বইয়ের নাম: অরিত্র সোমের কবিতা
কবি: অরিত্র সোম(Aritra Som)
প্রকাশক: মাস্তুল
প্রচ্ছদ: আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়
প্রকাশকাল: অগাস্ট, ২০২৩
বিনিময় মূল্য: ৩৭৫ টাকা
‘যে গেছে বনমাঝে চৈত্র বিকেলে
যে গেছে ছায়াপ্রাণ বনবিথীতলে
বন জানে অভিমানে গেছে সে অবহেলে
যে গেছে অশ্রুময়, বন-অন্তরালে…’
আমার একচিলতে ভাড়া বাড়ি ভরে উঠেছে চাপচাপ দীর্ঘশ্বাসে। জানলার ওদিকে চৈত্র শেষের উত্তর কলকাতা। আর আমি পূর্বতন উন্মাদ, এক নাগাড়ে শুনে চলেছি এই গান; মহীনের ঘোড়াগুলি-র ‘চৈত্রের কাফন’। সে এক অবিশ্বাস্য চৈত্রের দিনই বটে! সংক্রান্তির সেলে চারিদিক মুখর। একদিন পরেই পয়লা বৈশাখ। এমন সময়ে গনগনে রোদের ভিতর এসে পৌঁছেছে এক দুঃসংবাদ— অরিত্র সোম আর আমাদের মধ্যে নেই। কবি অরিত্র সোম…
অরিত্রকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম না। চিনতাম ওর লেখাকে। আর সে লেখা পড়তে পড়তে পরিচয় হয়েছিল ওর অল্টার-ইগো অজিতেশের সঙ্গে। তখনও জানতাম না, অরিত্র একদিন হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে। শুধু থেকে যাবে কবিতাগুলো। ওর একটিমাত্র কবিতার বই-ই ছিল এতদিন। নাম, ‘রামকৃষ্ণ হার্ডওয়্যারস লেন’। ছিমছাম, এক ফর্মার। সেখান থেকে গুটিকয়েক লেখা পড়েছিলাম কেবল। আর, কিছু পড়েছিলাম ফেসবুকে। সেসব পড়ে একটা কথাই মনে হত— এই ছেলের আরও অনেক বেশি লেখা উচিত। অরিত্র নিজেকে ভাঙার ক্ষমতা রাখত। ‘এক্সপেরিমেন্ট’ ছিল ওর সহজাত ভঙ্গি। তাই হয়তো, আমার পাঠক মন সেসব লেখার সূক্ষ্ম অনুরাগী হয়ে উঠেছিল, ক্রমেই। অরিত্রর লেখা কয়েকটা লাইন আমার মাথায় আজকাল দিবারাত্র ঠোক্কর খায়—

‘কাঁদো, কাঁদো। হালকা হও।
আর এই ফাঁকে জাহাজ নিয়ে — ঘুমিয়ে পড়ো
জীবন তোমাকে, একটা নিজস্ব শহর দিয়েছে’
১৪ এপ্রিল, ২০২৩, বারান্দায় চুপ করে বসে আছি, একা। জানি, অরিত্রর অত্যন্ত প্রিয়, আমাদের কয়েকজন কবি-বন্ধুরা এক ধাক্কায় বড় হয়ে যাবে আজকের পর থেকে। এই অভিশপ্ত চৈত্র-সংক্রান্তি সারাজীবনেও স্বাভাবিক হবে না আর। কবির মৃত্যু ঘটেছে। আত্মহনন। লেখার ভিতর বেপথু যতিচিহ্নের ব্যবহার, স্পেস, ইমেজারির কালগর্ভে আজ সে নিজেই তলিয়ে গেছে। একের পর এক লেখা পড়ে গেছি সবাই, অথচ বুঝিনি, কী নিপুণভাবে কাব্যময় সুইসাইডাল নোট লিখে চলেছিল অরিত্র। পরবর্তী সময়ে ওর বাদবাকি লেখা পড়তে পড়তে শিউরে উঠেছি, কেঁদেছি, মনে মনে ঝগড়াও করেছি ওর সঙ্গে। কবিদের এই এক স্বভাব! কীভাবে যেন বন্ধুর বন্ধু আমাদেরও কতদিনের পরিচিত হয়ে যায়। কবিতা এমনই…
‘আমি আমার জন্ম দেখতে চাই
আমি আমার মৃত্যু দেখব না বলে’

