পাড়ার জনা পঞ্চাশেক বাসিন্দাকে নিয়ে পিকনিকের (Picnic) আয়োজন করেছে স্থানীয় এক ক্লাব। সেই ক্লাবের সর্বেসর্বা বছর কুড়ির এক যুবক। কলকাতার নামী স্কুল থেকে র্যাংক-সহ উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে তখন সে গ্র্যাজুয়েশনের সেকেন্ড ইয়ারে, সেটাও কলকাতার ততধিক নামী এক কলেজে।
পড়াশোনায় তুখোড়, সে কারণে পাড়ায় কদরও আছে ওই তরুণের। তাই সে যখন পিকনিক আয়োজন করছে, পাড়ার দাদা-দিদি, কাকু-কাকিমা, জেঠু-জেঠিমারা ‘না’ করতে পারেনি।
বালিগঞ্জ থেকে বাস ছাড়ল, গন্তব্য গেঁওখালি। দ্বিতীয় হুগলি সেতু, কোনা এক্সপ্রেসওয়ে, কোলাঘাট পেরিয়ে মেচেদা থেকে বাস ঘুরল হলদিয়ার দিকে। তারপর তমলুক হয়ে পৌঁছে যাওয়া গেঁওখালিতে।
সারাদিন ধরে হইহুল্লোড়, দেদার খাওয়াদাওয়া, খেলাধুলো হল। একটা গোটা দিন মস্তিতে কাটিয়ে দিল সবাই। নেতৃত্বে ওই যুবক।

পিকনিক শেষে সময় এল বাড়ি ফেরার। বাস ফিরছে কলকাতার দিকে। বাসের সামনের সিটে চালকের পাশে বসা সেই যুবক হঠাৎ খেয়াল করল বাসচালক অন্ধকারে রাস্তা বুঝতে ভুল করেছেন। মেচেদার মোড়ে পৌঁছে তিনি ডান দিকে, মানে কলকাতার দিকে না ঘুরে, বাঁ দিকে খড়গপুরের দিকে বাস ঘুরিয়ে দিয়েছেন।
সেই যুবক সব বুঝেছে, কিন্তু কিচ্ছুটি বলেনি। তার মধ্যে সদা বহমান ভ্রমণপিপাসু মন তাকে চুপ করিয়ে রেখেছে। সে ভাবল চলুক বাস, আর একটু অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসা হবে।
আরও এক ঘণ্টা পর বাসচালকের যখন খেয়াল হল যে তিনি ভুল করেছেন, বাস তখন প্রায় খড়গপুর পৌঁছে গিয়েছে। বাসযাত্রীরা ভেবেছিলেন সন্ধ্যার মধ্যেই বাড়ি পৌঁছে যাবেন, সেটা না হওয়ায় তাঁরা রীতিমতো ক্ষুব্ধ। কিন্তু রেগে হবেই বা কী! বাড়ি তো ফিরতে হবে খড়গপুর থেকে।
অবশেষে বাস কলকাতার পথ ধরল এবং আরও ঘণ্টা তিনেক পর সবাই বাড়ি পৌঁছলেন। ওই যুবক যদি মেচেদার মোড়ে চালককে সতর্ক করে দিতেন, তা হলে এত কিছু কাণ্ডই হত না।

এই ঘটনার বছর চল্লিশেক পর প্রৌঢ়ত্বে পৌঁছে যাওয়া সেদিনের ওই যুবককে তাঁর তরুণ পুত্র জিজ্ঞেস করেছিল, “এত কিছু হচ্ছিল, তো তুমি চুপ করে বসেছিলে কেন? চালককে সতর্ক করে দিলেই তো পারতে।”
তাঁর জবাব ছিল, “বলে দিলে কি এই মজাটা হত রে! পিকনিক (Picnic) মানেই তো মজা, রোমাঞ্চ আরও কত কী! এই যে ফ্রি-তে বাস আমাদের খড়গপুর ঘুরিয়ে আনল, এর মধ্যে কিন্তু যথেষ্ট রোমাঞ্চ ছিল।”
উল্লেখ্য, সেদিনের সেই যুবকের ছেলেই এক লেখাটি লিখছে। হ্যাঁ, আমার বাবাই ছিলেন সেই দিনের সেই পিকনিকের আয়োজক। বাবার ছোটবেলা আর আমাদের ছোটবেলা কিন্তু এক রকমই ছিল। সেখানে পিকনিকের সংজ্ঞাও এক ছিল।
আমাদের কাছে পিকনিক (Picnic) মানে ছিল একটা দিনের একটা ছোট্ট পারিবারিক আউটিং, যেখানে রোজকার ব্যস্ততা ভুলে থাকা যায়। সারাদিন শুধু খেলাধুলো আর আনন্দ, পড়াশোনা নেই, মায়ের বকুনি নেই। খালি খেলা আর খাওয়া।

