকে রংচঙে একটা টেবল ল্যাম্প তুলে আনছে। গ্যারাজ সেল-এ গেছে মানেই কিছু কিনেছে।
আকাশে মেঘ জমছিল। বৃষ্টি হবে বোধহয়। কালকের বৃষ্টির পর ঘাস ভিজে আছে। ম্যাগ্নোলিয়ার পাতায়-পাতায় জল। এল্ম্ ট্রি থেকে বৃষ্টির ফোঁটার মতো জল ঝরছে।
রঙিন কাচের ওপর কারুকার্য করা আলো হাতে নিয়ে সুদেষ্ণা ফিরে এল। সানগ্লাস খুলে রেখে বলল, ‘কখন উঠলে? আমি তো নটার পরে গেলাম।’
‘ওইরকমই উঠেছি।’
‘ব্রেকফাস্ট দিচ্ছি। দাঁড়াও, আগে এটা দেখাই।’
সুদেষ্ণা কিচেন টেবিলের ওপর ল্যাম্পটা নামিয়ে রাখল। স্টেইন্ড গ্লাসের তৈরি ছ-কোণা শেড। ছাতার মতো দেখতে। শেডের ওপর রঙিন ফুল, লতাপাতা আঁকা। শমীককে জিজ্ঞেস করল, ‘দেখতে সুন্দর না? কতয় পেলাম বলো তো?’
শমীক আড়মোড়া ভাঙল, ‘কত আর? পাঁচ-ফাঁচ হবে।’
‘পাঁচ ডলারে টিফ্যানি ল্যাম্প? দোকানে এগুলোর কত দাম জানো?’
‘হু কেয়ার্স? পুরোনো জিনিস তুলে এনেছ। তা-ও আবার ওদের গ্যারাজ সেল থেকে। বিকেলের দিকে গেলে এমনিতেই দিয়ে দিত।’
শমীক হাসছে দেখে সুদেষ্ণা রেগে গেল। ল্যাম্পটা ওর দিকে ঘুরিয়ে দিল, ‘ডিজাইনটা ভালো করে দ্যাখো। এ জিনিস গ্যারাজ সেল-এ পেতে না। ডরোথির গ্র্যান্ডমাদারের বাড়িতে ছিল। অ্যান্টিক শপে এ জিনিসের কত দাম!’
‘তুমি কত দিলে?’
‘ট্যাগে লেখা ছিল পঁচিশ। পনেরোয় পেয়ে গেলাম।’
শমীক মজা পাচ্ছে, ‘পনেরো ডলারে অ্যান্টিক ল্যাম্প! জ্বললে হয় এখন!’
‘জ্বলবে না কেন?’
‘তার-ফার ঠিক আছে? দেখে নিয়েছিলে?’
সুদেষ্ণা মাথা নাড়ল, ‘অত দেখিনি। ঠিক আছে নিশ্চয়ই।’
শমীক ক্যাবিনেট খুলতে খুলতে বলল, ‘কে জানে কার দিদিমার লাইট। আমাদের নাইটে জ্বললে হয় শেষপর্যন্ত!’
সুদেষ্ণা হেসে ফেলল। শমীক নতুন বাল্ব বার করে এনে লাগাল। সুইন অন করতেই আলো জ্বলল। মেঘলা দিনের ছায়াচ্ছন্ন ঘরে সেই মায়াময় উজ্জ্বলতার দিকে চেয়ে থেকে সুদেষ্ণা বলল, ‘আলো জ্বলল তো?’
‘না জ্বললেও তুমি রেখে দিতে। কি হবে এত জিনিসপত্র জমিয়ে? নীল কোনওদিন কিছু নেবে? সব ফেলে দেবে।’
সুদেষ্ণা আলোর দিকে মুখ ফেরাল, ‘তার জন্যে এখনই বাড়ি খালি করে দেব? তোমার কি ধারণা নীলও বড় হয়ে এখানেই থাকবে?’