এই কবিতার পাশাপাশি আরেকটি কবিতা চোখে পড়ে—
‘ম্যাটাডোর নিয়ে বাড়ি ছাড়িয়ে
চলে যাচ্ছে ওরা
খইফুল পড়েছে বলে, জ্যোৎস্নাকেও
অবহেলা করছে রেলপাত’
এই লেখার শেষ লাইন— ‘আমার খাঁচাগুলো কেঁপে কেঁপে উঠছে…’
অরিত্রর কবিতার বিপরীত ব্যঞ্জনা আমার ভিতর বুনে দেয় অস্বস্তির বীজ। মৃত্যু, মৃত্যু, মৃত্যু। একটি পিঁপড়ের মৃত্যু, একটি পাখির মৃত্যু, কুকুরের মরদেহ নিয়ে বলতে বলতে, অরিত্র লিখে ফেলেছিল জন্ম এবং মৃত্যুর মধ্যিখানের প্যাসেজের গল্প। ও বোধহয় মৃত্যু পরবর্তী প্রতিটা দৃশ্যের কথা জানত। তাই, আত্মহত্যার প্রবণতা ওকে অবসাদ না, শেষ অবধি আবিষ্কারের উল্লাস দিয়েছিল। ‘কিছু বিশেষ দিনের ঘটনা’, ‘জুডাসের তৃতীয় চক্ষু’ পড়লে বোঝা যায়, আত্মহত্যা নিয়ে ওর ধারণা দিনের আলোর মতো স্পষ্ট ছিল।

‘দূরত্বে, জেগে আছি’—
এক শনিবার বিকেলে গুটিগুটি পায়ে জড়ো হয়েছি আমরা। মুখভার, চোখ ভরে আছে জলে। এই আয়োজন যাকে ঘিরে, সে অভিমান করত তার লেখা নাকি কেউ পড়ে না। অথচ, সেদিন কলেজ স্ট্রিটের সেই জমায়েতে অরিত্রর লেখা নিয়ে আলোচনা করেছিলেন সবাই। ওর বহুদিনের ইচ্ছে, আহ্লাদ ছিল ‘মাস্তুল’ থেকে ওর বই প্রকাশ হবে এবং প্রচ্ছদ করবে কবি ও প্রচ্ছদশিল্পী আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়, ওরফে অরিত্রর আকাশদা। অরিত্রর বই প্রকাশ হল। বইয়ের নাম- ‘অরিত্র সোমের কবিতা’। আকাশই প্রচ্ছদ করল। সম্পাদনায় তন্ময় ভট্টাচার্য এবং আকাশ গঙ্গোপাধ্যায়। শুধু সেই বই হাতে নিয়ে দেখা হল না অরিত্রর। আমরা কেঁদে চলেছি সময়কাল পেরিয়ে। স্ক্রিনে ফুটে উঠছে অরিত্রর ছবি।

