আগের পর্ব পড়তে: [১] [২] [৩] [৪] [৫] [৬] [৭] [৮] [৯] [১০] [১১] [১২] [১৩] [১৪] [১৫] [১৬] [১৭]
কত যে স্মৃতি (memories) ভিড় করে আসছে। সত্যি লিখতে বসে মনে হচ্ছে, এত ঘটনা সবারই জীবনে কি ঘটে? নাকি আমিই বেশি রিঅ্যাক্ট করি। এই সমস্ত স্মৃতিকথা লিখতে গিয়ে আমার স্পষ্ট উপলব্ধি হচ্ছে যে, তখনকার এবং এখনকার সমাজব্যবস্থা এবং মানুষের দৃষ্টিভঙ্গির শত শত গুণ পরিবর্তন হয়েছে। প্রায় পঁয়তাল্লিশ বছর আগের ঘটনা। কিন্তু এখনও জ্বলজ্বল করছে প্রতিটা মুহূর্ত। ওই বাধ্যবাধকতা কি ভাল ছিল, নাকি এখনকার সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে প্রাপ্ত সারা পৃথিবী ঘরে বসে চোখের সামনে দেখতে পাওয়া, উপলব্ধি করা, তার ভালমন্দ বিচার না করেই নিজেদের সংস্কৃতি বিসর্জন দিয়ে শুধুমাত্র বিশ্বায়নের হুজুগে গা ভাসিয়ে দেওয়া? কোনটা ঠিক। আমি বরাবরই একটু পিউরিটান। বন্ধুবান্ধবরা স্কুলে টিফিনে হয়তো গোল হয়ে বসে সিনেমার গল্প করছে, গান গাইছে, আড্ডা মারছে। আমি গেলেই সব চুপ। মুচকি মুচকি হাসি। —এই ইন্দ্রাণী দক্ষিণীতে কী গান শিখলি রে নতুন। শোনা প্লিজ। আমি আর জিজ্ঞাসা করলাম না কী সিনেমার গান গাইছিল অঞ্জনা। একটা খুব মিষ্টি হিন্দি গান। আমি তো নাম বললেও বুঝতে পারব না। আমার দৌড় মধুসূদন দত্ত, নেতাজি বা খুব জোর বেন হুর…এইসব ফিল্ম। মা’র কড়া নজর, এইসবের বাইরে কোনও সিনেমা যেন আমরা না দেখি।

প্রথম ফুচকা খেয়েছিলাম ক্লাস টেন-এ, বেনারস গিয়ে। একটা ফাইভ স্টার হোটেলে। রেজাল্ট ভাল হয়েছিল বলে একটা এইচএমটি নতুন হাতঘড়ি উপহার দিয়েছিল বাবা। আর মা আমার অনেকদিনের ফুচকা খাওয়ার সাধ মিটিয়েছিল মা’র পছন্দমতো পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হোটেলে গিয়ে। দুটো ফুচকা। চেয়ার-টেবিলে বসে চামচে করে খাওয়া। সেই অমৃতস্বাদ, সেই আনন্দ আর কখনও কোনওদিন রাস্তার ধারের ফুচকাওয়ালাদের তৈরি ফুচকা খেয়ে হয়নি। যা কিনা বিয়ের পর কর্তার কল্যাণে বারবার আস্বাদ করেছি এবং মা জানতে পারলে শঙ্কর বারবার শাশুড়ির বকুনি খেয়েছে। বেচারা!
