শেষ নাহি যে…
জীবনদর্শন ব্যাপারটা মোজেসের Ten Commandments-এর মতো সোজাসাপটা ভাবে লেখা থাকে না। অনেকটাই থাকে অবচেতনে— প্রভাবিত হয় নানা মানুষের, চলার পথের নানা অভিজ্ঞতা, ভুল-ত্রুটির দ্বারা। আমাদের আচরণে, নানা সিদ্ধান্তে অন্তর্নিহিত জীবনদর্শন প্রতীয়মান হয়।
আমার ব্যক্তিগত জীবনের বর্তমান পর্যায়ে বাবা-মা ছাড়াও একজনের প্রত্যক্ষ প্রভাব আছে। পাঠিকা হাসবেন না কিন্তু— তিনি আর কেউ নন, প্রখ্যাত সাংবাদিক সাহিত্যিক খুশবন্ত সিং।
একটি সাক্ষাৎকারে ওঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল অবসর জীবন উপভোগ করার বিষয়ে। নিজে মস্তি করতে করতে শতায়ু হয়েছিলেন— প্রশ্নটা ঠিক লোককেই করা হয়েছিল। পাঁচ ছ’টি মূল্যবান উপদেশ দিয়েছিলেন এই মাটিতে পা দিয়ে চলা সুরসিক সর্দারজি। সেগুলির মধ্যে একটি হল কয়েকটি সিরিয়াস হবি নিয়ে থাকা। এই ‘hobby’ কথার ঠিক সমার্থক কোনও শব্দ বাংলায় নেই। শখ বা নেশা কথাদুটি কাছাকাছি যায়।

বছর ৫৫ বয়স তখন, কর্মজীবনে ভালোই ব্যস্ত। নিজের কাজ উপভোগ করলেও বিকেলের দিকের ক্লান্তি জানান দিত বয়স হচ্ছে।
সামাজিক মেলামেশায়, কাছাকাছি বয়সীদের সঙ্গে আলোচনায়, অবসর জীবনে সময় কাটানোর প্রসঙ্গটা উঠে আসত মাঝে মাঝে। কারও তাস খেলার নেশা, কেউ কেউ গল্ফ বা টেনিস খেলায় আগ্রহী, অনেকেই চান দুনিয়ার নানা দেশে বেড়াতে।
তাস বা দাবা কোনোদিনও সেভাবে আকর্ষণ করেনি আমাকে। গল্ফ বা টেনিস খেলার সুযোগও পাইনি কখনও। যে খেলাগুলি কৈশোর-যৌবনকালে চুটিয়ে খেলেছি দেশবন্ধু পার্কে, ফুটবল ও ক্রিকেট — তা ষাটোর্ধ জীবনের উপযুক্ত নয়। আমি আবার অত্যন্ত আরামপ্রিয় অলস মানুষ, বেড়ানোর ঝক্কি এই বয়সে আর ভালো লাগে না।
আমার retirement planning-এর মধ্যে দুটি বাসনা উপরের দিকেই ছিল। প্রথমটা হল যখন ইচ্ছে পড়ে পড়ে ঘুমনো, দ্বিতীয়টি মনের আনন্দে বই পড়া। সামাজিক মাধ্যমে টুকটাক লেখালেখি অবশ্য শুরু করেছিলাম ঐ সময়েই, তবে সেটা যে অবসর জীবনের একটা বড় অঙ্গ হয়ে উঠবে সেটা পরিকল্পনার মধ্যে ছিল না।