সুমনের গানে শুনি, ‘কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক হওয়া যায়’। কী এক অস্বস্তি হতে, হাতে তুলে নিই ‘অরিত্র সোমের কবিতা’। তাতে লেখা, ‘যতটা রাস্তা পেরিয়ে আসা, পিছন ফিরলে সেখানে আত্মহত্যা দেখা যায় শুধু’। একের পর এক কবিতায় মৃত্যুকে আহ্বান জানিয়েছে সে। কিছু কিছু কবিতায় এতই ডার্ক ইমেজারি দিয়ে ছবি এঁকেছে, যা পড়তে পড়তে মনে হয়, এসব লেখা আসলে কোনও মানুষের না; পরপারের কোনও এক বাসিন্দার আত্মকথন। সে কীসের খোঁজে ছিল এতদিন? মৃত্যু পরবর্তী জীবন নাকি কবিতার গহীন আন্ধারের?
কোনও বই যখনই হাতে পাই, খুলে পড়তে শুরু করি। কিন্তু অরিত্রর এই বইটির ক্ষেত্রে তা পারিনি আমি। ২৭ বছর ৮ মাসের ক্ষুদ্র জীবনে, মৃত্যু নিয়ে ফ্যান্টাসাইজ করেছে সে। লিখে গেছে অস্বস্তিমাখা দুরূহ প্রলাপ। পাঠক, এই লেখা পড়তে গিয়ে যদি আপনাদের মনে হয় যে, আমি কবি এবং কবিতার মধ্যে দূরত্ব রাখছি না, সেক্ষেত্রে আমি অপারগ। কবিতা কবিকে ছাপিয়ে যাবে, তাই বোধহয় কাম্য। কিন্তু অরিত্রর ক্ষেত্রে তা কিঞ্চিৎ ব্যতিক্রম। কারণ, কবির তীব্র মৃত্যুচেতনা, স্বয়ং কবি এবং কবিতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মুখোমুখি দাঁড়িয়েছে। বইটিতে রয়েছে ‘রামকৃষ্ণ হার্ডওয়্যারস লেন’, প্রকাশিত এবং অপ্রকাশিত কবিতা। সেসব কবিতায় অরিত্র নিজের মৃত্যু দেখতে পায়। দেখে, কুঁকড়ে যাওয়া সাদা চেয়ার, আত্মহত্যার গতিপ্রকৃতি। ক্রমাগত অজিতেশের সঙ্গে কথা বলে যায় সে। ছুটে মরে নীহারিকা নাম্নী কোনও এক নারীর জন্য।

‘অজিতেশ বেরিয়ে গেছে ঘর থেকে। বিছানায় এখন বসে আছে কাক। ওর ঠোঁটে লেগে, পুড়ে যাচ্ছে আমাদের গন্ধ। অজিতেশ ঢুকে গেছে ইঁদুরের গর্তে। কবে বেরোবে আবার, মৃত্যুও জানে না…’
‘পরমান্ন’ কবিতায় সে লিখেছে, ‘কাঁঠাল পাতা নিয়ে আসে ভোলা সন্ন্যাসী/ নিজের নুনপোড়া মাংসের সাথে সেসব খেতে খেতে অজিতেশ বাবা হয়’। দৃশ্যের ভিতর দৃশ্যের জন্ম দেওয়াই ওর কবিতার অন্যতম অস্ত্র।
আবার, ‘প্রেমের কবিতা এখনো যে লিখতে পারলাম না নীহারিকা’ পড়তে গিয়ে মনে হয়, প্রেমের প্রতি ওর আবেদন খানিক মর্গের হিমশীতল আবহের মতো।
অরিত্র সোমের কবিতায় রাজনীতি আছে, চারপাশকে ছিঁড়ে কেটে দেখার স্পষ্ট ধার আছে। সে জীবনকে দেখত মেটাফরের চোখে। তার কবিতা কিছুটা ধোঁয়াশা, কিছুটা পরলোকচর্চার আধার যেন!
একবছর পেরিয়ে অরিত্রর বাড়ি গেছি, সেদিন ওর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। অরিত্র ওর মাকে স্বপ্নেও দেখা দেয় না আর। ঘরে সাজানো পরিপাটি লেখার ল্যাপটপ, হাতঘড়ি, হাসিমুখের ছবি। থরেথরে সাজানো প্রিয় কবিবন্ধু, অগ্রজদের কবিতার বই। অরিত্র মৃত্যুকে চুমু খেয়েছে পরম যত্নে। এই প্রসঙ্গে অত্যন্ত ডার্ক একটি লেখার কথা মনে আসে, যা ‘অরিত্র সোমের কবিতা’ বইটির অপ্রকাশিত ভাগে রয়েছে।
‘লাশ হয়ে দাঁড়িয়ে আছি। আর একটু পরেই, ঘটি ভেঙে ফিরে যাবে সবাই। নাইকুণ্ড ভরে গেছে জলে। কার ছায়া?’
লেখা এগোতে থাকে আরও।
‘মোমের মতো খসে পড়ছি। ভেতরে, সরু আধপোড়া একটি সুতো। কেরোসিনের আলোয় তাকে ম্রিয়মান দেখায়। চুবিয়ে নিই খানিক।’
কিছু পাঠ খুব ব্যক্তিগত। সেক্ষেত্রে বইয়ের সম্পাদনা, কবির লিখে ফেলা কিছু লাইন নিয়ে এভাবে হয়তো সত্যিই বলা হয়ে ওঠে না। ভুল বাসে উঠে পড়ি। গ্রীষ্ম, বর্ষা পেরিয়ে একলাফে হেমন্তকাল প্রবেশ করে আমার মনে। ঝিমঝিম করে ওঠে মাথা। এই কবির মৃত্যু না হলেও, আমার পাঠপ্রতিক্রিয়া আজ একই হত। হত কি? আধো অন্ধকারে কুয়াশা গাঢ় হয়। অরিত্র লিখছে —
‘অরিত্র একটা স্মৃতির নাম…
এইভাবে যারা ভেবেছিল, তারা
রাস্তা পেরিয়ে
বাড়ির দিকে চলে যাচ্ছে
মাঠে ফাঁকা বসে আছি আমি
আরও হাজার খানেক অরিত্র-র ওপর
বুঝতে চাইছি
স্মৃতি নামক কুয়োর গভীরতা’
ওর কবিতা জীবনের অপরপ্রান্ত থেকে লেখা। সে জানত, ‘আমাদের প্রত্যেকের মৃত্যুদৃশ্যে একজোড়া পা থাকবে…’
‘আমার তো কোনো প্রতিভা নেই। রাতদিন নেই।’
কবি অরিত্র সোম, নাকি তার অজিতেশ, কার স্বগতোক্তি এ-সকল?