আরও পড়ুন: জীবন থেকে জীবনে: তৃতীয় পর্যায় – পর্ব ১৫
বিয়ের পর প্রত্যেকদিন ফোনে মা’কে সারাদিনের ঘটনা, কাহিনী সবকিছুর বিবরণ দিতে হত। শেষের দিকে সবকিছু বলতাম না। কিন্তু মা ঠিক বুঝে যেত। যাক সে কথায় পরে আসব।
এবার আসি ২৫শে বৈশাখে আমার অনুভূতি এবং অভিজ্ঞতার কথায়। আমাদের একটা বাংলা মাসিক সাহিত্য পত্রিকা ছিল। মা সম্পাদক। আমি পুঁচকে প্রকাশক। ‘রূপসা’ নাম। আমাদের নিজস্ব লেটার প্রেসে ছাপা হত প্রত্যেক মাসে। তারপর গাঁট গাঁট পত্রিকা পাতিরামের কাছে পাঠানো হত। পাতিরাম তখন খুব নামকরা ডিস্ট্রিবিউটার ছিল সবরকম পত্রিকার। তখনকার সবচেয়ে নামকরা পত্রিকা দেশ, আনন্দবাজার হাউসের। তারও ডিস্ট্রিবিউটর ছিল পাতিরাম।
আমি তো কিছুই বুঝতাম না। শুধু দেখতাম আমাদের বাড়ির বসার ঘরে বড় বড় সাহিত্যিকরা আসছেন, ভিড় জমাচ্ছেন। কাপের পর কাপ চা, তার সঙ্গে নানারকম স্ন্যাক্স রান্নাঘর থেকে ‘কপ্পুরী’—আমাদের বাড়ির সর্বংসহা, মায়ের ডানহাত, বারবার ট্রে-তে করে দিয়ে আসছে। আবার যাচ্ছে, দিচ্ছে। সে এক মহা হইচই আড্ডাঘর, সেখানে আমাদের ভাইবোনেদের প্রবেশ নিষেধ।

এ হেন রূপসা’র ২৫শে বৈশাখ সংখ্যা ছাপা হত সারারাত ধরে আমাদের প্রেসে। ভোরবেলা পাঁচটায় সেই কপি হাতে হাতে আমাদের কাছে চলে আসত। সেই একদিন, বছরে মাত্র একদিন, আমার ছাড় ছিল। আমি আর আমার একমাত্র সঙ্গী, বন্ধু, মুস্কিল-আসান—এখনকার স্বনামধন্য জ্যোতিষী-প্রিয়াঙ্কা; দুজনে মা’র সঙ্গে এবং আরও অন্যান্য উঠতি কবি, সাহিত্যিকদের নিয়ে ছুটতাম রবীন্দ্রসদন চত্বরে। ভোরবেলা ছ’টার মধ্যে পৌঁছে যেতাম তখনকার রবীন্দ্রসদন চত্বর—এখনকার সঙ্গে মেলানো যায় না।
বিরাট খোলা, সবুজ ঘাসের মাঠ। মাঠজুড়ে পেল্লায় প্যান্ডেল। শ’য়ে শ’য়ে মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। বসে আছে ফরাসের ওপর। নতুন বাঁধা মঞ্চে তখনকার বিখ্যাত রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীরা গান গাইছেন, মঞ্চজুড়ে কবিগুরুর বিরাট প্রতিকৃতি। তাতে মোটা মোটা রজনীগন্ধার মালা। বড় বড় ফুলদানিতে গোছা গোছা রজনীগন্ধার স্টিক। চারদিক ফুলের গন্ধে ম’ ম’ করছে। দুর্দান্ত গরম। কিন্তু সব উপেক্ষা করে উজ্জ্বল মুখে আট থেক আশি-রা। ‘কী আনন্দ, কী আনন্দ, দিবারাত্রি নাচে মুক্তি, নাচে বন্ধ’ কবিগুরুর এই ছন্দে মেতে আছে।