‘সেই, আমার এসব বলার কোনও মানেও হয় না।’
সুদেষ্ণার গলার স্বর বিষণ্ণ শোনাল, ‘আসলে তোমার নিজেরই আর ভালো লাগে না। বাড়িটা সাফোকেটিং মনে হয়।’
‘তোমার কখনও সেরকম মনে হয় না? কত বছর ধরে সবকিছু নিয়ে বসে আছ। মাঝে মাঝে মনে হয় না, অনেক কিছু ফেলে দেওয়া যায়? ফেলে দেওয়া উচিত?’
‘ফেলে দেওয়া তিনটে মানুষ আর তাদের জিনিসপত্র নিয়ে এই সংসার ধরে রেখেছিলাম বলে আছে। তুমি কোনগুলো ফেলে দিতে বলো শমীক? লীনার জিনিসগুলো?’
শমীক কাছে এল। সুদেষ্ণার পিঠে হাত রাখল, ‘প্লিজ, কথাগুলো এভাবে নিও না। আমি তোমাকে হার্ট করতে চাইনি। গ্যারাজ সেল নিয়ে ঠাট্টা করতে করতে বলেছিলাম।’
সুদেষ্ণা সহজ হতে চেষ্টা করল, ‘সেই। আমিও সকাল থেকে টিফ্যানি ল্যাম্প নিয়ে পড়েছি। এনি ওয়ে, সকালে নীলের সঙ্গে কথা হয়েছে?’
শমীক মাথা নাড়ল, ‘না। নীচে দেখলাম না তো। এখনও ওঠেনি নাকি?’
সুদেষ্ণার মুখে প্রসন্নতা ফিরে এল, ‘তিনি লাস্ট উইক থেকে চাকরি নিয়েছেন। শনিবার সকাল, আর দু’দিন আফটার স্কুল।’
‘কাল বলনি তো! কোথায় কাজ করছে?’
‘বার্নস্ অ্যান্ড লেবল্-এ। বই পড়ছে। কফি খাচ্ছে। যে কদিন করতে চায় করুক।’
সুদেষ্ণার মেজাজ বুঝে শমীক স্বস্তি পেল।
শমীক বিছানার কাছে যেতে সুদেষ্ণা উঠে বসল। অন্ধকারে তার হাতের স্পর্শ। শমীক তাকে চুম্বন করেছিল। বাসনার সেই তীব্র আবেগ, উষ্ণ শ্বাস, উত্তপ্ত চুম্বনে আচ্ছন্ন সুদেষ্ণা বুকের মধ্যে নিরন্তর শব্দহীন এক গোপন কান্না অনুভব করছিল। এই সান্নিধ্য তাকে স্থির থাকতে দেয় না। কেন মনে হয়, শমীক তাকে ছেড়ে চলে যাবে। ক্রমশ যেন দূরে সরে যাচ্ছে। অথচ আজ এই মুহূর্তে কী গভীর আশ্লেষে বেঁধে রেখেছে। গ্রহণ আর প্রত্যাখ্যানের এই খেলায় নিরন্তর টানাপোড়েনে সুদেষ্ণা ক্লান্ত।
সুদেষ্ণা কিচেনে লাঞ্চ তৈরি করতে গেল। শমীক ভাবছিল আজই ওর নিউইয়র্কের অ্যাপার্টমেন্ট-এর লিজ সাইনিং-এর কথা বলবে। এক মাসের মধ্যে মুভ করতে হবে। সুদেষ্ণাকে জানানো দরকার। ও হয়তো এখনও আশা করে আছে শমীক শেষ অবধি এ-বাড়িতে থেকে যাবে। আগেও এরকম হয়েছে। কিন্তু শমীক এবার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। বুঝতে পারছে আর একসঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। ভেতরে ভেতরে ক্রমশই এক দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে। কৃতজ্ঞতা, মোহ, সান্নিধ্যের সুখ এখন শুধু অবশিষ্ট আবেগের মতো। ফেলে আসা প্রত্যহের জন্য তাদের কিছু স্মৃতি আছে। তবু, শুধুমাত্র অনুষঙ্গ নিয়ে জীবন কাটে না। শমীক আর এই সংসারের সঙ্গে নিজেকে জড়াতে চায় না। এক সময়ের প্রয়োজন, আবেগসর্বস্ব অভ্যাসের পুরনো বিন্যাস থেকে মুক্ত হতে চায়। সম্পর্ক ভেঙে যাওয়ার এই মুহূর্তে শমীক সুদেষ্ণার জন্য দুঃখ বোধ করছে। সুদেষ্ণার প্রচ্ছন্ন অনুযোগও মেনে নিয়েছে। আজ শমীকের মন্য হয় সমস্ত জীবন ধরে ঋণী থাকা, শুধুমাত্র কৃতজ্ঞতার জন্য বেঁচে থাকা খুব কঠিন।
রবিবার ব্রেকফাস্ট খেতে বসে নীলের সঙ্গে কথা হল। শমীক জিজ্ঞেস করল, ‘বুক স্টোরে কাজ কেমন লাগছে?’