একটা সময় আমার কাছে শীতকাল মানেই ছিল পিকনিক। গোটা একটা বছর অপেক্ষা করে বসে থাকতাম, শীতকালের জন্য। কারণ শীত এলেই যে পিকনিকের সময় আসবে। কখনও বাসে, কখনও লোকাল ট্রেনে চড়ে পিকনিকে যাওয়ার মজাই আলাদা ছিল।
এই প্রসঙ্গেই একটা গল্প মনে পড়ে গেল। সেবার অশোকনগরে পিকনিকে যাওয়া হচ্ছে। শিয়ালদহ থেকে বনগাঁ লোকালে উঠে বসল সবাই। পিকনিক পার্টির একশো জন একটা ট্রেনে। সেই সঙ্গে স্থানীয় রোজকার যাত্রীরা তো আছেই। সব মিলিয়ে প্রচণ্ড ভিড় হয়ে গেল ট্রেনে। এ দিকে এক একটা স্টেশনে ট্রেন তো তিরিশ সেকেন্ডের বেশি থামে না। তাই অশোকনগর আসার দুটো স্টেশন আগে থেকেই সবাই ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম।
ট্রেন অশোকনগর পৌঁছে গেল। আমরা নামলাম। একটু পরে খেয়াল করলাম যে দলের অন্তত দশ জন ট্রেন থেকে নামতেই পারেননি। ট্রেন ততক্ষণে পাড়ি দিয়েছে পরের স্টেশন হাবড়ার উদ্দেশে। যাঁরা নামতে পারেননি তাঁরা অবশ্য হাবড়াতে নেমে তারপর নিজেদের ব্যবস্থাতে অশোকনগরের পিকনিক স্পটে সরাসরি পৌঁছে যান। তবে এত কিছু অসুবিধার মধ্যেই সবাই চূড়ান্ত মজা পেয়েছিল সে দিন। যাঁরা ট্রেন থেকে নামতে পারেননি, তাঁদেরও কোনও অভিযোগ ছিল না।

এখন অবশ্য পাবলিক ট্রান্সপোর্টে পিকনিকে যাওয়ার চল উঠেই গিয়েছে। নিজস্ব গাড়ি বা বাস ভাড়া করেই পিকনিকে যাওয়ার রীতি। তবে পিকনিকের সংজ্ঞা একই আছে। রোজকার ব্যস্ততা, পড়াশোনা ভুলে একটা দিন শুধু নির্ভেজাল আনন্দে মেতে থাকাই হল পিকনিক।
একবার দেখে নিই পশ্চিমবঙ্গের এমন কিছু জায়গা যেখানে আপনি পিকনিকে মেতে উঠতে পারবেন।
রায়চক
কলকাতার কাছেই দক্ষিণ ২৪ পরগনা জেলার মধ্যে পড়ে এই রায়চক। ডায়মন্ড হারবারের এই এলাকাটি কলকাতা থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত। হুগলি নদীর তীরবর্তী রায়চকের অপরূপ প্রাকৃতিক শোভা মনে ভরপুর স্বস্তি এনে দেবে। রায়চকের প্রধান আকর্ষণ হল দ্য এফ ফোর্ট। ঔপনিবেশিক শাসনকালে এটি তৈরি হয়েছিল বলে জানা যায়। ফোর্টের ওয়াচ টাওয়ারে চড়ে নদীর অসাধারণ দৃশ্য উপভোগের সুযোগ মিলবে। এছাড়াও কাছেই রয়েছে ডায়মন্ড হারবার লাইট হাউস, চিংড়িকালী ফোর্ট। যদিও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে চিংড়িকালী ফোর্টটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। রায়চকে নদীর পাড়ের একটি জায়গা বেছে নিয়ে পিকনিক করতে পারেন।