ফেসবুকে অরিত্রর ছবি এখনও জ্বলজ্বল করছে নক্ষত্রসূচিকা মুদ্রার মতো। বইমেলার মাঠ থেকে ভেসে আসবে গানের সুর, লিটল ম্যাগাজিনের তুমুল হৈ-হল্লা। আমরা প্রতিবছর মাথা নিচু করে বেরিয়ে আসব তার বাড়ি থেকে। অরিত্রর আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হিসেবে কি আজন্মকাল দায়ী থাকবে না বাংলা কবিতা? অভিমান, একাকিত্ব, লিখতে না পারার যন্ত্রণা থেকে নিজেকে মুক্তি দিয়েছে সে।
অরিত্র সোম আত্মহননের কবি, পরাবাস্তবতার কবি। সে লিখে গেছে, ‘আত্মহত্যার প্রতি কয়েক মিনিট’। তার কবিতায় মাঝেমধ্যে এক পাগলকে দেখি। দেখি, মায়ের প্রতি নির্ভরতা।
কিন্তু সেই অরিত্রই লিখেছে, ‘আমাদের কোনো প্রতিভা নেই, আশ্রয় নেই, আয়না নেই, শরীর নেই’
অরিত্রর গলার দাগ, অভিমানী চোখ, শ্মশানবন্ধুদের ভিড় পেরিয়ে যাওয়া বাসি ফুল, খই মাথার মধ্যে ঘোরে। তার মা এই কবিতার বইটি জীবনের শেষ সম্বলের মতো আঁকড়ে ধরে আছেন।
এই বইয়ের শেষের ভাগের লেখা পড়লে বোঝা যায়, অরিত্র দূরপাল্লার এক ট্রেনে উঠে পড়েছিল বহুদিন আগেই। গন্তব্য স্পষ্ট—
‘কান্না নেই আর। শুধু শীতের বাতাসে ওড়ে শরীর
একা
একা
মৃত্যুর মতো, একা…’ সত্যিই কি তাই, অরিত্র?

আত্রেয়ী চক্রবর্তী
আত্রেয়ী চক্রবর্তী। জন্ম ১৯৯২, হাওড়ায়। কবি, ওড়িশি নৃত্যশিল্পী। ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ করলেও, মূলত লেখালেখি করেন বাংলা ভাষায়। প্রকাশিত কবিতার বই - আফজলকে লেখা চিঠি