নীল মাথা নাড়ল, ‘ভালো। দে হ্যাভ গুড আওয়ার্স।’
‘অনেকদিন ওই দোকানটায় যাওয়া হয়নি/’
‘কাম ওভার সাম ডে। বাই মি আ বুক। হ্যাভ আ কাপ অফ গুড কফি। দ্যাটস অফকোর্স অন মি।’
নীল চোখ কুঁচকে হাসছিল। শমীক নিউইয়র্কের ‘বার্নস্ অ্যান্ড লেবল’-এই যায়। মাঝে মাঝে লেখকদের বুক সাইনিং ডে থাকে। কভার করতে যেতে হয়। অরুন্ধতী রায়ের বইটার দিনও গিয়েছিল। এখন বড় বড় শহরের বইয়ের দোকানগুলোকে ঢেলে সাজিয়েছে। লেখকদের গল্প-কবিতা পড়ার জায়গা, কফি শপ। নীল যে দোকানটায় কাজ করছে, সেটা পাশের শহরে। রি-মডেলিং-এর পর শমীকের আর ওখানে যাওয়া হয়নি। একটা শনিবার গেলেই হয়। অবশ্য চলে যাওয়ার আগে যদি সময় পায়।

শমীক ভাবছিল নীল কি ওর নিউইয়র্ক চলে যাওয়ার কথা জানে? সুদেষ্ণা কিছু বলেছে? শমীক চুপ করে আছে দেখে সুদেষ্ণা বলল, তুমি আর কবে যাবে? মাত্র দুটো উইক-এন্ড তো আছে। নেক্সট শনিবার আমি থাকছি না।’
নীলের হাসি পাচ্ছিল। মার কাছে বুক স্টোরে যাওয়াটাও ডেট দেখে ঠিক করার মতো ব্যাপার। বইও তো কিনবে না। স্টার বাক্সের কফি আর চকলেট ব্রাউনি খেয়ে ফিরে আসবে। নীল মজা করে বলল, ‘ইট্স নট আ বিগ ডিল মাম্। স্যাম ক্যান মেক ইট এনি টাইম।’
‘নো, হি ক্যান্ট্।’ সুদেষ্ণার গলার স্বর বদলে গেল, ‘নীল, শমীক চলে যাচ্ছে। এ মাসেই।’
‘ওহ্ রিয়েলি? আই ডিড নট নো দ্যাট!’
শমীক জানে নীল অবাক হয়নি। ইদানীং ওর ব্যবহারে একটা নির্বিকার ভাব লক্ষ করছে। তবু কি একেবারেই প্রতিক্রিয়া হবে না? আসলে, কিন্তু বুঝতে দিতে চায় না। এই সম্পর্ক-টম্পর্ক নিয়ে আর বোধহয় মাথাও ঘামায় না। সতেরো বছরের আমেরিকান ছেলেদের মতোই হাবভাব। অথচ এই নীল বারো-তেরো বছর বয়সে কী প্রচণ্ড রিঅ্যাক্ট করত! শমীককে, সুদেষ্ণাকে সহ্য করতে পারত না। জিনিসপত্র ভেঙেচুরে তছনছ। স্কুলে গ্রেড খারাপ করেছে। দু’বার বাড়ি থেকে চলে গিয়েছিল। শমীক বুঝতে পারত ছেলেটার ওপর অনেক চাপ গেছে। ছোট থেকে পরপর এতগুলো ঘটনার জের সহ্য করা খুব কঠিন। ভেবে দেখতে গেলে নীলেরই বোধহয় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে।
নীলের কথায় শমীকের চিন্তার স্রোতে বাধা পড়ল, ‘স্যাম, নিউইয়র্কে তুমি কোথায় থাকছ?’