টাকি
কলকাতা থেকে মাত্র ৭৫ কিলোমিটার দূরে রয়েছে উত্তর ২৪ পরগনার টাকি। ঝটিকা সফরে একদিনের জন্য পিকনিক করতে হলে টাকি হতে পারে অন্যতম সেরা পছন্দের জায়গা। এই এলাকার মন্ত্রমুগ্ধকর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য তারিয়ে তারিয়ে উপভোগের সুযোগ মিলবে। পিকনিকের জন্য আদর্শ জায়গা হল এই টাকি। টাকির জালালপুরের কাছে রয়েছে মিনি সুন্দরবন। সুন্দরী, গরান, গেঁওয়ার মতো গাছের সারি রয়েছে এ তল্লাটে। ইছামতী নদীর ধারে এই টাকিতে গেলে পড়শি বাংলাদেশকে একেবারে চোখের সামনে থেকে দেখার সুযোগ মিলবে। চাইলে ইছামতীর বুকে নৌকা ভ্রমণেও মেতে উঠতে পারেন।

গড়চুমুক
কলকাতার কাছেই আরও একটি চিত্তাকর্ষক পিকনিক স্পট হল হাওড়ার গড়চুমুক। হাওড়ার এ-প্রান্তে গেলে জমে যাবে আপনার চড়ুইভাতি। ছুটির দিনে পছন্দের মানুষদের সঙ্গে নিয়ে পিকনিকে যেতে পারেন এই গড়চুমুকে। হাওড়া জেলার অন্যতম জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র ও পিকনিক স্পট হল এই গড়চুমুক। ফি বছর রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পিকনিক পার্টির ঢল নামে নদীর পাড়ের অপরূপ এই এলাকায়। এখানকার মূল আকর্ষণ হল মিনি চিড়িয়াখানা, ডিয়ার পার্ক ও ৫৮ গেট। পিকনিকের ফাঁকে চাইলে দ্রুত এগুলোও ঘুরে নিতে পারেন। মন চাইলে একদিন এখানে কাটিয়েও যেতে পারেন। ধারেকাছে বেশ কয়েকটি হোটেল পেয়ে যাবেন।

গাদিয়াড়া
তিন নদীর সঙ্গমস্থলের আরও একটি নজরকাড়া পিকনিক স্পট হল গাদিয়াড়া। হাওড়ার এই এলাকাটিও পিকনিক করার জন্য বেশ জনপ্রিয়। সপ্তাহান্তে একদিনের ছুটি কাটাতে হলে গাদিয়াড়া অন্যতম সেরা চয়েজ। হুগলি, রূপনারায়ণ এবং দামোদর নদীর সঙ্গমস্থলের এই এলাকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যও অসাধারণ। নদীর পাড়ে পিকনিকের সুবন্দোবস্ত রয়েছে এখানে।
বৈকুণ্ঠপুর, শিলিগুড়ি
শিলিগুড়ি শহরের গায়েই বৈকুণ্ঠপুর ফরেস্টের দুটি পিকনিক স্পট হল ডাবগ্রাম ফরেস্ট রেঞ্জের অধীনে ফারাবাড়ি নেপালি বস্তি এবং খোলাচাঁদফাপরি। দুটিই সাহু নদীর পাশে। ফরেস্টের মধ্যে দিয়ে বয়ে গিয়েছে এই নদী। চারপাশে শাল-সেগুনের সমারোহ। উন্নয়নের ছোঁয়াও রয়েছে। গত কয়েক বছরের মধ্যে দুটি এলাকাতেই সুন্দর পাকা রাস্তা তৈরি হয়েছে। তৈরি হয়েছে সুন্দর পাকা সেতু। সেতুগুলো সুন্দর করে রং করা হয়েছে। বনের পাশে সুন্দর খেলার মাঠও আছে। বনে বিভিন্ন পাখির ডাক আছে। আছে বানর। যদিও জঙ্গলের সেই গভীরতা নেই। তবুও শহরের মানুষ সারা বছরের একটানা ক্লান্তি কাটাতে একটা দিন জঙ্গলেই বনভোজন করতে ভালোবাসেন।
*ছবি সৌজন্য: Wikipedia, Wikimedia Commons, Vector Stock, Facebook, Istock, Pexels
জন্ম কলকাতাতে হলেও আদিবাড়ি বাঁকুড়ার ইন্দাস ব্লকের আকুই গ্রামে। বিডি মেমোরিয়াল স্কুল থেকে দ্বাদশ শ্রেণি উত্তীর্ণ, দীনবন্ধু অ্যানড্রুজ কলেজ থেকে স্নাতক এবং ইন্দিয়া গান্ধী জাতীয় মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর করে বর্তমানে ভ্রমণ সংক্রান্ত ব্যবসা করছেন শ্রয়ণ।