শুধু দেখতাম আমাদের বাড়ির বসার ঘরে বড় বড় সাহিত্যিকরা আসছেন, ভিড় জমাচ্ছেন। কাপের পর কাপ চা, তার সঙ্গে নানারকম স্ন্যাক্স রান্নাঘর থেকে ‘কপ্পুরী’—আমাদের বাড়ির সর্বংসহা, মায়ের ডানহাত, বারবার ট্রে-তে করে দিয়ে আসছে। আবার যাচ্ছে, দিচ্ছে। সে এক মহা হইচই আড্ডাঘর, সেখানে আমাদের ভাইবোনেদের প্রবেশ নিষেধ।
ইন্দ্রাণী ভট্টাচার্য
আমরা গান ধরলাম—
“আমার মুক্তি আলোয় আলোয়…
এই আকাশে…”
আশপাশের সবার দৃষ্টি হঠাৎ ঘুরে গেল আমাদের দিকে। ‘মাত্র আট আনা, আট আনা, আট আনা’- সবাই মিলে সঙ্গে সঙ্গে পত্রিকা ডান হাতে নিয়ে নাচাতে লাগলাম। হুড়মুড় করে সবাই এসে রূপসা কিনছে। আমাদের কী আনন্দ, মা একদিকে দাঁড়িয়ে প্রশ্রয়ের হাসি হাসছে। ওই একদিন মা একদম অন্যরকম।

ঝড়ের বেগে পাঁচশো ‘রূপসা’র সব শেষ। বিক্রি হয়ে গেল। এরপর চা, চিপস্ খেতে খেতে গান শোনা। বেলা বারোটা নাগাদ আবার আস্তে আস্তে বাড়ি ফেরা। এক বছরের আনন্দ, শক্তি বা এনার্জি সব জড়ো করে আবার পরের বছরের অপেক্ষা। কত বড় বড় শিল্পীর কত গান যে ওই সময় শুনেছি। গুনে শেষ করতে পারব না। তাঁরা ক্রমে ক্রমে, কালে কালে কিংবদন্তী হয়ে গেছেন। ঈশ্বরের আশীর্বাদে আমিও একদিন এইসব স্বপ্নের শিল্পীদের সঙ্গে একমঞ্চে গান গাইতে শুরু করলাম। তাঁরা প্রায় সবাই সাদরে আমাকে স্থান করে দিলেন। উৎসাহ দিলেন। প্রশংসা করলেন। যা কিনা আজও আমার পাথেয় হয়ে আছে। সেই সমস্ত জীবন্ত ঈশ্বরদের পদস্পর্শ করতে পেরেছি। সেই আশীর্বাদের ধুলো নতমস্তকে মাথায় সন্তর্পণে লেপন করেছি।
আমার জীবনের প্রথম এবং শেষ প্রেম সঙ্গীত। ঈশ্বরকে সবসময় একটাই অনুরোধ, অনুনয় করি—ঠাকুর আমার সব নিয়ে নাও, শুধু শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত আমার কণ্ঠ নিও না। সুর নিও না। আমার নিজস্ব যা আছে সবই তোমার কৃপা, তোমারই সম্পদ। শুধু এই দুটো আমারই থাকে যেন শেষ শয়ান পর্যন্ত। খ্রীষ্টধর্ম আমার বড় পছন্দের। তাদের ভাষায় বলি।- “আমেন”।
(চলবে)
ছবি সৌজন্য: লেখক
বিখ্যাত রবীন্দ্রসংগীত শিল্পী ও দূরদর্শন ব্যক্তিত্ব
One Response
অসম্ভব সুন্দর লেখনী আপনার। আবার আপ্লুত হলাম। আরো ভালো লাগলো কেননা আমাদের সেই কিশোর বয়সে আমরাও যেতাম রবীন্দ্র সদনের সামনে ২৫ সে বৈশাখের ভোরে। শুরু হতো সানাই এর মাঙ্গলিক সুরে। মঞ্চে তখন এক এক করে গান শোনাতেন শন্তিদেব ঘোষ, সুচিত্রা মিত্র, কণিকা ব্যানার্জী, চিন্ময় চট্টোপাধ্যায়, দ্বিজেন মুখার্জী রা। সে সব দিনই ছিল একেবারে অন্যরকম। আপনার লেখা পড়ে আবার সে সব স্মৃতি ফিরে এলো মনের মধ্যে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।