‘মিড টাউনে। বিটুইন থার্টি ফিফ্থ অ্যান্ড লেকসিংটন।’
‘তুমি সেটল করে নাও। একদিন যাব।’
শমীক সুদেষ্ণার দৃষ্টি থেকে চোখ সরিয়ে নিল। টেবল ছেড়ে ওঠার সময় নীলকে বলল, ‘চলে এসো, এনি উইক এন্ড। উই ক্যান হ্যাভ লাঞ্চ অর ডিনার।’
দু-সপ্তাহ পরে শমীক নতুন অ্যাপার্টমেন্টে চলে গেল। ছ-বছর সুদেষ্ণার সঙ্গে ছিল। অথচ শেষ কয়েকদিন প্রায় দেখাই হল না। ওই সময় শমীককে অফিসের কাজে ওয়াশিংটন যেতে হল। ফিরে এসে ‘ইউনাইটেড নেশনস্’-এ দু’দিন। থার্ড ওয়ার্ল্ড কান্ট্রির পপুলেশন কন্ট্রোলের ওপর কনফারেন্স কভার করা। পরপর তিন-চারটে অ্যাসাইনমেন্ট এসে গেল। নিউইয়র্ক থেকে দু-রাত ফিরতেই পারল না।
শনিবার মুভ করার কথা। শুক্রবার রাতে ফিরে এসে শমীক সুদেষ্ণাকে দেখতে পেল না। রাত প্রায় ন-টা। নীল টিভি দেখছিল। শমীক বলল, ‘মুভিং কোম্পানিকে কল করেছি। কাল সকাল আটটায় ভ্যান আসবে।’
‘জানি। তোমার ডিনার রাখা আছে। ইউ ওয়ান্ট মি টু ওয়ার্ম ইট আপ?’
শমীক সিঁড়ির দিকে দেখল, ‘সুদেষ্ণা কোথায়?’
‘মাম লীনার কাছে গেছে। সান ডে ইভনিং-এ ফিরবে।’
শমীক এই প্রথম বিচ্ছেদের কষ্টের মতো কিছু অনুভব করল। সুদেষ্ণা নেই। শমীক আসবে জেনেও চলে গেছে। কাল ফোনে কথা হয়েছিল। একবারও বলেনি লীনার কাছে যাচ্ছে। শমীক ভাবতেই পারছে না চলে যাবার আগে সুদেষ্ণার সঙ্গে ওর দেখা হবে না। নীলকে জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ আজই কেন যেতে হল, কিছু জানো? লীনার শরীর ঠিক আছে?’
‘লীনা যেমন থাকে, সেরকমই আছে। শেরউড থেকে কোনও কল আসেনি। মাম নিজে থেকেই দুদিনের জন্যে গেছে।’
শমীক আর কোনও প্রশ্ন করল না। ওপরে নিজের দরকারি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতে নিতে হঠাৎ চাবির কথা খেয়াল হল। এ বাড়ির চাবি কার কাছে ফেরত দিয়ে যাবে? কাল মুভারদের ভ্যান রওনা হওয়ার পরেই ওকে বেরিয়ে পড়তে হবে। সুদেষ্ণা নেই। নীলও হয়তো থাকবে না।
শমীকের রাগ হচ্ছিল। সুদেষ্ণা ওর সুবিধে, অসুবিধের কথাও ভাবল না। যেন ভাড়াটে চলে যাচ্ছে। যাওয়ার দিন এত অভিমান করে কী লাভ?