কবিতা বা গল্প-উপন্যাস লেখা বড় কঠিন কাজ। সে ক্ষমতা আমার নেই। তাই বিভিন্ন বিষয়ে প্রবন্ধ, স্মৃতিচারণ আর রম্যরচনাতেই সীমাবদ্ধ ছিল আমার লেখালেখি।
অপ্রত্যাশিতভাবে বেশ কয়েকজনের কাছ থেকে লেখা চালিয়ে যাওয়ার অনুপ্রেরণা পেলাম। এঁদের মধ্যে অন্যতম আমার ছোট পিসেমশায় ডঃ সুবীর মজুমদার এবং প্রখ্যাত সাহিত্যিক নন্দিতা বাগচি। বছর দুয়েক আগে প্রয়াত সুগায়ক সুরসিক সুবীর দা (এই নামেই ডেকেছি ওঁকে, বিয়ের আগে থেকেই পরিচয় হওয়ার সুবাদে) ছিলেন রীতিমতো উন্নাসিক— চট করে কারও প্রশংসা করতেন না। তাই ওঁর কাছ থেকে পাওয়া আমার শখের লেখালেখির প্রশংসা খুবই অনুপ্রাণিত করেছিল। একদিন হঠাৎ মেসেঞ্জারে নন্দিতা বাগচীর কাছ থেকে একটা বার্তা পেলাম: ‘খুব ঝরঝরে লেখনী আপনার। আরো লিখুন।’ এই সামান্য কয়েকটি কথা আমার লেখক-সত্তাকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছিল। পরবর্তীকালে নন্দিতাদির সঙ্গে চাক্ষুষ পরিচয় হয়েছে— অতি চমৎকার মহিলা।
ধীরে ধীরে সামাজিক মাধ্যমে পরিচিতি বাড়ল। বেশ কিছু পত্রপত্রিকা থেকে লেখার আমন্ত্রণ পেলাম। কলকাতার রাস্তাঘাটে বেশ কয়েকজন চিনতে পেরে আলাপ করেছেন। বহু পাঠক পাঠিকা কলকাতা সফরকালে দেখা করেছেন, বাড়িতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এঁদের মধ্যে অন্যতম উপহার আবাসনের মধ্য-আশি পার করা প্রদীপ ভট্টাচার্য মহাশয়, এবং একই আবাসনের হৈমন্তী ভট্টাচার্যদি। এত মানুষের ভালবাসা পেয়ে আমি সত্যিই আপ্লুত।

বছর দুয়েক আগে বাংলালাইভ আমন্ত্রণ জানান একটি নিজস্ব কলাম শুরু করার। অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করেছি এই অপ্রত্যাশিত সুযোগ পেয়ে।
***
নেই নেই করে ৩১টি পর্ব লিখে ফেললাম।
ফেসবুকে লিখলে পাঠকদের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এই দীর্ঘ ধারাবাহিকে সেটা পাইনি। তাই জানি না লেখাগুলি পাঠকের প্রত্যাশা মেটাতে কতটা সফল হয়েছে, বা আদৌ হয়েছে কিনা।
‘প্রবাসীর নকশা’র প্রেক্ষাপট প্রবাসজীবনই হওয়া উচিত। প্রত্যাশিতভাবেই জীবনের অনেকগুলো বছর কাটানো স্থানগুলির (অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা, লিবিয়া এবং মুম্বই) নানা কাহিনি শুনিয়েছি এই কলামে— তার কিছু নিজের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতা-প্রসূত, আর কিছু শোনা কাহিনি (যেমন একটি পর্বে অসীম এবং রেবা মিত্রর প্রেমের গল্প) পরিবেশন। বেশ কয়েকটি লেখা (মূলত অস্ট্রেলিয় ইতিহাস সম্পর্কিত) নিজস্ব পড়াশোনার ভিত্তিতে। চোরাপথে কলকাতাও থেকে থেকে ঢুকে পড়েছে লেখায়। নিজের ব্যক্তিগত জীবনের কিছু কথাও।

লেখাগুলিকে কালানুক্রমিকভাবে পরিবেশন করিনি ইচ্ছা করেই। আশঙ্কা ছিল সেটা করলে ধারাবাহিকটি আত্মজীবনীর রূপ পেত। একঘেয়েমি এড়াবার জন্য লেখাগুলির স্থান-কাল-বিষয় ঘন ঘন পালটেছে।
এই পর্বে প্রবাসীর নকশার এই পর্যায়ের ইতি টানলাম। ওয়েব সিরিজের ভাষায় season 1 শেষ হল। এই seasonটি উৎসর্গ করলাম উপরোক্ত ড. সুবীর মজুমদার মহাশয়কে।
সম্পাদকমণ্ডলী চাইলে আবার কোনও সময়ে season 2 শুরু করব।
‘প্রবাসীর নকশা’ প্রথম পর্যায় সমাপ্ত
জন্ম ১৯৫৫ সালে উত্তর কলকাতার শ্যামবাজারে। জীবনের অর্ধেকটা প্রবাসে কাটালেও শিকড়ের টান রয়েই গেছে। অধিকাংশ স্বপ্নের ভাষা আজও বাংলা-- প্রেক্ষাপট কলকাতা। আই আই টি খড়গপুরের মেকানিকাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের স্নাতক হলেও অবসরজীবন জুড়ে আছে বাংলা সাহিত্য। আর টুকটাক কিছু লেখালেখি।