বারো পার্বণের দ্বিতীয় পর্বে অতিথি ছিলেন সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়(Sanjoy Mukhopadhyay)। সঞ্জয়দাকে ঘিরে রাস্তাই বারবার আমাদের মঞ্চ। তা সে রাসবিহারী মোড় হোক বা নন্দন চত্বর বা যাদবপুর। ঋত্বিকতন্ত্র নিয়ে চার দশকেরও বেশি সময় তিনি তাঁর বোবাযুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। সক্রেটিসের মতোই তাঁকে আজও ছাত্ররা রাস্তায় ঘিরে ধরে।
আমাদের বড় হওয়ার পথে অন্যতম এই স্তম্ভ আমাদের মাস্টারমশাই সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়। কত বিপন্ন সময় কেটেছে তাঁর সঙ্গে। কত স্বপ্ন দেখিয়েছেন তিনি দুর্দিনে।
বারো পার্বণের দ্বিতীয় অনুষ্ঠানে অতিথি হিসাবে সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমার কথা বলার সুযোগ একরকম তাই গঙ্গাজলে গঙ্গাপুজো!
সেদিনের রবিবার সন্ধ্যায় গরম কিছুটা কম ছিল।

গত মাসে অঞ্জন দত্তর লেখালেখির বিষয়ে আলোচনাকে ঘিরে শুরু হয়েছিল বারো পার্বণ। অনুষ্ঠানের মূল উদ্যোক্তা অভিজিৎ বসু। সহযোগিতায় বুক কেবিনের কর্ণধার ভাস্কর পালিত। এদিনও সন্তোষপুরের বুক কেবিন দোকানে ধীরে ধীরে হাজির হচ্ছিলেন সঞ্জয়ের অনুরাগী পাঠক, শ্রোতা তথা দীর্ঘদিনের নানাবয়সী সহযাত্রীরা। আগের দিন ছিল ফাদার্স ডে, এও এক সমাপতন কারণ সঞ্জয়দা আমাদের অনেকেরই অভিভাবকসম মাস্টারমশাই। তা ছাড়া তিনি এ সময়ের অন্যতম বড় চিন্তক, লেখক, বুদ্ধিজীবী। প্রায় দু’ঘণ্টার আলোচনায় এদিন উঠে এল ঘটক থেকে নবারুণ, সোলানাস থেকে চমস্কি, সত্তর দশক থেকে আজকের হিন্দু ভারত আরও কত কী! বড় মায়াময় পরিবেশ ছিল সেদিন। বহুদূর থেকে মানুষরা এসছিলেন। তাঁরা নানা প্রশ্নও করছিলেন। উপস্থিত ছিলেন জারি বোবাযুদ্ধের লালাদা, ফিল্মমেকার দেবাশিস সেনশর্মা-সহ আরও নানা বয়সী গুণীজনরা।
মৃণাল সেন তাঁকে বলেছিলেন আঁদ্রে বাজা।
সন্দীপন চট্টোপাধ্যায় সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, শ্রেষ্ঠ প্রাবন্ধিক। যৌবনের বন্ধু নবারুণ অনেক আগে থেকেই মনে করতেন, প্রবীণ বয়স্কদের তুলনায় তাঁর সমসাময়িক সঞ্জয় অনেক এগিয়ে। জয় গোস্বামীও বারবারই বলেন, তাঁদের যৌবনে জীবনানন্দকে সিনেমা বা চিত্রকলা দিয়ে ওভাবে ব্যাখ্যা একমাত্র সঞ্জয়ই করতে পারতেন। সঞ্জয় অবশ্যই ব্যাখ্যা করেন না। বরং পালটা আরেকটা লেখাই লিখে ফেলেন বরাবর। সে লেখা সিনেমার অন্তর্জালক স্ক্রিপ্ট হতে পারে বা কবিতা- রঁলা বার্ত বা ওয়াল্টার বেঞ্জামিনের মতোই তাঁরও দেওয়াল নেই কোনও। গদার বা বার্গম্যান বা কালীঘাট বা বদলেয়ার বা দস্তভয়স্কি বা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় বা বাঙালির আধুনিকতা বা অনন্য রায় অথবা ঋত্বিক ঘটক। সব কিছুই সঞ্জয়ের বিষয়। সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় একদা তাঁকে বলেছিলেন, অসাধারণ বাগ্মী। একাধিক বাংলা শব্দবন্ধের জন্ম দিয়েছেন সঞ্জয় তাঁর লেখাগুলিতে, যেমন ‘নাশকতার দেবদূত’ বা ‘স্থানাঙ্ক নির্ণয়’ বা ‘অন্তর্বর্তী প্রতিবেদন’।

সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়কে লোকে চেনে চলচ্চিত্র বিশেষজ্ঞ হিসেবে। কিন্তু আদতে তিনি একজন এমন মৌলিক লেখক যাঁর তুলনা চলতে পারে রঁলা বার্ত বা ওয়াল্টার বেনিজামিনের সঙ্গে। তাঁর লেখাগুলিকে প্রবন্ধ বলব না সিনেমা না কবিতা তা নির্ধারণ কঠিন বলেই বাঙালি তাঁকে সহজ ভাবে দেগে দিয়েছে ‘প্রাবন্ধিক’ তকমায়। গত চার বা পাঁচ দশকজুড়ে অজস্র ছোটো ছোটো নামহীন কাগজে অজস্র শিল্পীদের নিয়ে লিখে গেছেন তিনি। কত কাগজ হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে কত লেখা। তবু তাঁর লেখায় উনিশ শতকের মহারথীদের পাশেই রয়েছেন দস্তয়ভস্কি থেকে মার্কেজ হয়ে একো, জিজেক, কুন্দেরা-রা। আছেন জীবনানন্দ, কমলকুমার, নবারুণ, সুবিমল থেকে গুন্টার গ্রাস হয়ে অমিয়ভূষণরা। সঞ্জয়ের সমস্ত লেখা গ্রন্থবদ্ধ হলে গত কয়েক দশকের বিকল্প সংস্কৃতির একটা নিরিখ আমরা পাব, যা একমাত্র সঞ্জয়ের মৌলিক লেখা থেকেই আমরা পেতে পারি।
সেদিন বেরিয়ে চায়ের দোকানেও জমে উঠল তর্ক, সঞ্জয়দাকে ঘিরে বারেবারেই যা ঘটে থাকে। এ কলকাতায় গরমের বিকেলে একজন প্রবীণ সদর্থে বিরল বুদ্ধিজীবীর জন্যেও যে মানুষ এসে জড়ো হতে পারে, তার প্রমাণ আরেকবার থাকল এ অনুষ্ঠানে। এও কিন্তু এ সময়েরই আরেকটা দিক। তাই সব কিছু খারাপ হয়ে যায়নি। জমায়েত জারি থাক। এই ভীষণ অসময়ে এভাবেই আমাদের গেরিলা সক্রিয়তা শিল্প দিয়ে, জীবন দিয়ে।

উল্লেখ্য, সম্প্রতি সঞ্জয়ের গদ্য সংগ্রহ-১ প্রকাশ করেছে দেজ পাবলিশিং। এদিন তাঁর বহু অনুরাগীরাও বইটি সংগ্রহ করলেন, তাঁর আরেকটি সাম্প্রতিককালের সাড়া জাগানো উপন্যাস বুনো স্ট্রবেরির সঙ্গে। স্বয়ং লেখক ভালোবেসে রাজিও হলেন সই করতে। বইটি উৎসর্গ করা হয়েছে, জীবনানন্দ, মানিক ও ঋত্বিক ঘটককে। জীমাঋ সংঘকে এ হেন স্যালুট একমাত্র সঞ্জয়ই দিতে পারেন, দিতে পারে তাঁর গদ্যভাষার মৌলিক দাগ, যা নবারুণের পর বাঙলা লেখালেখির সম্ভবত সবচেয়ে জোরালো দাগ, যা এখনও তোয়াজ করতে শিখল না কারও কাছে, মেধা ছাড়া… তাই এদিনের সন্ধ্যায় ব্যতিক্রমী মানুষের জমায়েতের পর আমাদের যথারীতি ঘোর কাটতে সময় লাগল। ভাল লাগল ভেবে এই ধুলোমলিন যান্ত্রিক ঘেঁটে যাওয়া শহরে এখনও সঞ্জয়দার অনুরাগী একজোট হলে, নেহাত মন্দ লাগে না শহরটা, জীবনটা!
ছবি: অনুষ্ক ঘোষাল
পেশা মূলত, লেখা-সাংবাদিকতা। তা ছাড়াও, গান লেখেন-ছবি বানান। শখ, মানুষ দেখা। শেল্ফ থেকে পুরনো বই খুঁজে বের করা। কলকাতার রাস্তা ধরে বিকেলে ঘুরে বেড়ানো।