শমীক ডাকল, ‘নীল, নীল! একবার সিঁড়ির কাছে এসো।’ নীল শুনতে পাচ্ছে না। শমীক চিৎকার করে ডাকল, ‘নীল, তুমি কি বেসমেন্টে?’ নীল টিভি দেখতে দেখতে শমীকের গলা শুনে উঠে এল। সিঁড়ির কাছে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, ‘কী হল, কিছু চাই?’
‘চাবিটা কী করব? কাল কি তুমি থাকবে?’
‘আমার তো কাজ আছে। ফিরতেও দেরি হবে। এনি ওয়ে, চাবিটা কোনও প্রবলেম না। তুমি মিসেস ক্রফটের কাছে রেখে যেও।’
শমীকের মনে হল নীলও যেন অন্যদিনের মতোই ব্যবহার করছে। শমীকের চলে যাওয়াটা ওদের কাছে এতই সামান্য ব্যাপার যে, সে নিয়ে ভাবারও সময় নেই।
আশ্চর্য! শমীক নিজেও বা এতটা আশা করছে কেন? চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত সে নিজেই নিয়েছে। সুদেষ্ণার সঙ্গে এত বছরের সম্পর্ক ভেঙে দিয়ে যাচ্ছে, সে জন্য তার কোনও দ্বন্দ্ব নেই, আক্ষেপ নেই। তবু যাওয়ার সময় সুদেষ্ণার না থাকা, নীলের নির্বিকার ব্যবহার বড় উপেক্ষার মতো লাগছে।
শমীক এই প্রথম বিচ্ছেদের কষ্টের মতো কিছু অনুভব করল। সুদেষ্ণা নেই। শমীক আসবে জেনেও চলে গেছে। কাল ফোনে কথা হয়েছিল। একবারও বলেনি লীনার কাছে যাচ্ছে। শমীক ভাবতেই পারছে না চলে যাবার আগে সুদেষ্ণার সঙ্গে ওর দেখা হবে না। নীলকে জিজ্ঞেস করল, ‘হঠাৎ আজই কেন যেতে হল, কিছু জানো? লীনার শরীর ঠিক আছে?’
শমীক চলে যাওয়ার পর কয়েক সপ্তাহ কেটে গেল। ওর ফোন এল না। সুদেষ্ণা বুঝতে পারছিল শমীক আর যোগাযোগ রাখতে চাইছে না। নীলকে যাই বলে যাক, এ-বাড়ির সঙ্গে শমীকের সব সম্পর্ক শেষ হয়ে গেছে। সুদেষ্ণাকে কখনও ওর প্রয়োজন হবে না।
প্রয়োজন শব্দটা উলঙ্গ সত্যের মতো সুদেষ্ণার চেতনায় আঘাত করছিল। আশ্রয়, অবলম্বন, ভালোবাসা—এইসব সূক্ষ্ম মায়াময় শব্দের আবরণে সে ঢাকা থাকে। সুদেষ্ণা জানে সে-ও নিজের প্রয়োজনে শমীককে এ-দেশে এনেছিল। শমীক পাশে না থাকলে সেই দুঃসহ সময় পার হয়ে আসা কঠিন হত। তবু, সুদেষ্ণা কখনও ভাবেনি শুধু প্রয়োজনের জন্য তারা পরস্পরকে অবলম্বন করে আছে। সে সমাজকে অস্বীকার করেছে। দুজনের অসম বয়সের সম্পর্ককে বাধা বলে মানেনি। এক তীব্র মোহের আবরণকে অন্ধ বিশ্বাসে আঁকড়ে ধরেছিল। সুদেষ্ণা ভেবেছিল সেই বোধের নাম ভালোবাসা। সেই অনুভব প্রেম।
এখন মাঝে মাঝে নিজেকে বড় অবিন্যস্ত লাগে। ঘটনাচক্রের আবর্তে ক্লান্ত এ-জীবন কখনও সুস্থির হবে না।
নিউইয়র্ক চলে আসার পর শমীক অনেকটা সময় পায়। অফিস ছুটির পরে সাবার্ব-এ ফেরার তাড়া নেই। পোর্ট অথরিটিতে গিয়ে বাসের জন্যে দাঁড়িয়ে থাকা নেই। রোজ যাতায়াতে দু’ঘণ্টা চলে যেত। ট্র্যাফিক, ওয়েদার, কিছু নিয়েই আর ভাবতে হয় না। নিউইয়র্কে সন্ধের পর এত জায়গায় যাওয়ার থাকে, অফিসের চাপ না থাকলে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ানো যায়। শমীক বহুদিন পরে কলকাতার মেজাজ ফিরে পাচ্ছিল। আমেরিকায় এসে পর্যন্ত বড় শহরে থাকা হয়নি। সুদেষ্ণার বাড়ি আর ছোট শহরে চাকরি— এভাবেই শুরু হয়েছিল। পড়াশোনাও ছোট কমিউনিটি কলেজে। নিউইয়র্কে চাকরি পাওয়ার পরও একইভাবে চলছিল। শমীক অনেকবার ভেবেছে। শেষপর্যন্ত সুদেষ্ণাকে বলতে হল। শমীকের তেত্রিশ বছর বয়স হয়েছে। এবার নিজের মুখোমুখি হওয়ার সময়। ইচ্ছে-অনিচ্ছেগুলো বুঝে নেওয়ার সময়। একটাই জীবন। শমীক নিজের মতো করে বাঁচতে চায়। ছোট শহরের নিস্তরঙ্গ পরিবেশ, সুদেষ্ণার সংসারের প্রতিদিনের রুটিন ওর আর ভালো লাগছিল না। এখন এই জমজমাট শহরে শমীক নতুনভাবে সময় কাটাচ্ছে। আঠারো তলায় ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্ট। ইচ্ছে হলে শুধু নিজের সঙ্গে নিজে থাকা। সন্ধেবেলায় শহরে হাজার আকর্ষণ। শমীক কোনওদিন ‘সোজো’-র প্রাইভেট আর্ট গ্যালারিতে যায়। কোনওদিন গুগেনহাইম মিউজিয়ম নয়তো মিউজিয়ম অফ মডার্ন আর্ট-এ যায়। প্রেস কার্ড নিয়ে লিংকন সেন্টারে ‘মহাত্মা ভার্সেস গান্ধী’ নাটক দেখে এল। নাসিরউদ্দিনের ইন্টারভিউ নিয়ে রাত জেগে রিভিউ লিখল। লেখাটা ‘এমপায়ার নিউজ’-এর রবিবারের আর্ট অ্যান্ড এন্টারমেন্ট সেকশনে গেল। শমীক তার কাজ আর ছুটির মেজাজ মিলিয়ে মুক্ত জীবনের স্বাদ অনুভব করছে। সুদেষ্ণার সঙ্গে কথা হয় না। শমীক ফোনে মেসেজ রেখেছিল। হয়তো নীল আসবে কোনওদিন।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: Wikimedia Commons, Flickr, Pexels
দীর্ঘকাল আমেরিকা-প্রবাসী আলোলিকা মুখোপাধ্যায়ের লেখালিখির সূচনা কলকাতার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পর্বে। আমেরিকার নিউ জার্সির প্রথম বাংলা পত্রিকা "কল্লোল" সম্পাদনা করেছেন দশ বছর। গত আঠাশ বছর (১৯৯১ - ২০১৮) ধরে সাপ্তাহিক বর্তমান-এ "প্রবাসের চিঠি" কলাম লিখেছেন। প্রকাশিত গল্পসংকলনগুলির নাম 'পরবাস' এই জীবনের সত্য' ও 'মেঘবালিকার জন্য'। অন্য়ান্য় প্রকাশিত বই 'আরোহন', 'পরবাস', 'দেশান্তরের স্বজন'। বাংলা সংস্কৃতির প্রচার ও প্রসারের জন্য নিউইয়র্কের বঙ্গ সংস্কৃতি সঙ্ঘ থেকে ডিস্টিংগুইশড সার্ভিস অ্যাওয়ার্ড পেয়েছেন।